১৮৮৭, ৯ই – ১০ই মে
নরেন্দ্র
আজ সোমবার, ৯ই মে, ১৮৮৭, জৈষ্ঠ কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি। নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা মঠে আছেন। শরৎ, বাবুরাম ও কালী শ্রীক্ষেত্রে গিয়াছেন। নিরঞ্জন মাকে দেখিতে গিয়াছেন। মাস্টার আসিয়াছেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর মঠের ভাইরা একটু বিশ্রাম করিতেছেন। ‘বুড়োগোপাল’ গানের খাতাতে গান নকল করিতেছেন।
বৈকাল হইল। রবীন্দ্র উন্মত্তের ন্যায় আসিয়া উপস্থিত। শুধু পা, কালাপেড়ে কাপড় আধখানা পরা। উন্মাদের চক্ষুর ন্যায় তাঁহার চক্ষের তারা ঘুরিতেছে। সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে?” রবীন্দ্র বলিলেন, “একটু পরে সমস্ত বলছি। আমি আর বাড়ি ফিরিয়া যাইব না; আপনাদের এইখানেই থাকব। সে বিশ্বাসঘাতক! বলেন কি মহাশয়, পাঁচ বছরের অভ্যাস, মদ – তার জন্য ছেড়েছি! আট মাস হল ছেড়েছি! সে কি না বিশ্বাসঘাতক!” মঠের ভাইরা সকলে বলিলেন, “তুমি ঠাণ্ডা হও। কিসে করে এলে?”
রবীন্দ্র – আমি কলিকাতা থেকে বরাবর শুধু পায়ে হেঁটে এসেছি।
ভক্তেরা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার আর আধখানা কাপড় কোথায় গেল?”
রবীন্দ্র বলিলেন, “সে আসবার সময় টানাটানি করলে, তাই আধখানা ছিঁড়ে গেল।”
ভক্তেরা বলিলেন, “তুমি গঙ্গাস্নান করে এসো; এসে ঠাণ্ডা হও। তার পর কথাবার্তা হবে।”
রবীন্দ্র কলিকাতার একটি অতি সম্ভ্রান্ত কায়স্থবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। বয়ঃক্রম ২০।২২ বৎসর হইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে দর্শন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার বিশেষ কৃপাভাজন হইয়াছিলেন। একবার তিন রাত্রি তাঁহার কাছে বাস করিয়াছিলেন। স্বভাব অতি মধুর ও কোমল। ঠাকুর খুব স্নেহ করিয়াছিলেন, কিন্তু বলিয়াছিলেন, “তোর কিন্তু দেরি হবে, এখন তোর একটু ভোগ আছে! এখন কিছু হবে না। যখন ডাকাত পড়ে, তখন ঠিক সেই সময় পুলিসে কিছু করতে পারে না। একটু থেমে গেলে তবে পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করে।” আজ রবীন্দ্র বারঙ্গনার মোহে পড়িয়াছেন। কিন্তু অন্য সকল গুণ আছে। গরিবের প্রতি দয়া, ঈশ্বরচিন্তা, এ-সমস্ত আছে। বেশ্যাকে বিশ্বাসঘাতক মনে করিয়া অর্ধবস্ত্রে মঠে আসিয়াছেন। সংসারে আর ফিরিবেন না, এই সঙ্কল্প।
রবীন্দ্র গঙ্গাস্নানে যাইতেছেন। পরামাণিকের ঘাটে যাইবেন। একটি ভক্ত সঙ্গে যাইতেছেন। তাঁহার বড় সাধ যে, ছেলেটির সাধুসঙ্গে চৈতন্য হয়। স্নানের পর তিনি রবীন্দ্রকে ঘাটের নিকটস্থ শ্মশানে লইয়া গেলেন। তাঁহাকে মৃতদেহ দর্শন করাইতে লাগিলেন। আর বলিলেন, “এখানে মঠের ভাইরা মাঝে মাঝে একাকী এসে রাত্রে ধ্যান করেন। এখানে আমাদের ধ্যান করা ভাল। সংসার যে অনিত্য তা বোধ হয়।” রবীনদ্র সেই কথা শুনিয়া ধ্যানে বসিলেন। ধ্যান বেশিক্ষণ করিতে পারিলেন না। মন অস্থির রহিয়াছে।
উভয়ে মঠে ফিরিলেন। ঠাকুরঘরে উভয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। ভক্তটি বলিলেন, এই ঘরে মঠের ভাইরা ধ্যান করেন। রবীন্দ্রও একটু ধ্যান করিতে বসিলেন, কিন্তু ধ্যান বেশিক্ষণ হল না।
মণি – কি, মন কি বড় চঞ্চল? তাই বুঝি উঠে পড়লে? তাই বুঝি ধ্যান ভাল হল না?
রবীন্দ্র – আর যে সংসারে ফিরব না, তা নিশ্চিন্ত! তবে মনটা চঞ্চল বটে।
মণি ও রবীন্দ্র মঠের এক নিভৃত স্থানে দাঁড়াইয়া আছেন। মণি বুদ্ধদেবের গল্প করিতেছেন। দেবকন্যাদের একটি গান শুনে বুদ্ধদেবের প্রথম চৈতন্য হয়েছিল। আজকাল মঠে বুদ্ধচরিত ও চৈতন্যচরিতের আলোচনা সর্বদাই হয়। মণি সেই গান গাহিতেছেন:
জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি কোথা ফিরে যাই।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই।।
রাত্রে নরেন্দ্র, তারক ও হরিশ – কলিকাতা হইতে ফিরিলেন। আসিয়া বলিলেন, উঃ খুব খাওয়া হয়েছে! তাঁহাদের কলিকাতায় কোন ভক্তের বাড়িতে নিমন্ত্রণ হইয়াছিল।
নরেন্দ্র ও মঠের ভাইরা, মাস্টার, রবীন্দ্র ইত্যাদি এঁরাও দানাদের ঘরে বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র মঠে আসিয়া সমস্ত কথা শুনিয়াছেন।
[সন্তপ্ত জীব ও নরেন্দ্রের উপদেশ ]
নরেন্দ্র গাহিতেছেন – গীতচ্ছলে যেন রবীন্দ্রকে উপদেশ দিতেছেন –
ছাড় মোহ, ছাড় ছাড় রে কুমন্ত্রণা, জান তাঁরে তবে যাবে যন্ত্রণা।
নরেন্দ্র আবার গাহিলেন – যেন রবীন্দ্রকে হিতবচন বলছেন:
পীলেরে অবধূত হো মাতোয়ারা পিয়ালা-প্রেম হরিরসকা রে।
বাল অবস্থা খেল গোঞাই, তরুণ ভয়ো নারী বশকা রে।
বৃদ্ধ ভয়ো কফ্ বায়ুনে ঘেরা, খাট পড়া রহে জা মস্কা রে।
নাভ কমলমে হ্যায় কস্তুরী, ক্যায়সে ভরম মিটে পশুকা রে।
বিনা সৎগুরু নর য়্যাসাহি ঢুঁঢ়ে, জ্যায়সা মৃগ ফিরে বনকা রে।
কিয়ৎক্ষণ পরে মঠের ভাইরা কালী তপস্বীর ঘরে বসিয়া আছেন। গিরিশের বুদ্ধচরিত ও চৈতন্যচরিত দুইখানি নূতন পুস্তক আসিয়াছে। নরেন্দ্র, শশী, রাখাল, প্রসন্ন, মাস্টার ইত্যদি বসিয়া আছেন। নূতন মঠে আসা পর্যন্ত শশী একমনে দিনরাত ঠাকুরের পূজাদি সেবা করেন। তাঁহার সেবা দেখিয়া সকলে অবাক হইয়াছেন। ঠাকুরের অসূখের সময় তিনি রাতদিন যেরূপ তাঁহার সেবা করিয়াছিলেন, আজও সেরূপ অনন্যমন, একভক্তি হইয়া সেবা করিতেছেন।
মঠের একজন ভাই বুদ্ধচরিত ও চৈতন্যচরিত পড়িতেছেন। সুর করিয়া একটু ব্যঙ্গভাবে চৈতন্যচরিতামৃত পড়িতেছেন। নরেন্দ্র বইখানি কাড়িয়া লইলেন। বলিলেন, “এইরকম করে ভাল জিনিসটা মাটি করে?”
নরেন্দ্র নিজে চৈতন্যদেবের প্রেমবিতরণের কথা পড়িতেছেন।
মঠের ভাই – আমি বলি কেউ কারুকে প্রেম দিতে পারে না।
নরেন্দ্র – আমায় পরমহংস মহাশয় প্রেম দিয়েছেন।
মঠের ভাই – আচ্ছা, তুমি কি তাই পেয়েছ?
নরেন্দ্র – তুই কি বুঝবি? তুই Servant Class (ঈশ্বরের সেবকের থাক)। আমার সবাই পা টিপবে। শরতা মিত্তির আর দেসো পর্যন্ত। (সকলের হাস্য) তুই মনে করছিস বুঝি যে সব তুই বুঝিছিস। (হাস্য) লে তামাক সাজ। (সকলের হাস্য)
মঠের ভাই – সাজ-বো-না। (সকলের হাস্য)
মাস্টার (স্বগত) – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের ভাইদের অনেকের ভিতর তেজ দিয়াছেন। শুধু নরেন্দ্রের ভিতর নয়। এ তেজ না থাকলে কি কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ হয়?
[মঠের ভাইদের সাধনা ]
পরদিন মঙ্গলবার, ১০ই মে। আজ মহামায়ার বার। নরেন্দ্রাদি মঠের ভাইরা আজ বিশেষরূপে মার পূজা করিতেছেন। ঠাকুরঘরের সম্মুখে ত্রিকোণ যন্ত্র প্রস্তুত হইল, হোম হইবে। পরে বলি হইবে। তন্ত্রমতে হোম ও বলির ব্যবস্থা আছে। নরেন্দ্র গীতাপাঠ করিতেছেন।
মণি গঙ্গাস্নানে গেলেন। রবীন্দ্র ছাদের উপরে একাকী বিচরণ করিতেচেন। শুনিতেছেন, নরেন্দ্র সুর করিয়া স্তব করিতেছেন।
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোমভূমির্ন তেজো ন বায়ু-
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।
ন চ প্রাণসংজ্ঞো ন বৈ পঞ্চবায়ু-
র্ন বা সপ্তধাতুর্ন বা পঞ্চকোষাঃ।
ন বাক্পাণিপাদং নচোপস্থপায়ু
চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।।
ন মে দ্বেষরাগৌ, ন মে লোভমোহৌ,
মদোনৈব মে নৈব মাৎসর্য্যভাবঃ।
ন ধর্মো ন চার্থো ন কামো ন মোক্ষ-
শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং
ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা,
চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।
এইবার রবীন্দ্র গঙ্গাস্নান করিয়া আসিয়াছেন; ভিজে কাপড়।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি, একান্তে) – এই নেয়ে এসেছে, এবার সন্ন্যাস দিলে বেশ হয়। (মণি ও নরেন্দ্রের হাস্য)
প্রসন্ন রবীন্দ্রকে ভিজে কাপড় ছাড়িতে বলিয়া তাঁহাকে একখানা গেরুয়া কাপড় আনিয়া দিলেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি) – এইবার ত্যাগীর কাপড় পরতে হবে।
মণি (সহাস্যে) – কি ত্যাগ?
নরেন্দ্র – কাম-কাঞ্চনত্যাগ।
রবীন্দ্র গেরুয়া কাপড়খানি পরিয়া কালী তপস্বীর ঘরে গিয়া নির্জনে বসিলেন। বোধ হয় একটু ধ্যান করিবেন।