ভবঘুরেকথা
যখন ইউনুস নবীরে খাইলো মাছেতে গিলিয়া

-সুফি আহমেদ মাহফুজ

মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে এমন বিরাট আকারের মাছ সাগরে অহরহ পাওয়া যায়। কিন্তু মাছের পেটে গিয়ে বেঁচে থাকা তাও কয়েকদিন ধরে, এটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু কোরানে বলা আছে, ইউনুস নবীকে মাছ গিলে খেয়ে ফেলেছিল এবং তিনি সেখান থেকে দীর্ঘ সময় পরে জীবিত বের হয়ে আসেন।

কোনো হাস্যকর আর অবান্তর কথা কোরানে থাকার প্রশ্নই আসে না। কোরানে বর্ণিত ইউনুস নবীকে মাছে খেয়ে ফেলার ঘটনাটি আসলে কি বোঝাচ্ছে, তা জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে প্রাচীন শাস্ত্র আর বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির লালিত দেহতত্ত্বে মাছ বা মীন রূপকের মানে কি।

তবেই বোঝা যাবে ইউনুস নবীকে ঠিক কোন ধরনের মাছ গিলে খেয়েছিল। যেখানে তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে অবশেষে ইসমে আযমের উছিলায় উদ্ধার পেয়েছিলেন।

সেখানে কুম্ভক, পূরক ও রেচক প্রক্রিয়াতে তারা নিজের অভ্যন্তরের বাতাসকে পুনঃ ব্যবহারযোগ্য করে তোলে এবং নিয়মিত পানিতে বাতাসের বুদবুদ ছাড়তে থাকে। অর্থাৎ মীন বা মাছের মাধ্যমে জীবজগতে একটি নতুন মাইল ফলক যুক্ত হয়েছিল।

ধর্মগ্রন্থের এসব গল্পসমূহ পড়ার আগে জানা প্রয়োজন ধর্মগ্রন্থ সাহিত্যের কোন শ্রেণীতে পড়ে এবং সেই শ্রেণীর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য কি। অন্যথায় ধর্মগ্রন্থে আজগুবী বিষয় খুঁজে পাওয়া একদমই স্বাভাবিক ব্যাপার। ধর্মগ্রন্থ রূপক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।

রূপক সাহিত্য এমন ধরনের সাহিত্য যেখানে আলোচ্য বিষয়কে ভিন্ন কোনো বিষয়ের মাধ্যমে অবতারণা করা হয়। বাংলাতে ‘অরণ্যে রোদন’ বা ‘কুম্ভিরাশ্রু’ শব্দসমূহ এই ধরনের রূপকের উদাহরণ। কুম্ভিরাশ্রু মানে মানুষের কপট মানসিকতা। অথচ শব্দগতভাবে এর অর্থ কুমিরের কান্না।

যাইহোক, কথা বলছিলাম ইউনুস নবীকে কি ধরনের মাছ গিলে ফেলেছিল সে বিষয়ে। মাছের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মাছ বা মীন রূপকের ব্যবহার বহু প্রাচীন। গাণিতিক ভাবে অসীম প্রকাশ করতে যে ‘ইনফিনিটি’ চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাও মীনের দেহের আদলে অঙ্কিত।

গ্রীকদের লোকগাথা, মিশরীয় সভ্যতা, বেদ-উপনিষদ, বাইবেল এবং কোরানে এই মীন রূপকের প্রচুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বেদ অনুসারে বিষ্ণুর প্রথম অবতার মীন। কারণ জীবের জন্ম পানি হতে। স্থলচর জীবরাও এসেছে জলচর প্রাণী হতে।

এককোষী জলজ প্লাংটন থেকে স্থলে উঠে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল বাতাস বা দমের সর্বোচ্চ ব্যবহার। যেটা নিশ্চিত করেছে মীন প্রজাতি। মীনদের মধ্যে মৃগেল বা রুই প্রজাতির মাছকে লক্ষ্য করলে বিষয়টি বোঝা যায়। একবার দম নিয়ে এরা চলে যায় পানির গভীরতম স্তরে।

সেখানে কুম্ভক, পূরক ও রেচক প্রক্রিয়াতে তারা নিজের অভ্যন্তরের বাতাসকে পুনঃ ব্যবহারযোগ্য করে তোলে এবং নিয়মিত পানিতে বাতাসের বুদবুদ ছাড়তে থাকে। অর্থাৎ মীন বা মাছের মাধ্যমে জীবজগতে একটি নতুন মাইল ফলক যুক্ত হয়েছিল।

মীন বা মাছ যে প্রক্রিয়ায় বায়ুর মূল খুঁজে পেয়েছিল তদ্রূপ সাধকরাও একই উপায়ে মন মহাজনকে ধরার চেষ্টা করে। এ কারণে মীনকে জীবশক্তির রূপক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বায়ুর সাধনাকে মাছ মারা বলা হয়েছে।

ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত প্রতিটি গল্পের ভেতরে লুকানো থাকে একটি বার্তা। এটাকে আরবিতে তাওয়ীল বলে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মাছ সম্পর্কিত বেশ কিছু গল্প পাওয়া যায়। যেমন- বেদে আছে মনু ঋষির মাছের পিঠে চড়ার ঘটনা, গীতায় অর্জুনের মাছের চোখে তীর মারা, বাইবেলে ঈসা মাসিহের নিজেকে জেলে বলা, কোরানে মুসা নবীর মাছ হারিয়ে যাওয়া, ইসরায়েলিদের শনিবারে মাছ মারতে নিষেধ করা, ইউনুস নবীর মাছের পেটে চলে যাওয়া, ইত্যাদি।

আগেই বলেছি মাছ জীবজগতের বিবর্তনে কতটা ভূমিকা রেখেছিল সে বিষয়ে। এ পর্বে মীনের ধারার সাথে কামের যোগ বিষয়ে বলবো। মাছের মাধ্যমে কামের লতার বহুগুণ বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। একটা মাছ, মাত্র একবার মিলনে প্রতি মৌসুমে কয়েক লাখ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে।

ফলে মাছের সারভাইভাল চান্স বহুগুণে বেড়ে গিয়ে জীবজগতে কামের প্রকৃতি এবং ফলাফল বদলে অসীম সম্ভাবনাময় করে দিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল মীন প্রজাতির বায়ুর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার কারণে।

মীন বা মাছ যে প্রক্রিয়ায় বায়ুর মূল খুঁজে পেয়েছিল তদ্রূপ সাধকরাও একই উপায়ে মন মহাজনকে ধরার চেষ্টা করে। এ কারণে মীনকে জীবশক্তির রূপক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বায়ুর সাধনাকে মাছ মারা বলা হয়েছে।

মহাত্মা ফকির লালন বলেছেন-

কানাই বলাই ভালই ছিল
মীনের ধারা তারাই পেল।।

শিশ্নকে রূপকার্থে ‘বলাই’ বলা হয়। অর্থাৎ মীন রূপী মহাজন কামের ধারা বা নদীতে বিরাজ করে। কামের ধারা না থাকলে মীন থাকে না। এখান থেকে মীন ধরতে হয়।

বেদে বর্ণিত মনু ঋষি একটি মাছ পালতেন। মাছটিকে তিনি এতটা বড় করলেন যে মাছের উপর সওয়ার করে সাগর পার করতে পারতেন। অর্থাৎ মীন মনুর বশে ছিল। মনু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ মানুষ।

মুসা নবীও দুই সাগরের সঙ্গম স্থলে হারিয়ে যাওয়া মাছের মাধ্যমেই পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। দুই সাগর মানে জগতের দুই আদি শক্তি নারী ও নর। জগতের এই যুগল শক্তির সাধনাকে তন্ত্র বলা হয়। বর্তমান বাউল সাধনায় দেহতত্ত্বও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে।

কোরানের মাছ সম্পর্কিত আয়াতগুলো মূলত দেহতত্ত্বের রূপক হিসেবে এসেছে। যেমন- সূরা আনবিয়া, আয়াত ৮৭তে মাছে গিলে ফেলার ঘটনার বর্ণনা আছে। কিন্তু আয়াতটিতে ইউনুস নামটি নেই। যাকে গিলে ফেলার কথা বলা হচ্ছে তাকে বলা হয়েছে যুল-নুন/ধুল-নুন।

ইসমে আযম হচ্ছে সেই নাম যার উপর কারো সর্বোচ্চ এবং নিরঙ্কুশ আস্থা থাকে। সফল বা কামেল হওয়ার জন্য সেই আস্থাপূর্ণ নামের ওসিলা গ্রহণ করা জরুরী। মীনের পেটের আধাঁরকে জয় করা ফরজ।

ধুল-নুনের অর্থ হচ্ছে বড় বা বিশেষ মাছওয়ালা। আরবিতে সাধারণভাবে মাছকে হূত বলা হয়। কিন্তু নুন ব্যবহারের মাধ্যমে মাছটিকে বিশেষ করা হয়েছে। উক্ত ব্যক্তিকে জালিম বিশেষণ দেয়া হয়েছে। জালিম অর্থ ভুল কর্ম সম্পাদনকারী/অত্যাচারী। কোরানে বলা আছে নিশ্চয়ই মানুষ নিজের উপর জুলুম করে।

মাছ বা মীনের রূপক অর্থ জীবশক্তি যা কামের ধারাতে প্রবাহিত। শুধু জীবশক্তি বা শুধু কাম, কোনোটাই বলা যাবে না। কামের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ মীন ধরার কৌশল। সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয় দমের উপর দখল কায়েমের মাধ্যমে। এভাবে মীন বড় হয়, জীবশক্তি শিবশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

এমতাবস্থায় কোন সাধক সাধনা হতে বিচ্যুত হলে মীনরূপী কাম তাকে কর্তব্য হতে গাফেল করে দেয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় গাফেল বা অকৃতকার্য ব্যক্তি সর্বদা নিজের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। যা সে কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারে না যতক্ষণ না সে বুঝতে পারে যে সে নিজের উপর অত্যাচারকারী।

অনুধাবন সাপেক্ষে ইসমে আযম বা সবচেয়ে মহান নামের ওসিলায় গাফেল হওয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ইসমে মানে ‘নাম’ আর আযম শব্দের মাধ্যমে ‘খোদায়ী’ রূপকে বোঝানো হয়ে থাকে।

ইসমে আযম হচ্ছে সেই নাম যার উপর কারো সর্বোচ্চ এবং নিরঙ্কুশ আস্থা থাকে। সফল বা কামেল হওয়ার জন্য সেই আস্থাপূর্ণ নামের ওসিলা গ্রহণ করা জরুরী। মীনের পেটের আধাঁরকে জয় করা ফরজ।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

4 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Israt Zerin , রবিবার ১৯ জুলাই ২০২০ @ ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

    কথায় বলে লোকে যা খুঁজে তারই নাকি খোঁজ পায়। স্ক্রল করতে করতে আপনার এই লেখা পড়াটা অনেকটা তেমন। বেশ রিসোর্সফুল। আমি বাকি লেখাগুলিও নিশ্চই পড়বো। মাইথোলজির উপর আমার সবসময়ই একটা টান। আপনার এই লেখা আমার জানার কিছু আবছা বিষয়গুলো দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দিলো। বাকিটা যা রইলো আরেকটু ঘেঁটে জেনে নিবো। কিন্তু একটা ধন্যবাদ না দিয়ে যাই কি করে। ধন্যবাদ। 🙂

    • ভবঘুরে , রবিবার ১৯ জুলাই ২০২০ @ ১:৪৭ অপরাহ্ণ

      আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ…
      ভবঘুরেকথা পড়বেন… জানাবেন…

  • Jahid Uddin Ahmed , শনিবার ১০ জুলাই ২০২১ @ ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

    এইসব বললে তো পকেটে পয়সা আসা বন্ধ হয়ে যাবে, তাই মাছ খেয়েছে বলতে তারা মাছই খেয়েছে ছাড়া অন্যকিছু বোঝায় না। অথবা এসব তত্ত্ব সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নেই তাই গাঁজাখুরি গল্প বলে পার পেয়ে যায়।

  • Anwar KAISAR , শনিবার ১০ জুলাই ২০২১ @ ১১:৪৭ অপরাহ্ণ

    ভালো লাগছে। আরো চাই।❤️❤️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!