-তপন কুমার বসু
কবিরাজ মনোরঞ্জন বসু আমার পিতার পরিচিত নাম। ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই তার গুরু আশ্রমের নাম, যা ক্রমবিবর্তিত ও সম্প্রসারিত হয়ে ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই রূপে মহিমান্বিত হয়েছে।
কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন সংসার বিবাগী। জীবদ্দশায় তিনি বিচিত্র সব অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন। পরিচিত হয়েছিলেন বহু জনগোষ্ঠীর সাথে। শিখেছিলেন অনেক ভাষা। জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে।
মূলত লালন অনুসারী মানুষ ছিলেন তিনি। লালন ও পূর্বাপর মহতের গানগুলিকে তিনি অন্তরে ধারণ করেছিলেন এবং এর মহৎ দিকগুলি অনুশীলন করেছিলেন গুরুর সান্নিধ্যে থেকে। ফকির সম্রাট লালন ফকিরের প্রশিষ্য কোকিল সাঁ বাবাজীর একান্ত ভক্ত ছিলেন তিনি।
তিনি শুধু আমার পিতাই ছিলেন না, আমাদের দুজনের (আমার এবং আমার স্ত্রীর) গুরুও ছিলেন। সংসার জীবনের অনেক কথাই মনে পরে। যেহেতু তিনি সংসার জীবনে আমাদের সাথে থাকতেন। জীবনে কখনও কোনদিন তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। কথা অতি বিনয়ের সাথে বলতেন।
বাবার কাছে বহু রকমের মানুষ আসতেন। তিনি তাতে কখনও বিরক্ত হতেন না। তাঁর জীবদ্দশায় কিছু ভক্ত তিনি করেছিলেন। তবে তিনি পেশাদারী কোন গুরু ছিলেন না (এ ব্যাপারে ভক্তরা ভাল বলতে পারবেন)। তার চিন্তা ও চেতনা ছিল- আত্মার কল্যাণ কিসে হবে ও আত্মার মুক্তি কিসে হবে?
আমাকে বলেছিলেন- ‘আত্মতত্ত্বের উপরে কোন তত্ত্ব নেই। আত্ম দর্শনের উপরে কোন দর্শন নেই। আত্মরক্ষার উপরে কোন ধর্ম নেই। ধর্ম পালন করতে না পার ক্ষতি নেই। কিন্তু অধর্ম করো না।’
তিনি বাইরে ছিলেন অতি সাধারণ মানুষ। কিন্তু অন্তরে ছিলেন গুহ্য সাধনের ভাবুক। দেহতত্ত্বের চিরায়ত পথে সাধক যেমন ধীরে ধীরে সাধন মার্গে অগ্রসর হন। তিনি তেমনি সাধন মার্গে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একেবারেই প্রচার বিমুখ। নিজেকে জাহির করা ও প্রচার করা পছন্দ করতেন না।
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই বলতেন, ‘বাবা কাগজের ফুলে ভ্রমর বসে না, আলোকে আলো জ্বেলে দেখতে হয় না। সত্য তৈরি করা যায় না। অনুসন্ধান করে বের করতে হয়। তাই সত্যের অলংকার লাগে না।’
অনেকেই বাউলদেরকে নাস্তিক মনে করেন। কিন্তু তিঁনি আমাকে শিখিয়েছিলেন বাউলরা কখনও নাস্তিক নয়। তারা সম্পূর্ণরূপে আস্তিক। তাঁর মতে- বিশ্বের বিচিত্রতা, বিশালতা, সৃষ্টি রহস্য আর প্রকৃতির নিয়ম বিধানের উপরই প্রকৃত বাউলদের ঈশ্বর বিশ্বাসের মূল বুনিয়াদ।
তিনি সকল প্রকার সংস্কার বর্জিত মানুষ ছিলেন। ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। জাতি, ধর্ম, গোত্র বিচার করতেন না। সমস্ত মানুষকেই তিনি এক চোখে দেখতেন। ভক্তদেরকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন।
এ প্রসঙ্গে একদিনের একটি ছোট্ট কথা উল্লেখ করব- সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। মোবাইলের ওপার থেকে আমার এক আত্মীয় আমার উপরে খুবই রাগান্বিত হয়ে বললেন, বাজারটা তুমি করতে পারো না? এত বৃষ্টির মধ্যে তোমার বাবাকে দিয়ে মাছ কিনতে পাঠিয়েছ? তারপরও প্রায় ৩/৪ কেজি ওজনের রুইমাছ? বৃষ্টির মধ্যে তিনি কি টানতে পারেন?
মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। কারণ সকালে আমি মোটামুটি ভাল বাজার করেছি। তাই স্ত্রীর কাছে মোবাইল করে জানতে চাইলাম বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে মাছ কিনতে পাঠিয়েছ কেন?
স্ত্রী উত্তর দিল, সে জানে না বাবা বাজারে গেছেন। দুপুরে বাড়ি এসে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, কালীগঞ্জ থেকে খোকন এসেছে তাই বাজার মাছ কিনতে গিয়েছিলাম (আমার মাছ কেনা তার পছন্দ হয় নাই)। খোকন’ দা বাবার একজন ভক্ত।
কোন ভক্ত বাড়িতে আসলে তিনি খুবই আনন্দ পেতেন এবং তাদের জন্য কিছু করতে চাইতেন। তিনি ভক্ত অনুরাগী মানুষ ছিলেন। পেশায় ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ব্যবসা আমি এবং আমার বাবা একই সাথে করতাম। বহু রোগীকে দেখেছি ঔষধের দাম নেওয়া তো দূরের কথা পথ্য কেনার টাকা ও আসাযাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত দিয়ে দিতেন।
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই একজন দয়ালু মানুষ ছিলেন। আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন কাছের মেয়েকে তিনি নিজ খরচে বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সাধ্যমত বিভিন্ন সময়ে মানুষকে দান করতেন। বাবার কোন শত্রু ছিল বলে আমার মনে হয় না।
অনেকেই বাউলদেরকে নাস্তিক মনে করেন। কিন্তু তিঁনি আমাকে শিখিয়েছিলেন বাউলরা কখনও নাস্তিক নয়। তারা সম্পূর্ণরূপে আস্তিক। তাঁর মতে- বিশ্বের বিচিত্রতা, বিশালতা, সৃষ্টি রহস্য আর প্রকৃতির নিয়ম বিধানের উপরই প্রকৃত বাউলদের ঈশ্বর বিশ্বাসের মূল বুনিয়াদ।
তার জন্য পর্যাপ্ত গ্রন্থ জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতির নিয়ম বিধানের উপর কোনো বিধান নেই, ঈশ্বর আছেন, তিনি দৈহিক বা বৌদ্ধিক কোন অবস্থাতেই মনুষ্যতুল্য নয়। তিনি শক্তি আর ক্রিয়াশীল। উদাহরণ স্বরূপ নিম্নের গানসহ আরো অনেক গান তিনি ব্যবহার করতেন-
সিরাজ সাঁই দরবেশে তাই কয়
শক্তিরূপেই ত্রি জগৎময়,
কেন লালন ঘুরছ সদাই
আত্মতত্ত্ব না সেরে।।
বাউলদের ঈশ্বর কল্পিত স্বর্গলোকে নয়, মানুষের অন্তরে বাস করে। প্রেম ভক্তির পথে দেহ সাধনার মধ্য দিয়ে তাকে পাওয়া যায়। কল্পিত কাহিনীর মহিমায় মানুষকে যত সহজে মোহিত করা যায়, দার্শনিক ও সাধন তত্ত্ব দ্বারা তা সম্ভব নয়।
যারা স্বপ্ন বা কল্প বিলাসীর তত্ত্ব থেকে রসোদ্দীপনা খুঁজে পেতে চায় তাদের কাছে বাস্তবতা, জীবনধর্মী কোন তত্ত্বকথা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পার না। সুকঠিন সত্যকে প্রকাশ করা দার্শনিকদের দায়িত্ব আর অসুন্দরকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা কামুকের কাজ।
লালন মানবজীবনের রহস্য উদঘাটন, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে জীবনের রহস্য ও ব্যাপ্তিকে আবিস্কার করে নবতর জীবনে উত্তরনের পথ দেখিয়েছিলেন তাঁর গানের মাধ্যমে। মানবিকতা ও জীববোধকে সর্বমানবিক রূপ দিয়ে চিরন্তনের মাহিমায় করেছেন ভাস্কর।
প্রকৃতপক্ষে লালন ও পূর্বাপর মহতের গানগুলি নিছক লোকসাহিত্যই নয়। বাউল গান বাংলার বাউলদের সাধন সংগীত। তত্ত্বজ্ঞনার্জনের সঠিক পথ।
পৃথিবীর যেখানেই বাঙালী আছে সেখানেই লালন সংগীত অর্থাৎ বাউল গান পৌঁছে গেছে। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানের স্পর্শ সবক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ এটা হচ্ছে গুরু পরম্পরা। তাই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষনেও সবক্ষেত্রে এই জ্ঞান পাওয়া যায় না।
বাউলদের গানগুলো মূলত তাদের সাধনতত্ত্ব ও ভজনতত্ত্ব। যার ভিতরে আধ্যাত্মিকতা আছে। এই গানগুলি মরমীয় উৎসরণেই ভাবাতুর নয়। এতে প্রশ্ন আছে, সংশয় আছে, যুক্তি আছে, আছে সঠিক পথ নির্ধারণের আত্ম আকুতি। বাউল তত্ত্ব বুঝতে গেলে বাউলদের গানগুলি অন্তরে ধারণ করে মহৎ দিকগুলি প্রকৃত গুরুর নিকট থেকে অনুশীলন করতে হয়।
আমার পিতার কোন অন্ধ অনুকরণ, কল্পনা বিলাসী আর স্বপ্নচারী তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। জীবনের বাস্তবতা আর প্রকৃতির নিয়ম বিধানের উপরই তিনি ছিলেন বিশ্বাসী।
লালন মানবজীবনের রহস্য উদঘাটন, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে জীবনের রহস্য ও ব্যাপ্তিকে আবিস্কার করে নবতর জীবনে উত্তরনের পথ দেখিয়েছিলেন তাঁর গানের মাধ্যমে। মানবিকতা ও জীববোধকে সর্বমানবিক রূপ দিয়ে চিরন্তনের মাহিমায় করেছেন ভাস্কর।
আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই। তিনি আমৃত্যু লালন দর্শনকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন এবং বহু মানুষের মধ্যে ফকির ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই হিসেবে মহিমান্বিত হয়ে আছেন। এটা আমার জন্য গর্ব আমার জন্য অহংকার।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………….
লেখক পরিচিত:
তপন বসু
[ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই-এর পুত্র]
প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ
প্রফুল্ল সিং আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ, মাগুরা।
…………………………………….
আরো পড়ুন:
ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই
আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই
মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
একজন লালন সাধকের কথা
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর দর্শন
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -এক
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -দুই
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -তিন
মনোরঞ্জন গোঁসাই: স্বরূপ সন্ধানী দার্শনিক
মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর জীবন দর্শন
2 Comments