-গৌতম মিত্র
৫. শ্রী অশ্বিনী গোঁসাই
খুলনা জেলার গঙ্গাচর্ণা গ্রামে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক কার্তিক বৈরাগীর পুত্র অশ্বিনী গোঁসাই জন্মগ্রহণ করেন। অশ্বিনী গোঁসাই ছিলেন একাধারে সাধক, সু-গায়ক ও শ্রেষ্ঠ কবি। বলা হয়ে থাকে, বাংলার শাক্তকবি রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, ফকিরকুলের শিরোমণি লালন ফকির এবং বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস প্রমুখ সাধক ভক্ত কবিদের সমগোত্রীয় ছিলেন তিনি।
বাল্যকালই অশ্বিনী গোঁসাই মতুয়া সাধক কবি গীতিকার হরিবর সরকারের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর কাছে তিনি গান শিখতেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গভীর তত্ত্বের জ্ঞান আরোহন করেন ও সুরকার হিসেবে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
তারক সরকার মহানন্দ গোঁসাইর সাথে হরিনাম গুণগান করে ঘুরে বেড়াতেন। মতুয়াদের মূল সংগীত ‘শ্রীশ্রী হরিসংগীত’-এর রচিয়তাও এই শ্রী অশ্বিনী গোঁসাই। শ্রীশ্রী হরিসংগীত সম্পর্কে বলা হয়েছে-
প্রেমতত্ত্ব ভাবতত্ত্ব রসতত্ত্ব গাঁথা।
আত্মত্ত্বে সমাহিত গানের কবিতা।।
যত গান রচিয়াছে অশ্বিনী গোঁসাই।
চিরন্তন ভাবে তাই পুরাতনী নাই।।
অশ্বিনী গোঁসাই মতুয়াদর্শন প্রচার করতেন নিজের রচিত নিত্য নতুন গান দিয়ে। তার রচিত গানের সুর, ছন্দ, তাল ছিল মনোমুগ্ধকর। অশ্বিনী গোঁসাইর হরিসংগীত-এর ভাব ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে হাজার হাজার মানুষ মতুয়া মতে দীক্ষিত হয়। ১৩৩৬ সালে এই মহামানব ইহ জগতের মায়া মমতা ত্যাগ করে আড়ালে চলে যান।
৬. শ্রী হরিবর সরকার
ফরিদপুর জেলার দূর্গাপুর গ্রামে ১২৭৫ বঙ্গাব্দে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম হরিবর সরকার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রী আনন্দ সরকার ছিলেন খ্যাতিমান কবি। জানা যায়, শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের বরে হরিবর সরকার জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভবত সেই জন্যই তার নাম রাখা হয় হরিবর।
পুত্রের শিক্ষার জন্য আনন্দ সরকার নিজ গ্রাম দূর্গাপুরে পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ শেষ করে ঘোনাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন হরিবর। সেখান থেকে বিশেষ যশের সঙ্গে পাস করে ছাত্রবৃত্তি পেয়ে তিনি মোক্তারী পড়তে যান। কিন্তু মোক্তারী পাস করা হয় নি তার।
এরপর হরিবর সরকার পড়াশোনা ত্যাগ করে তারক সরকারের কাছে কবিগান শিখতে শুরু করে। মহানন্দ হালদারের সাথে মতুয়া মতকে প্রচারের জন্য বেড়িয়ে পরেন। মতুয়া গায়ক হিসেবে অশ্বিনী গোঁসাইর মতো হরিবর সরকারও খ্যাতি অর্জন করেন।
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর হরিবর সরকারকে ‘কবি গুণাকার’ উপাধি ও ‘রোপ্য মুদ্রা’ উপহার দেন। বেতকাটা গ্রাম থেকেও ‘কবিরত্ন’ উপাধি পান। সু-কবি রসিক লাল মুখোপাধ্যায় হরিবর সরকারকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি দেন। এছাড়াও তিনি কবি চূড়ামণি, কবি শিরোমণি উপাধিতে ভূষিত হন।
হরিবর সরকার শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের বাণী থেকে ‘দ্বাদশ আজ্ঞা’ সংকলন ও ব্যাখা করেন। যা মতুয়াদের প্রধান পালনীয় নিয়ম।
৭. শ্রী রমনী গোঁসাই
বাংলাদেশের খুলনা জেলার হুড়কা গ্রামে ১২৭২ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক রমনী গোঁসাই বা রুপচাঁদ গোঁসাই। রুপচাঁদ গোঁসাইর স্ত্রীর নাম ছিল ফুলমালা দেবী। তারা দুজনে মিলে ‘গোপী যন্ত্র’ বাজিয়ে হরিনাম করতেন। এক সময় রুপচাঁদ গোঁসাই মহাজ্বরে আক্রান্ত হলে ফুলমালা দেবী গোঁসাইকে বলল-
এসব বৈরাগ্য ভাব সব ছেড়ে দাও।
গৃহে বসে হরিবলে জগৎ মাতাও।।
স্ত্রীর কথায় রুপচাঁদ গোঁসাই ঘরেই থিত হয়ে বসেন। ঘরে বসেই হরিনাম করতে থাকেন। এরপর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। এ সময় থেকেই রুপচাঁদ হরিগুরু চাঁদের আর্দশ বুকে ধারণ করে চলতে শুরু করেন।
তারক সরকারের সাথে করে তিনি ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়িতে যান। সেখানে তারক সরকার রুপচাঁদ গোঁসাইকে গুরুচাঁদ ঠাকুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয়ের পরপরই গুরুচাঁদ ঠাকুর রুপচাঁদ গোঁসাইকে বলেন-
মোর বাক্য রুপচাঁদ একবার লও।
শ্রী হরিচাঁদের নাম জগতে ছড়াও।।
এরপর রুপচাঁদ গোঁসাই দেশ বিদেশে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের লীলা মাহাত্ম্য প্রচার করতে লাগলেন। তার অনেক কীর্তির কথা প্রচারিত আছে। জানা যায়, তিনি হুড়কা গ্রামের জলে ডোবা শিশুর প্রাণ দান করেন। যশোরের মাহামুদপুর গ্রামে যজ্ঞেশ্বরের মৃগী রোগ থেকে মুক্ত করেন।
খুলনা, মাটভাঙ্গা, দেবীতলা, বয়ার ভাঙ্গা, শিবপুর, জয়ডিহি, শিয়ালী, নগরকান্দী, শূলঢীয়া, গাছবাড়ি এই সব অঞ্চলে রমনী গোঁসাই বিশেষ অলৌকিক ঘটনা দেখান। ১৩৩৮ সালে মহান মতুয়া সাধক মায়া জগৎ ত্যাগ করেন। রমনী গোঁসাইর কথামত তাঁর মৃতদেহকে ভেলায় করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
৮. শ্রী নকুল গোঁসাই
বাংলাদেশের খুলনা জেলার দৌলতপুর থানার লক্ষ্মীকাটী গ্রামে ১৩০২ বঙ্গাব্দে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক নকুল গোঁসাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দূর্গাচরণ মহাশয়। নকুলের মাতুলালয় ছিল যশোহর জেলার ডোমরায়। সেখানে তাঁরক সরকারের কবি গান শুনে নকুল গোঁসাই মতুয়া আদর্শে নিজেকে আত্ম নিয়োগ করেন।
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই নকুল গোঁসাই মতুয়া দল গঠন করেন। নকুল গোঁসাই শ্রীধাম ওড়াকান্দি যখন বারুণীতে দল নিয়ে তাঁর বিবরণ-
ডঙ্কা, শিঙ্গা, ভেরী, তুরী, লোহিত নিশান।
বীরমূর্ত্তি সে নকুল অগ্রে অগ্রে যান।।
দলে লোকশত তিন শত বয়সে সমান।
মহানন্দে করে সবে হরি গুন গান।।
নকুল গোঁসাই ছিল ওই দলের দলপতি। তৎকালীন সময় ৩০০ ভক্ত নিয়ে নকুল গোঁসাই শ্রীধাম ওড়াকান্দি যেত। এতো বড় দল দেখে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত খুশি হতেন। নকুল গোঁসাইর কাজ ছিল হরিচাঁদ ঠাকুর গুরুচাঁদ ঠাকুরের কর্মাদেশ দেশে দেশে ছড়িয়ে দেওয়া।
১৩৩৪ সালে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজে সামাজিক সংস্কার ও ধর্মীয় মনোভাব প্রচারে খুলনা যশোহরে প্রত্যেক মতুয়া ভক্তের বাড়িতে ভ্রমণ করেন। সেই সময় নকুল গোঁসাইর বাড়িতে গিয়ে মতুয়াদের শিক্ষা সচেতন করার নির্দেশ দেন।
নকুল গোঁসাই সারাজীবন শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশ মতো সমাজ সেবা করে গেছেন।
৯. শ্রী বিপিন চাঁন গোঁসাই
বরিশাল জেলার কেনুভাঙ্গা গ্রামে ১২৮২ বঙ্গাব্দে গুরুচাঁদের বারো গোঁসাইয়ের অন্যতম সাধক বিপিন চন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিষ্ণু চরণ আর মাতা হিমালা দেবী। বিপিন চাঁদ পাটগাতী গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরবর্তী শিক্ষার জন্য খুলনা জেলার ডিংসীপাড়া যান। কিন্তু সংসারের কারণে বেশীদূর পড়াশোনা করতে না পেরে বস্ত্র ব্যবসা শুরু করেন।
ওড়াকান্দির নিকটবর্তী সাফলী ডাঙ্গা নিবাসী গৌর বিশ্বাসের সাথে তিনি শ্রীধাম ওড়াকান্দি ‘বারুনী’তে যান। সেখানে গুরুচাঁদ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তারপর থেকে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিদেশে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় হরিগুরু চাঁদের মতাদর্শ প্রচার শুরু করেন।
তিনি দেবীচাঁদ, গোপাল সাধুর সাথে মতুয়া সমাজে বিধবা বিয়ে চালু করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিপিন গোঁসাই মতুয়া সমাজের কু-সংস্কারকে দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
(চলবে…)
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?