-আবু ইসহাক হোসেন
মনোরঞ্জন গোঁসাই: বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ
তিনি তাঁর বক্তব্যকে স্পষ্ট করার জন্য একাডেমিক বাউল কর্তৃক প্রকৃত লালনপন্থী বাউল সাধকদের লাঠিপেটার কথা উল্লেখ করেছেন। আর এই সব ভেজাল বাউলদের হাত পড়ে লালন ফকিরের পদকেও অনেক সময় ভেজাল ভরানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
ভেজাল বাউল এবং নামধারী লালন পন্থীদের হাতে যখন লালন ফকিরের বাণীর বিকৃতি ঘটছে। তখন শুধু সাধনার ধারার অনুসারী বাউলগণ কোনো কোনো পণ্ডিতগণ এর প্রতিবাদ না করলেও শুদ্ধচারী মনোরঞ্জন গোঁসাই প্রতিবাদ করেছেন।
নোরঞ্জন গোঁসাই ভেবেছেন লালন ফকিরের বাণীর শুদ্ধতা নিয়ে। তিনি তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে উদাহরণ তুলে ধরে বোঝাতে চেয়েছেন। কিভাবে লালন ফকিরের বাণীকে সচেতনভাবে ভেজালের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘গানগুলি বিকৃত ও বিলুপ্তি হয়েছে সেই সঙ্গে বিকৃত হয়েছে মত-পথ আর বিনষ্ট হয়েছে সৌন্দর্য্য।’
তিনি লালন ফকিরের বাণীর বিকৃতির উদাহরণ তুলে ধরলেন-
সবলোকে কয় লালন ফকির হিন্দু না যবন
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।।
বিবিদের নাই মুসলমানি
পৈতা যার নাই সেওতো বাউনি,
বোঝরে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন ফকির তেমনি খতনার জাত একখান।।
তিনি এই গানটির বিকৃতির শনাক্তদের পাশাপাশি আসল পাঠও তুলে ধরেছেন-
বিবিদের নাই মুসলমানি
পৈতা নাই যার সেওতো বাউনি,
বোঝরে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন ফকির তেমনি জাতি একজন।।
এই বিকৃতি শনাক্ত করার পাশাপাশি তিনি মত দিয়েছেন যে লালন ফকিরের ভণিতায় গীত অনেক গানই লালন ফকিরের নয়। অর্থাৎ তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে যেটা বুঝিয়েছেন তা হলো- লালন ফকিরের গানে শব্দ প্রক্ষেপণ তো হয়েছেই।
পাশাপাশি অনেক ভেজাল গান লালন ফকিরের নামে গীত হচ্ছে। যা লালন ফকিরের পথ-মতকে ধোঁয়াশা করে তুলছে- সাধারণ ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে। তাই লালন ফকিরের পথ-মত, যা তাঁর গানের ভেতর দিয়ে প্রচারিত। সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে তাঁর মতে প্রথমেই লালন ফকিরের গানের শুদ্ধতার বিচার প্রয়োজন।
লালন ফকিরের ভেজাল পদের মতো আন্দাজী গবেষকগণের লেখনির মাধ্যমে বাউল পথ-মত ভক্ত-অনুসারীদের নিকট হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ। অদীক্ষিত বাউল গবেষকগণ- যাদেরও লালন সাঁইজি কানা (অন্ধ) বলে সম্বোধন করেছেন- তারা বাউল পথ-মত সম্পর্কে সত্য না জেনে, সত্য উদঘাটান না করে আন্দাজী শোনা কথার উপর নির্ভর করে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, তত্ত্ব না জানা গবেষকগণের ধারণা যে সঠিক নয়- তা প্রমাণ করার জন্য তিনি চারিচন্দ্র ভেদের সাধনা সম্পর্কেও সত্য-উদঘাটন করেছেন। তিনি লিখলেন, ‘আমি সেই চারিচন্দ্রের সাধন সঙ্গীতগুলোর কিছু কিছু অংশ উপস্থিত করে ঐ সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাগুলির অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছি।’
তার কারণে এই শুদ্ধাচারী পথ-মত হয়ে উঠেছে অনেকটাই কদাচারের প্রতিচ্ছায়া। মনোরঞ্জন গোঁসাই এর বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন- চেষ্টা করেছেন সত্যটাকে উদ্ঘাটন করতে। তাইতো আমরা দেখি তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বাউল গবেষণার প্রতিস্বিক ব্যক্তিত্ব জনাব অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বাউল পথ-মতের দেহতাত্ত্বিক সাধনা সম্পর্কে আন্দাজী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি দৃঢ়ভাবে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহোদয় তাঁর ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ গ্রন্থে চারি চন্দ্রের সাধন সম্পর্কে বলেছেন যে, মলমূত্র, রজবীর্য মিলন করে বাউল সাধকগণ পান করেন, এটাই নাকি চারিচন্দ্রের সাধনা। এটা শুধু ড ভট্টাচার্য মহোদয়ের একার কথা নয় প্রকৃত তত্ত্ব না জানা আরো অনেকের। এটা প্রকৃত লালনপন্থী বাউলগণের বেলায় অত্যন্ত আপত্তিকর।
শুধু তাই নয়, তত্ত্ব না জানা গবেষকগণের ধারণা যে সঠিক নয়- তা প্রমাণ করার জন্য তিনি চারিচন্দ্র ভেদের সাধনা সম্পর্কেও সত্য-উদঘাটন করেছেন। তিনি লিখলেন, ‘আমি সেই চারিচন্দ্রের সাধন সঙ্গীতগুলোর কিছু কিছু অংশ উপস্থিত করে ঐ সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাগুলির অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছি।’
তিনি চারিচন্দ্র ভেদ সম্পর্কিত পদগুলো প্রমাণিত ভাবে তুলে ধরে আলোচনা করে ভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করেছেন।
চেয়ে দেখ নারে মন দিব্য নজরে
চারি চাঁদে দিচ্ছে ঝলক মণিকোঠার ঘরে,
হলে সেই চাঁদের সাধন, অধর চাঁদ পায় দরশন
চাঁদেতে চাঁদের আসন, রেখেছে ঘিরে।।
তিনি উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলছেন, ‘এবারে লক্ষ করা যেতে পারে, মণিকোঠা আর চাঁদেতে চাঁদের আসন ঘিরে রেখেছে।’ তিনি আরো আগ বাড়িয়ে উদ্ধৃতির অবতারণা করছেন-
সেই মণি বাঁধা ঘাট, মাঝে মুকুন্দ কপাট।
চারিচন্দ্র শহরে ফেরে, মাঝখানে সে লাট।।
তিনি বলছেন, ‘এবারে সহজেই অনুমেয়, চারিচন্দ্রের ভেতরে (লাট) আরও একটা পৃথক সত্তা। তিনি বিষয়টাকে পরিষ্কার করার জন্য আবার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন-
চারিচন্দ্রে এক চন্দ্র ঢাকা রয়
ক্ষণেক ক্ষণেক পৃথক রূপ হয়,
সেই মণিকোঠার খবর যে পায়
সকল খবর সেই জানে।।
মনোরঞ্জন গোঁসাই উদ্ধৃতির ব্যাখ্যায় সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন, ‘এবারে সহজেই বোঝা যায়, যে, চারিচন্দ্রের সাধন সম্বন্ধে যা বলে লোক চক্ষে হেয় প্রতিপন্ন আর অপাঙক্তেয় করা হয় সেগুলো আদৌ সত্য নয়। তিনি তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে আরো একটা পদের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন-
সেই চন্দ্রপক্ষ কয়, নেত্র বেদ হয়
দ্বিগুণ করিরে ভেদ, জানলে জানা যায়
কর চৌগুণের গুণ, তাতে হয় স্তম্ভন।।
তিনি এই উদ্ধৃতির শেষে চারিচন্দ্রের সাধনা বিষয়ক সিদ্ধান্তে জানালেন যে, ‘চারিচন্দ্রের সাধনা প্রাকৃতিক নিয়মতান্ত্রিক আর গাণিতিক; এর ভেতরে কোনো প্রকার পৈশাচিকতা নেই।’
শুধু তাই নয় তিনি অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের চব্বিশ চন্দ্র সম্পর্কিত তত্ত্বের সমালোচনা করে বললেন, ‘ঐ গ্রন্থে ভট্টাচার্য মহোদয় সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের কথা বলেছেন, সাধন করা বলেন নি। হাতে পায়ের কুড়ি আঙ্গুলে কুড়ি চন্দ্র, চক্ষু-কর্ণ চারি চন্দ্র, আর নাভিমূল অর্ধ্ব চন্দ্র এই কথাগুলিও অগ্রহণযোগ্য।’
সত্য সন্ধানি মনোরঞ্জন গোঁসাই সত্যকে সত্যভাবেই ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সে চেষ্টা ছিল যুক্তি নির্ভর। যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে যে সত্যে পৌঁছা সম্ভব নয়- সেই দিব্যজ্ঞানও তাঁর ভেতর ছিল। তাই তিনি ভক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যুক্তি দিয়ে। কারণ যুক্তিহীন ভক্তি হচ্ছে কুসংস্কার।
নির্বিচারী মান্যতার ভেতর নানাভাবে নানা ফাঁক-ফোকর গলে অসত্য এবং স্থূলতা প্রবেশ করে সত্যকে করে তোলে কলুষিত। আর কলুষিত সত্যই সমাজ দেহে অনাচার সৃষ্টি করে, সমাজকে ভুল পথে চালিত করে। কিন্তু বস্তুবাদী, শুদ্ধাচারী সাধক মনোরঞ্জন গোঁসাই ছিলেন আপাদমস্তক সত্যানুসন্ধানি।
এর বিরুদ্ধে মনোরঞ্জন গোঁসাই ছাড়া তেমনভাবে প্রতিবাদ করতে আর কোনো বাউল সাধক বা বাউল গবেষককে দেখা যায়নি। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যে লালন ফকিরের অনুসারীরা মূলত গুরুবাদী। অর্থাৎ তাদের কাছে ‘গুরু বাক্য বলবান/আর সব বাহ্য জ্ঞান’। এবং আমার মনে হয় লালন ফকিরের মত-পথের মধ্যে বিকৃতি ঢুকে পড়ার একটি কারণ।
তাই যক্তিহীন নির্বিচারী ভক্তিবাদকে তিনি গ্রহণ করেন নি এবং তাকে শুদ্ধাচারী বাউল সাধনাকে ধ্বংসের অনুঘটক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই তাঁর আক্ষেপ, ‘বহু পূর্ব থেকে এই মত-পথকে রক্ষা করার চেয়ে ধ্বংস করার প্রচেষ্টাই বেশি।
কারণ মনে হয়, বোধের অসমর্থতাই, সাহিত্য দর্শনের মাপকাঠি, না হয় তাদের স্বভাব। আবার এটাও হতে পারে, বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সার্বিক বলে মনে করা। উর্বর মস্তিষ্ক আর শক্তিশালী কেন্দ্র যা বলে, মানুষ তাই বিশ্বাস করে, বিচার করে দেখে না।’
এই নির্বিচারী মান্যতাই বাউল দর্শন তথা লালন ফকিরের পথ-মতকে বিকৃতির পথে নিয়ে গেছে। আর এই বিকৃতিই এই নষ্ট সময়ে প্রাধান্য বিস্তার করে কদাচারে রূপ লাভ করেছে। যার ফলে নানা ধরনের অসামাজিক আচার এবং আচরণ এবং বাউল মত সমর্থক হয়ে গেছে।
এর বিরুদ্ধে মনোরঞ্জন গোঁসাই ছাড়া তেমনভাবে প্রতিবাদ করতে আর কোনো বাউল সাধক বা বাউল গবেষককে দেখা যায়নি। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যে লালন ফকিরের অনুসারীরা মূলত গুরুবাদী। অর্থাৎ তাদের কাছে ‘গুরু বাক্য বলবান/আর সব বাহ্য জ্ঞান’। এবং আমার মনে হয় লালন ফকিরের মত-পথের মধ্যে বিকৃতি ঢুকে পড়ার একটি কারণ।
গুরুবাক্যকে মানতে গিয়ে অনুসারীগণ গুরুর অজ্ঞতাকে ধারণ করছে- হয়ে উঠছে স্বেচ্ছাচারী। গুরুবাক্যকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করার কোনো ধরনের প্রথা বাউল অনুসারীদের মধ্যে নেই। আর সে কারণেই লালন ফকিরের বর্তমানবাদী পথ-মত অনুমান এবং আন্দাজী পথ-মতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে অনেকক্ষেত্রে, বস্তুবাদী বাউল হয়ে উঠেছে ভোগবাদী।
(চলবে…)
<<বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -এক ।। বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -তিন>>
……………..
আবু ইসহাক হোসেন: লালন গবেষক
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………………….
আরো পড়ুন:
ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই
আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই
মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
একজন লালন সাধকের কথা
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর দর্শন
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -এক
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -দুই
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -তিন
মনোরঞ্জন গোঁসাই: স্বরূপ সন্ধানী দার্শনিক
মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর জীবন দর্শন
আমার কাকা মনোরঞ্জন বসু