১৮৮৫, ২৮শে জুলাই
গণুর মার বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
গণুর মার বাড়ির বৈঠকখানায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। ঘরটি একতলায়, ঠিক রাস্তার উপর। ঘরের ভিতর ঐকতান বাদ্যের (Concert) আখড়া আছে। ছোকরারা বাদ্যযন্ত্র লইয়া ঠাকুরের প্রীত্যর্থে মাঝে মাঝে বাজাইতেছিল।
রাত সাড়ে আটটা। আজ আষাঢ় মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ। চাঁদের আলোতে আকাশ, গৃহ, রাজপথ সব যেন প্লাবিত হইয়াছে। ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তেরা আসিয়া ওই ঘরে বসিয়াছেন।
ব্রাহ্মণীও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন। তিনি একবার বাড়ির ভিতর যাইতেছেন, একবার বাহিরে আসিয়া বৈঠকখানার দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেছেন। পাড়ার কতকগুলি ছোকরা বৈঠকখানার জানলার উপর উঠিয়া ঠাকুরকে দেখিতেছে। পাড়ার ছেলে-বুড়ো সকলেই ঠাকুরের আগমন সংবাদ শুনিয়া ব্যস্ত হইয়া মহাপুরুষ দর্শন করিতে আসিয়াছেন।
জানলার উপর ছেলেরা উঠিয়াছে দেখিয়া ছোট নরেন বলিতেছেন, “ওরে তোরা ওখানে কেন? যা, যা বাড়ি যা।” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সস্নেহে বলিতেছেন, “না, থাক না, থাক না।”
ঠাকুর মাঝে মাঝে বলিতেছেন, “হরি ওঁ! হরি ওঁ!”
শতরঞ্জির উপর একখানি আসন দেওয়া হইয়াছে, তাহার উপর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়াছেন। ঐকতান বাদ্যের ছোকরাদের গান গাহিতে বলা হইল। তাহাদের বসিবার সুবিধা হইতেছে না, ঠাকুর তাঁহার নিকটে শতরঞ্জিতে বসিবার জন্য তাহাদের আহ্বান করিলেন।
ঠাকুর বলিতেছেন, “এর উপরেই বস না। আই আমি লিচ্ছি।” এই বলিয়া আসন গুটাইয়া লইলেন। ছোকরারা গান গাহিতেছে:
কেশব কুরু করুণাদীনে কুঞ্জকাননচারী
মাধব মনোমোহন মোহন মুরলীধারী।
(হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার) ৷৷
ব্রজকিশোর, কালীয়হর কাতরভয়ভঞ্জন,
নয়ন-বাঁকা, বাঁকা-শিখিপাখা, রাধিকা-হৃদিরঞ্জন;
গোবর্ধনধারণ, বনকুসুমভূষণ, দামোদর কংসদর্পহারী।
শ্যাম রাসরসবিহারী।
(হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার) ৷৷
গান – এস মা জীবন উমা – ইত্যাদি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা কি গান! – কেমন বেহালা! – কেমন বাজনা!
একটি ছোকরা ফ্লুট বাজাইতেছিলেন। তাঁহার দিকে ও অপর আর আকটি ছোকরার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিতেছেন। “ইনি ওঁর যেন জোড়।”
এইবার কেবল কনসার্ট বাজনা হইতে লাগিল। বাজনার পর ঠাকুর আনন্দিত হইয়া বলিতেছেন, “বা! কি চমৎকার!”
একটি ছোকরাকে নির্দেশ করিয়া বলিতেছেন, “এঁর সব (সবরকম বাজনা) জানা আছে।”
মাস্টারকে বলিতেছেন, – এঁরা সব বেশ লোক।”
ছোকরাদের গান-বাজনার পর তাহারা ভক্তদের বলিতেছে – “আপনারা কিছু গান!” ব্রাহ্মণী দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি দ্বারের কাছ থেকে বলিলেন, গান এরা কেউ জানে না, এক মহিমবাবু বুঝি জানেন, তা ওঁর সামনে উনি গাইবেন না।
একজন ছোকরা – কেন? আমি বাবা সুমুখে গাইতে পারি।
ছোট নরেন (উচ্চহাস্য করিয়া) – অতদূর উনি এগোননি!
সকলে হাসিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ব্রাহ্মণী আসিয়া বলিতেছেন, – “আপনি ভিতরে আসুন।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “কেন গো!”
ব্রাহ্মণী – সেখানে জলখাবার দেওয়া হয়েছে; যাবেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – এইখানেই এনে দাও না।
ব্রাহ্মণী – গণুর মা বলেছে, ঘরটায় একবার পায়ের ধুলা দিন, তাহলে ঘর কাশী হয়ে থাকবে, – ঘরে মরে গেলে আর কোন গোল থাকবে না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, ব্রাহ্মণী ও বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে অন্তঃপুরে গমন করিলেন। ভক্তেরা চাঁদের আলোতে বেড়াইতে লাগিলেন। মাস্টার ও বিনোদ বাড়ির দক্ষিণদিকে সদর রাস্তার উপর গল্প করিতে করিতে পাদচারণ করিতেছেন!