সাধন-ভজন ও তার রীতি নীতি
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত সে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মনুষ্য জনম বিফল। মানব জনমের প্রধান উদ্দেশ্য পরম বা মালিকের প্রাপ্তি, সেই প্রাপ্তির জন্য সাধন-ভজনও একমাত্র মানব জনমেই সম্ভব। মনুষ্যত্ব অর্জন ও মালিক প্রাপ্তির প্রথম স্তর ও শেষ স্তর হল ধর্ম পথ বা সত্যপথ অবলম্বন করা। ধর্মের মূল কথা মালিকের উপর অটল বিশ্বাস রাখা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য মালিককে ভয় করা। মালিকের সন্তুষ্টির জন্য তার উপর পূর্ণ ভক্তি স্থাপন করা, মালিক প্রাপ্তির জন্য মালিকের বা পরমের প্রেমিক হওয়া।
মালিককে পূর্ণ বিশ্বাস-ভয়-ভক্তি-প্রেম ও মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য প্রথম স্তর ও প্রধান উপায় নিত্যকর্ম, নিত্যকর্ম অভ্যাস যোগ দ্বারা আত্মসংযমের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব অর্জন ও মালিক প্রাপ্তি সম্ভব। নিত্যকর্ম বলতে জীবন চলার পথে সুখে-সম্পদে-দুঃখে-বিপদে সকল প্রকার অনুকূল-প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও মালিকের নাম-গুণ-গান-স্মরণ-মনন-নিরিক্ষণ করা সকল অপরাধের জন্য মালিকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং আগামীদিনে সৎপথে চলার জন্য মনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য মালিকের কাছে প্রার্থনা করা।
ধর্ম ৪ পাদ: গার্হস্থ্য-ব্রহ্মচর্য্য-বানপ্রস্থ-সন্ন্যাস। কলিযুগে ধর্ম ১ পাদ গার্হস্থ্য আশ্রমই সার। ব্রহ্মচর্য্য-বানপ্রস্থ-সন্ন্যাস আশ্রম পালন করা অল্পআয়ু-স্বল্পজ্ঞানী কলিজীবের পক্ষে অসম্ভব। তাই বৈদিক যাগযজ্ঞ তপস্যা, অষ্টাঙ্গ যোগ সাধন ও কঠোর ব্রতানুষ্ঠানের পরিবর্তে গুরুদত্ত মহামন্ত্র স্মরণ-মনন করাই সংসারাবদ্ধ মায়ামুগ্ধ মানুষের জন্য সর্বোত্তম। এ বিষয়ে ভাবেরগীতের উক্তি-
মহৎ নামের মহিমা সীমা দেবার নয়,
স্মরণ-মনন-নিরিক্ষণ করলে সদক্ষণ বর্তে সুখচয়,
তার ডাকলে ভাব উদয় হয় অন্তরে,
(ভাবেরগীত- গীত নং- ৩৪১, কলি-১, লহর ১,২)
তন্ত্র মন্ত্র ধ্যান সেই নাম রস আশ্রয়,
নামেতে সকল পূর্ণ জানিহ নিশ্চয়,
নাম রস পরশ হলে বশ জানিবে ত্রিভূবন,
শ্রীগুরু নাম অমৃত সেবন,
(ভাবেরগীত- গীত নং- ৩৯১, কলি- ৩ ও ২)
ওক্তো বরক্তো নিযুক্ত চার ওক্তো নাম কর নির্জনে,
নিন্দে মন্দ সন্দ আদি যত নিয়ত শুনবে নাকো কানে ॥
আইনে দৃষ্টি রেখে চলো- নির্দেশিকা
(গীত- কলি-৩, লহর- ১,২)
নাম স্মরণের স্থান:
কোলাহল মুক্ত নির্জন ও পবিত্রতম স্থানই নাম স্মরণের উপযুক্ত। যদি ধারেকাছে সার্বজনীন কর্তাভজা উপাসনালয় থাকে তাহলে সেই স্থানই নাম স্মরণেরর উত্তম স্থান। অন্যথায় নিজ গৃহে যদি ব্যক্তিগত উপাসনালয় থাকে সেখানে, অন্যথায় কোলাহল মুক্ত পবিত্রতম যে কোন স্থানে নাম স্মরণ ও উপাসনা প্রার্থনার নিত্যকর্ম সু-সম্পন্ন করা যাবে।
নাম স্মরণ পদ্ধতি :: ১ম স্তর
দেহ-মন ও পরিধেয় বস্ত্র পবিত্রবস্থায় শুদ্ধাসনে উপবেশন করতঃ মনকে সংযত রেখে একাগ্রচিত্তে অন্তিমকাল জ্ঞান করতঃ গুরু দত্ত মহামন্ত্র সত্যনাম স্মরণ ও মালিকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। প্রথমে- হাত উপুড় করে অবনত মস্তকে জগৎকর্তার উদ্দেশ্যে প্রণাম করবে, তারপর-
গুরু সৃষ্টি কর্তা, গুরু পালন কর্তা, গুরু সংহার কর্তা।
গুরুই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের কর্তা পমর ব্রহ্ম, তাই শ্রীগুরুকে প্রণাম।
‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাই পরম পূজনীয়,
পিতা সন্তুষ্ট হলে সকল মালিক সন্তুষ্ট হয়, তাই পিতাকে বারবার প্রণাম।
‘মায়ের কৃপায় এই পৃথিবী দেখিতে পাইতেছি,
মায়ের আশির্বাদে সন্তানের সকল আশা পূর্ণ হয়,
তাই পরম পূজনীয় মা’কে বার বার প্রণাম।
(বঙ্গানুবাদ)
তারপর- গুরু আহ্বান বা ধ্যান মন্ত্র- (মনে মনে ৩ বার)
এসো গুরু বসো কাছে, উদয় হও মোর হৃদয় মাঝে,
নিরিখে নিরঞ্জন নীরের উপর ভাসে,
নিজ রূপ ধারণ করে গুরু দেখা দাও আমারে, জয়গুরু সত্য,
তারপর- মহাগ্রন্থ ভাবেরগীত থেকে (করজোড়ে ক্ষীণস্বরে- ধীর গতিতে শুদ্ধভাবে)
সার কর মন গুরু করুণাসিন্ধু চরণ যুগল গুরু মাহাত্ম্য গীতটি পাঠ করবে।
তারপর- হে দয়াময় মালিক এ কায়িকের গাফিলী তস্কির কসুর সকল মার্জনা করে হৃদয় আসনে উদয় হয়ে তোমার মহা সত্যনাম তুমিই জপ করিয়ে নাও প্রভূ ॥ (তিন বার মনে মনে)
তারপর- প্রাণায়াম (রেচক-পূরক-কুম্ভক) ও ধ্যানের মাধ্যমে গুরুদত্ত মহামন্ত্র সত্যনাম সাধ্যমত জপ করবে তবে কমপক্ষে ১০৮ বার। নাসিকাদ্বারা বায়ু ত্যাগ করার নাম রেচক, বায়ু গ্রহণ করার নাম পূরক, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে বায়ু ধরে রাখার নাম কুম্ভক, কুম্ভকের মাধ্যমে নাম স্মরণ করা বিধেয়।
তারপর- মহাগ্রন্থ ভাবেরগীত থেকে (করজোড়ে -মৃদুস্বরে- ধীর গতিতে শুদ্ধভাবে) ‘অপরাধ মার্জনা কর প্রভু প্রার্থনা গীতটি পাঠ করবে। এই গীতটির মাধ্যমে নিজের ভূল ত্র“টি-অপরাধসমূহের জন্য জগৎকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
তারপর- জগৎকর্তার প্রণাম- ‘যার শুরু নেই, শেষ নেই, জন্ম নেই মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই, বৃদ্ধি নেই, যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল কারণের কারণ সেই মহাত্মা জগৎকর্তাকে বারবার প্রণাম।
তারপর- অবনত মস্তকে জগৎকর্তাকে প্রণাম করত: নাম স্মরণ- উপাসনা-প্রার্থনার নিত্যকর্ম সু-সম্পন্ন করবে। সম্ভব হলে ভাবেরগীত থেকে অন্যান্য গীত কীর্ত্তন ও পাঠ করবে।
প্রত্যেক মানুষের ধারণশক্তি বা স্মরণ শক্তি এক রকম নয়। তাই বিদ্যাহীন-স্মরণ শক্তির সল্পতা হেতু বা যে কোন কারনে যদি কোন ব্যক্তির পক্ষে মহাগ্রন্থ ভাবেরগীত থেকে উক্ত গীত ২টি পাঠ করা সম্ভব না হয় তাহলে একাধিক উপযুক্ত ভক্তের সঙ্গে একসাথে নাম স্মরণের কাজ সু-সম্পন্ন করবে।
নাম স্মরণ পদ্ধতি :: ২য় স্তর
বিদ্যাহীন-স্মরণ শক্তির স্বল্পতা হেতু বা যে কোন কারণে যদি মহাগ্রন্থ ভাবেরগীত থেকে গুরু মাহাত্ম্য গীত ‘সারকর মন চরণ যুগল ও প্রার্থনা গীত ‘অপরাধ মার্জনা কর প্রভূ গীত ২টি পাঠ করা সম্ভব না হয় তাহলে নাম স্মরণ উপাসনা-প্রার্থনার নিয়ম (২য় স্তর)।
প্রথমে- অবনত মস্তকে জগৎকর্তার প্রণাম, তারপর গুরু প্রণাম মন্ত্র। ১ বার
তারপর- গুরু আহ্বান বা ধ্যানমন্ত্র (৩ বার মনে মনে), তারপর প্রাণায়াম (রেচক-পূরক-কুম্ভক) ও ধ্যানের মাধ্যমে সাধ্যমত সত্যনাম জপ, তবে কমপক্ষে ১০৮ বার।
তারপর- সাবর্জনীন প্রার্থনা
হে দয়াময় মালিক, আমাকে দয়া কর। আমার অপরাধ ক্ষমা কর।
আমি জ্ঞানতঃ অজ্ঞানত ভ্রম বশতঃ যে সকল অপরাধ করেছি,
তা আমায় ক্ষমা কর। এ বিশ্ব জগতে তুমি ভিন্ন আমার আর কেহ নাই।
তুমি নিত্য, সত্য, মঙ্গলময় ও আনন্দময়।
আমি তোমার গোলাম, তুমিই আমার প্রভূ।
পুত্র, কলত্র, বাড়ি, ঘর, বিষয় সম্পত্তি সবই তোমার,
আমার কিছুই নয়, আমাকে চরণ ছাড়া কর না,
কোন প্রকার কুসংসর্গে যেন ধর্মচ্যুত না হই।
তোমার চরণে আমার অচলা ভক্তির উদয় হোক,
তোমার নাম গুণ গানে যেন আমার ভ্রান্তি না জন্মে।
জন্ম-জন্মান্তরে যে সকল অপরাধ করেছি তা আমায় ক্ষমা কর।
সুখে সম্পদে দুঃখে বিপদে, যে অবস্থায় থাকি না কেন,
যেন তোমার চরণ ছাড়া না হই, ইহাই আমার একান্ত প্রার্থনা।
এই প্রার্থনার মাধ্যমে নিজের ভূল-ত্রুটি অপরাধসমূহের জন্য জগৎকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
তারপর- জগৎকর্তার প্রণাম, তারপর- অবনত মস্তকে জগৎকর্তার উদ্দেশ্যে প্রণাম করতঃ নাম স্মরণ উপাসনা-প্রার্থনার নিত্যকর্ম সু-সম্পন্ন করবে।
নাম স্মরণ পদ্ধতি :: ৩য় স্তর
বিদ্যাহীন-স্মরণ শক্তির স্বল্পতা হেতু বা যে কোন কারণে যদি কোন ব্যক্তির পক্ষে নাম স্মরণ পদ্ধতির ১ম/২য় স্তর অনুস্মরণ করা সম্ভব না হয় তাহলে নাম স্মরণ-উপাসনা-প্রার্থনার নিয়ম (৩য় স্তর)।
প্রথমে- অবনত মস্তকে জগৎকর্তার প্রণাম, তারপর গুরু প্রণাম, তারপর- সাধ্যমত সত্যনাম স্মরণ, তবে কমপক্ষে ১০৮ বার, তারপর- প্রার্থনা
তব সুখে চলি বলি, তোমার ছাড়া তিলার্দ্ধ নাই।
তুমি যা করাও তাই করি, যা খাওয়াও তাই খায়।
তুমি নিত্য, তুমি সত্য, তুমিই জগৎময়।
তারপর- হে দয়াময় মালিক এ কায়িকের গাফিলী-তস্কির কসুর সকল মাপ করহ। ৩ বার।
এই প্রার্থনার মাধ্যমে নিজের ভূল-ত্রুটি-অপরাধসমূহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তারপর অবনত মস্তকে জগৎকর্তার উদ্দেশ্যে প্রণাম করতঃ নাম স্মরণ-উপাসনা-প্রার্থনার নিত্যকর্ম সু-সম্পন্ন করবে। নাম স্মরণ পদ্ধতি-জপ-তপ, সাধন-ভজনসহ বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে গুরুদেবের কাছে থেকে জেনে নেওয়া একান্ত আবশ্যক।
সাবধানতা:
অজ্ঞ-মূর্খ কিছু কিছু ভণ্ড ব্যক্তি সাধু/গুরুদেব সেজে ধর্মীয় আচার বহির্ভূত কিছু কিছু স্ব-কল্পিত বাক্য সরল মনা ভক্তদের মাঝে অপপ্রচার করে, যেমন- চারি চন্দ্র ভেদ- পঞ্চরসের বটিকা সেবন, নারী নিয়ে সাধন-ভজন, অমরত্ব লাভ করা বা বেঁচে থাকার পথ ইত্যাদি। এসব ভন্ড সাধু/গুরুদেবদের কার্যকলাপে সজাগদৃষ্টি রাখা এবং এদের থেকে দূরে থাকা একান্ত প্রয়োজন।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণের ‘মল-মুত্র-রজ-বীর্য্য’ এই চারি চন্দ্র ভেদ- ‘মল-মূত্র-রজ-বীর্য্য-মাটি পঞ্চরসের বটিকা সেবন এবং নারী নিয়ে সাধন-ভজন ও অমরত্ব লাভের আশা করা সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। এসব বিষয় অন্য সম্প্রদায় বা ভিন্ন মর্তাদর্শের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন অবস্থাতেই নয়।
নারী নিয়ে সাধন-ভজনের নামে অবশ্যই পরকীয়া (ব্যাভিচার) দোষ ঘটতে শত ভাগ বাধ্য। মানুষ যে প্রকারের সাধন-ভজন করুক না কেন মানুষ কোন দিনই অমর হবে না। আর চারিচন্দ্র বা পঞ্চ রসের বটিকা সম্পূর্ণ অপবিত্র দ্রব্য যে মুখে পবিত্র মালিকের নাম গুণ গান করা হয় সেই পবিত্র মুখে অপবিত্র দ্রব্য পান-আহার করা কোন অবস্থাতেই উচিত নয়। ঐ সব অযোক্তিক কার্যাবলী ও কুসংস্কার কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণের সদাসর্বদা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।
…………………………………..
সূত্র ও কৃতজ্ঞতা:
১. ভবের গীত
২. কর্তাভজা সত্যধর্ম
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
কর্তাভজা সত্যধর্মের ৩০ ধারা
রামশরণ ও সতীমার দীক্ষাগ্রহণ
সতী মা
কর্তাভজা সত্যধর্ম
কর্তাভজার দশ আজ্ঞা
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
ডালিম তলার মাহাত্ম্য
বাইশ ফকিরের নাম
কর্তা
দুলালচাঁদ
কর্তাভজা সত্যধর্মের পাঁচ স্তম্ভ
সাধন-ভজন ও তার রীতি নীতি
ভাবেরগীত এর মাহাত্ম্য
কর্তাভজা সত্যধর্মের আদর্শ ও উদ্দেশ্য