স্বামী অড়গড়ানন্দজী
।। শ্রী পরমহংস স্বামী অড়গড়ানন্দজী মহারাজ এর পরিচয়।।
জন্ম – ১৯৩২ সালে, রাজস্থানের অসিয়াঁ গ্রামে। তিনি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। কিছুদিন দর্জির দোকানে কাজ করলেন। তারপর সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। বিয়ে করলেন, এক পুত্র সন্তানের পিতা হলেন। কিন্তু সংসারে শান্তি ছিল না। সেনাবাহিনীতে এক বাঙ্গালী মুখার্জী বাবু তাঁকে বিভিন্ন মহাপুরুষের জীবনী শোনাতেন, যা তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।
একদিন শুনলেন হরিদ্বারে সত্যযুগের এক সাধু এসেছেন। চলে গেলেন হরিদ্বার। সাধুদের জিজ্ঞেস করলেন। তাঁরা কিছু বলতে পারল না। গেলেন চিত্রকূটে। সেখানে এক বৃদ্ধা পাণ্ডার কাছে অনুসূইয়ার কথা শুনলেন। সত্যের অনুসন্ধানে এদিক সেদিক বিচরণ করতে করতে ২৩ বছর বয়সে, ১৯৫৫ সালের নভেম্বর মাসে যুগপুরুষ পরমহংস স্বামী পরমানন্দজীর শরণে এলেন।
“বোকা কোথাকার! তাঁর উৎপাত দেখ, সব পাহাড়ী নদীতে সোজা নামতে হয় আর তিনি নিম্নগামী হয়ে নামছেন, একদম অড়গড়।”
পরমানন্দজীর নিবাস চিত্রকূট, অনুসূইয়া, সাতনা, মধ্যপ্রদেশ (ভারত) এর ঘোর জঙ্গলে, যেখানে হিংস্র জীব জন্তু বাস করতো। এমন নির্জন অরণ্যে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া শ্রী পরমহংসজীর নিবাস এটাই ঘোষণা করে যে, তিনি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। পূজ্য পরমহংসজী তাঁর আগমনের সংকেত আগেই পেয়েছিলেন।
যেদিন তিনি এলেন, পরমহংসজীর ঈশ্বরের নির্দেশ মিলল। ভক্তকে বলতে গিয়ে তিনি বললেন যে, এক বালক ভবসাগর পার হওয়ার জন্য ব্যাকুল, তাকে আসতেই হবে। মহারাজজীর উপর দৃষ্টি পড়তেই তিনি বললেন, এই সেই বালক। স্বামীজীর সংশয় দেখা দিল। সেই রাতে স্বপ্নে সেই বাঙ্গালী মুখার্জী বাবু দেখা দিয়ে বললেন,
‘অনাদিকাল থেকে মহাপুরুষ যে রকম হয়ে আসছে, এই মহাপুরুষেরও সেসব লক্ষণ আছে এবং তিনিই আপনার গুরু মহারাজ।’
গুরুদেবের প্রতি নিষ্ঠা ঘনীভূত হল, সাধনা গতিশীল হল, এমন তপোধনের সংরক্ষনে থেকে তিনি জন্মমৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তির দিশায় অগ্রসর হয়ে গেলেন। লক্ষ্যে পৌঁছে গেলেন।
স্বামীজীর পূর্বাশ্রমের নাম ছিল গোলাপ সিং। গুরুদেবের কাছে আসার ছয় মাস পর আশ্রমে ধুনাঘর বানানোর কাজ শুরু হল। একদিন সাঁতরানোর পূর্ব অভ্যাস বশত মাথার বলে বলীয়ান হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ইট উঠাচ্ছিলেন। একটি শিলাখণ্ডের সাথে মাথার সংঘর্ষ হল। উঠে আসার পর গুরুজী দেখে বললেন,
“বোকা কোথাকার! তাঁর উৎপাত দেখ, সব পাহাড়ী নদীতে সোজা নামতে হয় আর তিনি নিম্নগামী হয়ে নামছেন, একদম অড়গড়।” এই শব্দ অনায়াসে মহারাজজীর শ্রীমুখ থেকে বের হয়েছে। সেই থেকে কিছু লোক তাঁকে অড়গড়ানন্দ নামে সম্বোধন করতে শুরু করে দিল। ‘অড়গড়’ মূলত চিন্তন পথে আসা এক প্রক্রিয়ার নাম। অড়গড় অর্থ কঠিন ও জটিল চিন্তা।
তিনি ৮ বছর সাধনার মাধ্যমে এ সংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঈশ্বর সেই একই কথাই বললেন। অবশেষে ঈশ্বরের নির্দেশে তিনি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অদ্বিতীয় ব্যাখ্যা ‘যথার্থ গীতা’ লিখলেন।
একবার তিনি সতী অনুসূইয়ার পাহাড়ী জঙ্গলে গভীর সাধনায় রত ছিলেন। কিছুদিন একটানা ধ্যান করেছিলেন। এক সময় গভীর সমাধিতে লীন হয়ে গেলেন। কিছু কাঠুরিয়া মারা গেছে ভেবে গুরুদেবকে খবর দিলেন। গুরুদেব বললেন – ‘তার শ্বাস বলছে সে বেঁচে আছে।’ তিনি গিয়ে স্বামীজীকে নিয়ে এলেন।
লেখালেখিতে মহারাজজীর অভিরুচি ছিল না, কিন্তু ঈশ্বর বললেন তাঁর একটি সংস্কার বাকী আছে সেটা হল গীতার যথার্থ ভাব লিখিতভাবে মানুষের কাছে প্রকাশ করা, যা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তিনি ৮ বছর সাধনার মাধ্যমে এ সংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঈশ্বর সেই একই কথাই বললেন। অবশেষে ঈশ্বরের নির্দেশে তিনি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অদ্বিতীয় ব্যাখ্যা ‘যথার্থ গীতা’ লিখলেন।
২০০৫ সালে শ্রী কাশীবিদ্বত্পরিষদ ‘যথার্থ গীতা’র ভাষ্য অনুসারে গীতাকে ‘মানব ধর্মশাস্ত্র’ বলে ঘোষণা দেয়। ২০০৮ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ‘যথার্থ গীতা’র ভাষ্য অনুসারে গীতাকে ‘ভারতের গুরুগ্রন্থ’ বলে স্বীকৃতি দেয়। মহারাজজীর এই কীর্তি ঈশ্বরীয় নির্দেশের ফল।
বিশ্ব ধর্ম সংসদ ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে হরিদ্বার মহাকুম্ভের অন্তর্রাষ্ট্রীয় অধিবেশনে (যেখানে বিশ্বের ৪৪ টি দেশের ধর্মীয় প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন সেখানে) ‘যথার্থ গীতা’কে ‘বিশ্ব গৌরব’, স্বামীজীকে ‘যথার্থ গীতা’ রচনার জন্য ‘ভারত গৌরব’ এবং ২০০১ সালে ‘বিশ্বগুরু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৫ সালে শ্রী কাশীবিদ্বত্পরিষদ ‘যথার্থ গীতা’র ভাষ্য অনুসারে গীতাকে ‘মানব ধর্মশাস্ত্র’ বলে ঘোষণা দেয়।
২০০৮ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ‘যথার্থ গীতা’র ভাষ্য অনুসারে গীতাকে ‘ভারতের গুরুগ্রন্থ’ বলে স্বীকৃতি দেয়। মহারাজজীর এই কীর্তি ঈশ্বরীয় নির্দেশের ফল। যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণীতে নিহিত মূলভাব হুবহু ব্যক্ত হওয়ার কারণে এর নাম ‘যথার্থ গীতা’ রাখা হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৫২০০ বছর পরে গীতার এই ব্যাখ্যা মানব মাত্রের জন্যই সমতা তথা মুক্তির বার্তা, যা অনুশীলন করে সাধনাত্মক ভ্রান্তি নির্মূল করা যাবে এবং পরমাত্মার পথে অগ্রসর হওয়া যাবে।
স্বামীজীর প্রবচন সংগ্রহ করে পরে কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘জীবনাদর্শ এবং আত্মানুভূতি’ গুরুদেব পরমহংস পরমানন্দজীর আদর্শ জীবন এবং আত্ম-উপলব্ধির এক সংহিতা। তাঁর জীবন বৃত্তান্ত এবং অলৌকিক ঘটনার সংকলন। পূজ্য গুরুদেবের কাছ থেকে সাধনার যেসব রহস্য তিনি উদঘাটন করেছেন, তাও তিনি এর মধ্যে তুলে ধরেছেন। এই কীর্তি এ বিষয়ে স্মরণীয় স্মৃতিকোষ তথা এ যুগের অপ্রতিম দান যা পাঠ করে পাঠক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি নিজেকে ধন্য মনে করে।
এসব আশ্রমে স্বামীজীর তত্ত্বাবধানে অনেক সাধক তপস্যারত আছেন। তাঁর যোগক্ষেমে শত শত সাধকের জীবনধারনের সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো ভক্ত বিনামূল্যে প্রসাদ গ্রহণ করছে। মহারাজজী প্রায়ই পরমহংস আশ্রম, শক্তেষগড়, মীর্জাপুর, উত্তরপ্রদেশে থাকেন। প্রতিবছর গুরুপূর্ণিমায় সেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়।
বর্তমানে স্বামী অড়গড়ানন্দজী মহারাজের তত্ত্বাবধানে অনেক আশ্রম আছে। এসব আশ্রমে স্বামীজীর তত্ত্বাবধানে অনেক সাধক তপস্যারত আছেন। তাঁর যোগক্ষেমে শত শত সাধকের জীবনধারনের সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো ভক্ত বিনামূল্যে প্রসাদ গ্রহণ করছে। মহারাজজী প্রায়ই পরমহংস আশ্রম, শক্তেষগড়, মীর্জাপুর, উত্তরপ্রদেশে থাকেন। প্রতিবছর গুরুপূর্ণিমায় সেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়।
ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে ধর্মকে শুদ্ধরূপে তুলে ধরার জন্য, মানুষকে সত্যের সন্ধান দেওয়ার জন্য মহাপুরুষের আবির্ভাব যে কোন স্থানে হতে পারে। তা না হলে যীশু, মহাবীর, বুদ্ধ, নানক এক পরম্পরা থেকে আসতো।
সমাজের সমস্যা ও শঙ্কার সমাধান কেবল সমকালীন মহাপুরুষই করতে পারেন। স্বামীজী সত্যের অনুসন্ধানে রত থেকে যা অর্জন করেছেন তা মানব কল্যাণে অকাতরে দান করে যাচ্ছেন। তিনি অনেক সাধককে ব্রহ্মবিদ্যা দান করে পথ প্রদর্শন করছেন।
শ্রী পরমহংস স্বামী অড়গড়ানন্দজী আশ্রম
শক্তেষগড়, চুনার, মীর্জাপুর (উত্তর প্রদেশ), ভারত
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
7 Comments