১৮৮৫, ২৫শে ফেব্রুয়ারি
শ্রীরামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে – বৃষকেতু অভিনয়দর্শনে, নরেন্দ্র প্রভৃতি সঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বৃষকেতু অভিনয়দর্শন করিবেন। বিডন স্ট্রীটে যেখানে পরে মনোমোহন থিয়েটার হয়, পূর্বে সেই মঞ্চে স্টার-থিয়েটার আভিনয় হইত। থিয়েটারে আসিয়া বক্সে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়াছেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – নরেন্দ্র এসেছে?
মাস্টার – আজ্ঞে হাঁ।
অভিনয় হইতেছে। কর্ণ ও পদ্মাবতী করাত দুইদিকে দুইজন ধরিয়া বৃষকেতুকে বলিদান করিলেন। পদ্মাবতী কাঁদিতে কাঁদিতে মাংস রন্ধন করিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অতিথি আনন্দ করিতে করিতে কর্ণকে বলিতেছেন, এইবার এস, আমরা একসঙ্গে বসে রান্না মাংস খাই। অভিনয়ে কর্ণ বলিতেছেন, তা আমি পারব না; পুত্রের মাংস খেতে পারব না।
একজন ভক্ত সহানুভূতি-ব্যঞ্জক অস্ফুট আর্তনাদ করিলেন। ঠাকুরও সেই সঙ্গে দুঃখপ্রকাশ করিলেন।
অভিনয় সমাপ্ত হইলে ঠাকুর রঙ্গমঞ্চের বিশ্রাম ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। গিরিশ, নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা বসিয়া আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে প্রবেশ করিয়া নরেন্দ্রের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন ও বলিলেন, আমি এসেছি।
[Concert বা সানাইয়ের শব্দে ভাবাবিষ্ট ]
ঠাকুর উপবেশন করিয়াছেন। এখনও ঐকতান বাদ্যের (কনসার্ট) শব্দ শুনা যাইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – এই বাজনা শুনে আমার আনন্দ হচ্ছে। সেখানে (দক্ষিণেশ্বরে) সানাই বাজত, আমি ভাবিবিষ্ট হয়ে যেতাম; একজন সাধু আমার অবস্থা দেখে বলত, এ-সব ব্রহ্মজ্ঞানের লক্ষণ।
[গিরিশ ও “আমি আমার” ]
কনসার্ট থামিয়া গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) – এ কি তোমার থিয়েটার, না তোমাদের?
গিরিশ – আজ্ঞা আমাদের।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আমাদের কথাটিই ভাল; আমার বলা ভাল নয়! কেউ কেউ বলে আমি নিজেই এসেছি; এ-সব হীনবুদ্ধি অহংকারে লোকে বলে।
[শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্র প্রভৃতি সঙ্গে ]
নরেন্দ্র – সবই থিয়েটার।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ হাঁ ঠিক। তবে কোথাও বিদ্যার খেলা, কোথাও অবিদ্যার খেলা।
নরেন্দ্র – সবই বিদ্যার।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ হাঁ; তবে উটি ব্রহ্মজ্ঞানে হয়। ভক্তি-ভক্তের পক্ষে দুইই আছে; বিদ্যা মায়া, অবিদ্যা মায়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুই একটু গান গা।
নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন:
চিদানন্দ সিন্ধুনীর প্রেমানন্দের লহরী।
মহাভাব রাসলীলা কি মাধুরী মরি মরি।
বিবিধ বিলাস রঙ্গ প্রসঙ্গ, কত অভিনব ভাবতরঙ্গ,
ডুবিছে উঠিছে করিছে রঙ্গ নবীন রূপ ধরি।
(হরি হরি বলে)
মহাযোগে সমুদায় একাকার হইল,
দেশ-কাল, ব্যবধান, ভেদাভেদ ঘুচিল (আশা পুরিল রে, –
আমার সকল সাধ মিটে গেল)
এখন আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া
বল রে মন হরি হরি।
নরেন্দ্র যখন গাহিতেছেন, ‘মহাযোগে সব একাকার হইল’ তখন শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, এটি ব্রহ্মজ্ঞানে হয়; তুই যা বলছিলি, সবই বিদ্যা।
নরেন্দ্র যখন গাহিতেছেন, “আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া বল রে মন হরি হরি,” তখন শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, ওইটি দুবার করে বল্।
গান হইয়া গেলে আবার ভক্তসঙ্গে কথা হইতেছে।
গিরিশ – দেবেন্দ্রবাবু আসেন নাই; তিনি অভিমান করে বললেন, আমাদের ভিতরে তো ক্ষীরের পোর নাই; কলায়ের পোর। আমরা এসে কি করব?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিস্মিত হইয়া) – কই, আগে তো উনি ওরকম করতেন না?
ঠাকুর জলসেবা করিতেছেন, নরেন্দ্রকেও খাইতে দিলেন।
যতীন দেব (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি – “নরেন্দ্র খাও” “নরেন্দ্র খাও” বলছেন, আমরা শালারা ভেসে এসেছি!
যতীনকে ঠাকুর খুব ভালবাসেন। তিনি দক্ষিণেশ্বরে গিয়া মাঝে মাঝে দর্শন করেন; কখন কখন রাত্রেও সেখানে গিয়া থাকেন। তিনি শোভাবাজারের রাজাদের বাড়ির (রাধাকান্ত দেবের বাড়ির) ছেলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি, সহাস্যে) – ওরে (যতীন) তোর কথাই বলছে।
ঠাকুর হাসিতে হাসিতে যতীনের থুঁতি ধরে আদর করিতে করিতে বলিলেন, “সেখানে যাস, গিয়ে খাস!” অর্থাৎ “দক্ষিণেশ্বরে যাস।” ঠাকুর আবার বিবাহ-বিভ্রাট অভিনয় শুনবেন; বক্সে গিয়ে বসিলেন। ঝির কথাবার্তা শুনে হাসিতে লাগিলেন।
[গিরিশের অবতারবাদ – শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? ]
খানিকক্ষণ শুনিয়া অন্যমনস্ক হইলেন। মাস্টারের সহিত আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আচ্ছা, গিরিশ ঘোষ যা বলছে (অর্থাৎ অবতার) তা কি সত্য?
মাস্টার – আজ্ঞা ঠিক কথা; তা না হলে সবার মনে লাগছে কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখ, এখন একটি অবস্থা আসছে; আগেকার অবস্থা উলটে গেছে। ধাতুর দ্রব্য ছুঁতে পারছি না।
মাস্টার অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – এই যে নূতন অবস্থা, এর একটি খুব গুহ্য মানে আছে।
ঠাকুর ধাতু স্পর্শ করিতে পারিতেছেন না। অবতার বুঝি মায়ার ঐশ্বর্য কিছুই ভোগ করেন না, তাই কি ঠাকুর এই সব কথা বলিতেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আচ্ছা, আমার অবস্থা কিছু বদলাচ্ছে দেখছ?
মাস্টার – আজ্ঞা, কই?
শ্রীরামকৃষ্ণ – কার্যে?
মাস্টার – এখন কাজ বাড়ছে – যত লোক জানতে পারছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখছ! আগে যা বলতুম এখন ফলছে?
ঠাকুর কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলছেন, “আচ্ছা, পল্টুর ভাল ধ্যান হয় না কেন?”
[গিরিশ কি রসুন গোলা বাটি? The Lord’s message of hope for so-called ‘Sinners’ ]
এইবার ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বর যাইবার উদ্যোগ হইতেছে।
ঠাকুর কোন ভক্তের কাছে গিরিশের সম্বন্ধে বলেছিলেন, “রসুন গোলা বাটি হাজার ধোও রসুনের গন্ধ কি একেবারে যায়?” গিরিশও তাই মনে মনে অভিমান করিয়াছেন; যাইবার সময় গিরিশ ঠাকুরকে কিছু নিবেদন করিতেছেন।
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – রসুনের গন্ধ কি যাবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – যাবে।
গিরিশ – তবে বললেন ‘যাবে’?
শ্রীরামকৃষ্ণ – অত আগুন জ্বললে গন্ধ-ফন্ধ পালিয়ে যায়। রসুনের বাটি পুড়িয়ে নিলে আর গন্ধ থাকে না, নূতন হাঁড়ি হয়ে যায়।
“যে বলে আমার হবে না, তার হয় না। মুক্ত-অভিমানী মুক্তই হয়, আর বদ্ধ-অভিমানী বদ্ধই হয়। যে জোর করে বলে আমি মুক্ত হয়েছি, সে মুক্তই হয়। যে রাতদিন ‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ বলে, সে বদ্ধই হয়ে যায়।”