১৮৮৬, ২২শে এপ্রিল
শ্রীরামকৃষ্ণ হীরানন্দ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানে
[ঠাকুরের উপদেশ – “যো কুছ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়” – নরেন্দ্র ও হীরানন্দের চরিত্র ]
কাশীপুরের বাগান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপরের হলঘরে বসিয়া আছেন। সম্মুখে হীরানন্দ, মাস্টার, আরও দু-একটি ভক্ত, আর হীরানন্দের সঙ্গে দুইজন বন্ধু আসিয়াছেন। হীরানন্দ সিন্ধুদেশনবাসী। কলিকাতার কলেজে পড়াশুনা করিয়া দেশে ফিরিয়া গিয়া সেখানে এতদিন ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখ হইয়াছে শুনিয়া তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছেন। সিন্ধুদেশ কলিকাতা হইতে প্রায় এগার শত ক্রোশ হইবে। হীরানন্দকে দেখিবার জন্য ঠাকুর ব্যস্ত হইয়াছিলেন।
ঠাকুর হীরানন্দের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মাস্টারকে ইঙ্গিত করিলেন, – যেন বলিতেছেন, ছোকরাটি খুব ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আলাপ আছে?
মাস্টার – আজ্ঞে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দ ও মাস্টারের প্রতি) – তোমরা একটু কথা কও, আমি শুনি।
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নরেন্দ্র আছে? তাকে ডেকে আন।”
নরেন্দ্র উপরে আসিলেন ও ঠাকুরের কাছে বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্র ও হীরানন্দকে) – একটু দুজনে কথা কও।
হীরানন্দ চুপ করিয়া আছেন। অনেক ইতস্তত করিয়া তিনি কথা আরম্ভ করিলেন।
হীরানন্দ (নরেন্দ্রের প্রতি) – আচ্ছা, ভক্তের দুঃখ কেন?
হীরানন্দর কথাগুলি যেন মধুর ন্যায় মিষ্ট। কথাগুলি যাঁহারা শুনিলেন তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন যে, এঁর হৃদয় প্রেমপূর্ণ।
নরেন্দ্র – The scheme of the universe is devilish! I could have created a beter world! (এ জগতের বন্দোবস্ত দেখে বোধ হয় যে, শয়তানে করেছে, আমি এর চেয়ে ভাল জগৎ সৃষ্টি করতে পারতাম।)
হীরানন্দ – দুঃখ না থাকলে কি সুখ বোধ হয়?
নরেন্দ্র – I am giving no scheme of the universe but simply my opinion of the present scheme. (জগৎ কি উপাদানে সৃষ্টি করতে হবে, আমি তা বলছি না। আমি বলছি – যে বন্দোবস্ত সামনে দেখছি, সে বন্দোবস্ত ভাল নয়।)
“তবে একটা বিশ্বাস করলে সব চুকে যায়। Our only refuge is in pantheism: সবই ঈশ্বর, – এই বিশ্বাস হলেই চুকে যায়! আমিই সব করছি।”
হীরানন্দ – ও-কথা বলা সোজা।
নরেন্দ্র নির্বাণষট্কম্ সুর করিয়া বলিতেছেন:
ওঁ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।। ১
ন চ প্রাণসংজ্ঞো ন বৈ পঞ্চবায়ুর্ন বা সপ্তধাতুর্ন বা পঞ্চকোষাঃ।
না বাক্পাণিপাদং ন চোপস্থপায়ুশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।। ২
ন মে দ্বেষরাগৌ ন মে লাভমোহৌ মদো নৈব মে নৈব মাৎসর্যভাবঃ।
ন ধর্মো ন চার্থো ন কামো ন মোক্ষশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।। ৩
ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা চিদানন্দরূপং শিবোঽহং শিবোঽহম্।। ৪
ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ন মে জাতিভেদঃ পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম।
ন বন্ধুর্নমিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্যশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।। ৫
অহং নির্বিকল্পো নিরাকাররূপো বিভুত্বা সর্বত্র সর্বেন্দ্রিয়াণাম্।
ন চাসঙ্গতং নৈব মুক্তির্নমেয়শ্চিদানন্দরূপং শিবোঽহং শিবোঽহম্।। ৬
হীরানন্দ – বেশ।
ঠাকুর হীরানন্দকে ইশারা করিলেন, ইহার জবাব দাও।
হীরানন্দ – এককোণ থেকে ঘর দেখাও যা, ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘর দেখাও তা। হে ঈশ্বর! আমি তোমার দাস – তাতেও ঈশ্বরানুভব হয়, আর সেই আমি, সোঽহম্ – তাতেও ঈশ্বরানুভব। একটি দ্বার দিয়েও ঘরে যাওয়া যায়, আর নানা দ্বার দিয়েও ঘরে যাওয়া যায়।
সকলে চুপ করিয়া আছেন। হীরানন্দ নরেন্দ্রকে বলিলেন, একটু গান বলুন।
নরেন্দ্র সুর করিয়া কৌপীনপঞ্চকম্ গাইতেছেন:
বেদান্তবাক্যেষু সদা রমন্তো, ভিক্ষান্নমাত্রেণ চ তুষ্টিমন্তঃ।
অশোকমন্তঃকরণে চরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ১
মূলং তরোঃ কেবলমাশ্রয়ন্তঃ, পাণিদ্বয়ং ভোক্তুমামন্ত্রয়ন্তঃ।
কন্থামিব শ্রীমপি কুৎসয়ন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ২
স্বানন্দভাবে পরিতুষ্টিমন্তঃ, সুশান্তসর্বেনিদ্রয়বৃত্তিমন্তঃ।
অহনির্শ ব্রহ্মণি যে রমন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ৩
ঠাকুর যেই শুনিলেন – অহনির্শ ব্রহ্মণি যে রমন্তঃ – অমনি আস্তে আস্তে বলিতেছেন, আহা! আর ইশারা করিয়া দেখাইতেছেন, “এইটি যোগীর লক্ষণ।”
নরেন্দ্র কৌপীনপঞ্চকম্ শেষ করিতেছেন:
দেহাদিভাবং পরিবর্তয়ন্তঃ, স্বাত্মানমাত্মন্যবলোকয়ন্তঃ।
নান্তং ন মধ্যং ন বহিঃ সমরন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ৪
ব্রহ্মাক্ষরং পাবনমুচ্চরন্তো, ব্রহ্মাহমস্মীতি বিভাবয়ন্তঃ
ভিক্ষাশিনো দিক্ষু পরিভ্রমন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ ৷৷ ৫
নরেন্দ্র আবার গাইতেছেন:
পরিপূর্ণমানন্দম্।
অঙ্গ বিহীনং স্মর জগন্নিধানম্।
শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্বাচোঽবাচং।
বাগতীতং প্রাণস্য প্রাণং পরং বরেণ্যম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – আর ওইটে “যো কুছ্ হ্যায় সব্ তুঁহি হ্যায়!”
নরেন্দ্র ওই গানটি গাইতেছেন:
তুঝ্সে হাম্নে দিলকো লাগায়া, যো কুছ্ হ্যায় সব্ তুঁহি হ্যায়!।
এক তুঝ্কো আপ্না পায়া, যো কুছ হ্যায় সব্ তুঁহি হ্যায়।
দিল্কা মকাঁ সব্কী মকী তু, কৌন্সা দিল্ হ্যায় জিস্মে নহি তুঁ,
হরিয়েক্ দিল্মে তুনে সমায়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
কেয়া মলায়েক্ কেয়া ইন্সান্, কেয়া হিন্দু কেয়া মুসলমান্,
জায়্সা চাহা তুনে বানায়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
কাবা মে কেয়া অওর্ দায়ের্ মে কেয়া, তেরী পারাস্তিস্ হায়গী সাব জাঁ,
আগে তেরে সির সভোঁনে ঝুকায়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
আর্স্ সে লে ফার্স জমী তাক্। আওর জমীন সে আর্স্ বারী তক্,
যাহাঁ মায় দেখা তুহি নজর মে আয়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
সোচা সম্ঝা দেখা ভালা, তু জায়সা না কোই ঢুঁড়্ নিকালা,
আব ইয়ে সমঝ্ মে জাফার কী আয়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়।
“হরিয়েক্ দিল্মে” এই কথাগুলি শুনিয়া ঠাকুর ইশারা করিয়া বলিতেছেন যে, তিনি প্রত্যেকের হৃদয়ে আছেন, তিনি অন্তর্যামী। “যাঁহা মায় দেখা তুহি নজর মে আয়া, যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়!” হীরানন্দ এইটি শুনিয়া নরেন্দ্রকে বলিতেছেন, – সব্ তুঁহি হ্যায়; এখন তুঁহুঁ তুঁহুঁ। আমি নয়; তুমি!
নরেন্দ্র – Give me one and I will give you a million (আমি যদি এক পাই, তাহলে নিযুত কোটি এ-সব আনায়াসে করতে পারি – অর্থাৎ ১-এর পর শূন্য বসাইয়া।) তুমিও আমি, আমিও তুমি, আমি বই আর কিছু নাই।
এই বলিয়া নরেন্দ্র অষ্টাবক্রসংহিতা হইতে কতকগুলি শ্লোক আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আবার সকলে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হীরানন্দের প্রতি, নরেন্দ্রকে দেখাইয়া) – যেন খাপখোলা তরোয়াল নিয়ে বেড়াচ্চে।
(মাস্টারের প্রতি, হীরানন্দকে দেখাইয়া) – “কি শান্ত! রোজার কাছে জাতসাপ যেমন ফণা ধরে চুপ করে থাকে!’