ভবঘুরেকথা
ফকির লালন

ফকির লালনের বাণী : সিদ্ধিদেশ

১.
সোনার মানুষ ভাসছে রসে।

২.
যে জেনেছে রসপান্তি
সেই দেখিতে পায় অনাসে।

৩.
তিনশো ষাট রসের নদী
বেগে ধায় ব্রহ্মাণ্ড ভেদি।

৪.
তার মাঝে রূপ নিরবধি
ঝলক দিচ্ছে এই মানুষে।

৫.
মাতাপিতার নাই ঠিকানা
অচিন দেশে বসতখানা।

৬.
আজগুবি তার আওনা-যাওনা
কারণবারির যোগ বিশেষে।

৭.
অমাবস্যায় চন্দ্র উদয়
দেখিতে যার বাসনা হৃদয়।

৮.
দমের উপর আসন ছিল তার,
আসমান জমিন না ছিল আকার।

৯.
বিম্বরূপে শূন্যকারে
ছিল তখন দমের পরে,
বিম্ব হতে ডিম্ব ঝরে
ছিল সাঁই নূরের ভিতর।

১০.
যখন ছিল বিন্দুমণি
ধরেছিল মা জননী,
ডিমে উসুম দিল শুনি
ধরে ব্রম্মার আকার।

১১.
ষোল খুঁটি একই আড়া
তিনশ ষাট রগের জোড়া,
নাভির নিচে হাওয়ার গোড়া
লালন কয় সাত সমুদ্দুর।

১২.
বিনা মেঘে বর্ষে বারি,
সুরসিক হলে মর্ম জানে তারি।

১৩.
মেঘ-মেঘিতে সৃষ্টির কারবার
তারাই সবে ইন্দ্ররাজার আজ্ঞাকারী।

১৪.
যেজন সুধাসিন্ধু পাশে
ইন্দ্ররাজার নয় সে অধিকারী।

১৫.
সুরসে নিরস ঝরে
সবাই কি তাই জানতে পারে
সাঁইয়ের কারিকুরি।

১৬.
যার একবিন্দু পরশে
এ জীব অনা’সে হয় অমরি।

১৭.
বারিতে হয় ব্রহ্মাণ্ডের জীবন
বারি হতে হয় জীবের পাপ বিমোচন হয় সবারি।

১৮.
দরবেশ সিরাজ কয় লালন
চিনে সেই মহাজন থাক নেহারি।

১৯.
আজব এক রসিক-নাগর
ভাসছে রসে,
হস্তপদ নাইকো রে তার
বেগে ধায় সে।

২০.
সেই রসের সরোবর
তিলে তিলে হয় সাঁতার,
উজান-ভেটেন কলকাঠি তার
ঘুরায় বসে।

২১.
ডুবলে রে দেল-দরিয়ায়
সে রসের লীলে জানা যায়,
মানবজনম সফল হয়
তার পরশে।

২২.
তার বামে কুলকুণ্ডলিনী
যোগমায়া যারে বলি।

২৩.
কী শোভা করেছে দ্বিদলময়,
সে মনোমোহিনী রূপ ঝলক দেয়।

২৪.
কি বা বলবো সে রূপের বাখানি লক্ষ লক্ষ চন্দ্র যিনি,
ফণি মনি সৌদামিনী সে রূপের তুলনা নয়।

২৫.
সহজ সুরসের গোড়া রসেতে ফল আছে ঘেরা,
কিরণ চলকে পারা দ্বিদলে ব্যাপিত হয়।

২৬.
সে রূপ জাগে যাঁর নয়নে কি করবে তাঁর বেদ সাধনে,
দ্বীনের অধীন লালন ভনে রসিক হলে জানা যায়।

২৭.
কি শোভা করেছেন সাঁই রংমহলে।
অজান রূপে দিচ্ছে ঝলক
দেখলে নয়ন যায় গো ভুলে।

২৮.
জলের মধ্যে কলের কোঠা
সপ্ততলা আয়না আঁটা,
তার ভিতরে রূপের ছটা
মেঘে যেমন বিজলী খেলে।

২৯.
লাল জরদ ছনি মণি
বের হয় যেন রূপ বাখানি,
দেখতে শোভা যেমন অগ্নি
তারার মালা চাঁদের গলে।

৩০.
গুরু রূপ যার বাঁধা হৃদয়
তবে সেরূপ চক্ষে উদয়।

৩১.
এড়াবে শমনেরও দায়
লালন ম’লো অবহেলে।

৩২.
অন্ধকারের আগে ছিলেন সাঁই রাগে
আলকারেতে ছিল আলের উপর।

৩৩.
ঝরেছিল একবিন্দু হইল গম্ভীর সিন্ধু
ভাসিল দীনবন্ধু নয় লাখ বছর।

৩৪.
অন্ধকার ধন্দকার নিরাকার কুওকার
তারপরে হল হুহুংকার।

৩৫.
হুহুংকারে সব্দ হল ফেনারূপ হইয়া গেল
নীর গম্ভীরে সাঁই ভাসলেন নিরন্তর।

৩৬.
হুহুংকারে ঝংকার মেরে দীপ্তকার হয় তারপরে
ধন্ধ ধরে ছিলেন পরওয়ার,
ছিলেন সাঁই রাগের পরে সুরাগে আশ্রয় করে
তখন কুদরতিতে করিল নিহার।

৩৭.
যখন কুওকারে কওঝরে বাম অন্ঘ ঘর্ষন করে
তাইতে হইল মেয়ের আকার।

৩৮.
মেয়ের রক্ত বিচে শক্ত হল ডিম্ব তুলে কোলে নিল
ফকির লালন বলে লিলা চমৎকার।

৩৯.
নৈরেকারে দুইজন নূরী ভাসছে সদাই।
ঝরার ঘাটে যোগান্তরে হচ্ছে উদয়।

৪০.
সদা সে নিরঞ্জন নীরে ভাসে।
যে জানে সে নীরের খবর
নীরঘাটায় খুঁজলে তারে পায় অনাসে।

৪১.
বিনা মেঘে নীর বরিষণ
করিতে হয় তার অন্বেষণ।

৪২.
যাতে হ’ল ডিম্বর গঠন
থাকিয়ে অবিম্বু শম্ভু বাসে।

৪৩.
যথা নীরের হয় উৎপত্তি
সেই আবেশে জন্মে শক্তি।

৪৪.
মিলন হ’ল উভয় রতি
ভাসলে যখন নৈরেকারে এসে।

৪৫.
নীরে নিরঞ্জন অবতার
নীরেতে সব করবে সংহার।

৪৬.
সিরাজ সাঁই তাই কয় বারে বার
দেখ রে লালন আত্মতত্বে বসে।

৪৭.
বলোরে সেই মনের মানুষ কোনজনা
মা করে পতি ভজনা মাওলা তাঁরে বলে মা।

৪৮.
কে বা আদ্য কেবা সাধ্য কার প্রেমেতে হয়ে বাধ্য
কে জানাল পরমতত্ত্ব বেদে নাই যাঁর ঠিকানা।

৪৯.
একেতে দুই হলো যখন ফুল ছাড়া হয় ফলের গঠন
আবার তারে করে মিলন সৃষ্টি করলেন সেইজনা।
৫০.
লা মোকামে সেই যে নূরি আদ্যমাতা নূর জহুরি
লালন বলে বিনয় করে আমার ভাগ্যে ঘটল না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!