যতটা দেখা যায় ততটাই জল। খালি চোখে কতটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়? হঠাৎই জানতে মন চাইলো। আগে কখনো এমন ইচ্ছে হয় নি। এই মুহূর্তে আদ্বিগন্ত জল হঠাৎই প্রশ্ন করলো খালি চোখে কতটা দূর অব্দি দেখতে পারা যায়? শরীফ বললো আকাশ পরিস্কার থাকলে নাকি সমুদ্রে সাড়ে চার কিলোমিটার পর্যন্ত দেখতে পারা যায়। তারপর জলের সঙ্গে আকাশের মিলন হয়ে যায়। হাওরে অতটা দেখা না গেলেও দৃষ্টি যতটা যায় ততটা কেবল জল আর জল। গতকালের মেঘ কেটে আজ একেবারে পরিস্কার আকাশ। বাঙালীর ছেলে সাঁতার না জানলেও জল দেখে মুগ্ধ হবেই। জলের দেশের মানুষ জল দেখলে বুকের ভেতর জল জল তো করবেই। এমনি ভাবুক ভাবুক ভাব নিয়ে জল দেখছিলাম। ঠিক তখনি ফরিদী ভাই বলে উঠলো আমি হইলাম পীর বংশের পোলা… কাল দোয়া কইরা দিসি দেখেন আজ এক ফোটা বৃষ্টি নাই। আশমান ফকফকরা। সত্যিই পীর বংশের ছেলের দোয়া এমন লাগাই লেগেছে যে শরৎ-এর আকাশও শীতের আকাশ ধারণ করেছে। কোথাও এক ফোটা মেঘের দেখা নেই। এমন মেঘশূন্য আকাশে আজও নান্দনিক ছবি পাওয়ার সম্ভবনা কম তাই ফরিদী ভাই একটু একটু অখুশি। কিন্তু আমরা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে যে সামনের দিকে এগিয়ে চলছি তাতেই সকলে পুলকিত। বেশ গদোগদো ভাব। আমাদের ময়ূরপঙ্খী মোহনগঞ্জ নেত্রকোণার সীমানে ছেড়ে কিশোরগঞ্জের দিকে এগিয়ে চলছে দ্রুত। কিন্তু আসলেই কি এগিয়ে চলছে? কোথায় চলছি কূল কিনারা হারা এই অথৈ জলের মধ্যে দিয়ে। চারপাশে দূর দূরান্তেও এক ফোটা সবুজের চিহ্ন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রী নৌযান তো দূরের কথা মাছ ধরা নৌকারও কোনো দেখা নেই বহুক্ষণ।ট্রলার প্রায় ঘণ্টা চারেক চলার পরে আমরা এখন হাওরের এমন এক জায়গায় অবস্থান করছি একে সাগর বলা যায়। বলা যায় কি আমরা তো বলেই ফেললাম। আজ আমাদের কে আটকাবে?
ভোর ছয়টার দিকে যখন আমরা অনেকেই ঘুমে কাদা তখন বাবু আর শাহীন ভাই-এর ষড়যন্ত্রে ট্রলার ছেড়েছে গোগলাজোড়ের ঘাট। আমি ঘুমের ঘোরেই গুসগুস-ফুসফুস শুনে বুঝেছিলাম কিছু একটা তাল চলছে। কিন্তু কান পেতে কথা শুনা অপেক্ষা ঘুম উত্তম তাই সেদিকেই মন দিয়েছি। হঠাৎ-ই শুনলাম ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে… এক চোখ একটু খুলেই দেখলাম আকাশ পরিস্কার। আবার ঘুমিয়ে পরলাম। আধ ঘণ্টা পর যখন ছই-এর বাইরে আসার উপক্রম করলাম তখন খেয়াল করলাম শাহীন ভাইও আবার ঘুমিয়েছে বাকি সকলের সাথে। ছই-এর উপর দেখা পেলাম বাবু ভাই-এর। আকাশে সূর্য বলছে আজ ঘাম ঝড়াবে। গতকালের কাঙ্খিত সূর্যি মামা আজ তার তেজ দেখাবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। গাগলজোর এখান থেকে আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আশেপাশে দূরে দূরে দু-একটা গ্রাম চোখে পরছে। কিন্তু সামনে কেবলি জল আর জল ; আর কিছুই দৃষ্টিতে ধরা পরছে না। জল দেখার যে আনন্দ তা দু’ চোখ ভরে নিচ্ছিলাম। এমন সময় বাবু ভাই বললো যমুনার জলের রূপ অনেক দেখেছি কিন্তু হাওরের চেহারা আসলেই অন্য রকম অনুভুতি দিচ্ছে। বাবু ভাই রোমান্টিক হয়ে উঠেছে। এমন উদাস মানুষের পাশে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। তাই আবারো ঘুমাতে গেলাম। গাগলাজোর গ্রামে আমাদের নাস্তা করে রওয়ানা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্কার দিন দেখে আমাদের কান্ডারীরা আর দেরি করেনি নোঙ্গর তুলতে। জানলাম ইটনা যেয়ে নাস্তা হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে ইটনা যেতে ঘণ্টা তিনেকের মতো সময় লাগতে পারে। তাই আর একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না।
শাহীন ভাই-এর পাশের ফাঁকা জায়গাটায় শুয়ে তো পরলাম। কিন্তু চাইলেই কি আর ঘুমানো যায় ; এক এক করে সকলে উঠে পরলাম। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দেখা – জল কেবল জল। কারণ এখানে আকাশ আর জলের মাঝে কেবল আমরা যাত্রা করেছি। দূরে বহু দূরে দু একটা মাছ নৌকা দেখা মেলে… আবার মেলে না… মনে গান বাজছে… কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়… ওরে ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও… মনের মাঝে শাহ্ আব্দুর করিমের গান ঝাঁপিয়ে আর একটা কথা মনে পরলো এই যে এতো জল… কয়দিন পরে আর থাকবে না… এখানে রোপন করা হবে ধান… সবুজে ভরে উঠবে… কৃষককে পকেটের পয়সা খরচ করে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে… দেশের মানুষের হাহাকার হবে জলের জন্য… সরকার সেচের জন্য বিদ্যুতে ভুর্তুকি দেবে… কৃষিতে বিদ্যুৎ দেয়া হবে বলে আমরা শহরে লোডসেডিং মেনে নিবো… কিন্তু এতো জল… কোথায় যাবে? বাবু ভাইকে মনের খেয়ালেই বললাম এই জল কোনোভাবে ধরে রাখা যায় না… বাবু ভাই কি সব ব্যাখ্যা দিয়েই চললো… আমার কানে কিছুই গেলো না… ভাবছি আবারো… কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়… আসলেই কোথায় ছিলাম কোথায় যাচ্ছি… মজিদ মাস্টারের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো না… গাগলাজোরে কত জনের সাথে পরিচয় হয়েছিল… ছোট বাচ্চাগুলোকে সকালে চকলেট দিবো ভেবেছিলাম… তাও হলো না… হয়তো আর কোনো দিন দেখাই হবে না… গাগলাজোর… মঞ্জিল… মজিদ মাস্টার… সব এখন অনেক দূরের বিষয়… কোথা থেকে এসেছিলাম কোথায় যাচ্ছি কে জানে… আপাতত ক্ষিদে লেগেছে… নাস্তা খাওয়া দরকার… কিন্তু কোথায় ইটনা… এতো অথৈ জল… সমুদ্র… কূল-কিনারা নেই… জল আর জল…
আমরা নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে জলে যাত্রা শুরু করেছিলাম… ইটনা পরেছে কিশোরগঞ্জে… তারমানে আমরা এখন কিশোগঞ্জে। অনেক সময় পর স্থলে পা দিয়ে নাস্তাটা হলো বেশ জমিয়ে। চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই শাহীন ভাই ভ্যান নিয়ে উপস্থিত…
আমরা ধানু নদী দিয়ে চলছি নাকি পার হয়ে এসেছি কে জানে… কোনটা হাওর কোনটা নদী আলাদা করে বোঝার কোনো উপায় নেই। মাঝিরা যা বোঝাচ্ছে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। বেলা নয়টার আগেই পৌছে ইটনা বাজারের ঘাটে আমাদের ট্রলার ভিড়লো… আমরা নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে জলে যাত্রা শুরু করেছিলাম… ইটনা পরেছে কিশোরগঞ্জে… তারমানে আমরা এখন কিশোগঞ্জে। অনেক সময় পর স্থলে পা দিয়ে নাস্তাটা হলো বেশ জমিয়ে। চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই শাহীন ভাই ভ্যান নিয়ে উপস্থিত… আমরা যাবো দেওয়ান বাড়ি দেখতে… ভ্যানে চেপে রওয়ানা দিলাম দেওয়ান বাড়ির উদ্দেশ্যে। উৎসুখ জনতা চলেছে আমাদের পিছু পিছু। তাদের নানা প্রশ্ন। আমরা কোথা থেকে আসছি-কোথায় যাবো। আশ্চর্য শাহ আব্দুল করিমই যখন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সেখানে আমি কোন ছার। গলায় সুর থাকলে সত্যি সত্যি ভ্যানের পেছন পেছন আসা ছেলে-বুড়োদের শুনিযে দিতাম-“বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়/কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।”
নয়বিবি সমাধি সৌধটি অনেকটা ভেঙে গেলও এখনো মুগ্ধ করার মতোই তার সৌন্দর্য। এর ইতিহাসটা জানতে পারলে বেশ ভালো হতো। নয়বিবি সমাধি নামটিই একটি গল্পের ইংগিত দেয়। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম। ইতিহাস জানার মতো সময় কই। শুনলাম পাশেই আছে প্রাচীন মসজিদ। সেটার দিকেই ছুটলাম।
বিশাল জায়গা নিয়ে একতলা বিশিষ্ট প্রাসাদটি দেওয়ানবাড়ি নামে পরিচিত… দেওয়ানবাড়ির বাইরের দিকে আদি যৌলুস আর নেই… ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত ছোট ইটের এই বাড়িটি ভেতরে কিন্তু বেশ কেতাদস্তুর। আধুনিক টাইলসও লেগেছে ভেতরের দেয়ালের গায়ে। আধুনিকভাবে বাসযোগ্য করা হলেও বনেদীয়ানা কমেনি এতটুকু। ভবনটির দায়িত্বে থাকা কিশোরটি বেশ উৎসাহ নিয়েই আমাদের প্রায় পুরোবাড়ি ঘুড়িয়ে দেখালো। বাড়ির মালিক ঢাকায় থাকেন। মাঝে মধ্যে আসেন। তার নিজস্ব রুমগুলো তালাবদ্ধ থাকলেও অনেকটাই আমরা ঘুড়ে দেখতে পারলাম। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি নিজ গ্রামে আসলে নাকি এই বাড়িতে বসে মিটিং সারেন। দেওয়ান বাড়ি ঘেঁষে বসতি গড়ে উঠেছে, তারা আয়েস করে দেওয়ানবাড়ির বাইরের উঠানে বিশাল জাল বিছিয়ে মেরামতে ব্যস্ত। আমাদের তেমন পাত্তা দিলো না তারা। দেওয়ান বাড়ির হর্তাকর্তারই তাদের থাকতে দিয়েছে বলে জানা গেলো। বহুদিন ধরেই তারা এখানে বসবাস করে আসছে। দেওয়ান বাড়ির পাশেই দেখতে পেলাম কারুকাজ করা ভগ্নপ্রায় বেশ কয়েকটি সমাধি ও সমাধি সৌধ… নয়বিবি সমাধি সৌধটি অনেকটা ভেঙে গেলও এখনো মুগ্ধ করার মতোই তার সৌন্দর্য। এর ইতিহাসটা জানতে পারলে বেশ ভালো হতো। নয়বিবি সমাধি নামটিই একটি গল্পের ইংগিত দেয়। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম। ইতিহাস জানার মতো সময় কই। শুনলাম পাশেই আছে প্রাচীন মসজিদ। সেটার দিকেই ছুটলাম। শাহীন ভাই সবার আগে ছুটছেন। ফরিদীভাই খাটখট ছবি তুলে নিচ্ছেন। ভাগ্নে মদন একের পর এক অহেতুক প্রশ্ন করেই চলেছে। সেই সাথে অবশ্যই উত্তরও নিজেই দিচ্ছে। বাবুভাই স্থানীয়দের সাথে খাতির লাগানোর স্বভাবসুলভ চেষ্টা চালিযে যাচ্ছে। আর আমি একটু ভাবসাব নিয়ে স্থাপত্যগুলো দেখছি যেনো হাত ছুয়েই সব ইতিহাস বুঝে ফেলছি কোনো এক যাদুমন্ত্রে। প্রযুক্তি যেভাবে এগুচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তো এভাবেই ইতিহাস জানা যাবে। স্থাপত্যের ইটের গায়ে হাত দিলেই মস্তিষ্কে ধারণ হয়ে যাবে সকল তথ্য। যাই হোক, সুলতানি স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত মসজিদটি সত্যিই নান্দনিক। তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মাঝারি আকারের মসজিদটি বহাল তবিয়তেই আছে। জানা গেলো দেওয়ান বাড়িই এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। উন্নয়নের ফলে আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে মসজিদের গায়ে… এমন একটি স্থাপত্য যে এখানে দেখবো তা আমরা আশা করিনি। এইবার সকলে ফটাফট ছবি তুলছে… সেলফি তুলছে কায়দা করে কেউ কেউ… স্থানীয় একপাল বাচ্চা আমাদের সঙ্গী হয়েছে… আমি ভাবছি… কবে কে কোথায় থেকে এসে এ মসজিদ বানিয়েছিল কে জানে… আবার তারা কোথায় হারিয়ে গেছে… কম মানুষ জন্মায়… আবার চলে যায়… অল্প মানুষই তার কীর্তি রেখে যায় এই ভবে… শত শত বছর পর আবার অন্য মানুষরা তাদের খুঁজতে আসে… কিন্তু চাইলেই কি আর খুঁজে পাওয়া যায়… কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়… সেলাম তোমায় শাহ্ আব্দুর করিম… এই লাইনগুলো তুমি না লিখলে এতো সহজে মনের ভাব মনকেই বুঝ দিতে পারতাম না…
ঠিক হলো আমরা অষ্টগ্রামের দিকে যাত্রা করবো… মিঠামইনে নামবো না… দিল্লির আখড়া দিল্লির লাড্ডুই থেকে গেলো… মনে দারুন স্বাদ যাওয়ার কিন্তু শাহীনভাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আমরা কেমনে বলি যত কষ্টই হোক দিল্লির আখড়া আমরা দেখেই ছাড়বো। কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবো না। কিন্তু বিধিবাম, বাদ সাধলো ভ্রমণতান্ত্রিক নিয়মাবলীর অলিখিত নিয়ম – ভ্রমণে কাণ্ডারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
ইটনাকে পেছনে ফেলে আমরা চলছি মিঠামইনের দিকে… সেখানে দিল্লির আখড়া দেখবো… রোদ এবার ফাটিয়ে দিচ্ছে… ছই-এর উপর আর বসা যাচ্ছে না… অগত্যা আবার দাও ঘুম… ঘুম… জেগে থাকা… আবার ঘুম… আবার জাগা… জল আর জল… আবার যেনো সমুদ্রে পরলাম আমরা… আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় বুঝলাম মিঠামইন চলে এসেছি… তখন মাত্র সাড়ে এগারোটা বাজে… আমাদের ময়ূরপঙ্খী ঘাটে ভিড়েছে… রোদ এতোটাই তীব্র যে গা পুরে যাওয়ার অবস্থা… খোজ নিয়ে জানা গেলো দিল্লির আখড়া ঘাট থেকে ১২ মাইল দূরে… রাস্তার অবস্থাও করুণ… যেতে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে… ঠিক হলো আমরা অষ্টগ্রামের দিকে যাত্রা করবো… মিঠামইনে নামবো না… দিল্লির আখড়া দিল্লির লাড্ডুই থেকে গেলো… মনে দারুন স্বাদ যাওয়ার কিন্তু শাহীনভাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আমরা কেমনে বলি যত কষ্টই হোক দিল্লির আখড়া আমরা দেখেই ছাড়বো। কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবো না। কিন্তু বিধিবাম, বাদ সাধলো ভ্রমণতান্ত্রিক নিয়মাবলীর অলিখিত নিয়ম – ভ্রমণে কাণ্ডারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাই ফ্যাকাশে মারা চেহারায় হাসি হাসি মুখ করেই মেনে নিলাম। আবারো সমুদ্র যাত্রা শুরু করলাম আমরা… গতকাল যেমন বৃষ্টিতে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম… আজ তেমন রোদ জ্বালাচ্ছে… তবে হাওরের মিষ্টি বাতাস সব ভুলিয়ে দেয়…
একসময় জমে উঠলো আড্ডা… কতো রঙের গল্প যে আড্ডার বিষয় হয়ে উঠলো তার কোনো হিসেব নেই। এবার অবশ্য ফ্ল্যাক্সে চা ছিল… ক্যামিকেল ছাড়া কলা ছিল… বিস্কুট ছিল… সাথে ছিল হাওরের ভালোবাসা… এগিযে চলে ময়ূরপঙ্খী… কূল কিনারা নেই… প্রায়ই দূরের নৌকাগুলোর কাছে যেয়ে জেনে নিতে হচ্ছে আমরা কিভাবে যাবো… কারণ আমাদের মাঝির কেরামতী শেষ। এতোদূরে সে আগে কখনো এই জলে আসেনি… এখন সময় হিসাব করতে হচ্ছে আমাদের… অষ্টগ্রাম যেয়ে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা হবে। কিস্তু অষ্টগ্রাম যেতে কতটা সময় লাগবে মাঝিরাও জানে না… এক এক সময় এক এক কথা বলছে তারা… যাচ্ছি তো যাচ্ছি… পথ ফুরায় না… বা এভাবে বলা ভালো পথ ফুরানোর প্রয়োজনই বা কি… চলুক না এভাবেই… জীবনানন্দ হাজার বছর হেঁটেছিলেন… আমরা না হয় কয়েকটা প্রহর চলি… হাওরের বিভ্রান্তিতে মনে পরলো আসলে ইটনার নাম ইটনা হলো কেন? যা দেখলাম সবইতো ইটেই নির্মিত… তারপরও ইটনা… হাওরের জলে এমন বিভ্রান্তি হবেই… না হলে হাওর ভ্রমণের কোনো মনেই হয় না…
একসময় বাঁধের রাস্তার মাঝের এক ব্রীজের তল দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের ট্রলার যখন আটকে গেলো তখন জানতে পারলাম এটাই অষ্টগ্রাম। মাঝিরা নৌকা ছাড়িয়ে ব্রিজের অপর পারে নেওয়ার ফাঁকে আমরা ঘুরে আসবো অষ্টগ্রাম। সাথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হবে।
শেষমেষ মাঝিদের কথাই মাথা ঘাড় সবকিছু পেতে মেনে নিতে হলো। অগত্যা নিকলির উদ্দেশ্যেই আবারো ইঞ্জিন স্টার্ট নিলো। অল্প সময়ের মধ্যে বাঁধ… অষ্টগ্রাম… মাছ ধরা নৌকা পেঁছনে ফেলে আমরা ছুটে চললাম যেখানে আকাশ জল ছুঁয়েছে। নিকলি পর্যন্ত গেলে আনুমানিক আমরা জলপথে ২৫০ কিলোমিটার পারি দিবো বলে আমরা অনেক হিসেব নিকেষ করে বের করলাম। তবে অনেকেই এর সাথে একমত হলো না। তাতে কি আমরা তো মেনে নিয়েছি।
দুপুর পেরিয়ে গেছে তাও ছোট্ট এই বাজারে পাওয়া গেলো ভাত মাছ। খাবার তেমন সুস্বাদু না হলেও খাওয়ার পরিমাণ কম হলো না। সাথে দেখলাম পুরাতত্ত্ববিভাগ ঘোষিত প্রাচীন মসজিদ ও সংলগ্ন মাজার। পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটিতেও আছে সুলতানি স্থাপত্যরীতির ছোঁয়া। সমাধীর কারুকাজ বেশ আকর্ষণীয়। পোড়ামাটির কারুকার্যগুলো মুগ্ধ হয়ে তন্ময় হয়ে দেখার সুযোগ নেই। কারণ শাহীনভাই বারবার ঘড়ি দেখছেন। এরপরে যে হাওরগুলো পারি দিতে হবে সেগুলোও দিগন্তছাড়া। আলো থাকতে থাকতে না যেতে পারলে মাঝিরা দিক হারাবে। অষ্টগ্রামে আরো অনেক কিছুই দেখার ছিলো কিন্তু শাহীনভাই আমদেরকে দাবরিযে নিয়ে এলো ট্রলারে। এখানে অবশ্য কিছুটা সময় জলে ঝাঁপাঝাঁপি চললো। এখন আমরা কোথায় যাবো… কতটা দূর অবদী আমরা যেতে পারবো। সেটা ঠিক করে রওয়ানা দিতে হবে। কারণ এমন একটা জায়গায় আমাদের যেতে হবে যেখান থেকে সড়ক পথে আমরা আজ রাতেই ঢাকা পৌঁছাতে পারবো। মাঝিদের কোনো ধারনা নেই। স্থানীয়রাও ঠিকঠাক কোনো পরামর্শ দিতে পারলো না। শেষমেশ আমাদের হাতে দুটি নাম রয়ে গেছে একটা বাজিতপুর অন্যটা নিকলি। আমরা বাজিতপুরের পক্ষে হলেও মাঝিরা নিকলির পক্ষে। শেষমেষ মাঝিদের কথাই মাথা ঘাড় সবকিছু পেতে মেনে নিতে হলো। অগত্যা নিকলির উদ্দেশ্যেই আবারো ইঞ্জিন স্টার্ট নিলো। অল্প সময়ের মধ্যে বাঁধ… অষ্টগ্রাম… মাছ ধরা নৌকা পেঁছনে ফেলে আমরা ছুটে চললাম যেখানে আকাশ জল ছুঁয়েছে। নিকলি পর্যন্ত গেলে আনুমানিক আমরা জলপথে ২৫০ কিলোমিটার পারি দিবো বলে আমরা অনেক হিসেব নিকেষ করে বের করলাম। তবে অনেকেই এর সাথে একমত হলো না। তাতে কি আমরা তো মেনে নিয়েছি। অন্যদের থোরাই কেয়ার করি। ধীরে ধীরে আকাশে বাতাসে সন্ধ্যা নামছে… শেষ বিকেলের আলোর ছটা চারদিকে… তুমুল আড্ডা এক সময় নিভে এলো বিষন্ন সন্ধ্যায়… সবার মুখের কথা একসময ফুরিয়ে এলো। যেনো এই সন্ধ্যা কোনো কথা বলার নেই। সবাই সবার কথা এমনিতেই বুঝতে পারছে। সন্ধ্যা বিষয়টা এমনিতেই বিভ্রান্তিকর। দিন রাতের মিলনের সন্ধিক্ষণটি নিয়ে অনেক মিথ রয়েছে। সেসব এখন বলার সময় নয়। মনের মাঝে উথাল-পাথাল করা ঢেউ কত প্রশ্ন-কত উত্তর… কিন্তু আপাতত কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না… পেছনে গত দুই দিনের ফেলে আসা পথ… মানুষ… মাটি… জল… সামনে জল.. মাটি… মানুষ আবার আগের জীবন… কার্মব্যস্ততার… ঠিক সময় মতো নিকলি পৌঁছাতে পারবো কিনা… অন্ধকারে পথ হারালে কি হবে… নিকলি যেয়ে কিভাবে শহরে ফিরবো… নিকলি থেকে কি সরাসরি বাস পাওয়া যাবে? নাকি ভৈরব যেতে হবে কিনা… আজ রাতে ফিরতে পারবো কিনা… এসব প্রশ্ন বা উত্তর সবই অবান্তর… আপাতত দিনের নিভে যাওয়া আলোর বিপরীতে দেখতে চাওয়ার বাসনায় মত্ত্ব আদিম মন… ঝিলমিল ঝিলমিল জলে আকাশে বিশ্বয়… কোথায় কে যেনে গেয়ে যাচ্ছে… রঙ-বেরঙের যতো নৌকা ভবের তলায় আয়/রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।” আসলেই কেউ গাইছে? নাকি বিভ্রান্তি এখনো ছাড়েনি। কি জানি… কে জানে… দূর এতো জানার দরকার কি… এতো জেনে হবে কি… এই ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলতে চলতে মনে মনে আমিও গাইতে লাগলাম…
কোন মেস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
চন্দ্র-সূর্য বান্ধা আছে নাওয়েরই আগায়
দূরবীনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
রঙ-বেরঙের যতো নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
জারি গায়ে ভাটি বায়ে করতাল বাজায়
মদন মাঝি বড়ই পাজি কতো নাও ডুবায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
হারা-জিতা-ছুবের বেলা কার পানে কে চায়
পাছের মাঝি হাল ধরিয়ো ঈমানের বৈঠায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।।
1 Comment