ভবঘুরেকথা
মাই ডিভাইন জার্নি

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : তিন

খেলাধুলায় তেমন রুচি ছিল না কখনোই আমার। বলা যায় একা দৌঁড়ালেও আমি দ্বিতীয় হবো বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যে আমি ফুটবলে পা ঠেকালাম না জীবনে; সে আমিই কেনো ফুটবল বিশ্বকপকে ঘিরে ব্রাজিল দলের সার্পোটার হয়ে উঠলাম? বিষয়টা কিছুটা গোলমেলে তো বটেই। ব্রাজিল-আজের্ন্টেনা নিয়ে এখনকার মতো তখনও পাড়া-মহল্লা সব দুইভাগে ভাগ হয়ে যেত।

যদিও তা নিয়ে আমার কোনো উন্মাদনা ছিল না সে দিনও-এখনোও। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন নাকি পাড়া প্রতিবেশীর সার্পোটের কারণে আমি ব্রাজিলের সার্পোটার হয়েছিলাম? প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে মাথায় এসেছে বহুবার। খেলার যেহেতু আমি কিছুই বুঝি না, তাই যে কোনো দলের সার্পোটারই তো হতে পারতাম। কেনো ব্রাজিল?

অনেক ভেবে আমি যে সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি তা হলো প্রাইমারির গণ্ডি পেরোনোর আগেই তিন গোয়েন্দা পড়ার বদৌলতে আমাজান জঙ্গলের প্রেমে পরেছিলাম; খুব কাছাকাছি সময়ে আলেক্স হেলির রুটস্ বইটির অনুবাদ পড়ে ফেলেছিলাম। পড়েছিলাম মার্টিন লুথার কিং এর জীবনীগ্রন্থ। আর পাঠ্য বইতে পড়েছিলাম ‘কালা মানিক’ খ্যাত পেলের কথা।

আসলে আমার ব্রাজিলের সার্পোট করার কারণ সম্ভবত তাদের খেলা নয়। আমি আসলে সেই কালো কালো মানুষগুলোর প্রেমে পরেছিলাম। ততদিনে আমি ‘প্রলেতারিয়েত’ শব্দটার সাথেও পরিচিত হয়ে উঠেছি। নিপীড়িত নির্যাতিত কালো মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে আমার কাছে ‘পেলে’ মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

খেলা শেষে ব্রাজিলের বিজয়ে কিভাবে মিছিল হবে তার মহরাও চলছে একপাশে। অন্যপাশে আতশবাজি জ্বালনোর প্রকৃয়া চলছে। সবাই উত্তেজিত মারমুখি। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই সবাই চুপচাপ হতে লাগলো কারণ ব্রাজিল ততক্ষণে দুই গোল খেয়ে গেছে।

যদিও পেলের খেলা বহু বহু পরে দেখবার ভাগ্য হয়েছিল। ম্যারোডোনার বদৌলতে যখন আশপাশের প্রায় সকলেই দল বদল করেছিল কোনো কারণ ছাড়াই আমি ব্রাজিলের সার্পোটার থেকে গিয়েছিলাম। আমার দৃঢ় ধারণা, কালো মানুষকে ভালোবেসেই আমি ব্রাজিলের প্রেমে পড়েছিলাম।

এই তো সেইবার যখন ফুটবল বিশ্বকাপের মৌসুমে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখনো কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। ক্লাস হতো গ্রীনরোডের একটা বহুতল ভবনে। সন্ধ্যায় ব্রাজিলের খেলা। কিন্তু ক্লাসের সিংহভাগ ছাত্রই আর্জেন্টিনার সার্পোটার হওয়ায় তাদের কারো তাড়া নেই খেলা দেখার।

ক্লাস চলতে লাগলো আপন গতিতে কিন্তু আমার পাশে বসা অনিক বারবার ঘড়ি দেখছে আর আমাকে বলছে চলেন খেলা দেখতে যাই; খেলা শুরু হলো বলে। অবশেষে যখন ক্লাস থেকে বের হলাম, রাস্তায় সুনশান নিরবতা। সবাই খেলা দেখতে চলে গেছে সম্ভবত। যে গুটি কয়েক দোকানে টিভি আছে সেখানে কিছু লোকজন আছে। আমরা যখন বেড়িয়েছি ততক্ষণে খেলা শুরু হয়ে গেছে।

কয়েক মিনিটের পথ কলাবাগান মাঠ। সেখানে বিশাল স্ক্রিনে খেলা দেখার আয়োজন চলছে। ক্লাস থেকে বের হতেই অনিক রহমান আমাকে প্রাণপন টানতে টানতে মাঠের দিকে নিয়ে চলতে লাগলো। অনিক নিজে ব্রাজিলের সার্পোটার। শুধু সার্পোটার বললে ভুল হবে মারমুখি সার্পোটার বলা যায়।

কয়েক মিনিটের পথ অনিক টানতে টানতে প্রায় মিনিটখানেকের মধ্যেই নিয়ে গেল। মাঠে ঢুকেই দাঁড়ানোর জায়গা করে নিলাম বেশ সামনের দিকেই। মাঠে সাজ সাজ রব। ব্রাজিলের বিশাল বিশাল পতাকা নিয়ে ভক্তরা মিছিল করে আসছে। মটরসাইকেলের ভাণ্ডার বাড়ছে।

খেলা শেষে ব্রাজিলের বিজয়ে কিভাবে মিছিল হবে তার মহরাও চলছে একপাশে। অন্যপাশে আতশবাজি জ্বালনোর প্রকৃয়া চলছে। সবাই উত্তেজিত মারমুখি। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই সবাই চুপচাপ হতে লাগলো কারণ ব্রাজিল ততক্ষণে দুই গোল খেয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে স্ক্রিনের সামনে থেকে ব্রাজিলের সার্পোটাররা মুখ চুন করে পিছিয়ে আসছে আর বিরোধী লোকজন সামনে যেয়ে উল্লাস করতে শুরু করে দিয়েছে। খেলা শেষে যখন আমরা বের হচ্ছিলাম তখন কারো মুখে কোনো কথা নাই। ততক্ষণে চার গোল হজম করেছে ব্রাজিল।

অনিক একটানা বলে যাচ্ছে আসলে ব্রাজিল বা ব্রাজিলের খেলার কোনো দোষ নেই। রেফারির দোষ, ঐ ফাউলের দোষ নানা আলোচনা। কিন্তু সেসব সত্যিই আর ভালো লাগছিল না। মন খারাপের সবচেয়ে চরম কারণটা হলো ততক্ষণে আর্জেন্টিনার সার্পোটাররা ভুয়া ভুয়া বলে মিছিল শুরু করে দিয়েছে।

আর ব্রাজিলের লোকজন গায়ের জার্সি কোথায় লুকাবে সেটা ভাবছে। অনিককে ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে ফাঁকা বাসে উঠে বসলাম। সাথে সাথে একপাল ছেলেপেলে উঠলো। উঠেই বললো কোনো হারু পার্টিরে বাসে উঠতে দিবি না। বলে মহাউল্লাসে ব্রাজিল ও ব্রাজিল সার্পোটারের মুখে যে চুন-কালি পরছে তা নিয়ে স্বউল্লাসে আলোচনা করতে লাগলো।

সত্যি বলছি সেই উল্লাসে গা জ্বলে যাচ্ছিল কিন্তু কি আর করা এমনভাব নিয়ে বাসে বসে থাকলাম জেনো খেলাটেলা আমি দেখিটেখি নাই। এসব আমার গায়ে লাগে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো গায়ে লাগছিল বেশ ভালোভাবেই লাগছিল। কেনো লাগছিল!! খেলা নিয়ে তো সত্যিই কোনো বারাবারি আন্তরিকতা ছিল না আমার। তবুও লাগছিল।

অন্যদিকে ব্রাজিলের জার্সি পরা কেউ বাসে উঠতে চাইলে বাসের বাস হেলপার ড্রাইভার কোনোমতেই তাদের নিচ্ছে না। আর জানালা দিয়ে ভুয়া ভুয়া বলে চিৎকার করে অপমান করছে। সেদিন মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই যখন ঘটনা উল্টে গেল।

আর্জেন্টিনা ৪ গোলে হেরে গেলো সেদিন কলাবাগান মাঠ থকে যখন বের হচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল বুকে পূর্ণ বাতাস নিতে পারছি। বেশ প্রশান্তি লাগছিল। আজ আর্জেন্টিনা সার্পোটারের মুখে কথা নেই ব্রাজিলের সার্পোটারের মুখে হাসি দেখে কে। আজ অনিক পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি ও খুশি মানুষ।

এতোটা ক্ষুদ্র-নিম্ন মানুষিকতা নিয়ে আমি কি আসলেই সঠিক কিছু ভাবতে পারি? আমার ভাবনা কি সঠিক পথে এগোয় আসলে? নাকি অহং দিয়ে ঢেকে বড় বেশি উদার ভাবার ভ্রান্ত চেষ্টা করে নিজেকে নিয়ে গর্ব করে আনন্দ পাই।

ওকে দেখে মনে হচ্ছিল নিজে গিয়ে আর্জেন্টিনার জালে চার চারটা গোল দিয়ে এসেছে। আজ অনিক আর ছাড়লো না; আগেই বলেছিল কেজিখানেক মিষ্টি খাওয়াবে। কিন্তু এলাকার সকল দোকানপাট বন্ধ থাকায় তা হলো না। শেষে মামা হালিম খাওয়ালো।

বেশ জম্পেশ হলো খাওয়া-দাওয়া। তারপর ফুচকা খেয়েও আমাদের আনন্দ শেষ হয় না। সেদিন বাসে করে যখন ফিরছিলাম তখন বুক চিতিয়ে বসে আছি। আজ ব্রাজিলের দলের সার্পোটাররা একই আচরণ করছে আর্জেন্টিনার সার্পোটারদের সাথে।

খেলার কিছুই বুঝি না খেলা নিয়ে কোনো উন্মাদনাও নেই কিন্তু আজ আর্জেন্টিনার এই হার যে সেই অপমানের মুখে ছাই চাপ দিয়েছে। একটা পৈচাশিক আনন্দ হচ্ছিল মনের মাঝে। বাস যত এগিয়ে যাচ্ছিল ততই আমি যেন নিজেকে চিনতে পারছিলাম। অনুধাবন করতে পারছিলাম আসলে আমি কতটা নিম্নস্তরের মানুষ।

আদৌও মানুষ!!! অন্যের দু:খ-কষ্ট-হতাশা-শোকে যে আনন্দ পায় আর যাই হোক তাকে মানুষের পর্যায়ে ফেলা যায় না। আমি সেদিন সেইক্ষণে জেনেছিলাম আমি মানুষ হওয়ার যোগ্য নই। অন্যের আনন্দে যে আনন্দ নিতে পারে না আর অন্যের দু:খ যে দু:খি হতে পারে না; তাকে ক্ষমা করা গেলেও অন্যের আনন্দে যে দু:খ পায় আর অন্যের দু:খে যে সুখ পায় তাকে মানুষ বলা যায় না কোনো মতেই।

এতোটা ক্ষুদ্র-নিম্ন মানুষিকতা নিয়ে আমি কি আসলেই সঠিক কিছু ভাবতে পারি? আমার ভাবনা কি সঠিক পথে এগোয় আসলে? নাকি অহং দিয়ে ঢেকে বড় বেশি উদার ভাবার ভ্রান্ত চেষ্টা করে নিজেকে নিয়ে গর্ব করে আনন্দ পাই। আসলে ভেতরটা পঁচে গেলে-গলে গেলে পোষাক দিয়ে বা ব্যক্তিত্ব দিয়ে তা লুকিয়ে রাখা যায় না।

এই ঘটনা যখনি মনে পরে তখন নিজেকে আর মানুষ হিসেবে দাবী করার কোনো যোগ্যতা থাকে না। আসলে মানুষের গর্ভে জন্মালেই মানুষ হওয়া যায় না মানুষ হয়ে উঠতে হয়। তাই লালন সাঁইজি বলেছেন-

আছে কোন মানুষের বাস কোন দলে।
ও মন মানুষ মানুষ সবাই বলে।।

অযোনী সহজ সংস্কার
কারে কি সঙ্গে সাধবো এবার,
বড় অগম্ভু মানুষ নীলে
সে মানুষ নীলে।।

সংস্কার সাধন না জানি
কোথা পাই সহজ কোথায় অযোনী,
বেড়াই গোলে হরিবোল বলে
ওসে হরিবোল বলে।।

তিন মানুষের করণ বিচক্ষণ
ও তাই জানলে হবে এক নিরূপণ,
অধীন লালন পলো গোলেমালে
বিষম গোলেমালে।।

এই জাগতিক মহাগোলমাল থেকে মুক্তি কি আর মেলে সহজে। লালন স্মরনোৎসবের তৃতীয় দিনের সকালবেলা, মানুষজন বেশ কমে এসেছে। নদীর ঘাটে সাধু-গুরুদের কেউ কেউ ছোট ছোট দলে আড্ডায় মশগুল। হাতে ক্যামেরা থাকলে যা হয় আর কি। এটা সেটার ছবি তুলছি।

মঞ্চের পাশে নদীরঘাট তখনো পাকা হয়নি; সে জায়গায় বিশাল দেহী জটাধারী এক পাগলা সাধু বসে কয়েকজনের সাথে রোদ পোহাচ্ছে। ছবি তুলতে তুলতে সেই সাধুর একখানা ছবি তুলে ফেললাম। ছবি তোলার পরই সাধু খেঁকিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলে উঠল- তুই এটা করলি কি?

সাধুর গগনবিদারী চিৎকারে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেল। সাধু তেড়ে আসলো। বললো তুই এটা করলি কি? আমার ছবি তুললি ক্যান? আমি ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। সত্যিই তো সাধুর অনুমতি নেয়া উচিত ছিল। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় মরছি কি বলবো ভাবছি; ভয়ও পেয়েছি বেশ কিছুটা। মজা দেখার জন্য জনতা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো; একদল আমার পক্ষে অন্যদল সাধুর দলে।

আমি সাধুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করি। কিন্তু সাধুর পক্ষের জনতা সাধুকে আবার উত্তেজিত করে তোলে। বলে তোর তো সব শেষ কইরা দিলরে পাগলা। তোর সব তন্ত্র-মন্ত্র ক্যামেরার বাক্সে বন্দি কইরা ফেলাইছে তুই তো শেষ। শান্ত সাধু আবারো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তেড়ে আসে আমার দিকে।

আমি বললাম ঠিক আছে পরেরবার যখন আসবো তখন তোমার জন্য ছবি সাথে করে নিয়া আসবো। পাগল বলে বাইচ্চ্যা থাক বাপ, বাইচ্চ্যা থাক, নিয়া আসিস মনে কইরা। পাগল শান্ত হয়ে ফিরতে চাইলে কি হবে তার পাশের লোকজন নিচু স্বরে বলতে লাগলো এখনি ধুয়া দিতে কও পাগলা পরের বার আসা হয় না হয়।

আমার পক্ষের জনতা তাকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাকে ধরে রাখা ৮/১০জনের কর্ম্ম নয়। বিশাল তার দেহ। তাও অল্পতেই শান্ত হয় সাধু বলে- ‘হ হ ঠিকই কইছিস ঐ বাক্সে তো আলো জলে নাই। আমার শক্তি মনে লয় নেয় নাই কি কও তোমরা।’

আমার পক্ষের লোকজন বলে, ‘হ হ ঠিকই তো।’ কিন্তু ঐ পক্ষের লোকজন হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে সাধুকে বলে, ‘আরে পাগল তোর শক্তি যদি থাকতো তাইলে ঐ ক্যামেরার বাক্স তোর হাতে থাকতো আর ঐ পোলা থাকতো গাছের উপরে। তোর শক্তি সব শেষরে পাগলা।’

তখন এখনকার মতো বাড়তি মানুষ কমই আসতো তাই কয়েকদিন থাকলে সকলের সাথেই একপ্রকার পরিচয় হয়েই যেত। দুই পক্ষেই তাই সমান সংখ্যক লোকজন জুটে গেল। যেহেতু আমরা অপরাধী পক্ষ তাই আমাদের গলা অনেকটাই কোমল আর অপরপক্ষ মারমুখী।

বিশালদেহি পাগল এই তেড়ে আসে আবার শান্ত হয় আবার তেড়ে আসে কোনো মতেই তাকে বোঝানো যায় না। ভয়ে ভয়ে আমি তাকে বুঝিয়েই চলেছি। গোটা দুয়েক বেনসন কয়েক কাপ চা খাওয়ার পর তার মাথা প্রায় ঠাণ্ডা। আমার পক্ষের লোকজন নিচু স্বরে আমাকে বলতে লাগলো দাদা এইবার এখান থেকে চলে যান পাগলা আবার ক্ষেপলে খবর আছে।

আমিও মনে মনে তাই ভাবছি। একসময় কুশলাদী বিনিময় করে উঠে দাঁড়ালাম। যেই ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি ঠিক তখনই ঐ পক্ষের একজন বললো, ‘পাগলা তোর ছবি তো তুইলা নিয়ে গেলো সেটা নাইলে বুঝলাম তা ভাইজানকে কও তোমার একটা ছবি ধুইয়া দিতে।’ পাগলা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, ‘ঠিক ঠিক। তেড়ে এসে বললো দে আমার ছবি আমারে ধুইয়া দে। আমি বড় কইরা বান্ধায়া রাখমু।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে পরেরবার যখন আসবো তখন তোমার জন্য ছবি সাথে করে নিয়া আসবো।’ পাগল বলে, ‘বাইচ্চ্যা থাক বাপ, বাইচ্চ্যা থাক, নিয়া আসিস মনে কইরা।’ পাগল শান্ত হয়ে ফিরতে চাইলে কি হবে তার পাশের লোকজন নিচু স্বরে বলতে লাগলো, ‘এখনি ধুয়া দিতে ক্ পাগলা পরের বার আসা হয় না হয়।’

পাগলা থেমে গিয়ে বলে, ‘ঠিক ঠিক’। আমার পথ আটকে বলে, ‘দে দে এখনি দে, পরের বার যদি তিনি না আনেন। বাপ এখনি দে।’ আমি নিরুপায় হয়ে বলি, ‘ঠিক আছে বিকালবেলা শহর থেকে ছবি ওয়াশ করে দিবো।’ সকলে তাকে বুঝিয়ে বলে। পাগলা বলে, ‘ঠিক ঠিক বাপ বাইচ্চ্যা থাক। বিকালে মনে কইরা দিবি।’

পাশের লোক বলে, ‘আরে পাগলা বিকালে দেখা হয় না হয় এখনি নিয়া নে। নদীতে কি পানির অভাব এখনি ধুইয়া দিতে ক্।’ পাগলের চোখ জল জল করে উঠলো আকাশ-বাতাস কাপিয়ে বলতে লাগলো, ‘ইসক্ কালান্দার! ইসক্ কালান্দার!’ হাতের লোহার চিমটায় লাগানো রিং গুলো ঝনঝন করে বাজতে লাগলো।

নৃত্য করতে শুরু করে দিল। সকলে জায়গা ছেড়ে দিলো। পাগলা মাতোয়ারা হয়ে গোল গোল ঘুরতে লাগলো আর চিৎকার করতে লাগলো। আমার কানে কানে কেউ কেউ বললো, ‌’ভাইজান পালান এখন পাগলার চোখ বন্ধ।’ আমারো মনে হচ্ছিল এইবার পালাই।

কিন্তু কিসের এক বন্ধনে যেন নড়তে পারলাম না ঠাঁই দাঁড়িয়ে পাগলের আশেকানা দেখছিলাম। একসময় নৃত্য থামিয়ে পাগলা বললো, ‘দে তর ক্যামরা ধুয়া ছবি বাইর কইরা দে। আমি ছবি বান্ধাইয়া গলায় ঝুলায়া রাখমু।’ আমি যতই বোঝাতে চাই পাগলা ততই উত্তেজিত। কয়েকজন পাগলাকে বললো, ‘হেরে সহ পানিতে চুবা।’

এইবার আমার অবস্থা কেরসিন। পাগলার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি আমাকে ক্যামেরা সহ নদীর পানিতে চুবাবে। ভয়ে আমার আত্মা খাঁচা ছাড়া অবস্থা। আমার পক্ষের লোকজন ক্রমশ কমে যাচ্ছে। একসময় দেখলাম আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। বাকি সবাই হাসছে, মজা নিচ্ছে এটা সেটা বলে।

কপাল দিয়ে চিকন ঘাম নিচে নেমে আসছে। কি করবো কিছুই বুঝতেছি না।

পাগলাকে মোলায়েম গলায় বললেন, শোন পরের দোলে আইসা এই ছেইলের কাছ থেকে তুই ছবি নিবি ঠিক আছে? বিশাল দেহী পাগলাকে সাধুর সামনে শান্তশিষ্ট শিশুর মতো লাগছে এখন। বিন্দুমাত্র উত্তেজনা-অস্থিরতা-উন্মাদন নেই তার শরীরের কোনো অঙ্গে-মনে। তার মুখে কথা নেই মাথা নেড়ে সায় দিলো।

ভেতরে ভেতরে হাত পা কাঁপতে শুরু করছে। পাগলা ততক্ষণে এক হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরেছে। সাঁতার না জানা আমি পানিতে চুবানি খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিবো নাকি দৌড় দিবো বুঝে উঠতে পারছি না। পাগলা বলেই চলছে, ‘ইসক্ কালান্দার! ইসক্ কালান্দার!’

জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যখন চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে সরিষা ফুল ভেসে উঠে তখন আমার সেই অবস্থা। এক হাতে ক্যামেরা-ক্যামেরার ব্যাগ শক্ত করে ধরে তখনো পাগলাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এভাবে যে ছবি ওয়াশ হয় না তা কিছুতেই বোঝাতে পারছি না।

পাগলা বোঝে না, সে বলে পানি ক্যামরা ধুইয়াই তুই এক্ষুনি ছবি বাইর করে দে। নাইলে আমি নিজেই ধুয়া বাইর করমু। লোকজন গোল করে ভিড় করে দেখছে অনেক লোকজন জমা হয়েছে; মজা দেখার জন্য। ছোটরা সামনে বসে পরেছে। বড়রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। জমে উঠেছে মজমা।

সেই সময় ভিড় ঠেলে আমার দেবদূত এসে উপস্থিত হলেন ঠিক সিনেমার মতো। প্রায় চার ফুট উচ্চতার শীণকায় ভাব গাম্ভীর্য পূর্ণ নুরানী চেহারার আতরমাখা-সবুজ রঙের কাবলি চোখে সুরমা পরা এক সাধু এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখেই পাগলার নৃত্য একেবারে থেমে গেলো। সাধু খুবই শান্ত শীতল ভঙ্গীতে তার হাতের বিশাল লাঠি খানা মাটিতে একটা বারি দিয়ে বললেন, ‌’কি হইতেছে এইখানে?’

পাগলের রণ ভঙ্গী শেষ, আমার হাত ছেড়ে মাথা নতজানু করে কাঁচুমাচু করে সাধুর চরণে ভক্তি দিলো। সাধু ইশায়া দিয়ে তার সাথে এগিয়ে যেতে বললো। একটা চায়ের দোকানে চা সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে সাধু সকল কথা শুনে বললো, ‘বাপ তুমি সত্যি সত্যি কথা দাও পরের বার মেলায় তুমি পাগলার ছবি ধুয়া নিয়া আসবা’। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি।

এবার তিনি পাগলাকে মোলায়েম গলায় বললেন, ‘শোন পরের দোলে আইসা এই ছেইলের কাছ থেকে তুই ছবি নিবি ঠিক আছে?’ বিশাল দেহী পাগলাকে সাধুর সামনে শান্তশিষ্ট শিশুর মতো লাগছে এখন। বিন্দুমাত্র উত্তেজনা-অস্থিরতা-উন্মাদন নেই তার শরীরের কোনো অঙ্গে-মনে। তার মুখে কথা নেই মাথা নেড়ে সায় দিলো।

সাধু বলে চললেন, ‘ওর মাথাটা একটু গরম হয় শীতকালে, আপনি কিছু মনে নিবেন না বাবা। ছোট মানুষ তো বুদ্ধি একটু কম।’ আসপাশের ভিড় করে থাকা সকলে মাথা নেড়ে সায় দিলো। বিজ্ঞের সাথে সকলের একসাথে জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়া দেখে বুঝে ফেললাম- আসলেই পাগলা ছোট মানুষ ও তার বুদ্ধি কম।

সাধু আমাকে দেখিয়ে পাগলাকে বললেন, ‘উনারে আর তেক্ত করবি না ঠিক আছে।’ পাগলা আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম সাধুর কাছে বিদায় নিতে। সাধুর চোখের দিকে তাকিয়ে ভক্তি দিতে গিয়ে মনে হলো চোখে চোখে অনেককিছুই বলছেন আমাকে। কিন্তু আমি তা ঠিকঠাক মতো ধরে উঠতে পারছি না। কি বলছিলেন সাধু কিচ্ছুটি না বলে?

ফিরে চললাম সাঁইজির ধামের দিকে। আমার তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো অবস্থা। উৎসাহি কেউ কেউ নিরাশ হয়ে ফিরছে একটা চুবানির দৃশ্য বাস্তবায়িত হলো না বলে মনে বিষাদ। অতি উৎসাহি কেউ কেউ আবার তাদের পরিচিতদের ডেকে আনতে গিয়েছিল সম্ভবত। কারণ উল্টো দিক থেকে আসা অনেকে যখন বুঝে ফেলছে ঘটনা ঘটে নাই তখন তাদের চোখে অগ্নি।

কেউ কেউ আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলছে, ‌’হেরে চুবাইতে চাইছিল পাগলায়।’ কাহিনী রংচঙ্গে বাড়তে লাগলো। অবশ্য আমার সে সবে কান নেই। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম ভিন্ন এক চিন্তায় কে মারে আরে কে বাঁচায়? কে বিপদে ফেলে আর কে রক্ষা করে? কে গর্জায় কে বা বর্ষায়? বাস্তবে নদীতে চুবানি না দিলেও পাগলা সেদিন সত্য সত্য এক চুবানি আমাকে দিয়েছিল।

সেই চুবানি থেকে কি আজও আমি উঠতে পেরেছি? পেরেছি ভেসে উঠতে? অনুমতি না নিয়ে হুটহাট করে সাধুর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করা বড়ই অনৈতিক আচরণ। ডুবার আগে প্রথমে গা ভেজাতে হয়; জলের তাপমাত্রা দেহের তাপমাত্রায় সমতা আনতে হয় তার পর ধীরে ধীরে ডুব দিতে হয় নইলে চুবানি নিশ্চিত।

পাগলার দেখা আমি পরে আর পাইনি। অনেকদিন তার ছবি আমার ট্রাভেল ব্যাগে ছিল। পাগলা তোর চরণে ভক্তি চিরকালের। তুমি যে শিক্ষা আমায় দিয়েছিলে সেদিন বুঝতে পারিনি তা সেদিন। তা বুঝতে অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে।

জয় সাধু! জয় পাগলা! জয়! জয়! আমরা কখন নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনি। আর কে এসে বিপদ থেকে রক্ষা করে তা বোঝা কি এতোই সহজ? সাঁইজি বলেছেন-

সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা।
জীবের কি সাধ্য আছে গুণে পড়ে তাই বলা।।

কখনো ধরে আকার
কখনো হয় নিরাকার,
কেউ বলে আকার সাকার
অপার ভেবে হই ঘোলা।।

অবতার অবতারী
সবই সম্ভব তারই,
দেখ জগৎ ভরি
এক চাঁদে হয় উজলা।।

ভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড মাঝে
সাঁই বিনে কি খেল আছে,
ফকির লালন কয় নাম ধরে সে
কৃষ্ণ করিম কালা।।

‘সাঁই আমার কখন খেলে কোন খেলা’ : ভিডিও

এটা সেটা ভাবতে ভাবতে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম সাঁইজির ধামের গেটের পাশে বসে; সাথে এবার জুটেছে পরিচিত এক ভদ্রলোক। যিনি পেশায় বড় একটি পত্রিকার সাংবাদিক। এক নাগাড়ে তিনি কি সব যেন বলে চলছেন। মিথ্যা বলবো না আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছি এমন ভান করে মনে মনে ভাবছিলাম সাধু কিছু না বলে চোখের ভাষায় কি বলতে চেয়েছিলেন? আচ্ছা! মানুষ কি কেবল মুখ দিয়েই কথা বলে?

নাকি চোখেরও একটা নিজস্ব ভাষা আছে? তা শুধু প্রেমিকার চোখই নয় জগতের সকলের চোখেই সেই ভাষা থাকে! যে জানে সে সেই ভাষা বলতে পারে আর যে পড়তে জানে সেই তা ধরতে পারে। এসব অবশ্য অনেক অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম। চিন্তা চলছে-কথা চলছে-চা চলছে যা হয় আর কি। এক সাথে অনেককিছুই চলে যখন আদৌতে কিছুই চলে না বা সোজা বাংলার বললে বলতে হয় কিছুই হয় না।

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে একটু একটু করে ঠাণ্ডা নেমে আসছে দোলের চাঁদের আলোকে ভর করে। অল্পস্বল্প পরিচিত এক শিল্পী সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে দেখে এগিয়ে আসলেন কুশলাদি বিনিময় হলো উনি চলে যাওয়ার পর বেঞ্চিতে বসে থাকা সাংবাদিক বন্ধুটি খেঁকিয়ে উঠে বললো, ভাই আপনি উনার সাথে এতো আদবের সাথে কথা বললেন? আপনি জানেন না উনি তো খারাপ মেয়েছেলে। 

মানুষের শরীরের বেশিভাগটা অংশ জুড়ে থাকার কথা ছিল হৃদয় ও প্রজ্ঞা; কিন্তু অধিকাংশ মানুষের শরীর জুড়ে থাকে পেট যা কেবল খাই খাই করে আর তারচেয়ে অধিকমাত্রায় মানুষের মাঝে থাকে যৌনতা।

খারাপ বলতে?

উনি তো ওর সাথে শুইছে ওর সাথে শুইছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‌’ভাই আপনার লকলকে জিহ্বা দেখে তো মনে হচ্ছে আপনার সাথে শোয় নাই দেখেই আপনি এসব কথা বলছেন। আপনার সাথে শুইলে তা রাষ্ট্র করে বেড়াতেন না; তাই না?’

ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কের ইতি হয়ে গেল সেদিন থেকেই। জানি না আমি ভুল বলেছিলাম কিনা। আমি অবশ্য এমন চিন্তার মানুষদের কখনো মিস করি না। যাদের চিন্তায় নোংরামি তাদের সাথে সম্পর্ক না থাকাই ভালো। তারপর আবার ভাবি আমি কি তারচেয়ে চিন্তায় খুব বেশি উন্নত?

এই যে আমি সেই সব কথা বলছি এখন; সেই সাংবাদিক ভদ্রলোক হয়তো সেই ঘটনা মনে রাখেনি; কিন্তু দেখো আমি কেমন করে সযত্নে সেই ঘটনা স্মৃতির মণিকোঠায় তুলে রেখেছি। আমিও তো সে হিসেবে তারই মতো। হয়তো আমরা সবাই এক রকমই। কিন্তু চেষ্টা করলে তা থেকে বেড়িয়ে অনেক সুন্দর করে ভাবতে পারি। ভাবতে পারি নির্মলভাবে।

মানুষের ভেতরে নোংরা ঘাটাঘাটি না করে সুন্দরকে দেখতে পারি। মানুষের নোংরা ঘাটতে ঘাটতে যে নোংরামির ইতিহাস তুমি তোমার ভেতরে জমা করছো একসময় তারই বহি:প্রকাশ হবে তোমার চরিত্রে-স্বভাবে।

তুমি নিজের অজান্তেই তাদের মতোই হয়ে উঠবে। তাই ভালো দেখার অভ্যাস; ভালো শোনার অভ্যাস; ভালো বলার অভ্যাস যদি তুমি দেখার চেষ্টা করো তাহলে তুমিই তোমার ভেতরের সাধুতাকে খুঁজে পাবে। সাধুতা কঠিন পথ নয় এটা সহজ পথ।

মানুষের শরীরের বেশিভাগটা অংশ জুড়ে থাকার কথা ছিল হৃদয় ও প্রজ্ঞা; কিন্তু অধিকাংশ মানুষের শরীর জুড়ে থাকে পেট। যা কেবল খাই খাই করে। আর তারচেয়ে অধিকমাত্রায় মানুষের মাঝে থাকে যৌনতা।

পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাণীর যৌনতার নির্দিষ্ট সময় ঋতু বা ক্ষণ থাকলেও মানুষের তা নেই। তবে মানুষের আছে বিচারশীলতার সক্ষমতা। যা দিয়ে প্রত্যেকের নিজকেই নিতে হয় যথার্থ সিদ্ধান্ত। তবে মনে বিচারশীলতা জাগ্রত না হলে মানুষ সাধন জ্ঞানের অনুসন্ধিসু না হয়ে; হয়ে উঠে কামুক। সাঁইজি বলেছেন-

গেড়ে গাঙ্গেরে ক্ষেপা হাপুর হুপুর ডুব পাড়িলে।
এও তো মজা যাবে জানা কার্তিকে ওলানির কালে।।

বাই চালা দেয় ঘড়ি ঘড়ি
ডুব পাড় গা তাড়াতাড়ি,
তাইতে হল কাফের নাড়ি
তাইতো হানা দেয় আমারে।।

কুতফি যখন কফের জালায়
তাগা তাবিজ বাঁধবি গলায়,
তাতে কি হবে ভালাই
মস্তকের জল শুষ্ক হলে।।

ক্ষান্ত দে-রে ঝাপই খেলা
শান্ত হ-রে ও মন ভোলা,
এখনও কি আছে বেলা
লালন কয়, দেখ চক্ষু মেলে।।

সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আমি এক জায়গায় দু’দণ্ড দাঁড়ানোর ফুসরত পেতাম না। প্রচণ্ড চঞ্চল চিত্ত; কোথায় জানি যাওয়ার তাড়া লেগে থাকতো সকল সময়। স্থিরতা বিষয়টা আমার ছিল না কোনোকালেই। আমার কেনো যেনো মতে হতো বেশি সময় দাঁড়ালে পায়ে শিকড় গজিয়ে যাবে। আমি আর আমার গন্তব্যে যেতে পারবো না কখনো।

অথচ সত্যি করে বলছি আজ তোমায়, আমি আজো জানতে পারিনি আমার গন্তব্য কোথায়। মানুষ আসলে কোথায় যেতে চায়, মানুষ কি জানে? তুমি জানো? তুমি সত্যি সত্যি জানো তুমি কোথায় যেতে চাও? যদি জানো সেখানে যদি তুমি আদৌ পৌঁছাইতে পারো তাহলে কি তুমি করবে? ভেবেছ কখনও??

এক বন্ধু বলেছিল সে হিমালয়ে যেতে চায়। আমি প্রতিউত্তরে বলেছিলাম তুমি কি আসলে হিমালয়েই যেতে চাও নাকি হিমালয় গিয়েছিলে সেটা সবাইকে জানাতে চাও? সে নির্বাক ছিল। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলেছিল, ‘হিমালয়ে উঠতে অনেক দম লাগে ভাবছি সিগারেটটা ছেড়ে দেবো।’

আমরা এভাবেই নিজেকে ঢেকে রাখি। লুকিয়ে ফেলি। গুটিয়ে ফেলি। শামুকের মতো। আমরা বেঁচে থাকি অন্যদের দেখাবার জন্য। বা অন্যকে দেখবার জন্য। আমি কি ভাবে বেঁচে বর্তে আছি তা মার্কেটিং করবার জন্য। কিংবা অন্যেরা কিভাবে বেঁচে থাকে তার বিজ্ঞাপন দেখবার জন্য। আমরা বা আমি কবে বাঁচবো নিজের জন্য? নিজেদের জন্য? নিজের জন্য কিভাবে বাঁচতে হয় তা কি আমরা শিখেছি?

তার শেখার পথ কি আমরা খুঁজেছি কখনো? না মশাই! নিজের জন্য বা নিজেদের জন্য বাঁচা মানে স্বার্থপরতার ভেতর দিয়ে বাঁচা নয় মোটেই। নিজের জন্য বাঁচা মানে প্রকৃত মানুষরূপে বিকশিত হওয়া। আর প্রকৃত মানুষ রূপে বিকশিত হলেই মনুষত্ব পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। মানুষ তার প্রকৃত ফাংশন একটিভ করতে পারে।

তখন সে প্রকৃতিতে মিশে যাবে। তখন সে সত্য জ্ঞান অনুভব করতে পরবে উপলব্ধি করতে পাবে। স্বরূপের দর্শন পাবে। এই জায়গায় সাঁইজি বলেছেন-

সামান্যে কি তার মর্ম জানা যায়।
হৃদকমলে ভাব দাঁড়ালে
অজান খবর আপনি হয়।।

দুগ্ধে জলে মিশাইলে
বেছে খায় রাজহংস হলে,
কারো সাধ যদি হয় সাধন বলে
হয় সে রাজহংসের ন্যায়।।

মানুষে মানুষের বিহার
মানুষ ভজলে দৃষ্ট হয় তার,
সে কি বেড়ায় দেশ দেশান্তর
পীড়েই পেড়োর খবর পায়।।

পাথরেতে অগ্নি থাকে
বের করতে হয় ঠুকনি ঠুকে,
দরবেশ সিরাজ সাঁই দেয় তেমনি শিক্ষে
লালন ভেঁড়ো সং নাচায়।।

আমার পুরানো বন্ধু যিনি ইউরোপীয় সাহিত্য কণ্ঠস্থ করেন-মুখস্থ করেন। তিনি একবার আমার ঘরে প্রবেশ করে খুবই বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘তোর মতো অশিক্ষিত মূর্খের ঘরে এতো বই কেনো?’

আমি সেই পুরানো কৌতুক পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলাম, ‘যার যাতে ঘাটতি আছে তার তো তাই দরকার।’

জ্ঞান-বুদ্ধি-পুঁথিগত বিদ্যা নাই বলেই তো বই পড়তে হয়। বন্ধুটি একথা শুনে আরো বিরক্ত হয়েছিল। এরপর আর কোনোদিন আমার ঘরে আসেনি। সম্পর্কও ফিকে হয়ে গিয়েছে। আজ তাকে পেলে বলতাম বন্ধু তুই ঠিকই বলেছিলি এই সকল বই না পড়লেই বরঞ্চ এক হিসেবে ভালো হতো। সভ্যতার পরাকাষ্ঠে এখানে শুধুই যুদ্ধ-হানাহানি-বিষাদ-ঘৃণা-লোভ-মোহকেই মার্কেটিং করেছে কখনো তা সমাজবাদী হয়ে; কখনো সমাজবিরোধী হয়ে।

আসলে সকলেই তাদের নিজস্ব পণ্য বিক্রি করতে চায়। তা সে ডান বাম উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যে ই হোক না কেনো। মনের কথা আর কয়জনে বলতে পারে? সবাই কি আর লালন ফকির হয়? রুমি হয়? বৌদ্ধ হয়? বেদব্যাস হয়? মাঝখান থেকে এতো কিছুর ফেরে পরে নিজেকেই আজো চিনতে পারলাম না। বিশ্ব সাহিত্য পড়ে কি হবে?

একথা বললে লোকে মারতে আসবে আলোকিত মানুষজনজন তৎক্ষণাৎ তালেবান হয়ে উঠবে। কতলকে তখন বৈধ বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু পরের লাইনে আমি কি বলতে চাইছি সেটা পড়ার বা শোনার সময়ই নেই; তাকে আমি কি বলি বলো। তুমিই বলো?

এইসব ফালতু লেখা কেনো লিখছি যদি তুমি জানতে চাও। আর যদি সময় করে তুমি এই লেখাগুলো পড়ে থাকো তাহলে তোমাকে তো এর উত্তর আমায় দিতেই হবে। আমি দিতে চাই এর উত্তর। পাল্টা কথায় বলতে চাই তুমিই তো আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে। সেদিন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পরিনি।

কিই-বা বলার ছিল। জীবন কি? আমি কে? কিছুই কি আমি জানি!!! আমার স্মৃতির জীবন তো এমনি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনার প্রবাহমানতা। কি করে এতো এতো কথা বলি তোমাকে বলো তো? তাই ভাবছি লিখে ফেলি। কখনো যদি তোমার খুব একলা লাগে জীবনে।

যদি অখণ্ড অবসর হয়। যদি বিশ্বসাহিত্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা পড়তে পড়তে ক্লান্ত বোধ করো তবে সময় পেলে পড়ে দেখতে পারো আমি কেমন করে ভাবি-আমি কেমন করে ভাবতাম। পড়ে তুমিই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই সব দুর্দান্ত ক্ষণ গুলিতে কি আমার এই সব কথা শুনতে তোমার আদৌ ভালো লাগতো!

গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার
লও গো সুপথে,
তোমার দয়া বিনে চরণ
সাধবো কি মতে।।

তুমি যারে হও গো সদয়
সে তোমারে সাধনে পায়,
দেহের বিবাদীগণ স্ববশে রয়
তোমার কৃপাতে।।

যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন
যে বোল বাজাও বাজে তেমন,
তেমনি যন্ত্র আমার মন
বোল তোমার হাতে।।

জগাই-মাধাই দস্যু ছিল
তাহে প্রভুর দয়া হলো,
লালন পথে পড়ে র’লো
চরণ পাবার আশাতে।।

গুরু দোহাই তোমার : ভিডিও

(চলবে…)

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!