ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ৭ই মার্চ
‘ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’ – গুহ্যকথা

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে মেঝেতে মাদুরের উপর বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন। ভক্তদের বলিতেছেন, আমার পায়ে একটু হাত বুলিয়ে দে তো। ভক্তেরা পদসেবা করিতেছেন। (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে) “এর (পদসেবার) অনেক মানে আছে।”

আবার নিজের হৃদয়ে হাত রাখিয়া বলিতেছেন, “এর ভিতর যদি কিছু থাকে (পদসেবা করলে) অজ্ঞান অবিদ্যা একেবারে চলে যায়।”

হঠাৎ শ্রীরামকৃষ্ণ গম্ভীর হইলেন, যেন কি গুহ্যকথা বলিবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – এখানে অপর লোক কেউ নাই। সেদিন – হরিশ কাছে ছিল – দেখলাম – খোলটি (দেহটি) ছেড়ে সচ্চিদানন্দ বাহিরে এল, এসে বললে, আমি যুগে যুগে অবতার! তখন ভাবলাম, বুঝি মনের খেয়ালে ওই সব কথা বলছি। তারপর চুপ করে থেকে দেখলাম – তখন দেখি আপনি বলছে, শক্তির আরাধনা চৈতন্যও করেছিল।

ভক্তেরা সকলে অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন। কেহ কেহ ভাবিতেছেন – সচ্চিদানন্দ ভগবান কি শ্রীরামকৃষ্ণের রূপ ধারণ করিয়া আমাদের কাছে বসিয়া আছেন? ভগবান কি আবার অবতীর্ণ হইয়াছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ কথা কহিতেছেন। মাস্টারকে সম্বোধন করিয়া আবার বলিতেছেন – “দেখলাম, পূর্ণ আর্বিভাব। তবে সত্ত্বগুণের ঐশ্বর্য।”

ভক্তেরা সকলে অবাক্‌ হইয়া এই সকল কথা শুনিতেছেন।

[যোগমায়া আদ্যাশক্তি ও অবতারলীলা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – এখন মাকে বলছিলাম, আর বকতে পারি না। আর বলছিলাম, ‘মা যেন একবার ছুঁয়ে দিলে লোকের চৈতন্য হয়।’ যোগমায়ার এমনি মহিমা – তিনি ভেলকি লাগিয়ে দিতে পারেন। বৃন্দাবনলীলায় যোগমায়া ভেলকি লাগিয়ে দিলেন। তাঁরই বলে সুবোল কৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীমতীর মিলন করে দিছলেন। যোগমায়া – যিনি আদ্যাশক্তি – তাঁর একটি আকর্ষণী শক্তি আছে। আমি ওই শক্তির আরোপ করেছিলাম।

“আচ্ছা, যারা আসে তাদের কিছু কিছু হচ্ছে?”

মাস্টার – আজ্ঞা হাঁ, হচ্ছে বইকি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেমন করে জানলে?

মাস্টার (সহাস্যে) সবাই বলে, তাঁর কাছে যারা যায় তারা ফেরে না!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – একটা কোলাব্যাঙ হেলেসাপের পাল্লায় পড়েছিল। সে ওটাকে গিলতেও পারছে না, ছাড়তেও পারছে না! আর কোলাব্যাঙটার যন্ত্রণা – সেটা ক্রমাগত ডাকছে! ঢোঁড়াসাপটারও যন্ত্রণা। কিন্তু গোখরোসাপের পাল্লায় যদি পড়ত তাহলে দু-এক ডাকেই শান্তি হয়ে যেত। (সকলের হাস্য)

(ছোকরা ভক্তদের প্রতি) – “তোরা ত্রৈলোক্যের সেই বইখানা পড়িস – ভক্তিচৈতন্যচন্দ্রিকা। তার কাছে একখানা চেয়ে নিস না। বেশ চৈতন্যদেবের কথা আছে।”

একজন ভক্ত – তিনি দেবেন কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – কেন, কাঁকুড়ক্ষেত্রে যদি অনেক কাঁকুড় হয়ে থাকে তাহলে মালিক ২/৩টা বিলিয়ে দিতে পারে! (সকলের হাস্য) অমনি কি দেবে না – কি বলিস?

শ্রীরামকৃষ্ণ (পল্টুর প্রতি) – আসিস এখানে এক-একবার।

পল্টু – সুবিধা হলে আসব।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কলকাতায় যেখানে যাব, সেখানে যাবি?

পল্টু – যাব, চেষ্টা করব।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ওই পাটোয়ারী!

পল্টু – ‘চেষ্টা করব’ না বললে যে মিছে কথা হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – ওদের মিছে কথা ধরি না, ওরা স্বাধীন নয়।

ঠাকুর হরিপদর সঙ্গে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হরিপদর প্রতি) – মহেন্দ্র মুখুজ্জে কেন আসে না?

হরিপদ – ঠিক বলতে পারি না।

মাস্টার (সহাস্যে) – তিনি জ্ঞানযোগ করছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, সেদিন প্রহ্লাদচরিত্র দেখাবে বলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছিল। কিন্তু দেয় নাই, বোধ হয় এইজন্য আসে না।

মাস্টার – একদিন মহিম চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা ও আলাপ হয়েছিল। সেইখানে যাওয়া আসা করেন বলে বোধ হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন মহিমা তো ভক্তির কথাও কয়। সে তো ওইটে খুব বলে, ‘আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌।’

মাস্টার (সহাস্যে) – সে আপনি বলান তাই বলে!

শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ ঠাকুরের কাছে নূতন যাতায়াত করিতেছেন। আজকাল তিনি সর্বদা ঠাকুরের কথা লইয়া থাকেন।

হরি – গিরিশ ঘোষ আজলাল অনেকরকম দেখেন। এখান থেকে গিয়ে অবধি সর্বদা ঈশ্বরের ভাবে থাকেন – কত কি দেখেন!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তা হতে পারে, গঙ্গার কাছে গেলে অনেক জিনিস দেখা যায়, নৌকা, জাহাজ – কত কি।

হরি – গিরিশ ঘোষ বলেন, ‘এবার কেবল কর্ম নিয়ে থাকব, সকালে ঘড়ি দেখে দোয়াত কলম নিয়ে বসব ও সমস্ত দিন ওই (বই লেখা) করব।’ এইরকম বলেন কিন্তু পারেন না। আমরা গেলেই কেবল এখানকার কথা। আপনি নরেন্দ্রকে পাঠাতে বলেছিলেন। গিরিশবাবু বললেন, ‘নরেন্দ্রকে গাড়ি করে দিব।’

৫টা বাজিয়াছে। ছোট নরেন বাড়ি যাইতেছেন। ঠাকুর উত্তর-পূর্ব লম্বা বারান্দায় দাঁড়াইয়া একান্তে তাঁহাকে নানাবিধ উপদেশ দিতেছেন। কিয়ৎপরে তিনি প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। অন্যান্য ভক্তেরাও অনেকে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসিয়া মোহিনীর সঙ্গে কথা কহিতেছেন। পরিবারটি পুত্রশোকের পর পাগলের মতো। কখন হাসেন, কখনও কাঁদেন, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে এসে কিছু শান্তভাব হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমার পরিবার এখন কিরকম?

মোহিনী – এখানে এলেই শান্ত হন, সেখানে মাঝে মাঝে বড় হাঙ্গাম করেন। সেদিন মরতে গিছলেন।

ঠাকুর শুনিয়া কিয়ৎকাল চিন্তিত হইয়া রহিলেন। মোহিনী বিনীতভাবে বলিতেছেন, “আপনার দু-একটা কথা বলে দিতে হবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – রাঁধতে দিও না। ওতে মাথা আরও গরম হয়। আর লোকজনের সঙ্গে রাখবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!