ভবঘুরেকথা
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়

“পৃথিবীতে সব ব্যাপারেই একটা নির্দিষ্টকাল আর সব কাজেরই একটা উপযুক্ত সময় আছে।” সলোমনের এই মহাজন বাক্য আমি আমার আশ্বাসলাভের জন্য পাইনি। বাড়ি থেকে কোন জায়গায় গেলেই আমার সন্ধানীদৃষ্টি বেশ সজাগ ও সতর্ক রাখতাম, যদি কোনভাবে আমার ভাগ্যে নির্দিষ্ট গুরুর শ্রীমুখটি কোনো জায়গায় চোখে পড়ে। কিন্তু আমার ইস্কুলের লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর দর্শন কোথাও পাই নি।

অমরের সঙ্গে হিমালয়ে পলায়ন আর শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজীর আমার জীবনে আবির্ভাবের সেই পরম পূণ্যদিনটির মাঝখানে দু’বছর কেটে গিয়েছিল। এর মধ্যে আমি অনেকজন সাধুমহাত্মার দর্শনলাভ করেছিলাম: গন্ধবাবা, সোহহং স্বামী, নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী, মাস্টার মহাশয় এবং বিখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসু মহাশয়।
গন্ধবাবা’র সঙ্গে আমার সাক্ষাতের দু’টি পূর্বাভাস ছিল- একটি ছিল সুসঙ্গত আর অন্যটি বেশ কৌতূকজনক।

“ঈশ্বরই সরল; আর সব জটিল। প্রকৃতির আপেক্ষিক জগতে কোন পরম মান খুঁজতে যেয়ো না।”

মন্দিরস্থিত কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় এইসব দার্শনিক চরম তত্ত্বসকল মৃদুভাবে আমার কর্ণকুহরে এসে প্রবেশ করল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি যে একটি দীর্ঘকায় পুরুষ। যাঁর পরিচ্ছদে, অথবা বলতে গেলে তার অভাবে, তাঁকে পরিব্রাজক সাধু বলেই বোধ হয়।

আমি সকৃতজ্ঞভাবে হেসে বললাম, “সত্যিই আপনি আমার মনের জটিল চিন্তারাশির মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছেন। প্রকৃতির রুদ্র আর প্রসন্ন এই দুই ভাবমূর্ত হয়েছে কালীপ্রতিমার মধ্যে; কিন্তু তাদের বৈপরীত্য আমার চেয়ে অনেক জ্ঞানী-গুণীদেরও হতবুদ্ধি ঘটিয়েছে।”

তিনি বললেন, “অতি অল্পলোকই আছেন যাঁরা তাঁর রহস্যভেদ করতে পারেন। শুভাশুভ এই দুই ভাবের দুর্ভেদ্য প্রহেলিকাময় মানুষের জীবন যেন ‘স্ফিংসের’ (গ্রীক পুরাণে বর্ণিত এক অতিকায় প্রাণী; সাধারণতঃ বলা হয় তার মস্তকটি নারীর, এবং দেহটি সিংহ বা কুকুরের মত। তার ডানাও আছে। প্রাচীন গ্রীক শহর থীবসের রাস্তা দিয়ে যারাই যেত, তাদেরকেই সে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। উত্তর দিতে না পারলে পথিককে সে খেয়ে ফেলত।) মত সকল লোকের বুদ্ধির কাছে এক বিরাট রহস্য সৃষ্টি করে।

এর সমাধানের কোন চেষ্টা না করে অধিকাংশ লোক তাদের জীবন বৃথাই ব্যয় করে। মান্ধাতার আমল হতে, এমন কি আজ পর্যন্তও, লোকে সেই দণ্ডই দিয়ে আসছে। মাঝেমধ্যে এক আধজন হয়ত তাদের বিরাট ব্যক্তিত্বের জোরে কখনও পরাজয় মানতে চায় না। দ্বৈত মায়াবাদের মধ্যে হয়তবা সে অদ্বৈতবাদের অখণ্ড সত্যের সন্ধান পায়। “আপনার কথাগুলি খাঁটি সত্যি, মশাই।”

“বহুদিন ধরে অকপটভাবে জ্ঞানরাজ্যে অন্তদর্শনের অনুশীলন করে দেখেছি, প্রবেশের পথ দারুণ কঠিন। আত্মসমীক্ষা আর চিন্তার প্রতি নিরন্তর অবলোকনে এক কঠিন আর দারুণ অভিজ্ঞতা হয়। প্রবল আত্মাভিমানকেও তা চূর্ণ করে দেয়। সত্যিকারের আত্মবিশ্লেষণই কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে সত্যদ্রষ্টার ভাব আনয়ন করে। ‘আত্মপ্রকাশের’ ধারা বা ব্যক্তিগত স্বীকৃতি শেষপর্যন্ত তাদের আত্মম্ভরি করে তোলে যাদের এই ধারণা জন্মায় যে, ঈশ্বর ও সৃষ্টির ব্যাখ্যায় তাদেরই ব্যক্তিগত অধিকার আছে।”

আলোচনাটি বেশ ভালই লাগছিল; বললাম, “এ রকম উদ্ধত মৌলিকত্বের কাছ হতে সত্য কিন্তু নীরবে সরে যায়, তাতে আর সন্দেহ নেই।”

“মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত না তার ব্যক্তিগত সংস্কার হতে মুক্ত হতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে শাশ্বত সত্য উপলব্ধি করতে পারব না। মানুষের মন যুগ-যুগান্তরব্যাপী সংস্কারের পলিমাটিতে আবৃত, সংখ্যাতীত জগৎমায়ার অধীন নিরানন্দ জীবনের নিষ্ফলতায় পরিপূর্ণ। মানুষ যখন তার অন্তঃশত্রুর সঙ্গে লড়াই শুরু করে, যুদ্ধক্ষেত্রের ভীষণ লড়াই তখন তার কাছে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়।

দুর্ধর্ষ শারীরিক শক্তিতে পরাজিত হবার মত মরজগতের শত্রু এরা নয়! সর্বব্যাপি দৃষ্টি, নিরলস, এরা মানুষকে স্বপ্নেও অনুসরণ করে থাকে। ভীষণ আর মারাত্মক রকমের অস্ত্রশস্ত্রে গুপ্তভাবে সজ্জিত অন্ধ কামনার এইসব সৈন্যদল আমাদের হত্যা করবার সুযোগ অনবরত খুঁজে বেড়ায়। অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তার আদর্শের অপমৃত্যু ঘটায়, সে নিতান্তই হতভাগ্য বইকি ! তাকে অক্ষম, নীরস আর ঘৃণ্য ছাড়া আর কিইবা বলা যায়?”

“মশায়, এই সব ভ্রান্ত হতভাগ্যদের জন্যে কি আপনার এতটুকুও সহানুভূতি নেই?”

সাধুটি মুহূর্তের জন্যে চুপ করে রইলেন। পরে একটু শ্লেষের সঙ্গে বললেন, “সর্বগুণাধার অপ্রত্যক্ষ ঈশ্বর আর প্রত্যক্ষ মানুষ, যার প্রায় কিছুই গুণ নেই বললেই চলে, এই দু’জনকে সমানভাবে ভালোবাসা অভাবনীয় বই কি!
কিন্তু উদ্ভাবনী শক্তিও কম নূন্য নয়।

অনন্তের মধ্যে খুঁজে দেখলে, মানুষের মন যা স্বার্থবুদ্ধিজড়িত, তার মধ্যেও একটা ঐক্যের ভাব শীঘ্রই খুঁজে পাওয়া যায়।

এক হিসেবে অন্ততঃ মানুষের বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের পরিচয় মেলে। এই ভ্রাতৃত্বভাবের আবিষ্কারে মানুষের ক্ষুদ্র ও ভীত মন স্তম্ভিত হয়ে যায়। এইভাবে মানুষের জন্যে মানুষের দরদ সৃষ্টি হয়। বিকাশোন্মুখ মানবাত্মার নিরাময় শক্তির বিষয়ে যে মন অন্ধ ছিল, তা একটা উদার দিব্যদৃষ্টি লাভ করে।”

“সকল যুগের সাধুসন্তরা তো আপনারই মতো জগতের দুঃখে কাতর হয়েছেন।”

“একমাত্র স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তিরাই অপর মানুষদের জীবনের দুঃখ-দৈন্যের প্রতি সহানুভূতি হারায়, কারণ নিজেদের সীমিত দুঃখকষ্টের মধ্যেই তাদের মন ডুবে থাকে।” সাধুটির গম্ভীরবদন বেশ কোমল হয়ে এল। বলতে লাগলেন, “যে ছুরি দিয়ে চেরার মত আত্মব্যবচ্ছেদ করে দেখে, সেই বিশ্বানুকম্পার বিস্তার অনুভব করতে পারে। আর তার অহঙ্কারের উচ্চনাদও থেমে আসে। এইসব জমিতেই ভগবৎ প্রেমের ফুল ফোটে। অবশেষে জীব আর কিছু না হোক, মনের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তার সৃষ্টিকর্তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“আর কেন প্রভু, আর কেন? আর যে পারি না।” দুঃখের দারুণ কশাঘাতে জর্জরিত আর তাড়িত মানুষ অবশেষে সেই অসীম সত্তার দিকেই ধাবিত হয়, যাঁর অনুপম রূপের মাধুরীই একমাত্র তাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে।”

সাধুটি আর আমি কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে কালী মায়ের অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন করবার জন্যে গিয়েছিলাম। আমার ক্ষণিকের সাথীটি তখনই আবার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের কারুকার্য ও শোভাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে বলে উঠলেন, “ইটকাঠ মনে কোনো সাড়া জাগায় না, হৃদয় কেবল প্রাণের সুরেই বিকশিত হয়।” সূর্যকিরণের মধ্যে দিয়ে আমরা দরজার দিকে অগ্রসর হলাম। মন্দিরে তখন অসংখ্য ভক্ত পুজার্থীর দল যাওয়া আসা করছিল।

সাধুটি আমায় গম্ভীরভাবে নিরীক্ষণ করে বললেন, “তুমি শিশু, ভারতবর্ষও শিশু! প্রাচীন মুনি ঋষিরা আধ্যাত্মিক জীবনের অক্ষয় আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তাঁদের সনাতন প্রথা অধুনাতন দেশ ও কালের পক্ষেও যথোপযুক্ত। জড়বাদের মোহে আচারভ্রষ্ট আর বিকৃত না হয়ে সেইসব ধর্মানুশাসন বা তার উপদেশাদি এখনও ভারতবর্ষকে গড়ে তুলছে। হাজার হাজার বছরধরে বিপর্যস্ত-বুদ্ধি পণ্ডিতেরা যার মূল্যায়ন করতে পারেননি, সন্দেহপ্রবণ সেই কালের বিচারে বেদের মূল্য আজ নিরূপিত হয়ে গেছে। এইটেকেই তোমার উত্তরাধিকার বলে গ্রহণ কোরো।”

পরম বাগ্মী সেই সাধুটির কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করবার সময় তিনি এক ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন, “এখান থেকে যাবার পরই কিন্তু তোমার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ঘটবে, দেখো।” মন্দির সীমানা ছেড়ে আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। একটা বাঁক ঘুরতেই বহুদিনের পরিচিত একটি লোকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ইনি হচ্ছেন সেই সব মহাপ্রভুদের একজন, যাঁরা একবার আলাপ জুড়লে আর তাঁদের স্থানকালের মাত্রাজ্ঞান থাকে না। আমি কিন্তু তখন তার হাত এড়িয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়বার মতলব করছিলাম দেখে সে বললে, “আচ্ছা, তোমায় আমি শীগগিরই ছেড়ে দেবো; কিন্তু আমাদের সেই ছাড়াছাড়ি হবার পর যা কিছু ঘটেছে, তা সব একে একে বল দেখি !”

বললাম, “কি মুশকিল! আরে আমাকে যে এখুনিই যেতে হবে।”

কিন্তু হলে কি হয়, কে বা শোনে কার কথা। সে তো আমার হাতটি পাকড়ে ছোটখাটো যত সব খবর একে একে বার করে নিতে লাগল। মজা মন্দ নয়! যতই আমি বলি, ততই সে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো আরও খবরের সন্ধানে লালায়িত হয়। মনে মনে আমি মা কালীর কাছে প্রার্থনা শুরু করলাম যাতে চট্ করে পালাতে পারি, আর একটা উপায় বার করে দেবার জন্যে।

সঙ্গীটি হঠাৎ আমাকে ছেড়ে চলে গেল। একটা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিগুণ জোরে পা চালিয়ে দিলাম এই ভয়ে যে, আবার তার বকবকানির পাল্লায় পড়তে না হয়। পশ্চাতে দ্রুত পদধ্বনি শুনতে পেয়ে আমিও গতি বৃদ্ধি করলাম। পিছন ফিরে তাকাতে আর সাহস হল না। কিন্তু প্রায় ছুটে এসে বন্ধুবর খুব স্ফূর্তির সঙ্গে আমার কাঁধটি ধরে এসে দাঁড়াল।

তার পরেই সে শুরু করলো, “আরে! আমি যে তোমায় গন্ধবাবার কথা বলতে একেবারেই ভুলে গিয়েছি। উনি ঐ সামনের বাড়িতেই থাকেন।” বলে সে সামান্য দূরে একটা বাড়ি দেখিয়ে দিল। তারপর বলল, “ওঁর সঙ্গে দেখা করে যেয়ো কিন্তু, বুঝলে? ভারি অদ্ভুত লোক! তুমি অনেক আশ্চর্য ব্যাপার ওখানে দেখতে পাবে। যাইহোক, এখন আমি চললাম তবে।” এই বলে এবার কিন্তু সে সত্যিই চলে গেল।

তার এই কথায় কালীঘাটের মন্দিরের সেই সাধুটির ভবিষ্যদ্বাণীর কথা আমার মনে পড়ে গেল। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে প্রবেশ করলাম। দেখি, একটি বেশ প্রশস্ত বৈঠকখানায় একটা গেরুয়ারঙের পুরু গালিচার ওপর বহু লোক এখানে-ওখানে বসে রয়েছে। বসতেই একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের চাপা ফিসফিসানি আমার কানে এসে পৌঁছল, “ঐ দেখ, গন্ধবাবা বাঘছালের উপর বসে রয়েছেন। উনি যে কোন গন্ধহীন ফুলের ভিতর স্বাভাবিক সুগন্ধ এনে দিতে পারেন। তাছাড়া, কোন শুকনো কুঁড়ি ফুটিয়ে তুলতে অথবা কারুর গা থেকেও অতি মনোরম গন্ধ বার করতে পারেন।”

শুনে সাধুটির দিকে আমি সোজা তাকালাম। সাধুটিরও চঞ্চল দৃষ্টি আমার উপর স্থির হয়ে দাঁড়াল। শ্যামবর্ণ নধর দেহ, শ্মশ্রূবিশিষ্ট, চক্ষু দু’টি বেশ বড় বড় আর উজ্জ্বল। বললেন, “বাবা, তোমায় দেখে খুব খুশি হয়েছি। কি চাও বল? কোন্ গন্ধ চাই?”

মনে হল, কথাগুলো যেন ছেলেমানুষের মত। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হবে?”

বললেন, “অলৌকিক উপায়ে গন্ধ বেরোচ্ছে, দেখতে পাবে।”

“ভগবানকে গন্ধ তৈরি করার কাজে লাগান নাকি?”

“তাতে কি হয়েছে? ভগবানই ত’ গন্ধ তৈরি করেন।”

“তা বটে ! তবে তিনি ফুলের নরম পাপড়ির ভিতরেই গন্ধ তৈরি করেন, সদ্যসদ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেবার জন্যে। আপনি ফুল তৈরি করতে পারেন কি?”

“হ্যাঁ! তবে সাধারনতঃ আমি কেবল গন্ধই তৈরি করি।”

“তাহলে আতর তৈরির কারখানা ত’ সব উঠে যাবে।”

“আরে না, না, তাদের ব্যবসা সব ঠিক বজায় থাকবে। আমার নিজের উদ্দেশ্য হচ্ছে – ঈশ্বরের শক্তির কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া মাত্র, আর কিছু নয় বুঝলে?”

“মশায়, ঈশ্বরের প্রমাণের কোন দরকার করে নাকি? তিনি কি সর্বত্র সকল বিষয়েই অলৌকিক ব্যাপার ঘটাচ্ছেন না, বলুন?”

“হ্যাঁ, কিন্তু তাঁর অনন্ত সৃষ্টিবৈচিত্র্যের মধ্যে আমরাও তো সামান্য কিছু দেখাতে পারি।”

“কতদিন আপনারে এ বিদ্যায় পারদর্শী হতে লেগেছে?”

“বার বৎসর।”

“এই অলৌকিক উপায়ে গন্ধ তৈরি করার জন্যে! পূজনীয় সাধুজী, মনে হয়, যে কোন গন্ধবিক্রেতার দোকান থেকে গোটা কতক টাকার বদলে আপনি যা পেতে পারেন, তারজন্যে বৃথাই আপনি এই বারোটা বছর ব্যয় করেছেন।
গন্ধ ত’ ফুলের সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায়।”

“হ্যাঁ, কিন্তু গন্ধ ত’ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেও চলে যায়। শুধু মাত্র দেহের তৃপ্তির জন্যে আমি তা চাইব কেন?”

“দার্শনিকপ্রবর! তোমার কথা শুনে খুব খুশি হলাম। নাও, তোমার ডানহাতটি বাড়িয়ে দাও তো দেখি”, বলে আশীর্বাদচ্ছলে দক্ষিণ হস্তটি প্রসারিত করলেন।

গন্ধবাবার কাছ থেকে আমি গজকতক দূরে বসেছিলাম। আমার গা ছুঁয়েও কোন লোক সেখানে বসে ছিল না। আমি হাতটি বাড়িয়ে দিলাম – যোগিবর তা স্পর্শ করলেন না।

শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কি গন্ধ চাই?”

“গোলাপ।”

“বেশ, তাই হবে।”

অপরিসীম বিস্ময়ে দেখলাম যে, গোলাপের মনোরম সৌরভ আমার করতলের মধ্যস্থল হতে তীব্রভাবে ফুটে বেরচ্ছে। আমি একটু হেসে কাছের ফুলদানী থেকে একটি গন্ধহীন ফুল তুলে নিয়ে বললাম, “এই ফুলে কি জুঁই ফুলের গন্ধ হতে পারে?”

“তাই হবে।”

ফুলের পাপড়িগুলো থেকে তখনই জুঁই ফুলের গন্ধ ভুর ভুর করে বেরতে লাগল। এই অপূর্ব ইন্দ্রজালের সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়ে, তাঁর একটি শিষ্যের পাশে গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন যে, গন্ধবাবা, যাঁর আসল নাম স্বামী বিশুদ্ধানন্দ – তিব্বতে এক গুরুর কাছ থেকে যোগের নানা আশ্চর্য প্রক্রিয়া শিক্ষা করে এসেছেন। তিব্বতী যোগীটির বয়স শুনলাম হাজার বছরেরও ওপর।

শিষ্যটি গুরুর বিষয়ে বেশ একটু গর্ব প্রকাশ করে বললেন, “তাঁর শিষ্য গন্ধবাবা। আপনি এইমাত্র যে রকম দেখলেন, তেমনি যখন তখন কিন্তু উনি শুধু কথা বলে গন্ধ তৈরি করেন না। অবিশ্যি মেজাজ অনুযায়ী ওঁর কাজের অনেক তারতম্য হয়। ওঁর অদ্ভুত শক্তি! কলকাতার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিই ওঁর শিষ্য।”

আমি মনে মনে ঠিক করলাম, আমি আর এঁদের দল বাড়াব না। একেবারে আক্ষরিক অর্থে “অলৌকিক শক্তিশালী” কোন গুরু আমার ঠিক মনের মত নয়। গন্ধবাবাকে বিনম্র নমস্কার জানিয়ে সেখান হতে প্রস্থান করলাম। বেড়াতে বেড়াতে বাড়ি ফেরবার সময় সেদিনকার তিনটি বিচিত্র ঘটনার কথা ভাবতে লাগলাম।

বাড়ির দরজায় পা দিতেই উমাদিদির সঙ্গে দেখা। বলল, “বড়ই চাল বেড়ে গেছে দেখছি, আবার সেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যাপার কি?” বিনা বাক্য ব্যয়ে হাতটি বাড়িয়ে দিদিকে তা শুঁকতে ইশারা করলাম। শুঁকেই চেঁচিয়ে বলে উঠল, “আঃ! কি চমৎকার গোলাপের গন্ধ, আর কি অস্বাভাবিক রকমের উগ্র!”

“সত্যিই ব্যাপারটা উগ্র রকমের অস্বাভাবিক।”

ভেবে নিঃশব্দে তার নাকের কাছে সেই অলৌকিক উপায়ে সুগন্ধকরা ফুলটি ধরলাম।

“ওঃ! জুঁই ফুল আমি বড্ড ভালোবাসি!” বলেই সে ফুলটি ছিনিয়ে নিল। কারণ দিদি খুব ভালো রকমই জানত যে, ও ধরণের ফুল একেবারেই গন্ধহীন; কিন্তু তা থেকে জুঁই ফুলের গন্ধ বারম্বার শুঁকতে শুঁকতে তার মুখের উপর একটা হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পেল। দিদির উপর গন্ধের প্রতিক্রিয়াতে আমার একটা সন্দেহ দূর হল যে, হয়তবা গন্ধবাবা আমার উপর আত্মসম্মোহিত অবস্থা আনাতে আমিই কেবল গন্ধটা টের পাচ্ছিলাম।

পরে আমি আমার বন্ধু অলকানন্দের কাছ হতে গন্ধবাবার আর একটি অলৌকিক শক্তির কথা শুনেছিলাম – যা শুনে আমার মনে হল যে, হায় রে! পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ক্ষুধিত মানুষের আজকে যদি তা থাকত!

অলকানন্দ বলেছিল, “বর্ধমানে গন্ধবাবার আস্তানায় এক উৎসব উপলক্ষ্যে শতাধিক অভ্যাগতের মধ্যে আমিও উপস্থিত ছিলাম। বিরাট আনন্দোৎসব, অনেকেই এসেছেন। যোগিবরের শূন্য থেকে জিনিষ তৈরি করবার কথা শুনে আমি একটু হেসে কিছু অসময়ের ট্যাঞ্জারিন কমলালেবু তৈরি করবার কথা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে কলাপাতার ওপর পরিবেশন করা লুচিগুলো বেশ ফুলে উঠল। প্রত্যেকটি লুচির খোলের ভেতর একটি করে খোসা ছাড়ানো ট্যাঞ্জারিন কমলালেবু ! আমারটিতে তো ভয়ে ভয়ে কামড় দিলাম। কিন্তু দেখলাম, তা অতি সুস্বাদু!”

বহু বৎসর পরে আমি আত্মোপলব্ধিবলে জানতে পেরেছিলাম, কি করে গন্ধবাবা ঐ সব তৈরি করতেন। কিন্তু হায়! এই প্রক্রিয়াটি চিরকালই জগতের ক্ষুৎপীড়িত মানবগোষ্ঠীর আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে। বিভিন্ন ইন্দ্রিয়গ্রহ্য উত্তেজনা, যা মানুষের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ – তা সব ইলেকট্রন আর প্রোটনের স্পন্দন তারতম্যে উৎপন্ন হয়। এই স্পন্দনগুলি আবার প্রাণ অর্থাৎ “লাইফট্রন” দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই লাইফ ট্রন’ই হচ্ছে সূক্ষ্ম প্রাণশক্তি, অথবা পারমাণবিক শক্তি অপেক্ষাও সূক্ষ্মতর শক্তি, যা সুকৌশলে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত পঞ্চতন্মাত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।

গন্ধবাবা কতকগুলি যৌগিক প্রক্রিয়ার বলে নিজেকে এই বিশ্বপ্রাণশক্তির সঙ্গে একসুরে বেঁধে, এইসব লাইফ ট্রনগুলির স্পন্দনশীল গঠনকার্যে পরিবর্তন সাধিত করে, তাদের ইচ্ছামত রূপ দিয়ে ঈপ্সিত ফললাভ করতে পারতেন। তাঁর গন্ধ বা ফল তৈরি করা বা অন্যান্য আশ্চর্য ব্যাপার সকল এইসব জাগতিক স্পন্দনেরই বাস্তব রূপ মাত্র – সম্মোহিত অবস্থায় তৈরি কোন আভ্যন্তরীণ অনুভূতি নয়!

যে সব লোকেদের অ্যানেস্থেটিক প্রয়োগে বিপদ ঘটতে পারে, তাদের ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের সময় মানসিক ক্লোরোফর্ম হিসাবে ডাক্তাররা সম্মোহনবিদ্যা প্রয়োগ করেন। কিন্তু কারোর ওপর বারবার সম্মোহন শক্তির প্রয়োগ অত্যন্ত ক্ষতিকর; কারণ এর ফলে পরে এমন একটি তামসিক মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া প্রকাশিত হয়, যাতে করে তা কালে ক্রমে ক্রমে মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে একটি বিশৃঙ্খলার ভাব এনে ফেলে।

সম্মোহনবিদ্যা হচ্ছে অপরের চিত্তভূমিতে অনধিকার প্রবেশ। এর সাময়িক ঘটনাবলী ঈশ্বরানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কার্যকলাপের তুল্য কখনই নয়‌। দিব্যভাবে উদ্বুদ্ধ প্রকৃত মুনিঋষিরা, এই নিখিল বিশ্বসৃজনকারী একজন যে স্বপ্নদ্রষ্টা আছেন, তাঁরই ইচ্ছার সঙ্গে একসুরে বাঁধা তাঁদের ইচ্ছাশক্তিবলে এই স্বপ্নজগতে নানা পরিবর্তন আনয়ণ করতে পারেন। গন্ধবাবা প্রদর্শিত অলৌকিক কার্যাবলী দেখতে অবশ্য খুবই আশ্চর্যজনক বটে, কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে সেসব একেবারেই নিরর্থক।

একমাত্র আনন্দবিধান করা ছাড়া তার আর অন্য কোনও সার্থকতা না থাকাতে এরা গভীর ঈশ্বরানুসন্ধিৎসার পথ থেকে মানুষকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে। প্রকৃত গুরুরা কিন্তু অলৌকিক শক্তির অযথা ও সাড়ম্বর প্রদর্শন করাকে আদৌ পছন্দ করেন না। পারস্য দেশের মরমী আবু সৈয়দ একবার এই জল, স্থল, ও অন্তরীক্ষের উপর ক্ষমতালাভে দৃপ্ত কতকগুলি ফকিরকে মৃদু ভৎসনাচ্ছলে বলেছিলেন, “ব্যাং জলেতেও সমান স্বচ্ছন্দ্য, কাক-শকুন অতি সহজেই বাতাসে উড়ে বেড়ায়। পূর্বে ও পশ্চিমে শয়তান একইভাবে বর্তমান। সত্যিকারের খাঁটি মানুষ তাকেই বলে, যে তার স্বজনদিগের সঙ্গে সাধু ব্যাবহার করে – ভাবের হাটে যার বেচাকেনা চলে, কিন্তু মুহূর্তেকের তরেও সে ভগবানের ভোলে না।”

আর এক উপলক্ষ্যে পারস্যদেশের সেই মহান শিক্ষাগুরু ধর্মজীবন সম্বন্ধে এইরকম উপদেশ দিয়েছিলেন, “তোমার মাথার ভেতর যা’ সব ঢুকে আছে (স্বার্থপর চিন্তা আর নানা দুরাশা) তা সব দূর করে ফেল; তোমার হাতে যা আছে, তা সব অকুণ্ঠভাবে বিতরণ কর। আর দুঃখের আঘাতে কখনও মুষড়ে পোড়ো না।”

কালীঘাটের সেই নিরপেক্ষ সাধু, অথবা তিব্বতে শিক্ষাপ্রাপ্ত সেই যোগী, কেউই আমার গুরু অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষায় পরিতৃপ্তি এনে দিতে পারেন নি। আমার অন্তরে তাঁর পরিচয়ের জন্যে কোন উপদেষ্টার প্রয়োজন হয়নি, আর সেখানে একটা স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ বাণীর প্রতিধ্বনি প্রবলতর হয়ে উঠত কারণ তাঁর বিরল আবির্ভাব ঘটত নীরবতার মধ্য হতে। শেষ পর্যন্ত যখন আমি আমার গুরুর দর্শন পেলাম, তখন একমাত্র তাঁর মহিমময় আদর্শের মধ্যেই প্রকৃত মানুষটির পরিচয় পেলাম – আর কিছুরই দরকার রইল না।

……………………………….
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi) শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত। মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। – পরমহংস যোগানন্দ

পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!