১৮৮৫, ১৪ই জুলাই
পূর্বকথা – ৺কাশীধামে শিব ও সোনার অন্নপূর্ণাদর্শন -অদ্য ব্রহ্মাণ্ডকে শালগ্রাম রূপে দর্শন
বেলা দশটা বাজিয়াছে। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে কথা কহিতেছেন। মাস্টার গঙ্গাস্নান করিয়া আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন ও কাছে বসিলেন।
ঠাকুর ভাবে পূর্ণ হইয়া কত কথাই বলিতেছেন। মাঝে মাঝে অতি গুহ্য দর্শনকথা একটু একটু বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সেজোবাবুর সঙ্গে যখন কাশী গিয়েছিলাম, মণিকর্ণিকার ঘাটের কাছ দিয়ে আমাদের নৌকা যাচ্ছিল। হঠাৎ শিবদর্শন। আমি নৌকার ধারে এসে দাঁড়িয়ে সমাধিস্থ। মাঝিরা হৃদেকে বলতে লাগল – ‘ধর! ধর!’ পাছে পড়ে যাই। যেন জগতের যত গম্ভীর নিয়ে সেই ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে তারপর কাছে আসতে দেখলাম, তারপর আমার ভিতরে মিলিয়ে গেলেন!
“ভাবে দেখলাম, সন্ন্যাসী হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। একটি ঠাকুরবাড়িতে ঢুকলাম – সোনার অন্নপূর্ণাদর্শন হল!
“তিনিই এই সব হয়েছেন, – কোন কোন জিনিসে বেশি প্রকাশ।
(মাস্টারাদির প্রতি) – “শালগ্রাম তোমরা বুঝি মান না – ইংলিশম্যানরা মানে না। তা তোমরা মানো আর নাই মানো। সুলক্ষণ শালগ্রাম, – বেশ চক্র থাকবে, – গোমুখী। আর সব লক্ষণ থাকবে – তাহলে ভগবানের পূজা হয়।”
মাস্টার – আজ্ঞা, সুলক্ষণযুক্ত মানুষের ভিতর যেমন ঈশ্বরের বেশি প্রকাশ।
শ্রীরামকৃষ্ণ – নরেন্দ্র আগে মনের ভুল বলত, এখন সব মানছে।
ঈশ্বরদর্শনের কথা বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবাবস্থা হইয়াছে। ভাব-সমাধিস্থ। ভক্তেরা একদৃষ্টে চুপ করিয়া দেখিতেছেন। অনেকক্ষণ পরে ভাব সম্বরণ করিলেন ও কথা কহিতে লাগিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – কি দেখছিলাম। ব্রহ্মাণ্ড একটি শালগ্রাম। – তার ভিতর তোমার দুটো চক্ষু দেখছিলাম!
মাস্টার ও ভক্তেরা এই অদ্ভুত, অশ্রুতপূর্ব দর্শনকথা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন। এই সময় আর-একটি ছোকরা ভক্ত, সারদা, প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সারদার প্রতি) – দক্ষিণেশ্বরে যাস না কেন? কলিকাতায় যখন আসি, তখন আসিস না কেন?
সারদা – আমি খবর পাই না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – এইবার তোকে খবর দিব। (মাস্টারকে সহাস্যে) একখানা ফর্দ করো তো – ছোকরাদের। (মাস্টার ও ভক্তদের হাস্য)
[পূর্ণের সংবাদ – নরেন্দ্রদর্শনে ঠাকুরের আনন্দ ]
সারদা – বাড়িতে বিয়ে দিতে চায়। ইনি (মাস্টার) বিয়ের কথায় আমাদের কতবার বকেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – এখন বিয়ে কেন? (মাস্টারের প্রতি) সারদার বেশ অবস্থা হয়েছে। আগে সঙ্কোচ ভাব ছিল। যেন ছিপের ফাতা টেনে নিত। এখন মুখে আনন্দ এসেছে।
ঠাকুর একজন ভক্তকে বলিতেছেন, “তুমি একবার পূর্ণর জন্য যাবে?”
এইবার নরেন্দ্র আসিয়াছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে জল খাওয়াইতে বলিলেন। নরেন্দ্রকে দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইয়াছেন। নরেন্দ্রকে খাওয়াইয়া যেন সাক্ষাৎ নারায়ণের সেবা করিতেছেন। গায়ে হাত বুলাইয়া আদর করিতেছেন, যেন সূক্ষ্মভাবে হাত-পা টিপিতেছেন! গোপালের মা (‘কামারহাটির বামনী’) ঘরের মধ্যে আসিলেন। ঠাকুর বলরামকে কামারহাটিতে লোক পাঠাইয়া গোপালের মাকে আনিতে বলিয়াছিলেন। তাই তিনি আসিয়াছেন। গোপালের মা ঘরের মধ্যে আসিয়াই বলিতেছেন, “আমার আনন্দে চক্ষে জল পড়ছে।” এই বলিয়া ঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ হইয়া নমস্কার করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সে কি গো। এই তুমি আমাকে গোপাল বল – আবার নমস্কার!
“যাও, বাড়ির ভিতর গিয়ে একটি বেন্নন রাঁধ গে – খুব ফোড়ন দিও – যেন এখানে পর্যন্ত গন্ধ আসে।” (সকলের হাস্য)
গোপালের মা – এঁরা (বাড়ির লোকেরা) কি মনে করবে?
গোপালের মা কি ভাবিতেছেন যে, এখানে নূতন এসেছি, – যদি আলাদা রাঁধব বলে বাড়ির লোকেরা কিছু মনে করে!
বাড়ির ভিতর যাইবার আগে তিনি নরেন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া কাতরস্বরে বলিতেছেন, “বাবা! আমার কি হয়েছে; না বাকী আছে?”
আজ রথযাত্রা – শ্রীশ্রীজগন্নাথের ভোগরাগাদি হইতে একটু দেরি হইয়াছে। এইবার ঠাকুর সেবা হইবে। অন্তঃপুরে যাইতেছেন। মেয়ে ভক্তেরা ব্যাকুল হইয়া আছেন, – তাঁহাকে দর্শন ও প্রণাম করিবেন।
ঠাকুরের অনেক স্ত্রীলোক ভক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁহাদের কথা পুরুষ ভক্তদের কাছে বেশী বলিতেন না। কেহ মেয়ে ভক্তদের কাছে যাতায়াত করিলে, বলিতেন, ‘বেশী যাস নাই; পড়ে যাবি!’ কখন কখন বলিতেন, ‘যদি স্ত্রীলোক ভক্তিতে গড়াগড়ি যায়, তবুও তার কাছে যাতায়াত করবে না।’ মেয়েভক্তেরা আলাদা থাকবে – পুরুষ-ভক্তেরা আলাদা থাকবে। তবেই উভয়ের মঙ্গল। আবার বলিতেন, “মেয়েভক্তদের গোপাল ভাব – ‘বাৎসল্য ভাব’ বেশি ভাল নয়। ওই ‘বাৎসল্য’ থেকেই আবার একদিন ‘তাচ্ছল্য’ হয়।”