ভবঘুরেকথা
নিজেকে জানো রমজান ইবাদত প্রার্থনা ভক্তি নিবেদন

-মূর্শেদূল মেরাজ

রমজান: অভিমত

জাহেরি ও বাতেনি মতের বিশ্বাসের একটা মৌলিক পার্থক্য হলো; জাহেরি মতে স্রষ্টা বা পরমের ভয়ে ভীত হয়ে সাধন-ভজন করতে হয়। আর বাতেনি মতে পরমের সাথে প্রেমের মাধ্যমে সাধন-ভজন করতে হয়। বাতেনি বা মারফতে পরমের সাথে সাধকের সম্পর্ক হয় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। আর সাধন পথে গুরুর সাথে পঞ্চপ্রেমের সকল প্রেমই করতে হয়।

সাধককুল বলে, তাঁকে খুঁজতে হয় প্রেমে, ভয়ে বা অপ্রেমে খুঁজলে তাঁকে পাওয়া যাবে না। তাঁকে পাওয়ার একটাই পথ তা হলো বিনয়-ভক্তি-শ্রদ্ধ; আর এ সবই নিহিত প্রেমের মাঝে। তাই সাধককুল প্রেমিক-আসিক-দিওয়ানা হওয়ার কথাই বলে গেছেন… বলে যাচ্ছেন…।

বাতেনি বা তাসাউফ মতে বলে, নিজেকে জানার-পরমকে জানার ‘প্রেম’ই প্রথম এবং শেষ কথা। তাই আল্লাহর সাথে-খোদার সাথে-ভগবানের সাথে-ঈশ্বরের সাথে-পরমের সাথে-প্রকৃতির সাথে-গুরুর সাথে মিলনের লীন হওয়ার সহজ পথ হচ্ছে প্রেম।

আর তার জন্য চাই ‘প্রেমের প্রেমিক’ হওয়া। যেজন তা হতে পারে, সেজনই তাঁকে পেতে পারে। অন্যরা তো কেবল পাওয়ার অভিনয় করে মাত্র। ফকির লালন সাঁইজি এই জাহের-বাতেনের ভেদ ভেঙ্গে স্পষ্ট করেই বলছেন ‘গুপ্ত পথ মেলে ভক্তির সন্ধানে’-

আয় গো যাই নবীর দীনে।
দীনের ডংকা বাজে শহর মক্কা মদীনে।।

তরিক দিচ্ছেন নবী জাহের বাতেনে
যথা যোগ্য নায়েক চিনে,
রোজা আর নামাজ দেখতো এহি কাজ
গুপ্ত পথ মেলে ভক্তির সন্ধানে।।

অমূল্য দোকান খুলেছে নবী
যেই ধন চাইবি সেই ধন পাবি,
বিনা কড়ির ধন সেধে দেয় এখন
না নইলে আখেরে পস্তাবি মনে।।

নবীর সঙ্গে ইয়ার ছিলো চারি জন
চারকে দিলেন নবী চরি মর্যাদা ধন,
নবী বিনে পথে গোল হবে চারি মতে
ফকির লালন বলে যেন গোলে পরিসনে।।

ভয়-ভীতি চিন্তা-চেতনা-দেহ-মন-বুদ্ধি-বিবেচনাকে সংকুচিত করে ফেলে। আর প্রেম করে প্রসারিত-উদারচিত্ত। ভয়ের বর্হিপ্রকাশ ক্রোধ-প্রতিশোধপরায়ণ-হিংসা-দ্বেষ। আর প্রেমের বর্হিপ্রকাশ নমনীয়তা-বিনয়-ভক্তি। যে জ্ঞান সাধককে নমনীয় করতে পারে না, তাতে অহংবোধ থেকে যায়। আর অহংবোধ দিয়ে শুদ্ধচর্চা করা অসম্ভব।

তবে সমস্যা হলো ‘প্রেম’ যেমন শেখাও যায় না, তেমনি শেখানোও যায় না। প্রেম শেখা বা শেখানোর ব্যাপার না প্রেমকে ধারণ করতে হয়। তবেই সাধক প্রেমিক হয়ে উঠে। সাধারণভাবে প্রেমিক হওয়ার অভিনয় করা যায়। কিন্তু প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠতে গেলে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা-তপস্যা করতে হয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি বলেছেন, ‘পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতাসুলভ চরিত্র অর্জনের পথে অন্তরায়, তাই এ উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই সিয়ামের আসল তাৎপর্য।’

ভক্তিপ্রাণে শুদ্ধতার চর্চা, মনে প্রেমভাব জাগায়। এর জন্য চাই সহজ-শুদ্ধ সাধন-ভজন। সাধকের মাঝে যখন প্রেমের উদয় হয়। তখন তা আর আড়ালে থাকে না। দৃশ্যমান হয়। সাধকের প্রাণ যেমন নেচে উঠে। তেমনি তার প্রকাশ সকলকে মুগ্ধ করে। চম্বুকের মতো সাধকের পানে আকর্ষণ করে। সে পথ সহজ পথ হলেও সহজে তা মেলে না।

তবে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারলে সাধক প্রেমিক হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখবার বাসনা মনের মধ্যে টিকে থাকে। ততক্ষণ অহংকার সাথে থাকে। আর অহংকার থাকলে প্রেমের জন্ম হয় না। সাধক যখন নিজের সর্বস্ব ত্যাগ-আমিত্ব ত্যাগ করে কেবল অপরের জন্য বাঁচে। সকলের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে।

অপরের মনে-দেহে চুল পরিমাণ কষ্ট না দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টায় রত থেকে সাধনা চালিয়ে যায়। তখনই সে সাধক প্রেমিক হয়ে উঠে। যাকে দেখলেই মানুষের মন ভরে উঠে। চিত্তে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে। চোখে-মুখে উল্লাস জাগে। চেতনার বিকাশ ঘটে। ভক্তিভাব অন্তর থেকে জেগে উঠে। সেই তো প্রেমিক। বাকিরাতো প্রেমের হাটের বণিক মাত্র। বেচাকেনা হলে বাজার সদাই করে ঘরে ফেরায় আশায় থাকে।

এই নিজেকে চেনার-জানার-বোঝার; নিজের ভেতরের প্রেমভাবকে জাগ্রত করার জন্য চাই একান্ত-স্থিরচিত্ত। আর এই একান্ত সময় পাওয়ার অন্যতম উপযুক্ত সময় রমজান মাসের সংযমের মাধ্যমে। যদি সাধক এর মর্ম বুঝে বিলীন হতে পারে, তবে সংসারে থেকেও সাধক সেই স্বাদ নিতে পারে।

যে সাধক পানাহার-পাপাচার-কামাচার থেকে নিজেকে বিরত রেখে খোদার বা স্রষ্টার বা পরমের প্রেমে মশগুল হতে পারে, সেই এগিয়ে যেতে পারে সাধনার পথে। নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে পরমের ভাব অনুভব করার এই সাধন নিজেরটা নিজেকেই করতে হয়।

কেউ করে দিতে পারে না। গুরু কেবল পথ দেখায় মাত্র। নিজের নিষ্ঠা না থাকলে হয় না। রোজা হচ্ছে এমন এক সাধন যার স্বাক্ষী সাধক নিজে। এখানে ফাঁকি দিলে নিজের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদা সমুহের মধ্যে স্থূলতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা।’

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি বলেছেন, ‘পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতাসুলভ চরিত্র অর্জনের পথে অন্তরায়, তাই এ উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই সিয়ামের আসল তাৎপর্য।’

শাহ সুফি সৈয়্যেদ আহমদ আলী সুরেশ্বরী বলেছেন, ‘রমজানের ত্রিশটি রোজায় ত্রিশটি বুরাই দূর হয়ে ত্রিশটি নূর হাসিল হয়। এই রোজায় ঈমান বিমল হয়, নেক কাজে মন যায় ও নানাবিধ পীড়া থেকে মুক্তি ঘটে।’

বাবা কাশেম আলী চিশতী রোজা সম্পর্কে বলেছেন, “সাপের মাথায় ব্যাঙ নাচে, তবু সাপে আহার করে না; বুঝি সাপে রোজা রাইখাছে।”

রমজান দর্শন সম্পর্কে সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী বলেছেন, “সিয়াম সন্বন্ধে কোরানে সংক্ষেপে যাহা আছে সিয়াম দর্শন বুঝিবার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট। হাদিস দ্বারা সিয়ামের স্বরূপ বাস্তবরূপ ধারণ করিয়া উহার দর্শনকে বিস্তারিত ও সহজভাবে মূর্ত করিয়া তুলিয়াছে।

গুরুবাদ এবং জন্মান্তরবাদ তথা রূপান্তবাদ কোরানের সকল কথার মধ্যে সূক্ষ্ম ও রূপকভাবে বিধৃত রহিয়াছে। ইহাকে অস্বীকার করিলে কোরান ও হাদিসে অংকিত জীবন দর্শন বুঝিয়া নেওয়া সম্ভবপর নয়। যখন যেমন বুঝিয়াছি তখন তেমন লিখিয়াছি।

রমজানের সিয়াম সাধনার ব্যবস্থা অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক (Elastic) করিয়া রচনা করা হইয়াছে। যাহার যতটুকু সামর্থ বা যোগ্যতা আছে সে তাহা হইতে ততটুকু কল্যাণ আহরণ করিতে পারিবে। সিয়াম একটি সার্বজনীন সাধন ব্যবস্থা। আল্লাহ্‌তালা নিজেই বলিয়াছেন, ‘রমজান আমার জন্য, তাই আমি নিজ হাতে ইহার প্রতিফল দান করি এবং আমি নিজেই রমজানের সিয়াম সাধনার প্রতিফল।’

রমজানের সিয়াম সাধনাকে সংক্ষেপে বলিতে গেলে ইহাকে ধর্মসমূহ হইতে তাগুত বর্জন করিবার প্রকৃষ্ট সাধনা বলা যাইতে পারে। এইজন্য একান্ত প্রাসঙ্গিক না হইলেও তাগুত সংক্রান্ত দুটি বাক্যের ব্যাখ্যা করা একান্ত প্রয়োজন মনে করি।

উর্দ্দু এবং বাংলা ভাষায় প্রচলিত রোজা কথাটি ফারসি ভাষা হইতে গ্রহণ করা হইয়াছে। আরবিতে ইহাকে বলে সিয়াম। সিয়াম যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে বলে ‘সায়েম’ বা রোজদার। আমরা আরবি শব্দটিই ব্যবহার করিব। সিয়াম অর্থ Rejection, প্রত্যাখান, বর্জন, ত্যাগ, বিরত বা বারিত থাকা এবং যে ব্যক্তি বিরত বা বারিত থাকে তাঁহাকে সায়েম বলে।

এখন কথা হইল সায়েম অর্থাৎ রোজদার কোন বিষয় হইতে বিরত হইয়া থাকিবে? এবং কি প্রত্যাখান করিবে? প্রত্যাখান করিবার এবং বিরত হইবার একমাত্র বিষয় হইল দুনিয়া তথা তাগুত। এই জন্যই যদিও তাগুত সংক্রান্ত বাক্যগুলোর মধ্যে কোরানের সিয়ামের উল্লেখ নাই তবুও সেই বাক্যসমূহ হইতে দুইটি মাত্র বাক্যের ব্যাখ্যা এই পুস্তিকায় প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিলাম।

একাগ্রভাবে সঠিক ধারায় রমজানের সিয়াম সাধনা করিতে পারিলে তাহাতে ক্বদর রাত্রির সন্ধান পাওয়া যায়। যাহার ফলে সাধকের নিকট নাজেল হয় কোরান, হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফোরকান। এইজন্য রমজান মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে নৈসর্গিক একটি রাত্রিকে ক্বদর রাত্রিরূপে পালন করিবার ব্যাবস্থা রাখা হইয়াছে।

ক্বদর রাত্রি সিয়ামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকার কারণে ক্বদর রাত্রি বুঝাইবার উদ্দেশ্যে সূরা ক্বদরের ব্যাখ্যা এই পুস্তিকায় জুড়িয়া দেওয়া হইল। সেইরূপ একই কারণে ‘কাওসার’ এর পরিচয় দেওয়ার জন্য সূরা কাওসারের ব্যাখ্যাও এর সঙ্গে সন্নিবেশিত করা হইল।

গুরুবাদ এবং জন্মান্তরবাদ তথা রূপান্তবাদ কোরানের সকল কথার মধ্যে সূক্ষ্ম ও রূপকভাবে বিধৃত রহিয়াছে। ইহাকে অস্বীকার করিলে কোরান ও হাদিসে অংকিত জীবন দর্শন বুঝিয়া নেওয়া সম্ভবপর নয়। যখন যেমন বুঝিয়াছি তখন তেমন লিখিয়াছি।

তাই বিজ্ঞ পাঠকের নিকট অনুরোধ রহিল যেন আমার লিখিত পুস্তকাদি বক্তব্যসমূহের পূর্বাপর অসামঞ্জস্যগুলি সংশোধন করিয়া লন। সিয়াম দর্শন গ্রন্থটি সর্বসাধারণের জন্য পাঠ্য নয়। ইহা সত্যসন্ধানী এবং চিন্তাশীল গবেষকদের জন্য।”

বেশিভাগ মন্তব্যে ইংগিত বা ইশারাও এতোটাই আড়ালে রাখা হয়েছে যে তা সাধারণ পাঠকের মনে প্রশ্নই স্পষ্ট হয় না। বা বলা যায় ঘুরে ফিরে শরিয়তের ব্যাখ্যাই এসেছে কেবল ইবাদতের অংশে লোক দেখানোটা বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে মাত্র। আবার বাংলায় অনুবাদ করতে যেয়েও অনেক ইংগিত বাতিল হয়ে গেছে, সূক্ষ্মবিবেচনার অভাবে।

ডা বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান জাহাঙ্গীর আল সুরেশ্বরী রোজা সম্পর্কে বলেছেন, “রোজা কথাটি যদিও বাংলায় চালু, কিন্তু ইহা ফারসি ভাষা হতে এসেছে। উর্দুতেও রোজাই বলা হয়। কিন্তু আরবিতে ইহাকে সিয়াম বলে। যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করে তাকে বলে সায়েম।

এখন প্রশ্নটি হলো, সিয়াম বলতে কী বোঝায়? সিয়াম অর্থ হলো, প্রত্যাখ্যান, বর্জন, ত্যাগ, বিরত থাকা। ইংরেজিতে রিজেকশন বলা যেতে পারে। সুতরাং যে ব্যক্তি এই প্রত্যাখ্যান, বর্জন, ত্যাগ এবং বিরত থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তাকে সায়েম বলে তথা রোজাদার বলে।

এখন কথাটি হলো যে, সায়েম তথা রোজাদার কোন বিষয়টি হতে বিরত থাকবে? এবং কী তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে? প্রত্যাখ্যান করার অথবা বর্জন করার একমাত্র বিষয়টি হল আমিত্ব। আমিত্ব বলতে কী বোঝায়? যে ‘আমি’-টি নির্ভেজাল নয়, বরং ভেজাল আছে সেই ভেজাল ‘আমি’-টিকে বলা হয় আমিত্ব।

‘আমি’-টি কখন ভেজালে পরিণত হয়? যখন ‘আমি’-র সঙ্গে খান্নাসরূপী শয়তানটি বহাল তবিয়তে বাস করে এক ‘আমি’-কে দুই ‘আমি’-তে পরিণত করে। এক ‘আমি’-র মাঝে দুই ‘আমি’ থাকাটাকেই ভেজাল বলে।

এই দুই ‘আমি’-র ভেজাল হতে পরিত্রাণ পাবার জন্য, মুক্তিলাভ করার আশায় যে ‘আমি’-টি নকল ‘আমি’-টিকে বর্জন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তাকেই রোজাদার বলা হয়। আরবিতে তাকে বলা হয় সায়েম। ইহাই রোজার তথা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য।”

ইমাম গাজ্জালী বলেছেন, “আখলাকে ইলাহী বা আল্লাহর গুণে মানুষকে গুণান্বিত করাই সিয়ামের উদ্দেশ্য। সিয়াম মানুষকে ফেরেস্তাদের অনুকরণের মাধ্যমে, যতদূর সম্ভব নিজেকে প্রবৃদ্ধির গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। মানুষের মাঝে সহজাত এমন কিছু প্রবৃত্তি আছে যা বাঁচার জন্য প্রয়োজন যেমন- খাদ্য গ্রহণ প্রবৃত্তি, আত্মস্থ প্রবৃত্তি, আত্মপ্রতিষ্ঠা প্রবৃত্তি, ক্রীড়া, যৌন ও বিশ্রাম প্রবৃত্তি।” (ইহইয়াউল উলুম)

রোজা-রমজান বা সংযমের ইবাদতের অন্তদর্শন সম্পর্কে অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের অনেকের ব্যাখ্যার সাথে অন্ত্যমিলও যেমন আছে, তেমনি পার্থক্যও রয়েছে। তবে সকলেই এমন পর্দা করে বলেছেন যে রোজার বাতেনি মতটা কোথাও স্পষ্ট হয়নি।

বেশিভাগ মন্তব্যে ইংগিত বা ইশারাও এতোটাই আড়ালে রাখা হয়েছে যে তা সাধারণ পাঠকের মনে প্রশ্নই স্পষ্ট হয় না। বা বলা যায় ঘুরে ফিরে শরিয়তের ব্যাখ্যাই এসেছে কেবল ইবাদতের অংশে লোক দেখানোটা বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে মাত্র। আবার বাংলায় অনুবাদ করতে যেয়েও অনেক ইংগিত বাতিল হয়ে গেছে, সূক্ষ্মবিবেচনার অভাবে। তবে ফকির লালন সাঁইজি এই পদে বেশ জোড়ালো ইংগিত দিয়েই বলেছেন-

নবীর আইন বোঝার সাধ্য নাই।
যার যেমন বুদ্ধিতে আসে বলে তাই।।

বেহেস্তের লায়েক আহাম্মখ সবে
তাই শুনি হাদিছ কেতাবে,
এমত কথায় হিসেবে
বেহেস্তের গৌরব কিসে জানতে পাই।।

সকলে বলে আহাম্মখ বোকা
আহাম্মখ পায় বেহেস্তে জায়গা,
এত বড় পূর্ণ ধোকা কে ঘুচাবে ধোকা
কোথা যাই।।

রোজা নামাজ বেহেস্তের ভজন
তাই করে কি পাবে সে ধন,
বিনয় করে বলছে লালন
থাকতে পারে ভেদ, মুরশিদের ঠাঁই।।

ফকির লালন সাঁইজি সহজ ভাষায় বলেছেন, নবীর আইন বোঝার সাধ্য নাই। এই ভেদ ধরতে মুরশিদের আশ্রয়ই সহজ পথ। তবে জটিল পথেও বোঝা অসম্ভব নয়। তবে গুরু-মুরশিদ শিষ্য-ভক্তকে জ্ঞানানুসারে বুঝিয়ে দেয়। আর জটিল পথে নিজগুণে বুঝতে হয়।

সেক্ষেত্রে শুদ্ধজ্ঞান চর্চা ও প্রেম ভাব নিয়ে সাধককে এগিয়ে যেতে হয়। জানতে হয় অনেক মত-পথ। ভেদের কথা জানতে গেলে ডুবতে হয় মারফতের বা ভাবের সাগরে। আরেকটা পদে লালন সাঁইজি নামাজের কথা বলেছেন। তবে এই পদটা একটু খেয়াল করলে রোজার ভেদের প্রশ্নটা আরো স্পষ্ট হবে-

বলো কোন নামাজে খোদার দিদার হয়।
নামাজ পড় রোজা করো
কেবলি দোজখের ভয়।।

পাঞ্জেগানা নামাজ পড়া
পাঁচজনে করেছেন খাড়া,
এ তো নামাজের ধারা
দায়িমি নামাজ কারে কয়।।

ঈসা মূছা ইব্রাহিম নবী
ইউনুছ ও আদমসফি,
এ পাঁচজনের নামাজ সবি
পড়ছে সবে এ দুনিয়ায়।।

এক ওয়াক্ত করলে ক্বাজা
আশি হুব্বা হয় সাজা,
চল্লিশ বছর নামাজ ক্বাজা
করেছেন রাসূল দয়াময়।।

নামাজ পড়ে বেহেস্তে যাব
এ কথা মন সবাই ভাব,
রাসূল দর্শন কিভাবে পাব
ফকির লালন ভাবে তাই।।

দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তে যাওয়া অর্থাৎ সিদ্ধি বা মোক্ষ লাভই শুদ্ধ সাধনার লক্ষ্য হতে পারে না। মুক্তি বা নির্বাণের সাধনায় কিছু পাওয়ার আশা করাই বোকামি। সাধনার একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে পরমের দর্শন অর্থাৎ নিজের দর্শন; সহজ শব্দে বলতে গেলে আত্মদর্শন বা স্বরূপ দর্শন। পরমের দর্শন বিনে সাধন বৃথা।

আরেক পক্ষ এসব কিছুই মানতে নারাজ। এই অবিশ্বাসী পক্ষ বলে, বিশ্বাসে কোথাও পৌঁছানো যায় না। যতদূর যেতে হয় ততদূর যুক্তি-প্রমাণই একমাত্র উপায়। তারা আরেকটু তলিয়ে দেখলে জানতে পারবে। সাধকও একই কথা মানে। তফাত কেবল এক জায়গায়। সাধক আগে বিশ্বাস করে তারপর পথ চলতে শুরু করে। তার পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আর অবিশ্বাসী আগে পথ চলা শুরু করে।

আর এই পরমের দর্শনপ্রাপ্তির জন্যই সকল সাধন-ভজন। এই পথে যে ভাবে, সেই সাধনায় মুক্তির দিশা পায়। আর পরমের মিলনের পথের কথাই যদি হজরত মোহাম্মদ রমজানের মাধ্যমে তার অনুসারীদের দিয়ে থাকেন। তবে বুঝতে হবে হজরত কোন ধ্যান করার কথা বলেছেন। কোন জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন। কোন আহার বর্জনের কথা বলেছেন। আবার রোজা ভঙ্গ করে কোন আহার গ্রহণ করতে বলেছেন।

আহার কি কি? আর কোন আহার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলে নফসের খান্নাসকে দূরে রাখা যায়। রূহের আহার কি? নফসের আহার কি? রূহের আহার কি? মনের আহার কি? দেহের আহার কি? তেমনি কোন ধ্যান-কোন জ্ঞান ইত্যাদির ভেদও জানতে হবে। একান্ত থেকে সাধককেই এসবের উত্তরের সন্ধান করতে হবে। আর যখন সে সন্ধান পাবে তখনই সে আহার মুক্ত হতে পারবে।

রমজানের এ সাধনা হলো যুগল সাধন। একপক্ষ বলে এই যুগল হলো পরম আর সাধকের। আরেকপক্ষ বলে এ যুগল হলো প্রকৃতি আর সাধকের। এক অর্থে পরম আর প্রকৃতি একই। আবার বাস্তবিক অর্থে তা ভিন্ন। লালন বলে, ‘যা ছুঁলে প্রাণে মরি, এ জগতে তাইতে করি’। সবই টল-অটলের খেলা। হতে হবে রাজহংসের ন্যায়। পানি থেকে দুধটুকুই খেতে হবে। পানি না। ডুবতে হবে কিন্তু জল যেন না ছোঁয়।

মত যত, পথ তত। সাধন পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু গন্তব্য একই। কেউ বলে কাম নয়, প্রেমে মজো। আবার কেউ বলে, ‘প্রেমিক হও’। কেবল প্রেমিক হতে পারলেই সকল অসাধ্য সাধন হবে। আবার কেউ ছড়ি ধরে বলে ভয় পাও, ভীত হও তাতেই দেখবে পুরস্কার অপেক্ষা করছে।

আরেক পক্ষ এসব কিছুই মানতে নারাজ। এই অবিশ্বাসী পক্ষ বলে, বিশ্বাসে কোথাও পৌঁছানো যায় না। যতদূর যেতে হয় ততদূর যুক্তি-প্রমাণই একমাত্র উপায়। তারা আরেকটু তলিয়ে দেখলে জানতে পারবে। সাধকও একই কথা মানে। তফাত কেবল এক জায়গায়। সাধক আগে বিশ্বাস করে তারপর পথ চলতে শুরু করে। তার পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আর অবিশ্বাসী আগে পথ চলা শুরু করে।

তবে যে যাই বলুক না কেনো। ফকির লালন এক লাইন বলেই সব হিসেবে শেষ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ডুবে দেখ দেখি মন কিরূপ লীলাময়’। আসলেই তাই ডুবলেই পাওয়া যাবে। ভেসে ভেসে বললে কিছুই প্রাপ্তির বা হারানোর শঙ্কা নেই। রমজান শেষ করতে পারলেই ঈদের খুশি মিলবে। নয়তো পাহানার থেকে বিরত থাকাকেই রোজা ভাবতে হবে। রোজা প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-

যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ,
রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।

।। জয়গুরু ।।

…………………….
বি.দ্র. রমজান সম্পর্কে লেখা কি এখানেই শেষ হলো নাকি এখনো আরো কিছু বাকি রয়ে গেল?

………………………………….

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরো পড়ুন:

রমজান: সংযোমের সাধন:: এক
রমজান: সংযোমের সাধন:: দুই
রমজান: সংযোমের সাধন:: তিন
মানুষের জন্য সিয়াম: এক
মানুষের জন্য সিয়াম: দুই

শবে বরাত: নাজাতে ফিকির
শবে মেরাজ: ঊদ্ধলোকের রহস্যযাত্রা
মেরাজতত্ত্ব
মেরাজ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!