ভবঘুরেকথা
ফকির লালন শাহ্

ফকির লালনের বাণী : সাধকদেশ

৮০১.
শব্দের ঘর নিঃশব্দের কুড়ে সদাই তারা আছে জুড়ে,
দিয়ে জীবের নজরে ঘোর টাঁটি।

৮০২.
আপন ঘরে পরের কারবার দেখলাম নারে তার বাড়িঘর,
আমি বেহুঁশ মুটে বা কার মোট খাঁটি।

৮০৩.
থাকতে রতন আপন ঘরে এ কী বেহাত আজ আমারে,
লালন বলে মিছে মনরে এ ঘরবাটি।

৮০৪.
আমি দেখলাম এ সংসার ভোজবাজি প্রকার
দেখতে দেখতে কেবা কোথা যায়।

৮০৫.
মিছে এ ঘর-বাড়ি মিছে ধন টাকা-কড়ি
মিছে দৌড়াদৌড়ি করি কার মায়ায়।

৮০৬.
কীর্তিকর্মার কীর্তি কে বুঝিতে পারে
সে বা জীবকে লয়ে কোথায় রাখে ধরে।

৮০৭.
এ কথা আর শুধাব কারে
নিগুড় আত্মতত্ত্ব কে বলবে আমায়।

৮০৮.
যে করে এই লীলে তারে চিনলাম না
আমি আমি বলি ভবে আমি কোন জনা।

৮০৯.
মরি কি আজব কারখানা
এবার গুণে পড়ে কিছুই ঠাহর নাহি হয়।

৮১০.
ভয় ঘোঁচে না আমার দিবা রজনী
কার সাথে কোন দেশে যাব না জানি।

৮১১.
বসতবাড়ির ঝগড়া কেজে
কিছুই আমার মিটলো না।

৮১২.
কার গোয়ালে কে দেয় ধূমা
সব দেখি তা-না-না-না।

৮১৩.
ঘরের চোরে ঘর মারে যার
বসতের সুখ হয় কিসে তার।

৮১৪.
ভূতের কীর্তন দেখি যে প্রকার
তেমনি তার বসতখানা।

৮১৫.
দেখেশুনে আপ্ত কল
বাড়ির কর্তা ব্যক্তি হত হলো।

৮১৬.
সাক্ষাতে ধন চোরে গেল
এ লজ্জা তো যাবে না।

৮১৭.
সর্বদা হাকিমের তরে
আর্জি করি বারে বারে।

৮১৮.
এ কি আসমানী চোর
ভাবের শহর লুটছে সদাই,
তাঁর আসা যাওয়া কেমন রাহা
কে দেখেছো বলো আমায়।

৮১৯.
শহর বেড়ে অগাধ দোরে
তাঁর মাঝখানে ভাবের মন্দিরে
সেই নিগম জায়গায়;
তাঁর পবনদ্বারে চৌকি ফেরে
এমন ঘরে চোর আসে যায়।

৮২০.
এক শহরে চব্বিশ জেলা
দাগছেরে কামান দু’বেলা
বলিয়ে জয় জয়;
ধন্য চোর এ ঘর মারে
করে না সে কাহারো ভয়।

৮২১.
মন বুদ্ধির অগোচর চোরা
বললে কি বুঝবি তোরা
আজ আমার এই কথায়;
লালন বলে ভাবুক হলে
চোরের ধাক্কা লাগে তাইরি গায়।

৮২২.
বাড়ির কাছে আরশি নগর।
সেথা এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।

৮২৩.
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে।

৮২৪.
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে
কেমনে সে গাঁয় যাই রে।

৮২৫.
কি বলবো সেই পড়শির কথা
তার হস্তপদ স্কন্ধমাথা নাইরে।

৮২৬.
ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীরে।

৮২৭.
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
যম যাতনা সকল যেতো দূরে।

৮২৮.
সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

৮২৯.
আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।
আমি জনম ভ’রে একদিন না দেখলাম তারে।

৮৩০.
নড়েচড়ে ঈশান কোনে
দেখতে পাইনে দুই নয়নে।

৮৩১.
হাতের কাছে যার ভবের হাট-বাজার
আমি ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে।

৮৩২.
সবে বলে, প্রাণ-পাখি
শুনে চুপে চেপে থাকি।

৮৩৩.
জল কি হুতাশন, মাটি কি পবন
আমায় কেউ দিল না নির্ণয় করে।

৮৩৪.
আপন ঘড়ের খবর হয় না
বাঞ্ছা করি পরকে চেনা।

৮৩৫.
লালন বলে, পর বলতে পরওয়ার
আমি কি রূপ, সে কিরূপ ওরে।

৮৩৬.
এ কি আজগুবি এক ফুল।
ও তাঁর কোথায় বৃক্ষ
কোথায় আছে মূল।

৮৩৭.
ফুটেছে ফুল মান সরোবরে
স্বর্ণ গুফায় ভ্রমরা তাঁর।

৮৩৮.
কখন মিলন হয়রে দোহার
রসিক হলে জানা যায় রে স্থুল।

৮৩৯.
শম্ভু বিম্বু নাই রে সে ফুলে
মধুকর কেমনে খেলে,
পড়ো সহজ প্রেম স্কুলে
জ্ঞানের উদয় হলে যাবে ভুল।

৮৪০.
শোনিত শুক্র এরা দুইজন
সে ফুলে হইল সৃজন,
সিরাজ সাঁই বলে রে লালন
ফুলের ভ্রমর কে তা কর গে উল।

৮৪১.
যে জন বৃক্ষমূলে বসে আছে।
তার ফলের কি অভাব আছে।

৮৪২.
কল্পবৃক্ষে যে-জন বসে রয়
বাঞ্ছা করলে সে ফল হাতে পায়।

৮৪৩.
ভুবনজোড়া গাছের গোড়া
মূল শিকড় তলাতে আছে।

৮৪৪.
গাছের গোড়ে বসে যে রয়
চৌদ্দ ভুবন সে দেখতে পায়।

৮৪৫.
এ-কুল ও-কুল দু’কুল যায়
জনম হবে না পশুর মাঝে।

৮৪৬.
ডাল নাই তার পাতা আছে
তিন ডালে জগৎ জুড়েছে।

৮৪৭.
লালন বলে ভাবিস মিছে
ফুল ছাড়া ফল রয়েছে।

৮৪৮.
অমৃত মেঘের বারি
কথায় কি মেলে।
চাতক স্বভাব না হলে।

৮৪৯.
মেঘে কত দেয় গো ফাঁকি
তবু চাতক মেঘের ভুখী।

৮৫০.
অমনি মতে হলে আঁখি
তারে সাধক বলে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!