-প্রবাল চক্রবর্তী
হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন পবিত্র গ্রন্থে বর্ণিত ত্রিদেবের অন্যতম ভগবান শ্রী বিষ্ণু। এঁর যে প্রতিমা বা চিত্র আমরা দেখে অভ্যস্ত, সেই মূর্তিটির ভিত্তিতেই এই বিশ্লেষণ। কোনও বিতর্ক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে যে এই লেখা নয়, তা সোচ্চারে ঘোষণা কেবলমাত্র এই কারণেই, যে দেবদেবীরাও আজকাল অসাধু, ভণ্ড, মূর্খ ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতির শিকার।
আমার মতে, ভগবান শ্রী বিষ্ণু গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক-
প্রথমত: তাঁর গাত্রবর্ণ কালো। ভারত তথা পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরও তাই। অতএব তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিভূ। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতাই তো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি!!
দ্বিতীয়ত: তাঁর চার হাতে (ঘড়ির কাঁটার গতি অনুযায়ী) চক্র, শঙ্খ, পদ্ম ও গদা। চক্র বা চাকা মানুষের প্রথম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (না, আগুন নয়, কারণ, আগুনকে মানুষ “আবিষ্কার” করেনি, পোষ মানিয়েছিল)। চক্র প্রগতির প্রতীক, শিল্পায়নের প্রতীক, প্রযুক্তির প্রতীক। আর এই চক্রের নামটিও চমৎকার, “সুদর্শন”, হ্যাঁ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রগতি তো সুদর্শন বটেই!!
ঊর্দ্ধ বাম হাতে শঙ্খ, যার নাম “পাঞ্চজন্য” অর্থাৎ পাঁচজনের মিলিত শব্দ। আজও বিভিন্ন সাধারণ (বা অসাধারণ) সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা ভাবি “পাঁচজন কী ভাববে” বা “পাঁচজনের মতামত নিই”, অর্থাৎ, এই “পাঁচজন” আসলে জনগণ, সংখ্যাটা এখানে নেহাতই বাগধারা!! জনমতের ভিত্তিতেই তো গঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার, গৃহীত হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
ভগবান শ্রী বিষ্ণুর বাম অধহস্তে পদ্ম। এই ফুলটি সৌন্দর্য্যে, সুগন্ধে এবং গঠনসৌকর্য্যে অনবদ্য। একটি বৃন্তে কী অপরূপ সৌন্দর্য্যে সাজানো থাকতে পারে বিবিধ মাপের পাঁপড়ি, তা পদ্মকে দেখে শেখা যায়। এই ফুলটি “বিবিধের মাঝে মিলনের” এক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত প্রতীক।
অধদক্ষিণহস্তে ভগবান ধারণ করেছেন গদা। অস্ত্রবিদ্যায় যুদ্ধোপকরণকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, অস্ত্র ও শস্ত্র (শাস্ত্র নয়)। অস্ত্র অর্থে ক্ষেপণীয় বস্তু যথা তীর, বর্শা বা চক্র, আর শস্ত্র মানে, যাকে হাতে রেখেই যুদ্ধ করতে হতো, যেমন তরোয়াল, কুঠার, গদা, বল্লম। শস্ত্রযুদ্ধ কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই, মূলত সম্মুখসমর!! আর সংসদ তৈরি হয়েছে কেন? যুক্তি, অপযুক্তি, পরাযুক্তি ও প্রতিযুক্তির “সম্মুখসমরের” জন্য নয় কী?
ভগবান শ্রী বিষ্ণুর “প্রতিমা” (মনে রাখতে হবে “প্রতিম” শব্দের অর্থ “মতন” … ভ্রাতৃপ্রতিম = ভাইয়ের মতন। আর এই প্রতিম শব্দেরই স্ত্রীলিঙ্গ প্রতিমা) কি গণতন্ত্রের প্রতিমা নয়?
এবারে আসি ভগবান শ্রী বিষ্ণুর দশটি অবতারের বর্ণনায়। তার আগে একটু মনে করিয়ে দিই ব্রিটিশ মহাবিজ্ঞানী স্যার চার্লস ডারউইন প্রণীত “বিবর্তন তত্ত্ব”। অতি সরলীকরণ করলে বলা যায়, ডারউইন সাহেব তাঁর তত্ত্বে বলেছেন, যে প্রাণের সৃষ্টি হয় পানির ভেতরে (সেই যুগে পৃথিবীতে স্থলভাগ অপেক্ষা জলভাগই ছিল বেশি), এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণীতে রূপান্তর, কয়েক সহস্র বছর ধরে এই পুরোটাই সংঘটিত হয় সমুদ্রের পানির ভিতরেই।
এরপরে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় উভচর প্রাণী, অর্থাৎ যারা পানি ও স্থলে বিশ্বাস করতে সমান স্বচ্ছন্দ। তারপরে আসে স্থলচর প্রাণীরা। অবশ্য প্রাথমিক স্থলচরদের অনেকেই আসলে বাস করতো জলা অঞ্চলে, অর্থাৎ পানির আকর্ষণ সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারে নি তারা। পরবর্তীতে এই স্থলচর প্রাণীদের একটি শাখা বিবর্তিত হয়ে মনুষ্যজাতির জন্ম হয়।
ভগবান শ্রী বিষ্ণুর প্রথম তিনটি অবতার লক্ষ্য করুন। মৎস্য, কুর্ম (কচ্ছপ) এবং বরাহ (শূকর)। মৎস্য জলচর, কচ্ছপ উভচর এবং শূকর স্থলচর (যদিও জলকাদার আকর্ষণ সে মোটেও কাটাতে পারে নি)। ডারউইনের থিওরির সঙ্গে আশ্চর্য মিল পাচ্ছেন কী?
ভাবতে থাকুন। চোখ রাখুন। পরবর্তী লেখায় আসছে নতুন কোনো বিশ্লেষণ। ততটা সময় পাশে থাকুন। অপেক্ষায় থাকুন।