ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ২০শে ও ২৪শে সেপ্টেম্বর
অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ ও ডাক্তার রাখাল – ভক্তসঙ্গে নৃত্য

শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে নিজের ঘরে বসিয়া আছেন। রবিবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ; ৫ই আশ্বিন; শুক্লা একাদশী। নবগোপাল, হিন্দু স্কুলের শিক্ষক হরলাল, রাখাল, লাটু প্রভৃতি; কীর্তনীয়া গোস্বামী; অনেকেই উপস্থিত।

বহুবাজারের রাখাল ডাক্তারকে সঙ্গে করিয়া মাস্টার আসিয়া উপস্থিত; ডাক্তারকে ঠাকুরের অসুখ দেখাইবেন।

ডাক্তারটি ঠাকুরের গলায় কি অসুখ হইয়াছে দেখিতেছেন। তিনি দোহারা লোক; আঙুলগুলি মোটা মোটা।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে, ডাক্তারের প্রতি) – যারা এমন এমন করে (অর্থাৎ কুস্তি করে) তাদের মতো তোমার আঙুল। মহেন্দ্র সরকার দেখেছিল কিন্তু জিভ এমন জোরে চেপেছিল যে ভারী যন্ত্রণা হয়েছিল; যেমন গরুর জিভ চেপে ধরেছে।

রাখাল ডাক্তার – আজ্ঞা, আমি দেখছি আপনার কিছু লাগবে না।

[শ্রীরামকৃষ্ণের রোগ কেন? ]

ডাক্তার ব্যবস্থা করার পর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – আচ্ছা, লোকে বলে ইনি যদি এত – (এত সাধু) তবে রোগ হয় কেন?

তারক – ভগবানদাস বাবাজী অনেকদিন রোগে শয্যাগত হয়েছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – মধু ডাক্তার, ষাট বছর বয়সে রাঁড়ের জন্য তার বাসায় ভাত নিয়ে যাবে; এদিকে নিজের কোন রোগ নাই।

গোস্বামী – আজ্ঞা, আপনার যে অসুখ সে পরের জন্য; যারা আপনার কাছে আসে তাদের অপরাধ আপনার নিতে হয়, সেই সকল অপরাধ, পাপ লওয়াতে আপনার অসুখ হয়!

একজন ভক্ত – আপনি যদি মাকে বলেন মা, এই রোগটা সারিয়ে দাও, তা হলে শীঘ্র সেরে যায়।

[সেব্য-সেবকভাব কম – ‘আমি’ খুঁজে পাচ্ছি না ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – রোগ সারাবার কথা বলতে পারি না; আবার ইদানীং সেব্য-সেবক ভাব কম পড়ে যাচ্ছে। এক-একবার বলি, ‘মা, তরবারির খাপটা একটু মেরামত করে দাও’; কিন্তু ওরূপ প্রার্থনা কম পড়ে যাচ্ছে; আজকাল ‘আমি’টা খুঁজে পাচ্ছি না। দেখছি তিনিই এই খোলটার ভিতরে রয়েছেন।

কীর্তনের জন্য গোস্বামীকে আনা হইয়াছে। একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কীর্তন কি হবে?’ শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ, কীর্তন হইলে মত্ততা আসিবে; এই ভয় সকলে করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন, “হোক একটু। আমার নাকি ভাব হয়, তাই ভয় হয়। ভাব হলে গলার ওইখানটা গিয়ে লাগে।”

কীর্তন শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাব সম্বরণ করিতে পারিলেন না; দাঁড়াইয়া পড়িলেন ও ভক্ত সঙ্গে নৃত্য করিতে লাগিলেন।

ডাক্তার রাখাল সমস্ত দেখিলেন; তাঁহার ভাড়াটিয়া গাড়ি দাঁড়িয়া আছে। তিনি ও মাস্টার গাত্রোত্থান করিলেন, কলিকাতায় ফিরিয়া যাইবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে উভয়ে প্রণাম করিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে মাস্টারের প্রতি) – তুমি কি খেয়েছ?

[মাস্টারের প্রতি আত্মজ্ঞানের উপদেশ – ‘দেহটা খোলমাত্র’ ]

বৃহস্পতিবার, ২৪শে সেপ্টেম্বর পূর্ণিমার দিন রাত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ঘরের ছোট খাটটির উপর বসিয়া আছেন। গলার অসুখের জন্য কাতর হইয়াছেন। মাস্টার প্রভৃতি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – এক-একবার ভাবি দেহটা খোল মাত্র; সেই অখণ্ড (সচ্চিদানন্দ) বই আর কিছু নাই।

“ভাবাবেশ হলে গলার অসুখটা একপাশে পড়ে থাকে। এখন ওই ভাবটা একটু একটু হচ্ছে, আর হাসি পাচ্ছে।”

দ্বিজর ভগিনী ও ছোট দিদিমা ঠাকুরের অসুখ শুনিয়া দেখিতে আসিয়াছেন; তাঁহারা প্রণাম করিয়া ঘরের একপাশে বসিলেন। দ্বিজর দিদিমাকে দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “ইনি কে? – যিনি দ্বিজকে মানুষ করেছেন? আচ্ছা দ্বিজ এমন এমন (একতারা) কিনেছে কেন?”

মাস্টার – আজ্ঞা, তাতে দুইতার আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – একে ওর বাবা বিরুদ্ধ; সব্বাই কি বলবে? ওর পক্ষে গোপনে (ঈশ্বরকে) ডাকাই ভাল।

শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে দেয়ালে টাঙ্গানো গৌর নিতাইয়ের ছবি একখানা বেশি ছিল; গৌর নিতাই সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া নবদ্বীপে সংকীর্তন করছেন এই ছবি।

রামলাল (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – তাহলে, ছবিখানা এঁকেই (মাস্টারকে) দিলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা; তা বেশ।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও হরিশের সেবা ]

ঠাকুর কয়েকদিন প্রতাপের ঔষধ খাইতেছেন। গভীর রাত্রে উঠিয়া পড়িয়াছেন, প্রাণ আই-ঢাই করিতেছে। হরিশ সেবা করেন, ওই ঘরেই ছিলেন; রাখালও আছেন; শ্রীযুক্ত রামলাল বাহিরে বারান্দায় শুইয়া আছেন। ঠাকুর পরে বলিলেন, “প্রাণ আই-ঢাই করাতে হরিশকে জড়াতে ইচ্ছা হল; মধ্যম নারায়ণ তেল দেওয়াতে ভাল হলাম, তখন আবার নাচতে লাগলাম।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!