ভবঘুরেকথা

তারকের মাথায় হরিচাঁদ
হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া।
সে তারক কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।।
একদিন ওড়াকান্দি হইল উদয়।
হরিচাঁদ পদ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।।
শুন শুন শুন প্রভু করি নিবেদন।
অধমের এ মিনতি কর হে গ্রহণ।।
ঢাকা ধামে যাব আমি করিবারে গান।
কৃপা করে আশির্বাদ কর মোরে দান।।
তাই শুনি হরিচাঁদ কহিল তখন।
আমা প্রতি সদা তব থাকে যেন মন।।
মন খাটি চাই বাছা মন খাটি চাই।
আমার কৃপায় তোর কোন চিন্তা নাই।।
হেন কালে শান্তি মাতা আসিল তথায়।
মায়ের চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।।
শুন শুন শুন মাগো চরণে জানাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
তারকের কান্নাদেখে শান্তি মাতা কয়।
তোমার মনের বাঞ্ছা পূর্ণ যেন হয়।।
ঢাকায় যাইবে তুমি গান গাহিবার।
মম অভিলাষ বাছা কহিব এবার।।
এক জোড়া ভাল শাঁখা এনে মোরে দাও।
আমার মনের বাঞ্ছা তুমি হে পুরাও।।
তাই শুনি সে তারক পড়িলেন পায়।
মায়ের চরণ ধুলি মাখিলেন গায়।।
ঠাকুরে চরণ ধুলী অঙ্গেতে মাখিয়া।
আসিলেন সে তারক ঘরতে ফিরিয়া।।
তারপর দল বল সঙ্গেতে করিয়া।
বুধবারে করে যাত্রা শ্রীহরি স্মরিয়া।।
নৌকা যোগে করিলেন ঢাকায় গমন।
সুন্দর তরণী খানি অতি সুশোভন।।
নদী পথে বেয়ে বেয়ে চলিতে লাগিল।
চারদিন পরে তরী ঢাকায় পৌছাইল।।
জমিদার বাড়ী গান শুনিতে পাইল।
সেই ঘাটে সে তারক তরণী বাঁধিল।।
একদল আসিয়াছে পূর্বে সে বাড়ীতে।
নাম করা কবিয়াল বিখ্যাত জগতে।।
মন্ত্র তন্ত্র জানে ভাল দুই মহাশয়।
বিপক্ষের কন্ঠস্বর বন্ধ করে দেয়।।
অন্য দল তার সনে আটিতে পারে না।
সেই জন্য অন্য কেউ সেখানে আসে না।
তারকেরে পেয়ে তারা বায়না করিল।
দল বল লয়ে সেথা উদয় হইল।।
তার পর উঠিলেন কবির খেলায়।
বিপক্ষের সরকার দেখিবারে পায়।।
সকলের কন্ঠস্বর বন্ধ করে দিল।
গান গাহিবারে তারা কেহ না পারিল।।
তাই দেখে সে তারক কেন্দে ছাড়ে হাই।
কোথা বাবা হরিচাঁদ চরণে জানাই।।
আমি অতি মুঢ় মতি না জানি সাধন।
বিপদে পড়িয়া আজি লইনু স্মরণ।।
তুমি যারে রক্ষা কর ওগো দয়াময়।
জীবনে মরণে আর নাহি কোন ভয়।।
হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয় ধরিয়া।
নয়ন জলে বক্ষ জেতেছে ভাসিয়া।।
তারকের কান্না শুনি হরি দয়াময়।
পুত্তলিকা মুর্তি ধরি বসিল মাথায়।।
কোথাকার স্বর বন্ধ কোথায় লু’কাল।
সবাকার অন্তরেতে আনন্দ বাড়িল।।
সকলের কন্ঠস্বর হইল মধুর।
শ্রোতাগণ বলে সব মধুর মধুর।।
তারপর সে তারক ধরে ধুয়া গান।
ধুয়া গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।।
শ্রোতা যারা ভাসে তারা নয়নের জলে।
আধ আধ ভাষা দিয়া হরি হরি বলে।।
কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে গড়াগড়ি যায়।
কেহ এসে পড়িলেন তারকের পায়।।
এক শিশু বসে ছিল পিতার কোলেতে।
হরিচাঁদ ছবি খানি দেখিল চোখেতে।
জলে ভরা আখি দু’টি লাগিল কান্দিতে।।
পুতুলেতে খেলা করে তারকের মাথে।
তাই দেখে সে বালক কান্দিতে লাগিল।।
তার পিতা তারে লয়ে গৃহে চলি গেল।
আসরেতে শ্রোতা যারা জ্ঞান হারা প্রায়।।
প্রেমের তরঙ্গে তারা ভাসিয়া বেড়ায়।
জমিদার গান শোনে বসে দোতালায়।
বিপক্ষের কবিয়াল ছিল যে সেথায়।।
দুই জনে গান শুনে ভাসে আখি জলে।
জ্ঞান হারা প্রায় তারা নামে ভূমী তলে।।
কবির খোলায় গিয়ে পড়িল ধরায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
হেন দৃশ্য হলো সেথা কহন না যায়।
আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
বিপক্ষের সরকার ভাসি আখি জলে।
তারকের পদ ধরি কেন্দে কেন্দে বলে।।
তুমি হও মহাজন এই ধরা পরে।
অপরাধ করিয়াছি ক্ষমা কর মোরে।।
তন্ত্র মন্ত্র শিখে আমি কবিগান গাই।
তব কাছে তন্ত্র মন্ত্র পুড়ে হল ছাই।।
তোমার চরণে আজ নিয়েছে স্মরণ।
কি করিব কোথা যাব বলহে এখন।।
তাই শুনি তারকের দয়া উপজিল।
সান্তনা করিয়া তারে কহিতে লাগিল।।
শুন শুন শুন বাছা বলি তব ঠাই।
তন্ত্র মন্ত্র দিয়ে আর কার্য কিছু নাই।।
হরি নাম মহা মন্ত্র জগতের সার।
অনায়াসে হয়ে যাবে ভব সিন্ধু পার।।
যাও বাছা দেশে চলে কর কবিগান।
মন খাটি হলে পরে বাড়িবে সম্মান।।
তাই শুনে সে বেচারা বিদায় হইল।
তারকের আজ্ঞা পেয়ে দেশে চলি গেল।।
জমিদার তারকেরে সভক্তি অন্তরে।
ভোজনাদি করাইল অতি সমাদরে।।
দল বল সহ তিনি রহিল তথায়।
পরদিন সবে মিলে হইল বিদায়।।
বাড়ী থেকে যখনেতে আসি রাস্তায়।
একটি বালক এসে তারকেরে কয়।।
শুন শুন শুন তুমি আমার বচন।
গতকাল গান তুমি করিলে যখন।।
নিজ চোখে দেখি তব মাথার উপর।
একটি পুতুল তুমি রাখিয়াছ সেরে।
আমাকে দেখাও তুমি দেখি প্রাণ ভরে।।
এই কথা বলে সে যে কান্দিতে লাগিল।
অমিন তারক তারে বুকেতে ধরিল।।
সে ছেলেকে ধরে বুকে ছাড়ে আখি জল।
আধ আধ ভাষা দিযে বলে হরিবল।।
মস্তকেতে হস্ত দিয়া লাগিল বলিতে।
তোমা সম ভাগ্যবান নাহি এ জগতে।।
সে পুতুল থাকে কোথা বলি তব ঠাই।
ওড়াকান্দি আছে সেই ক্ষীরোদের সাই।।
তাই শুনে সাথে যারা কান্দিতে লাগিল।
কেন্দে কেন্দে তারকের চরণে পড়িল।।
সূর্য্য নারায়ণ আর কাঙ্গালী বেপারী।
নয়ন জলে তে ভেসে বলে হরি হরি।।
এই ভাবে সবে মিলে কান্দিতে লাগিল।
বহুক্ষণ পরে সবে সুস্থির হইল।।
তারপর সে বালকে সান্তনা করিয়া।
তথা হতে চলিলেন বিদায় হইয়া।।
তারপর বহু স্থানে কবিগান করি।
দেশেতে চলিল সবে বলে হরি হরি।।
ঢাকা হতে এক জোড়া শাঁখা কিনে নিয়ে।
উদয় হইল শেষে ওড়াকান্দি গিয়ে।।
শান্তি মার চরণেতে সেই শাঁখা দিয়ে।
স্তুতি করে সে তারক কান্দিয়ে কান্দিয়ে।।
খুশি হয়ে শান্তি দেবী আশীর্বাদ করে।
শুন শুন শুন বাছা বলি যে তোমারে।।
তোমার মনের বাঞ্ছা পূর্ণ যেন হয়।
ভক্তি পথে মন যেন সদা তব রয়।।
তারক বলেছে মাগো অন্য আশা নাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
তারপর সে তারক কান্দিয়া কান্দিয়া।
শান্তি হরিচাঁদ পদ বন্দনা করিয়া।।
জয়পুর চলিলেন হরষিত মন।
ভাবে গদ গদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
এ দিকেতে লক্ষ্মীপাশা কালীমাতা যিনি।
মনে মনে বিষাদিত হইলেন তিনি।।
ভাবিলেন শান্তি মাকে শাঁখা পরাইল।
আমাকেও সে তারক শাঁখা নাহি দিল।।
আমার বরেতে সেই আসিল ধরায়।
আমাকে বঞ্চিত করে কেমন হৃদয়।।
আমি তারে ভালবাসি পুত্রের সমান।
কন্যা রূপে শাঁখাপরি জুড়াই পরাণ।।
মনে মনে কালীমাতা বাসনা করিল।
এই ভাবে বহুদিন গত হয়ে গেল।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
হরিচাঁদ ছবি খানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রিতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!