ভবঘুরেকথা
তারক ঠাকুর

মতির ফাঁশি মুক্তি
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
হরিভক্ত গুণ কথা করিব বর্ণন।।
কালিয়া থানার মধ্যে রায়পুর গ্রাম।
সেই গ্রামে বাস করে মতিচন্দ্র নাম।।
স্বাভাবিক ভাবে তার জীবন চলিত।
মাঝে মাঝে সেই গ্রামে তারক আসিত।।
তারকেরে ভক্তি করি জীবন কাটায়।
কৃষি কার্য্য করিতেন সেই মাহাশয়।।
একদিন সেই মতি জমি চষিবারে।
মাঠ মধ্যে চলিলেন হাল স্কন্ধে করে।।
সে জমির আর নিয়ে গোলমাল ছিল।
সেই দিন তার সঙ্গে কোন্দল বাঁধিল।।
দুই জন হাতা হাতি মারামারি করে।
ক্রোধ ভরে সেই মতি বাড়ী দেয় তারে।।
হালুয়া লাঠির বাড়ী মস্তকেতে দিল।
নাকে মুখে রক্ত উঠে মাটিতে পড়িল।।
ছট ফঠ করি শেষে জীবন ত্যাজিল।
তাই দেখে সেই মতি ভয়ে পালাইল।।
মাঠ ভরা কৃষকেরা ছুটিয়া আসিল।
মরা শব লয়ে তারা থানায় চলিল।।
খুনি কেচ লিখে সেই দারগা তখন।
কোটেতে পাঠায় কেচ করিয়া যতন।।
শমন করিযা জারী মতিকে ধরিল।
হাত কড়া দিয়ে তারে জেলেতে পুরিল।।
জেলেতে থাকিয়া মতি ভাসে আখি জলে।
কি হইতে কি হইল মনে মনে বলে।।
সত্য সত্য স্বাক্ষী পেয়ে হাকিম তখন।
জজ কোর্টে পাঠাইল করিয়া লিখন।।
জজ বাবু স্বাক্ষী পেয়ে হুকুম করিল।
সে মতির ফাঁশি হয়ে রায়েতে লিখিল।।
ফাঁশির হুকুম হল শুনে মতি শেষে।
কান্দিতে লাগিল মতি আখি জলে ভাসে।।
পরিবারসহ কান্দে সে কথা শুনিয়া।
হায় হায় কি হইল না পায় ভাবিয়া।।
সে মতির ফাঁশি হবে সকলে শুনিয়া।
যার যার মন কথা বেড়ায় বলিয়া।।
ফাঁশির হুকুম হল আইন ধারায়।
তিন সত্ত্বা মধ্যে তার এক সত্ত্বা পায়।।
কাউকে দেখিতে ইচ্ছা যদি থাকে মনে।
কোন দ্রব্য খেতে ইচ্ছা থাকে তার মনে।।
মানিতে ছাপাই স্বাক্ষী মনে যদি চায়।
মানিলে মানিতে পারে আইনেতে কয়।।
তাই শুনে সেই মতি মানিল ছাপাই।
আমার ছাপাই স্বাক্ষী তারক গোঁসাই।।
সেই ভেবে সেই মতি তারকে স্মরিয়া।
তারকের ছবি খানি হৃদয়ে ধরিয়া।।
আখি জলে ভেসে ভেসে কেন্দে ছাড়ে হাই।
অন্তিমের ইচ্ছা আমি তোমাকে জানাই।।
সে মতির ইচ্ছা যাহা জজ বাবু শুনে।
নোটিশ লিখিয়া দিল পিওনের স্থানে।।
পিওন নোটিশ লয়ে তারকে জানায়।
তারক জানিয়া তাহা ভাবিল হৃদয়।।
লোক মুখে শুনিয়াছি খুনের ঘটনা।
কেমনেতে দিব স্বাক্ষী কিছু ত জানি না।।
মতি মোরে স্বাক্ষী মানে কী মনে ভাবিয়া।
কেমনেতে দিব স্বাক্ষী জজ কোর্টে গিয়া।।
ইতি উতি কতকিছু মনেতে ভাবিল।
স্বাক্ষীর তারিখ দিনে কোর্টে নাহি গেল।।
তারপর জজ বাবু শমন পাঠায়।
পিওন আসিয়া সেই শমন দেখায়।।
পিওন বলেছে তুমি শুন মহাশয়।
এ তারিখে নাহি গেলে বিপদ নিশ্চয়।।
কোর্টের অমান্য হবে স্বাক্ষী যায় জেলে।
শুন শুন মহাশয় আমি যাই বলে।।
এই কথা বলে তিনি করিল গমন।
তাই শুন রসরাজ ভাবে মনে মন।।
মতি মোরে ভক্তি করে চিরদিন জানি।
সত্য সত্য অপরাধি লোক মুখে শুনি।।
কি করিব কোথা যাব ভাবিয়া না পাই।
কোথা মোর হরিচাঁদ তোমাকে জানাই।।
তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়।
জীবনে মরণে তার নাহি কোন ভয়।।
হরিচাঁদ ছবিখান হৃদয়ে ধারিয়া।
নিশ্চিত শয়ন করে শ্রীহরি স্মরিয়া।।
স্বপনেতে সে তারক দেখিতে পাইল।
দয়াময় হরিচাঁদ কহিতে লাগিল।।
শুন শুন বাছাধন বলি যে তোমায়।
স্বাক্ষী দিতে চলে যাও নাহি কোন ভয়।।
যেই খানে তুমি যাবে সঙ্গে সঙ্গে রব।
তোমার মনে বাঞ্ছা আমি পুরাইব।।
স্বপনে দেখিয়ে সেই তারক সুজন।
ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দুনয়ন।।
হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া।
কোর্টের সমীপে গিয়ে রহিল বসিয়া।।
হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বোঝে ধরায়।
কার দ্বারা কিবা করে হরি দয়াময়।।
জজের জীবন কথা শুন দিয়া মন।
ঘটনা প্রবাহ আজ করিব বর্ণন।।
বিবাহ করেছে মাত্র সন্তান না হয়।
জজের রমনী কান্দে সেই বেদনায়।।
নিদ্রা যোগে সে রমনী দেখিতে পাইল।
হরিচাঁদ এসে তারে কহিতে লাগিল।।
শুন শুন শুন মাগো বলি যে তোমায়।
তোমার লাগিয়া আমি এসেছি হেথায়।।
তারক নামেতে মোর ভক্ত একজন।
আগামী সকালে এসে দিবে দরশন।।
জজ কোর্টে স্বাক্ষী দিতে আসিবে সে জন।
তাহার বরেতে হবে তোমার নন্দন।।
যদি তারে ভক্তি করি আনিবে হেথায়।
মন বাঞ্ছা পূর্ণ হবে তাহার দ্বারায়।।
হেন কথা হরিচাঁদ যখনে কহিল।
নিদ্রা ভেঙ্গে সেই নারী কান্দিতে লাগিল।।
স্বামীর চরণ ধরে কেন্দে কেন্দে কয়।
স্বপ্নের বৃত্তান্ত কথা সকল জানায়।।
তাই শুনে জজ বাবু আখি জলে ভাসে।
কিছু কাল মৌন হয়ে রহিলেন বসে।।
মনে মনে ভাবিলেন এ সত্য ঘটনা।
স্বাক্ষীর ঘটনা মোর নারী ত জানেনা।।
নিশ্চই স্বপনে এসে কহিলেন হরি।
তারকেরে আনিবারে করিব না দেরি।।
এত বলি দুই জন পুলিশ ডাকিয়া।
তারকেরে আনিবারে দিল পাঠাইয়া।।
পুলিশ দুজন গিয়ে খুঁজিতে লাগিল।
কোর্টের কাছেতে গিয়ে দেখিতে পাইল।।
মৌন হয়ে বসে আছে তারক সুজন।
তারকেরে দেখে তারা কহিল তখন।।
তার নাম কিবা হয় বল মহাশয়।
এই খানে বসে আছে কিসের আশায়।।
তারক আমার নাম কহিল তখন।
স্বাক্ষী দিতে আসিয়াছি শুন বিবরণ।।
তাই শুনি পুলিশেরা কহিল তখন।
জজ বাবু ডাকিতেছে তোমারে এখন।।
জজের আদেশে মোরা আসিয়াছি নিতে।
এখন যাইতে হবে আমাদের সাথে।।
তারক বলেছে আমি এই খানে রব।
ডাক হরে স্বাক্ষী দিয়ে গৃহে চলে যাব।।
পুলিশ বলেছে ‍তুমি বোকা মন্দ নও।
জজ বাবু ডাকিতেছে বুঝিতে কি পাও।।
তারক বলেছে আমি বুঝি না কখন।
হোক সে জজ বাবু যাব না এখন।।
তাই শুনে পুলিশেরা হইল বিদায়।
জজের কাছেতে গিয়ে সকল জানায়।।
তারক বলিল আমি এই খানে রব।
হোক সে জজ বাবু আমি না যাইব।।
তাই শুনে বলিতেছে জজের রমনী।
ছল ছল আখি দু’টি কহিছে তখনি।।
স্বামীর চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।
শুন তুমি ওগো স্বামী বলি যে তোমায়।।
সে মানুষ আনিবারে কর হে গমন।
কেন্দে কেন্দে সে রমনী কহিল তখন।।
তাই শুনে দুই জন গমন করিল।
তারকের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল।।
তারকের পদে পড়ে কেন্দে কেন্দে কয়।
আমাদের গৃহে চল ধরি তব পায়।।
কান্না দেখে কহিলেন তারক গোঁসাই।
স্বাক্ষী দিতে আসিয়াছি কেমনেতে যাই।।
তাই শুনে জজ বাবু কান্দিয়া বলেছে।
গত রাত্রে তব স্বাক্ষী হইয়া গিয়াছে।।
দয়া করে চল বাবা আমাদের ঘরে।
বলিতে বলিতে তার আখি দু’টি ঝরে।।
কেন্দে কেন্দে দুই জনে পড়িল ধরায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল।
দুজনার ধরে তুলে কহিতে লাগিল।।
চল চল জজ বাবু তব ঘরে যাই।
বিলম্ব সহিতে নারি তোমাকে জানাই।।
এত বলি চলিলেন জজের বাসায়।
কেন্দে কেন্দে সেই নারী চরণ ধোয়ায়।।
চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়।
আখি জলে ভেসে ভেসে কেন্দে কেন্দে কয়।।
স্বপনেতে দেখিয়াছি অপূর্ব মুরতী।
শিয়রে বসিয়া মোরে কহিল ভারতী।।
শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই।
তব ঘরে পুত্র কন্যা দেখিতে না পাই।।
তোমার মঙ্গল লাগি আসিয়াছি হেথা।
তব গর্ভে পুত্র হবে শুন সেই কথা।।
তারক নামেতে মোর ভক্ত একজন।
তোমাদের কোর্টে এসে দিবে দরশন।।
তারে যদি ঘরে এনে করিবে যতন।
তার বরে তব গর্ভে হইবে নন্দন।।
তাই বলি ওগো বাবা চরণে জানাই।
তোমার বরেতে যেন পুত্র ধন পাই।।
কান্না দেখে তারকের দয়া উপজিল।
মস্তকেতে হস্ত দিয়ে কহিতে লাগিল।।
শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই।
তব গর্ভে ছেলে হবে কোন চিন্তা নাই।।
এই বাক্য যখনেতে তারক বলিল।
কেন্দে কেন্দে সেই নারী চরণে পড়িল।।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।
জজ বাবু পড়িলেন তারকের পায়।।
এই ভাবে ভক্তি স্তুতি করিতে করিতে।
তারক বুঝায় শেষে বিশুদ্ধ ভাবেতে।।
ভাবাবেশে সেই নারী রন্ধন করিয়া।
ভোজন করায় শেষে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
প্রাণভরি সে তারক ভোজন করিল।
বলে কয়ে সেই দিন গৃহেতে চলিল।।
পরদিন জজ বাবু কোর্টেতে উদয়।
নজর পড়িল গিয়ে রায়ের খাতায়।।
ভাল করে লক্ষ করে দেখিবারে পায়।
নিজের হাতের লেখা খাতার পাতায়।।
খালাস পেয়েছে মতি দেখিতে পাইল।
ছাপাই স্বাক্ষীর পরে খালাস হইল।।
তাই দেখে জজ বাবু ভাবিল হৃদয়।
নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।
মতিকে বাহির করি বুকেতে ধরিয়া।
মিনতী করিল কত কান্দিয়া কান্দিয়া।।
মতিকে বিদায় করি গৃহেতে চলিল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!