ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ৭ই মার্চ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে ভক্তসঙ্গে
(রাখাল, ভবনাথ, নরেন্দ্র, বাবুরাম)

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে আনন্দে বসিয়া আছেন। বাবুরাম, ছোট নরেন, পল্টু, হরিপদ, মোহিনীমোহন ইত্যাদি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। একটি ব্রাহ্মণ যুবক দুই-তিনদিন ঠাকুরের কাছে আছেন। তিনিও বসিয়া আছেন। আজ শনিবার, ২৫শে ফাল্গুন, ৭ই মার্চ, ১৮৮৫, বেলা আন্দাজ তিনটা। চৈত্র কৃষ্ণা সপ্তমী।

শ্রীশ্রীমা নহবতে আজকাল আছেন। তিনি মাঝে মাঝে ঠাকুরবাড়িতে আসিয়া থাকেন – শ্রীরামকৃষ্ণের সেবার জন্য। মোহিনীমোহনের সঙ্গে স্ত্রী, নবীনবাবুর মা, গাড়ি করিয়া আসিয়াছেন।

মেয়েরা নহবতে গিয়া শ্রীশ্রীমাকে দর্শন ও প্রণাম করিয়া সেইখানেই আছেন। ভক্তেরা একটু সরিয়া গেলে ঠাকুরকে আসিয়া প্রণাম করিবেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। ছোকরা ভক্তদের দেখিতেছেন ও আনন্দে বিভোর হইতেছেন।

রাখাল এখন দক্ষিণেশ্বরে থাকেন না। কয় মাস বলরামের সহিত বৃন্দাবনে ছিলেন। ফিরিয়া আসিয়া এখন বাটীতে আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – রাখাল এখন পেনশান খাচ্ছে। বৃন্দাবন থেকে এসে এখন বাড়িতে থাকে। বাড়িতে পরিবার আছে। কিন্তু আবার বলেছে, হাজার টাকা মাহিনা দিলেও চাকরি করবে না।

“এখানে শুয়ে শুয়ে বলত – তোমাকেও ভাল লাগে না, এমনি তার একটি অবস্থা হয়েছিল।

“ভবনাথ বিয়ে করেছে, কিন্তু সমস্ত রাত্রি স্ত্রীর সঙ্গে কেবল ধর্মকথা কয়! ঈশ্বরের কথা নিয়ে দুজনে থাকে। আমি বললুম, পরিবারের সঙ্গে একটু আমোদ-আহ্লাদ করবি, তখন রেগে রোখ করে বললে, কি! আমরাও আমোদ-আহ্লাদ নিয়ে থাকব?”

ঠাকুর এইবার নরেন্দ্রের কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – কিন্তু নরেন্দ্রের উপর যত ব্যাকুলতা হয়েছিল, এর উপর (ছোট নরেনের উপর) তত হয় নাই।

(হরিপদর প্রতি) “তুই গিরিশ ঘোষের বাড়ি যাস?”

হরিপদ – আমাদের বাড়ির কাছে বাড়ি, প্রায়ই যাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – নরেন্দ্র যায়?

হরিপদ – হাঁ, কখন কখন দেখতে পাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – গিরিশ ঘোষ যা বলে (অর্থাৎ ‘অবতার’ বলে) তাতে ও কি বলে?

হরিপদ – তর্কে হেরে গেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, সে (নরেন্দ্র) বললে, গিরিশ ঘোষের এখন এত বিশ্বাস – আমি কেন কোন কথা বলব?

জজ অনুকূল মুখোপাধ্যায়ের জামায়ের ভাই আসিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি নরেন্দ্রকে জান?

জামায়ের ভাই – আজ্ঞা, হাঁ। নরেন্দ্র বুদ্ধিমান ছোকরা!

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – ইনি ভাল লোক, যে কালে নরেন্দ্রের সুখ্যাতি করেছেন। সেদিন নরেন্দ্র এসেছিল। ত্রৈলোক্যের সঙ্গে সেদিন গান গাইলে। কিন্তু গানটি সেদিন আলুনী লাগল।

[বাবুরাম ও ‘দুদিক রাখা’ – জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও ]

ঠাকুর বাবুরামের দিকে চাহিয়া কথা কহিতেছেন। মাস্টার যে স্কুলে অধ্যাপনা করেন, বাবুরাম সে স্কুলে এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়েন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বাবুরামের প্রতি) – তোর বই কই? পড়াশুনা করবি না? (মাস্টারের প্রতি) ও দুদিক রাখতে চায়।

“বড় কঠিন পথ, একটু তাঁকে জানলে কি হবে! বশিষ্ঠদেব, তাঁরই পুত্রশোক হল! লক্ষ্মণ দেখে অবাক্‌ হয়ে রামকে জিজ্ঞাসা করলেন। রাম বললেন, ভাই, এ আর আশ্চর্য কি? যার জ্ঞান আছে তার অজ্ঞানও আছে। ভাই, তুমি জ্ঞান-অজ্ঞানের পার হও! পায়ে কাঁটা ফুটলে, আর একটি কাঁটা খুঁজে আনতে হয়, সেই কাঁটা দিয়ে প্রথম কাঁটাটি তুলতে হয়, তারপর দুটি কাঁটাই ফেলে দিতে হয়। তাই অজ্ঞান কাঁটা তুলবার জন্য জ্ঞান কাঁটা যোগাড় করতে হয়। তারপর জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যেতে হয়!”

বাবুরাম (সহাস্যে) – আমি ওইটি চাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ওরে, দুদিক রাখলে কি তা হয়? তা যদি চাস তবে চলে আয়!

বাবুরাম (সহাস্যে) – আপনি নিয়ে আসুন!

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – রাখাল ছিল সে এক, তার বাপের মত ছিল। এরা থাকলে হাঙ্গাম হবে।

বাবুরামের প্রতি) – “তুই দুর্বল। তোর সাহস কম! দেখ দেখি ছোট নরেন কেমন বলে, ‘আমি একবারে এসে থাকব’!”

এতক্ষণে ঠাকুর ছোকরা ভক্তদের মধ্যে আসিয়া মেঝেতে মাদুরের উপর বসিয়াছেন। মাস্টার তাঁহার কাছে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে) – আমি কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী খুঁজছি। মনে করি, এ বুঝি থাকবে! সকলেই এক-একটা ওজর করে!

“একটা ভূত সঙ্গী খুঁজছিল। শনি-মঙ্গলবারে অপঘাতে মৃত্যু হলে ভূত হয়, তাই সে ভূতটা যেই দেখত কেউ ছাদ থেকে পড়ে গেছে, কি হোঁচট খেয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়েছে, অমনি দৌড়ে যেত, – এই মনে করে যে, এটার অপঘাত মৃত্যু হয়েছে, এবার ভূত হবে, আর আমার সঙ্গী হবে। কিন্তু তার এমনি কপাল যে দেখে, সব শালারা বেঁচে উঠে! সঙ্গী আর জোটে না।

“দেখ না, রাখাল ‘পরিবার’ ‘পরিবার’ করে। বলে, আমার স্ত্রীর কি হবে? নরেন্দ্র বুকে হাত দেওয়াতে বেহুঁশ হয়ে গিছল, তখন বলে, ওগো তুমি আমার কি করলে গো! আমার যে বাপ-মা আছে গো!

“আমায় তিনি এ-অবস্থায় রেখেছেন কেন? চৈতন্যদেব সন্ন্যাস করলেন – সকলে প্রণাম করবে বলে, যারা একবার নমস্কার করবে তারা উদ্ধার হয়ে যাবে।”

ঠাকুরের জন্য মোহিনীমোহন চ্যাংড়া করিয়া সন্দেশ আনিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – এ সন্দেশ কার?

বাবুরাম মোহিনীকে দেখাইয়া দিলেন।

ঠাকুর প্রণব উচ্চারণ করিয়া সন্দেশ স্পর্শ করিলেন ও কিঞ্চিৎ গ্রহণ করিয়া প্রসাদ করিয়া দিলেন। অতঃপর সেই সন্দেশ লইয়া ভক্তদের দিতেছেন। কি আশ্চর্য, ছোট নরেনকে ও আরও দুই-একটি ছোকরা ভক্তকে নিজে খাওয়াইয়া দিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – এর একটি মানে আছে। নারায়ণ শুদ্ধাত্মাদের ভিতর বেশি প্রকাশ। ও-দেশে যখন যেতুম ইওরূপ ছেলেদের কারু-কারু মুখে নিজে খাবার দিতাম। চিনে শাঁখারী বলত ‘উনি আমাদের খাইয়ে দেন না কেন?’ কেমন করে দেব, কেউ ভাজ-মেগো! কেউ অমুক-মেগো, কে খাইয়ে দেবে!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!