ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ১৫ই জুলাই
সুপ্রভাত ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ – মধুর নৃত্য ও নামকীর্তন

শ্রীরামকৃষ্ণ বৈঠকখানার পশ্চিমদিকের ছোট ঘরে শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন। রাত ৪টা। ঘরের দক্ষিণে বারান্দা, তাহাতে একখানি টুল পাতা আছে। তাহার উপর মাস্টার বসিয়া আছেন।

কিয়ৎক্ষণ পরেই ঠাকুর বারান্দায় আসিলেন। মাস্টার ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। সংক্রান্তি, বুধবার, ৩২শে আষাঢ়; ১৫ই জুলাই, ১৮৮৫।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি আর-একবার উঠেছিলাম। আচ্ছা, সকালবেলা কি যাব?

মাস্টার – আজ্ঞা, সকালবেলায় ঢেউ একটু কম থাকে।

ভোর হইয়াছে – এখনও ভক্তেরা আসিয়া জুটেন নাই। ঠাকুর মুখ ধুইয়া মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। পশ্চিমের ঘরটির উত্তর দরজার কাছে দাঁড়াইয়া নাম করিতেছেন। কাছে মাস্টার। কিয়ৎক্ষণ পরে অনতিদূরে গোপালের মা আসিয়া দাঁড়াইলেন। অন্তঃপরে দ্বারের অন্তরালে ২/১টি স্ত্রীলোক ভক্ত আসিয়া ঠাকুরকে দেখিতেছেন। যেন শ্রীবৃন্দাবনের গোপীরা শ্রীকৃষ্ণদর্শন করিতেছেন! অথবা নবদ্বীপের ভক্ত মহিলারা প্রেমোন্মত্ত হইয়া শ্রীগৌরাঙ্গকে আড়াল হইতে দেখিতেছেন।

রামনাম করিয়া ঠাকুর কৃষ্ণনাম করিতেচেন, কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! গোপীকৃষ্ণ! গোপী! গোপী! রাখালজীবন কৃষ্ণ! নন্দনন্দন কৃষ্ণ! গোবিন্দ! গোবিন্দ!

আবার গৌরাঙ্গের নাম করিতেছেন –

শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ। হরেকৃষ্ণ হরে রাম, রাধে গোবিন্দ!

আবার বলিতেছেন, আলেখ নিরঞ্জন! নিরঞ্জন বলিয়া কাঁদিতেছেন। তাঁহার কান্না দেখিয়া ও কাতর স্বর শুনিয়া, কাছে দণ্ডায়মান ভক্তেরা কাঁদিতেছেন। তিনি কাঁদিতেছেন, আর বলিতেছেন, ‘নিরঞ্জন! আয় বাপ – খারে নেরে – কবে তোরে খাইয়ে জন্ম সফল করব! তুই আমার জন্য দেহধারণ করে নররূপে এসেছিস।’

জগন্নাথের কাছে আর্তি করিতেছেন – জগন্নাথ! জগবন্ধু! দীনবন্ধু! আমি তো জগৎছাড়া নই নাথ, আমায় দয়া কর!

প্রেমোন্মত্ত হইয়া গাহিতেছেন – “উড়িষ্যা জগন্নাথ ভজ বিরাজ জী!”

এইবার নারায়ণের নামকীর্তন করিতে করিতে নাচিতেছেন ও গাহিতেছেন – শ্রীমন্নারায়ণ! শ্রীমন্নারায়ণ! নারায়ণ! নারায়ণ!

নাচিতে নাচিতে আবার গান গাইতেছেন:

হলাম যার জন্য পাগল, তারে কই পেলাম সই।
ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, আর পাগল শিব,
তিন পাগলে যুক্তি করে ভাঙলে নবদ্বীপ
আর এক পাগল দেখে এলাম বৃন্দাবনের মাঠে,
রাইকে রাজা সাজায়ে আপনি কোটাল সাজে!

এইবার ঠাকুর ভক্তসঙ্গে ছোট ঘরটিতে বসিয়াছেন। দিগম্বর! যেন পাঁচ বৎসরের বালক! মাস্টার, বলরাম আরও দুই-একটি ভক্ত বসিয়া আছেন।

[রূপদর্শন কখন? গুহ্যকথা – শুদ্ধ-আত্মা ছোকরাতে নারায়ণদর্শন ]
(রামলালা, নিরঞ্জন, পূর্ণ, নরেন্দ্র, বেলঘরের তারক, ছোট নরেন)

শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন করা যায়! যখন উপাধি সব চলে যায়, – বিচার বন্ধ হয়ে যায়, – তখন দর্শন। তখন মানুষ অবাক্‌ সমাধিস্থ হয়। থিয়েটারে গিয়ে বসে লোকে কত গল্প করে, – এ-গল্প সে গল্প। যাই পর্দা উঠে যায় সব গল্প-টল্প বন্ধ হয়ে যায়। যা দেখে তাইতেই মগ্ন হয়ে যায়।

“তোমাদের অতি গুহ্যকতা বলছি। কেন পূর্ণ, নরেন্দ্র, এদের সব এত ভালবাসি। জগন্নাথের সঙ্গে মধুরভাবে আলিঙ্গন করতে গিয়ে হাত ভেঙে গেল। জানিয়ে দিলে, “তুমি শরীরধারণ করেছ – এখন নররূপের সঙ্গে সখ্য, বাৎসল্য এইসব ভাব লয়ে থাকো।”

“রামলালার উপর যা যা ভাব হত, তাই পূর্ণাদিকে দেখে হচ্ছে! রামলালাকে নাওয়াতাম, খাওয়াতাম, শোয়াতাম, -সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতাম, – রামলালার জন্য বসে বসে কাঁদতাম, ঠিক এই সব ছেলেদের নিয়ে তাই হয়েছে! দেখ না নিরঞ্জন। কিছুতেই লিপ্ত নয়। নিজের টাকা দিয়ে গরিবদের ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়। বিবাহের কথায় বলে, ‘বাপরে! ও বিশালাক্ষীর দ!’ ওকে দেখি যে, একটা জ্যোতিঃর উপর বসে রয়েছে।

“পূর্ণ উঁচু সাকার ঘর – বিষ্ণুর অংশে জন্ম। আহা কি অনুরাগ!

(মাস্টারের প্রতি) – “দেখলে না, – তোমার দিকে চাইতে লাগল – যেন গুরুভাই-এর উপর – যেন ইনি আমার আপনার লোক! আর-একবার দেখা করবে বলেছে। বলে কাপ্তেনের ওখানে দেখা হবে।”

[নরেন্দ্রের কত গুণ – ছোট নরেণের গুণ ]

“নরেন্দ্রের খুব উঁচু ঘর – নিরাকারের ঘর। পুরুষের সত্তা।

“এতো ভক্ত আসছে, ওর মতো একটি নাই।

“এক-একবার বসে বসে খতাই। তা দেখি, অন্য পদ্ম কারু দশদল, কারু ষোড়শদল, কারু শতদল কিন্তু পদ্মমধ্যে নরেন্দ্র সহস্রদল!

“অন্যেরা কলসী, ঘটি এ-সব হতে পারে, – নরেন্দ্র জালা।

“ডোবা পুষ্করিণী মধ্যে নরেন্দ্র বড় দীঘি! যেমন হালদার-পুকুর।

“মাছের মধ্যে নরেন্দ্র রাঙাচক্ষু বড় রুই, আর সব নানারকম মাছ – পোনা, কাঠি বাটা, এই সব।

“খুব আধার, – অনেক জিনিস ধরে। বড় ফুটোওলা বাঁশ!

“নরেন্দ্র কিছুর বশ নয়। ও আসক্তি, ইন্দ্রিয়-সুখের বশ নয়। পুরুষ পায়রা। পুরুষ পায়রার ঠোঁট ধরলে ঠোঁট টেনে ছিনিয়ে লয়, – মাদী পায়রা চুপ করে থাকে।

“বেলঘরের তারককে মৃগেল বলা যায়।

“নরেন্দ্র পুরুষ, গাড়িতে তাই ডান দিকে বসে। ভবনাথের মেদী ভাব ওকে তাই অন্যদিকে বসতে দিই!

“নরেন্দ্র সভায় থাকলে আমার বল।”

শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জে আসিয়া প্রণাম করিলেন। বেলা আটটা হইবে। হরিপদ, তুলসীরাম, ক্রমে আসিয়া প্রণাম করিয়া বসিলেন। বাবুরামের জ্বর হইয়াছে, – আসিতে পারেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারাদির প্রতি) – ছোট নরেন এলো না? মনে করেছে, আমি চলে গেছি। (মুখুজ্জের প্রতি) কি আশ্চর্য! সে (ছোট নরেন) ছেলেবেলায় স্কুল থেকে এসে ঈশ্বরের জন্য কাঁদত। (ঈশ্বরের জন্য) কান্না কি কমেতে হয়!

“আবার বুদ্ধি খুব। বাঁশের মধ্যে বড় ফুটোওলা বাঁশ!

“আর আমার উপর সব মনটা। গিরিশ ঘোষ বললে, নবগোপালের বাড়ি যেদিন কীর্তন হয়েছিল, সেদিন (ছোট নরেন) গিছিল, – কিন্তু ‘তিনি কই’ বলে আর হুঁশ নাই, – লোকের গায়ের উপর দিয়েই চলে যায়!

“আবার ভয় নাই – যে বাড়িতে বকবে। দক্ষিণেশ্বরে তিনরাত্রি সমানে থাকে।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!