-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
মাই ডিভাইন জার্নি: দুই
ছবির হাটের ঘুঁড়ি উৎসব সেন্টমার্টিনে অনুমতি না পাওয়ায় সেবার হয়েছিল ইনানী বীচে। ব্যাপক আনন্দ উল্লাসে উৎসব শেষ করে মাঝরাতে আমরা রিসোর্ট ছেড়ে গিয়েছিলাম চাঁদের মাতাল আলোয় সমুদ্রে পা ভেজাতে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমরা কয়েকজন সমুদ্র পারে কোরালের উপরে হাঁটছিলাম সর্তক পায়ে।
কেউ গান গাইছে, কেউ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গগনবিদারী চিৎকার করছে, আবার কেউ একটানা কথা বলেই যাচ্ছে, সবাই উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। অন্যরা বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। আমার সামনে সাগর ভাই। প্রকৃতির গর্ভে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এখানেই যদি থেকে যাওয়া যেত।
একসময় বলেই ফেললাম- যদি এখানেই থাকতে পারতাম তাহলে কি ভালোই না হতো। শহরের যান্ত্রিকতার যন্ত্রণা আর নিতে পারি না। সাগর ভাই হাঁটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো- “আমি তো এরমাঝেই থাকি। এখানেই থাকি।”
আমি সন্দেহ নিয়ে চোখ ছোট করে ফেল্লাম সাগর ভাই পাগল হয়ে গেছে এই ভেবে। সাগর ভাই সেটা ধরে ফেলে বললো- “আরে শোন অবাক হওয়ার কি আছে, সত্য সত্যই আমি এর মাঝেই থাকি; শহরে আমার শরীর থাকে মন এসবেই থাকে সমুদ্রে-জঙ্গলে-পাহাড়ে। আমি শহরে থাকি কিন্তু শহরের যান্ত্রিকতা নেই না… আমি প্রকৃতিতেই থাকি।”
সাগর ভাই সেদিন কি ভেবে এই কথাগুলো বলেছিল বা কতটা বিশ্বাস থেকে বলেছিল তা আমি জানি না। “আমরা যার মাঝে বসত করি চাইলে তার মধ্যে নাও থাকতে পারি”-এই বিষয়টা আমার মাথায় বড় বড় অক্ষরে জীবনের ডায়রীতে শিরোনাম হিসেবে থেকে গেছে। বহু বহু বার আমি একথা ভেবেছি।
সাগরের পারে সাগর ভাইয়ের সাথে ঐ মুর্হূতটা আমার ভাবনার জগতে বেশ আলোড়ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যেখানে থাকি সেখানে কি বাস করি? আর যেখানে বাস করি সেখানে কি থাকি? বিষয়টা বেশ গোলমেলে। ভাবতে গেলে হারিয়ে যাই। আমার শহুরে সংস্কার বেশিদূর ভাবতে দেয় না।
শহুরে সংস্কার-আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার-পৈত্রিক সংস্কার সব কিছু উলটপালট করে দেয়। ধরো তুমি হয়তো পায়েস খাও চেটে চেটে কিন্তু আমার শহুরে অহংকার আমাকে শিখিয়েছিল খাওয়ার পর হাত ধুয়ে মুছে পরিষ্কার বাটিতে চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে মিষ্টান্ন খেতে হবে।
যেন চামচ আর বাটির সংর্ঘষ হয়ে কোনো শব্দ সৃষ্টি না হয়। প্রথম যখন সাধুর বাড়িতে কলাপাতার উপর খাবার শেষের আগেই বারণ করা সত্ত্বেও এক সাধু হাসিমুখে বিনয়ের সুরে আধা খাওয়া খাবারের উপরেই মিষ্টান্ন দিয়ে চলে গেলো। তখন মেজাজ আমার ঊর্ধ্বগামী।
একটু খেয়াল করে দেখলাম সকলেই বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে এবং পরম আনন্দে খেয়ে যাচ্ছে। আমি বিরক্তি নিয়ে বসে আছি বা খাওয়ার অভিনয় করছি। আসলে এই যে অভিনয় করা জীবন এই যে ইমিটিশনের জীবন; এই যে নিজের ভেতরের আমিকে পরিবর্তন না করে ঢেকে রেখে অন্য এক মেকি আমির প্রকাশ; সেটাই আমাকে ভাবায়, খুব ভাবায়। কেনো অভিনয়?
কেনো সহজ হতে পারি না। লালন সাঁইজি কোন্ সহজ হতে বলেছেন সেই গভীরতায় যাচ্ছি না তবে উপরি উপরি ভাবলে সেখানেই পৌঁছাই-
হাতে হাতে বেড়াও মিছে তওবা পড়ে।
না হলে মন সরলা কি ধন মেলে কোথা ঢুঁড়ে।।
মক্কা মদীনায় যাবি
ধাক্কা খাবি, মন না মরে
হাজী নাম বাড়ালি কেবল জগৎ জুড়ে।।
মুখে যে পড়ে কালাম
তারই সুনাম, হুজুর বাড়ে
মন খাঁটি নয় বাঁধলে কি হয় বনে কুঁড়ে।।
মন যার হয়েছে খাঁটি
মুখে যদি গলদ পড়ে,
খোদা তাতে নারাজ নয় রে লালন ভেঁড়ো।।
এই তো সেবার হুমায়ুন সাধুর আখড়ায় সাধুসঙ্গের প্রথম রাত যখন শেষ হয়ে যাবে যাবে ভাব; তখন মঞ্চের কাছে মানুষজনের জটলা থেকে আমরা মেলায় আসা যাওয়ার পথের পাশে একটা বন্ধ চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডার ধোঁয়া ওড়াচ্ছিলাম।
অনেক আলোচনার ফাঁকে আলমগীর ভাই বলে উঠলেন- “এই যে সাধুগুরুরা এতো এতো জ্ঞান-তত্ত্ব নিয়ে বসে থাকেন তারা মানুষের মাঝে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন না কেনো? এটা আমি বুঝি না।” এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। আলমগীর ভাই ভালো মানুষ কিন্তু স্বভাবে তার্কিক প্রকৃতির। তর্ক না করে থাকতে পারেন না।
কখনো কখনো আমি দেখেছি তিনি অনেক জোর করে তর্ক করা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান ইদানীং; কিন্তু স্বভাব দোষে সফল হন না সর্বক্ষেত্রে।
সিদ্ধার্থ বা মহামানবেরা তা জীবন দিয়ে তোমার জন্যই উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। এর বেশি কিছু না। সাধন কর্মে তুমি যাতে একলা না হয়ে যাও। তাই তাঁরা তোমার প্রেরণা স্বরূপ কর্ম করে গেছেন। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরতে পারো।
রাত ভোর হয়ে আসছে; শীতল পরিবেশ। আলমগীর ভাই লড়াই করেই যাচ্ছেন। শেষে আমি বলে ফেললাম- “ভাই বুঝলাম সাধুগুরুরা কিছুই করেন না। নিজেকে নিয়েই থাকেন। আমি কেবল একটা কথাই বুঝি না। এই যে আপনি বৌ-বাচ্চা নিয়ে এই শেষরাতে নিজের নরম বিছানায় শুয়ে না থেকে সাধুর বাড়ির আঙ্গিনায় আমার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। এটা হচ্ছে কেনো?
আমার বিশ্বাস আপনাকে জোর করে নিয়ে গেলেও হয়তো এতো অপর্যাপ্ততায় আপনি অন্য কোথাও এভাবে যেতেন না। এখানে এতো মানুষ, কোথায় বসবেন তার ঠিক নাই, ঘুমানোর কোনা জায়গা পাবেন কিনা সন্দেহ, জায়গা পাওয়া গেলেও বালিশ পাওয়া যাবে কিনা, এই শীত শীত ভাবের রাতে গায়ে দেয়ার কোনো চাদর বা কাঁথা পাওয়া যাবে কিনা তার ঠিক নাই। আরো কতো শত সমস্যা।
তারপরও কোনো অভিযোগ নেই বেশিভাগ মানুষের। আমার ধারণা এইটাই সাধুগুরুরা করেন। আপনার মতো মানুষকেও ঘুমাতে না দিয়ে এই রাতে এইখানে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
শ্রীকৃষ্ণ হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষকে ডেকে জ্ঞানদান করেননি। তিনি অর্জুনকে জ্ঞানদান করেছিলেন কারণ একজন প্রকৃত জ্ঞানপ্রাপ্ত হলেই জ্ঞানের ধারা অব্যাহত থাকবে। সত্যের জ্ঞান বিলানোর জিনিস নয় মোটেই। এটা অর্জনের জ্ঞান; যার প্রয়োজন সেই সন্ধানে নামে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তা অনুধাবন করছে ততক্ষণ সে কেবল দর্শক মাত্র। এই জ্ঞানজলে গা ভেজাতে চাইলে নামতে হবে এই জ্ঞান সাগরে, দিতে হবে ডুব। শেষ পর্যন্ত সাঁতরে গেলে সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হবে। অনুসন্ধানী মন না থাকলে এই জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়।
আলমগীর ভাই সে রাতে কি বুঝেছিলেন, আমি কতটা বুঝাতে পেরেছিলাম আমি জানি না। হয়তো রাত শেষের ক্লান্তি বা শীত শীত ভাব বা বাড়ি ফেরার তারা বা গোষ্ঠ গানের সূচনা সবকিছু মিলিয়ে আড্ডা থেমে গিয়েছিল। হয়তো আলমগীর ভাই আর তর্ক বাড়াতে চাননি।
আমি ঠিক জানি না সেই রাতে আলমগীর ভাই বিষয়টাকে কিভাবে নিয়েছিলেন। তবে আমার তখনো মনে হয়েছে; এখনো মনে হয়। বিশ্বাস নিয়েই মনে হয়। কোনো ঘটনা তোমার মনে আলোড়ন তোলার পরও তুমি চাইলে পাশ ফিরে ঘুমিয়েও পরতে পারো। আবার সিদ্ধার্থের মতো বেড়িয়েও পরতে পারো।
সিদ্ধার্থ বা মহামানবেরা তা জীবন দিয়ে তোমার জন্যই উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। এর বেশি কিছু না। সাধন কর্মে তুমি যাতে একলা না হয়ে যাও। তাই তাঁরা তোমার প্রেরণা স্বরূপ কর্ম করে গেছেন। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরতে পারো।
যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবো আমার অনেক আগ্রহ ছিল কিন্তু করতে পারি না এই-সেই ঝামেলায়; জানি তুমি মনে কষ্ট পাবে তবুও বলছি আমার কেনো যেন মনে হয় তুমি আসলে তোমার নিজের সাথে প্রতারণা করছো। আসলে তোমার চূড়ান্ত ইচ্ছাই ছিল না বা ইচ্ছা নেই।
যদি থাকতো তবে এ ব্রহ্মাণ্ডের কি এমন শক্তি আছে যে তোমাকে আটকায়? আর ঘর ছেড়ে হারিয়ে যেতে হবে এমনো তো কথা নেই। সন্ধান তো নিজের ভেতরেও হতে পারে। এই যে জীবনকে যাপন করে যাওয়া তার মানে কি আমরা জানি? সেই প্রাচীন প্রশ্ন জীবনের মানে কি?
হুমায়ুন সাধুর সাধুসঙ্গ: ভিডিও
হুুমায়ুন সাধুর আখড়ার কথা উঠছে অথচ হুুমায়ুন সাধুর কথা, সুমন ক্বারীর কথা বলছি না, সেই মায়ের কথা বলছি না, ইব্রাহিম ভাই এর কথা বলছি না সেটা কি করে সম্ভব! তাদের কথা বলার জন্য মন আকুপাকু আকুপাকু করছে। কিন্তু মনকে সামাল দিতে হবে। তাদের কথাও হবে; হবে একরাতের জন্য গিয়ে কেনো কিসের আকর্ষণে কোন সূত্রে ছয় রাত থেকেছিলাম সেইবার।
কোনো এক বৃষ্টিস্নাত রাতে লিখে ফেলতে হবে সেই সব অসামান্য কথা-কাহিনী। কথা-কাহিনী শব্দটা আসতেই মনে পরে যায়, সেই যেবার হুমায়ুন আহমেদের “কোথাও কেউ নেই” নাটকের চূড়ান্ত পর্ব হচ্ছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যাতে নাটকে কার্যকর না হয় সে জন্য আমাদের মহল্লায় কোরান খতম হয়েছে, মিলাদ হয়েছে, উত্তেজিত জনতা মিছিল করেছে, পরিচালকের বাড়িতে হামলার পরিকল্পনা করেছে।
তখন এখনকার মতো তথ্যপ্রবাহ ছিল না। আমরা তখন কেবল হুমায়ুন আহমেদকে নামে চিনতাম। উনার কোনো ছবি তখনো আমরা দেখিনি। পাশের বাড়ির আন্টি একটা ম্যাগাজিনে সাদাকালোতে ছাপা হুমায়ুন আহমেদের ছবি আমাদের বাসায় এনে দেখিয়েছিলেন।
এই লোক যে কত পাষাণ তা নিয়ে গালগল্প করতে পাড়ার সব মহিলারা জড়ো হয়েছিল। এলাকার বড় ভাইরা বাকের ভাই সেজে ঘুরে বেড়াতো। তবে নটকে যখন ঘটনা বাঁক নিলো, বদি ভিলেন হয়ে বাকের ভাইয়ের বিপক্ষে সাক্ষী হয়ে গেলো, তখন মুরব্বী থেকে আমরা পর্যন্ত মহল্লার যে যুবকটি বদি সেজে সেই ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতো তাকে ঘৃণা করতাম।
পাশের মহল্লার ছেলেপেলেরা তাকে একা পেয়ে কয়েক দফা মারপিটও করেছিল বলে শুনেছিলাম। এই রকমই ছিল আমার বেড়ে ওঠার গল্পটা। মানুষগুলো অন্যরকম ছিল এখনকার চারপাশের মানুষের সাথে ঠিক মিশেল হয় না। নাকি আমি দেখার সেই দৃষ্টি হারিয়েছি সেটাও বুঝে উঠি না মাঝে মধ্যে। একটা নাটকের চরিত্রের জন্য এমন আবেগ!
এখনো মনে পরে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকরের পরদিন শুধু আমাদের মহল্লা নয় প্রায় গোটা পুরান ঢাকা নিরব হয়ে গিয়েছিল। আমার নতুন ঢাকায় যাতায়াত তখনো হয়নি আমি জানি না সেখানে কি ঘটেছিল। আমি কেবল আমার দেখাটাই দেখেছি। সেদিন আমরা কেউ স্কুলে যাইনি। বাসায় ভালো রান্না হয়নি।
যাক সে কথা। করিম শাহ্’র কথা বলছিলাম। আমি বেশ কয়েকবছর সাঁইজির উৎসবে করিম শাহ্’কে পেয়েছিলাম। এখন আপসোস হয় তখন যদি প্রশ্ন করতে শিখতাম তাহলে হয়তো অনেককিছু জানতে পারতাম। সেসময় সাধুদের মুখে এটা বেশি শুনতাম যে, সাঁইজির গান করেন… সাঁইজের ঘরের মুরিদ আবার কাদেরীয়া বা চিশতীয়া ইত্যাদি তরিকা বহন করেন।
দুধওয়ালা দুধ দিতে এসে অনেকটা সময় নিয়ে বসে কেঁদে গেলো। এলাকার ময়লা পরিস্কার হলো না কয়েকদিন। অসল দুপুরে কোনো বাড়ি থেকে রেডিওতে সিনেমার বিজ্ঞাপন শোনা যায়নি বেশ কয়েকদিন। আসলে এমনি ঘটে যখন মনের সাথে মিশে যাওয়া মন আর মিশেল খায় না; তখন সেই মনই জানে তার বিচ্ছেদের কান্না। অন্যে কি আর টের পায়?
সেবার লালন ফকিরের তিরোধান উৎসবের শেষ দিন। যারা কেবল মেলা দেখতে আসে তারা চলে গেছে। মেলার দোকানপাট খুলে ফেলা হচ্ছে। মেলা শেষে হাজার হাজার মানুষ কোথায় যেন হারিয়ে যায় এক নিমিষে এসব ভাবছিলাম আর চায়ের দোকানে অলস আড্ডা দিচ্ছিলাম করিম শাহ্’র সাথে। করিম শাহ্ বলছিলেন আগে কেমন লালন উৎসব হতো। শুনছিলাম তখন কেমন ছিল মাজার প্রাঙ্গণ।
তার অপরূপ বর্ণনায় আমি যেন কল্পনায় ডানা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম সেই সময়ে। তখন আমি এখনার আমির চেয়েও অনেক বেশি অস্থির। এটা জানতে চাই; সেটা জানতে চাই। আসলে জানতে চাই কিনা সেটাও নিশ্চিত নই। হয়তো প্রশ্ন করতে ভালো লাগতো। হয়তো জানতেই চেয়েছিলাম। আসলে বিষয়গুলো এতো সহজ নয়। সাদা-কালোর মাঝে অনেকগুলো গ্রে টোন থাকে।
সেগুলোকে দেখতে না জানলে-বুঝতে না জানলে-সে হিসেবে ভাবতে না জানলে শুরুর দিকটায় বিপদ ঘটে। এক কথায় ভালো আর এক কথায় খারাপ বলে দেয়াটা বোকামির চূড়ান্ত বলেই এখন মনে হয়।
যাক সে কথা। করিম শাহ্’র কথা বলছিলাম। আমি বেশ কয়েকবছর সাঁইজির উৎসবে করিম শাহ্’কে পেয়েছিলাম। এখন আপসোস হয় তখন যদি প্রশ্ন করতে শিখতাম তাহলে হয়তো অনেককিছু জানতে পারতাম। সেসময় সাধুদের মুখে এটা বেশি শুনতাম যে, সাঁইজির গান করেন… সাঁইজের ঘরের মুরিদ আবার কাদেরীয়া বা চিশতীয়া ইত্যাদি তরিকা বহন করেন।
বিষয়টা বেশ ঘোলাটে লাগতো। একজন সাঁইজির ভক্ত আবার কি করে অন্য তরিকারও হয়। কেনো এ তরিকা? এই প্রশ্নে করিম শাহ্ দীর্ঘসময় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন বায়াত না হলে বাজান এই ভেদের কথা বলা যাবে না; আর বললেও তুমি বুঝবা না। আগে গুরু ধরো।
কিন্তু গুরু ধরার জন্য নিজেকে সেদিনও প্রস্তুত করতে পারিনি। আজও কি পেরেছি? একটা দীর্ঘসময় আমাকে কাটাতে হয়েছে যেসময় সাধুরা একটা পর্যায় পর্যন্ত যেয়ে থেমে যেত। বলতো বায়াত না নিলে আর বলা যাবে না। সেসময় মন খারাপ হতো মিথ্যা বলবো না মেজাজও খারাপ হতো।
কিন্তু এখন বুঝি পাত্র না তৈরি হলে তাতে পর্দাথ যেমন রাখা যায় না। তেমনি দেহ রূপী মানুষ পাত্র তৈরি না হলে তাতে সত্য জ্ঞান দান যেমন করা যায় না; তেমনি সেই জ্ঞান অর্জন করতে হলেও নিজেকে তৈরি করতে হয়। নিজে তৈরি না হলে আসলে সে জ্ঞান পেলেও কোনো কাজে দেয় না। এটা আসলে বুদ্ধির খেলা নয়-এটা উপলব্ধির খেলা। তাই সাঁইজি বলেছেন-
রাসুল যিনি নয় গো তিনি আব্দুল্লার তনয়।
আগে বোঝ পরে মজ
নৈলে দলিল মিথ্যা হয়।।
মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর ছেলে
রজঃবীজ জন্ম নিলে,
আমেনাকে মা বলিলে
প্রকাশ হলেন মদিনায়।।
তাঁর চার সন্তান চার সন্ততি গণনা
এই হল সৃষ্টির বাসনা,
তিন বিবি হয় সৈয়াদিনা
এগারটি বাদ পড়ে রয়।।
মুহাম্মদ জন্মদাতা
নবী হলেন ধর্মপিতা,
ফকির লালন বলে সৃষ্টির লতা
আল্লাতে মিশে রয়।।
এই অল্প কিছু বছরের অভিজ্ঞতায় আমি কেবল এইটুকুই বুঝেছি সাধুর বাড়িতে, সাধুর আখড়া, দরগায়, সমাধিতে, রওজায় তুমি তোমার অহং-কে যদি সঙ্গে নিয়ে যাও। তাহলে তুমি কিছু দেখতেও পাবে না, জানতেও পাবে না, বুঝতেও পারবে না। সর্বোপরি তুমি কিছুই পাবে না শূন্য হাতে ফিরে আসবে।
মশাই ভাবছেন আমি অলৌকিক প্রাপ্তির কথা বলছি? বলছি অতিভৌতিক কিছু? সাধুর বাড়ির জল পান করলেই সর্বরোগ সেরে যাবে? না মশাই এখনো অতো তলের কথা তো বলিই নি। সে বিশাল যাত্রা অল্পজ্ঞানে তা ধরবে না। উপরি বিষয় বলি, না মশাই সাধুর বাড়িতে কোনো পরা পানি বা তেল নেই যা দিয়ে আপনি পাল্টে যাবেন, জীবন পাল্টে যাবে, ধারনা পাল্টে যাবে, বোল পাল্টে ফেলতে পারবেন।
তবে কি আছে সাধুর বাড়ি? আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পরি- আমি দেখেছি সাধুর বাড়িতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে জ্ঞান। এ জ্ঞান নিজেকে জানার জ্ঞান, নিজেকে চেনার জ্ঞান। সেই প্রাচীন প্রশ্ন “হু এম আই” কখনো প্রশ্নটা জেগেছে মনে মশাই? বা “নো দ্যাইসেলফ”?
যদি জাগে তবে নিজের অহং টা বাড়িতে রেখে একবার যাবেন সাধুর বাড়ি, বারবার যাবেন। প্রাপ্তি আপনার নিশ্চিত। কারণ ঐখানেই শিক্ষা চলছে নিজেকে জানার। না মশাই এখানে কোনো সার্টিফিকেট বিলি করা হয় না। দেয়া হয় না অর্থ উপার্জনের পথ।
বাতলে দেয়া হয় না ধনী হওয়ার গোপন রহস্য। তবে মশাই এটুকুও মনে রাখতে হবে, এখানেও অনেক প্রতারক আছে, আছে প্রলোভন লোভ লালসা মোহ। আগেই বলেছি অহং রেখে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে অহং এর পিছু পিছু চলে আসে মায়া-মোহ-লোভ-লালসা। এগুলোকে সাথে করে ঘুরলে মূল হারানো ছাড়া উপায় নেই। সাঁইজি তাই বলেছেন-
মন তুই করলি এ কী ইতরপানা।
দুগ্ধেতে যেমনরে তোর
মিশলো চোনা।।
শুদ্ধ রাগে থাকতে যদি
হাতে পেতে অটলনিধি,
বলি মন তাই নিরবধি
বাগ মানে না।।
কী বৈদিক ঘিরল হৃদয়
হল না সুরাগের উদয়,
নয়ন থাকিতে সদাই
হলি কানা।।
বাপের ধন তোর খেল সর্পে
জ্ঞানচক্ষু নাই দেখবি কবে,
লালন বলে হিসাবকালে
যাবে জানা।।
যে, যে বাসনা নিয়ে যাবে সে তাই পাবে রওজায় এটি প্রচলিত কথা। কথাটার সাথে আমরা শহুরে মানুষ বা দু’পাতা পড়ে ফেলা মানুষজন ধর্ম-প্রাপ্তি-মানতের সাথে গুলিয়ে ফেলি। কথাটার ভিন্ন মানে করে নিজেকে পণ্ডিত প্রমাণে ব্যস্ত থাকি। আসলে বিষয়টা একটু ভিন্নভাবেও ভাবা যায় বলেই আমার ধারণা।
আদৌতে তুমি যে প্রাপ্তির আশায় যাবে, যে মানুষিকতা সঙ্গে নিয়ে যাবে তোমার সাথে সেই প্রকৃতির মানুষের সাথেই পরিচয় হবে, যোগাযোগ হবে, আলাপচারিতা হবে। যদি তুমি জ্ঞান অর্জন করতে চাও তাহলে দেখবে তুমি জ্ঞানীর সাথেই সঙ্গ করছো।
আর যদি মনে লোভ থাকে-কামনা থাকে-বাসনা থাকে তাহলে সেই প্রকৃতির লোকের সঙ্গেই সঙ্গ হবে। যাক অনেক ভারী কথা হয়ে গেলো। এবার শেষ করতে হবে। এবারের মতো শেষ করি ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে।
সেবার বেশকিছুটা সময় ছিল হাতে ঘুরছিলাম কুষ্টিয়া শহরে, ইচ্ছা সেখান থেকে যাব শিলাইদাহ্। প্রথমবার যাচ্ছি। কিভাবে যাবো কত সময় লাগবে জানতে চাইলে, এক একজন এক এক রকম কথা বলছিল। কারো সাথে কারো কথা মেলে না। কেউ বলে আধ ঘণ্টা লাগবে কেউ বলে ৩ ঘণ্টা লাগবে।
কি ভেবে দুপুরের দিকে বেড়িয়ে পরলাম। সেই যাওয়া, সেখানে ঘুরে বেড়ানো সেই সব ভিন্ন আলোচনা। তবে ঘটনা যা ঘটলো যখন আমি ছেঁউড়িয়া ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সড়কে উঠেছি ততক্ষণে সন্ধ্যা। এলাকার মানুষজন বললো ভাইজান এই রাস্তাটা ভালা না, আপনি বিদেশি মানুষ রাতে একা এই পথে যাবেন না।
আপনি যে রাতেরবেলা সুস্থ ফিরা আসছেন এইটাই শুকরিয়া। অনেক সময় ধরে রব ফকির জড়িয়ে ধরে ছিল। মানুষ মানুষের জন্য এতো ভালোবাসা বুকে কি করে জমিয়ে রাখে সাঁইজি, এই ভেদ আমি আজো জানলাম না। সেই মেম্বার বা সেই ভ্যানওয়ালার সাথে আর দেখা হয়েছে কিনা জানি না; তাদের চেহারাও মনে নেই।
কোনো ভ্যান রিকশাও যাবে না এই সময়। তখন সম্ভবত চরমপন্থীদের কোনো একটা ঝামেলা চলছিল। ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে জটলা হলে গেল আমাকে ঘিরে।
এক একজন এক এক অভিজ্ঞতার কথা বলছে এই পথে রাতে গিয়ে কি হয়েছে সেই সব। কেউ কেউ বললো চলেন আমার বাড়িতে আজ রাত থাকেন কাল সকালে যাবেন। কিন্তু মন পরে আছে সাঁইজির মাজারে। আমাকে কে আটকায়। শেষে এলাকার মেম্বার এসে একটা ভ্যান ঠিক করে দিলো।
বলে দিলো- ভাইজান যাই হোক এই ভ্যান থেকে আপনি নামবেন না। আর দুই তিন প্যাকেট সিগারেট কিনা নেন। খান আর না খান একটার পর একটা ধরাইয়া হাতে রাখবেন। হাতে আগুন দেখলে ভাববে আমরা কেউ যাচ্ছি কেউ আটকাবে না।
ঘণ্টাখানেক রাস্তা যেতে পারলে আর বিপদ নাই। আল্লাহ আল্লাহ কইরা চলে যান। বেশ কিছুটা পথে সদলবলে তারা এগিয়ে দিয়ে গেলো। গম্ভীর মুখে ভ্যানচালক আমাকে ঝিঁঝি ডাকা অন্ধকার রাতে নিয়ে এসছিল। যখনি রাস্তার দুই পাশে কোনো শব্দ হয় বা আলো জ্বলে উঠে তখনি ভ্যানচালক পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিজ মুখে তাক করে এগিয়ে যায়।
আর বলে ভাইজান ডরায়েন না। আমি আছি। নদীর পারে এসে বললো ভাইজান দাঁড়ান এক মিনিট আমি ভ্যানটা এক বাড়িতে রাইক্ষ্যা আসি। তারপর আপনার সাথে লালনে যাবো। এই রাতে আর বিপদ মাথায় নিয়া ফিরা যাইবো না।
মাজারে যখন ফিরেছি তখন রব ফকির আমাকে দেখে দৌঁড়ে এসে বলেছিল- দাদা আমি শুনলাম আপনি শিলাইদাহ্ গেছেন। আমি তো চিন্তার মধ্যে ছিলাম; আমারে বইলা যাবেন না? আমি সাথে লোক দিতাম। এখন দিনকাল ভালো না ঐ রাস্তাটা খুবই খারাপ; প্রত্যেক দিন ঐদিক থেকে খারাপ খবর আসে।
আপনি যে রাতেরবেলা সুস্থ ফিরা আসছেন এইটাই শুকরিয়া। অনেক সময় ধরে রব ফকির জড়িয়ে ধরে ছিল। মানুষ মানুষের জন্য এতো ভালোবাসা বুকে কি করে জমিয়ে রাখে সাঁইজি, এই ভেদ আমি আজো জানলাম না। সেই মেম্বার বা সেই ভ্যানওয়ালার সাথে আর দেখা হয়েছে কিনা জানি না; তাদের চেহারাও মনে নেই।
রব ফকিরও দেহ রেখেছেন। কিন্তু তাদের ভালোবাসা আমি আজো অনুভব করি। তাদের ভালোবাসাতেই বার বার ফিরে যাই। ভাবি সেই কথাটাই “আমরা যার মাঝে বসত করি চাইলে তার মধ্যে নাও থাকতে পারি”। আসলে আমি কি এই সময়ে বাস করছি? আসলেই কি আমি এখন যান্ত্রিকতার মাঝে থাকি? নাকি সেই সময়গুলোতেই বেঁচে থাকি। ভাবি আর ভাবনা প্র্যাকটিস করি-
কবে সাধুর চরণধুলি, মোর লাগবে গায়।
আমি বসে আছি আশার সিন্ধু কুলে সদাই।।
চাতক যেমন মেঘের জল বিনে
অহর্নিশি চেয়ে থাকে মেঘ ধিয়ানে,
ও সে তৃষ্ণায় মৃত্যু করতে জীবনে হইল
ওই দশা আমার।।
ভজন সাধন আমাতে নাই
কেবল মহৎ নামের দেই গো দোহাই,
তোমার নামের মহিমা জানাও গোঁসাই
পাপীর হও সদয়।।
শুনেছি সাধুর করুনায়
সাধুর চরণ পরশিলে হয় গো সোনা,
বুঝি আমার ভাগ্যে তাও হল না
ফকির লালন কেঁদে কয়।।
(চলবে…)
…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই
মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে