কাশীপুর বাগানে ভক্তসঙ্গে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
১৮৮৫, ২৩শে ডিসেম্বর
কাশীপুর উদ্যানে নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে
কৃপাসিন্ধু শ্রীরামকৃষ্ণ – মাস্টার, নিরঞ্জন, ভবনাথ
শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরে বাস করিতেছেন। এত অসুখ – কিন্তু এক চিন্তা – কিসে ভক্তদের মঙ্গল হয়। নিশিদিন কোন না কোন ভক্তের বিষয় চিন্তা করিতেছেন।
শুক্রবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২৭শে অগ্রহায়ণ, শুক্লা পঞ্চমীতে শ্যামপুকুর হইতে ঠাকুর কাশীপুরের বাগানে আইসেন। আজ বারো দিন হইল। ছোকরা ভক্তেরা ক্রমে কাশীপুরে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছেন – ঠাকুরের সেবার জন্য। এখনও বাটী অনেকে যাতায়াত করেন। গৃহী ভক্তেরা প্রায় প্রত্যহ দেখিয়া যান – মধ্যে মধ্যে রাত্রেও থাকেন।
ভক্তেরা প্রায় সকলেই জুটিয়াছেন। ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভক্ত সমাগম হইতেছে। শেষের ভক্তেরা সকলেই আসিয়া পড়িয়াছেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের শেষাশেষি শশী ও শরৎ ঠাকুরকে দর্শন করেন, কলেজের পরীক্ষাদির পর, ১৮৮৫-র মাঝামাঝি হইতে তাঁহারা সর্বদা যাতায়াত করেন। ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে স্টার থিয়েটারে শ্রীযুক্ত গিরিশ (ঘোষ) ঠাকুরকে দর্শন করেন। তিনমাস পরে অর্থাৎ ডিসেম্বরের প্রারম্ভ হইতে তিনি সর্বদা যাতায়াত করেন। ১৮৮৪, ডিসেম্বরের শেষে সারদা ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে দর্শন করেন। সুবোধ ও ক্ষীরোদ ১৮৮৫-র অগস্ট মাসে ঠাকুরকে প্রথম দর্শন করেন।
আজ সকালে প্রেমের ছড়াছড়ি। নিরঞ্জনকে বলছেন, “তুই আমার বাপ, তোর কোলে বসব।” কালীপদর বক্ষ স্পর্শ করিয়া বলিতেছেন, “চৈতন্য হও!” আর চিবুক ধরিয়া তাহাকে আদর করিতেছেন; আর বলিতেছেন, “যে আন্তরিক ঈশ্বরকে ডেকেছে বা সন্ধ্যা-আহ্নিক করেছে, তার এখানে আসতেই হবে।” আজ সকালে দুইটি ভক্ত স্ত্রীলোকের উপরও কৃপা করিয়াছেন। সমাধিস্থ হইয়া তাহাদের বক্ষে চরণ দ্বারা স্পর্শ করিয়াছেন। তাঁহারা অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন; একজন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “আপনার এত দয়া!” প্রেমের ছড়াছড়ি! সিঁথির গোপালকে কৃপা করিবেন বলিয়া বলিতেছেন, “গোপালকে ডেকে আন।”
আজ বুধবার, ৯ই পৌষ, অগ্রহায়ণের কৃষ্ণা দ্বিতীয়া, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৮৮৫। সন্ধ্যা হইয়াছে। ঠাকুর জগন্মাতার চিন্তা করিতেছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর অতি মৃদুস্বরে দু-একটি ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন। ঘরে কালী, চুনিলাল, মাস্টার, নবগোপাল, শশী, নিরঞ্জন প্রভৃতি ভক্তেরা আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – একটি টুল কিনে আনবে – এখানকার জন্য। কত নেবে?
মাস্টার – আজ্ঞা, দু-তিন টাকার মধ্যে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – জলপিড়ি যদি বার আনা, ওর দাম অত হবে কেন?
মাস্টার – বেশি হবে না, – ওরই মধ্যে হয়ে যাবে!
শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা, কাল আবার বৃহস্পতিবারের বারবেলা, – তুমি তিনটের আগে আসতে পারবে না?
মাস্টার – যে আজ্ঞা, আসব।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি অবতার? অসুখের গুহ্য উদ্দেশ্য ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আচ্ছা, এ-অসুখটা কদ্দিনে সারবে?
মাস্টার – একটু বেশি হয়েছে – দিন নেবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কত দিন?
মাস্টার – পাঁচ-ছ’ মাস হতে পারে।
এই কথায় ঠাকুর বালকের ন্যায় অধৈর্য হইলেন। আর বলিতেছেন – “বল কি?”
মাস্টার – আজ্ঞা, সব সারতে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাই বল। – আচ্ছা, এত ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন, ভাব, সমাধি! – তবে এমন ব্যামো কেন?
মাস্টার – আজ্ঞা, খুব কষ্ট হচ্ছে বটে; কিন্তু উদ্দেশ্য আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কি উদ্দেশ্য?
মাস্টার – আপনার অবস্থা পরিবর্তন হবে – নিরাকারের দিকে ঝোঁক হচ্ছে। – ‘বিদ্যার আমি’ পর্যন্ত থাকছে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, লোকশিক্ষা বন্ধ হচ্ছে – আর বলতে পারি না। সব রামময় দেকছি। – এক-একবার মনে হয়, কাকে আর বলব! দেখো না, – এই বাড়ি-ভাড়া হয়েছে বলে কত রকম ভক্ত আসছে।>
“কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন বা শশদরের মতো সাইন্বোর্ড তো হবে না, – আমুক সময় লেকচার হইবে!” (ঠাকুরের ও মাস্টারের হাস্য)
মাস্টার – আর একটি উদ্দেশ্য, লোক বাছা। পাঁচ বছরের তপস্যা করে যা না হত, এই কয়দিনে ভক্তদের তা হয়েছে। সাধনা, প্রেম, ভক্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, তা হল বটে! এই নিরঞ্জন বাড়ি গিছলো। (নিরঞ্জনের প্রতি) তুই বল দেখি, কিরকম বোধ হয়?
নিরঞ্জন – আজ্ঞে, আগে ভালবাসা ছিল বটে, – কিন্তু এখন ছেড়ে থাকতে পারবার জো নাই।
মাস্টার – আমি একদিন দেখেছিলাম, এরা কত বড়লোক!
শ্রীরামকৃষ্ণ – কোথায়?
মাস্টার – আজ্ঞা, একপাশে দাঁড়িয়ে শ্যামপুকুরের বাড়িতে দেখেছিলাম। বোধ হল, এরা এক-একজন কত বিঘ্ন-বাধা ঠেলে ওখানে এসে বসে রয়েছে – সেবার জন্য।
[সমাধিমন্দিরে – আশ্চর্য অবস্থা – নিরাকার – অন্তরঙ্গ নির্বাচন ]
এই কথা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। সমাধিস্থ!
ভাবের উপশম হইলে মাস্টারকে বলিতেছেন – “দেখলাম, সাকার থেকে সব নিরাকারে যাচ্ছে! আর কথা বলতে ইচ্ছা যাচ্ছে কিন্তু পারছি না।
“আচ্ছা, ওই নিরাকারে ঝোঁক, – ওটা কেবল লয় হবার জন্য; না?”
মাস্টার (অবাক্ হইয়া) – আজ্ঞা, তাই হবে!
শ্রীরামকৃষ্ণ – এখনও দেখছি নিরাকার অখণ্ডসচ্চিদানন্দ এইরকম করে রয়েছে। …… কিন্তু চাপলাম খুব কষ্টে।
“লোক বাছা যা বলছ তা ঠিক। এই অসুখ হওয়াতে কে অন্তরঙ্গ, কে বহিরঙ্গ, বোঝা যাচ্ছে। যারা সংসার ছেড়ে এখানে আছে, তারা অন্তরঙ্গ। আর যারা একবার এসে ‘কেমন আছেন মশাই’, জিজ্ঞাসা করে, তারা বহিরঙ্গ।
“ভবনাথকে দেখলে না? শ্যামপুকুরে বরটি সেজে এলো। জিজ্ঞাসা করলে ‘কেমন আছেন?’ তারপর আর দেখা নাই। নরেন্দ্রের খাতিরে ওইরকম তাকে করি, কিন্তু মন নাই।”