ভবঘুরেকথা
ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই

-স্বপন কুমার রায়

অর্ধ শতাব্দী আগেই বিশ্ববিখ্যাত বাউল কবি লালন সাঁইজির মহতী গুরু-শিষ্য পরম্পরায় ফকির কোকিল সাঁই এবং তাঁর বড়ই আদরের শিষ্য ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই-এর খ্যাতি বাউল-ফকির-বৈষ্ণব ভক্ত সমাজে ছড়িয়ে পরেছিল। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে আমি এই মহান মরমী বাউল সাধকের দর্শন গ্রহণ করি। 

মরমী সাধক (সিদ্ধ সাধক) এবং মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি কলেজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক পীযুষকান্তি দত্ত বাবু আমার প্রতি অগাধ দয়াবশত আমাকে এই তীর্থ সান্নিধ্যে নিয়ে যান। সুযোগ যখন পেয়েছি তখন এ বিষয়ে দুটো কথা না বললেই নয়।

আমরা যখন তাঁর মাগুরাস্থ গৃহাশ্রমে গেলাম তিনি নিজেই আমাদের স্বাগত জানালেন। শীর্ণ, সৌমকান্তি, প্রবীণ, শ্বেতবসন, যুক্তকর। এমন নির্ভেজাল সাধুর কণ্ঠেই সাঁইজির সেই বিখ্যাত গানের লাইনটি শোভা পায়-

স্বরূপ রূপে রূপকে জানা
সেই তো বটে উপাসনা,
গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা
ব্যোমকালী আর বলিও নারে।।

হাতজোড় করেই আমাকে বললেন, ‘প্রভু…’ ইত্যাদি। আমি হেসে বললাম, ‘ঠিকই বলেছেন, আমি আপনার সেই প্রভুর খোঁজেই আপনার এখানে এসেছি। আমাকে দয়া করুন। তাঁর কথা কিছু বলুন। সেই যে যিনি ‘খোদার ছোট নবীর বড়’ তাঁরই কথা শুনতে চাই।

আর বলুন, গোঁসাই আপনার হিরন্ময় সাধক জীবনের কী সাফল্য এবং কী অসম্পূর্ণতা। যার জন্য আবার এখানে আসতে হবে বা হবে না।’

তিনি জেনে নিলেন যে আমার একটি ক্ষুদ্র মরমী উত্তরাধিকার আছে। কিন্তু তিনি এও তো বুঝলেন যে, এ আঙিনায় আমি অসাধু, তর্কবাজ, অকর্মা এবং অনধিকারী। তবু আমাকে তিনি বাউল তত্ত্বের দুটি দিকই খুলে বলে দিলেন।

কেন তিনি আমাকে বিগতযৌবন, বহিরাগতজ্ঞানে এগিয়ে গেলেন না তা আমি জানি না। পীযূষ স্যার জানেন। এটা তাঁর সার্টিফিকেটের মন্ত্রবল। সবাই জানেন বাউল তত্ত্বের সাংঘাতিক একটি জটিল দিক আছে। আর আছে ভীষণ একটি গোপনীয় দিক।

আমাদের উচিৎ নিজের নিষ্পাপ শৈশবকে পুনরুদ্ধার করা। লালন সাঁইজির গানে একটা যেন সেই শিশুর নিজের জীবনধারা ফিরে পাওয়া, যে শিশু মেলার মধ্যে নানা রং ঢং দেখে নিজের বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলেছে। সাধক যেন সাধনার দ্বারা সেই জীবন ফিরে পায়।

তাঁর সব কথা আমি প্রকাশ্যে বলিনি। অন্যদের জন্য আমার লেখা The two Mystic Poets: Kabir and Lalon (চণ্ডীগড়, ভারত থেকে প্রকাশিত) বইটিতেও জটিল কথাগুলো কিছু বলেছি কিন্তু গোপনীয় বিষয়ের তেমন কিছু বলিনি।

তবে আচ্ছাদন ঠিক রেখে এর অনেক অংশ বলা এবং সংরক্ষণ করা দরকার বলে আমি নিশ্চয়ই মনে করি। কিন্তু এখন সেসব কথা নয়। এখন কেবল তাঁর একটি প্রামাণ্য ও নিজের উপার্জিত সাধন অভিজ্ঞতার কথা বলব। আর বলব তাঁর কাছে যেটা ছিল মর্মান্তিক স্মৃতি। আমার কাছে সেটা তাঁর সীমাহীন গুরুভক্তি সম্পর্কিত কথা।

তাঁর সাধন অভিজ্ঞতাটি আমাদের সবার উপর প্রযোজ্য। এটি একটি শর্তহীন আদেশ। দর্শনের ভাষায় Categorical Imperative.

আমাদের উচিৎ নিজের নিষ্পাপ শৈশবকে পুনরুদ্ধার করা। লালন সাঁইজির গানে একটা যেন সেই শিশুর নিজের জীবনধারা ফিরে পাওয়া, যে শিশু মেলার মধ্যে নানা রং ঢং দেখে নিজের বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলেছে। সাধক যেন সাধনার দ্বারা সেই জীবন ফিরে পায়।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের পর আমি মনোরঞ্জন কবিরাজ নামে খ্যাত আরেক মরমী সাধকের কাছে সে প্রসঙ্গে প্রামাণ্য বর্ণনা পেলাম। কবিরাজ গোঁসাই বললেন এবং আমি শুধু শুনলাম না, নিজের চোখে দেখলাম যে, ‘সাধকের জীবন, শিশুর জীবন। শিশুর যেমন ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে, কৌতুহল থাকে, বিশ্বাস থাকে, থাকে ভয় সংশয়; থাকে জ্ঞান ও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা।

আর থাকে আনন্দ; সীমাহীন আনন্দ থাকে অথচ কাম-কলুষ-কুটিলতা থাকে না। সাধকেরও তেমনি।’ -এ কথা বলে তিনি হাসলেন। দেখলাম, সে হাসিতে আনন্দ আছে; কাম-কলুষ-কুটিলতা নেই।

এ জিনিসটাকেই না কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছিলেন, ‘সেই প্রেম নৃ-লোকে না হয়।’ হবে না কেন? হয়। তবে এ দৃশ্য অপার্থিব, দিব্য। তাঁর মধ্যে দেখলাম হৃতযৌবনের অস্থিরতা নেই; বার্ধক্যের বিড়ম্বনা নেই। তাঁর মধ্যে যে অপূর্ণতার বেদনাটুকু রয়েছে সেটার জন্যও তিনি তাঁর গুরুর প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসের অভাবকেই দায়ী করেছেন।

এ থেকে আমার কিন্তু মনে হয়েছে; গুরু তিনিই যিনি অদেখা সত্য সম্পর্কে কিছু কিছু অতি দরকারি বিশ্বাস সৃষ্টি করে দিতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি যে ঘটনার বর্ণনা দিলেন। সেটাকে আমি গদ্যময় বাস্তবতা দিয়ে মেলাতে পরিনি; বরং ছন্দোময় বৃহত্তর বাস্তবতার মধ্যে বসিয়ে তবে বুঝেছি।

তিনি তাঁর সাধক জীবনের টগবগে দিনগুলোর কথা বলছিলেন। বললেন ছেঁউড়িয়া গুরুপাটে বেশ কয়েকদিন পরমানন্দে অতিবাহিত করার পর গুরু অর্থাৎ দ্বিতীয় পিতাকে প্রণাম করে তিনি বিদায় চাইলেন।

যেভাবেই হোক অবহিত হয়ে তাঁর বিদায়ের সময় গুরু তাঁকে মৃদু হেসে বললেন, ‘বাবারে মনোরঞ্জন! ঘটিটা আমি খুব ভাল পেয়েছিলাম কিন্তু ওতে ছিদ্র আছেরে।’ তাঁর মতে এই অবিশ্বাসের ছিদ্রপথে অনেক অনর্থ তাঁর জীবনে ঢুকেছে। তবে তিনি কবিরাজ; তাঁর ভেষজ ওষুধে রোগীর আরোগ্য গুরুকৃপা ভিন্ন কিছু নয়। তাঁর বিশ্বাস এমনি প্রবল।

গুরু বললেন, বার বার নিষেধ করব না, বাবা যাবিই যখন যা; তবে এ বেলা না বাবা ওবেলা যাবি।

তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন- কেন! কোন মঙ্গল-অমঙ্গল চিন্তা…

তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে না, পাগল, দই আসছে খেয়ে যা।

সত্যিই দই এলো। খলিশাকুণ্ডি থেকে কিংবা দৌলতপুর থেকে। দই খাওয়াতো হল কিন্তু কুষ্টিয়া থেকে মাগুরার প্রায় সব রাস্তাই জঙ্গলাকীর্ণ। বেলা থাকতে থাকতে রওনা দিতে হবে। তাঁর আগে অবশ্য গোপনে এটাও জেনে নেওয়া দরকার যে যারা দই এনেছে তাদের কি সেটা আনার কথা ছিল? না কি এটি গুরুর সফলতা থেকে পাওয়া সামর্থ্য; ফকিরের যথার্থ কেরামতি।

তিনি সেটা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁরা বলল, না না… ভাগ্যগুণে ভাল দই মিলেছে তাই গুরুর জন্য… এমনটা যে এর আগে একেবারে হয়নি তাও নয়। আবার এটাও পূর্বনির্ধারিত কিছু, তেমনটাও না।

যেভাবেই হোক অবহিত হয়ে তাঁর বিদায়ের সময় গুরু তাঁকে মৃদু হেসে বললেন, ‘বাবারে মনোরঞ্জন! ঘটিটা আমি খুব ভাল পেয়েছিলাম কিন্তু ওতে ছিদ্র আছেরে।’ তাঁর মতে এই অবিশ্বাসের ছিদ্রপথে অনেক অনর্থ তাঁর জীবনে ঢুকেছে। তবে তিনি কবিরাজ, কবিরাজ গোঁসাই; তাঁর ভেষজ ওষুধে রোগীর আরোগ্য গুরুকৃপা ভিন্ন কিছু নয়। তাঁর বিশ্বাস এমনি প্রবল।

এবারে আমি আরও একটু অপার্থিব ঘটনার মধ্যে প্রবেশ করব। এটা হল তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা-সাক্ষাতের প্রসঙ্গ।

সাত আট বছর পর আমি তখন কুষ্টিয়া কলেজে বাংলা পড়াই। একদিন আমার ক্লাস শেষ হতে না হতেই আমার সিনিয়র ও আমার বড়ই দরদী সিনিয়র (নজরুল গবেষক, আদর্শ শিক্ষক, মরহুম ড জমির উদ্দীনের কথা বলছি) জমির স্যারকে বললাম, স্যার! আমার সাধুসঙ্গ দরকার, আমি এখন লালনের আখড়ায় যাব।’

তিনি বললেন, আরে ভাই! এখন কোথায় সাধু পাবেন, অনুষ্ঠান নেই, উৎসব নেই। তামাকের ধোঁয়াও পাবেন বলে মনে হয় না।

তিনি আমাদের বোনের স্বামী সুতরাং আরো নানা কৌতুক করে বললেন, ‘আপনার যখন মনে হয়েছে সেখানে গেলেই সাধুর চরণধুলো আপনার গায়ে লাগবে তখন যান।’

সূক্ষ্মত কী- সেটা আমি বলব না। শুধু এটুকু বলব, অনেক গাঁজাখোর, কিছু পথবাসী ব্রাত্য ফকিক দরবেশ, একজন রবীন্দ্রনাথ এবং এই উদ্ভান্ত আমি, এই আমরা সবাই বিশ্বাস করি যে, ‘কোথাও দু:খ, কোথাও মৃত্যু কোথাও বিচ্ছেদ নাই।’

বিভাগে নাস্তা খেয়ে সময় নষ্ট না করে আমি ছুটলাম। গেটের কাছ রিকসা থেকে নেমে দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়াতেই দেখলাম একটা দাঁড়ানো মাইক্রোবাস থেকে এটা ডান পা মাটি স্পর্শ করল। তিনি দাঁড়ালেন। তাঁর সাথে এসেছেন পুত্র তপন ও তাঁর স্ত্রী এবং শিশুপুত্র। এসেছে কয়েকজন স্বজন ও শিষ্যবর্গ।

এবারে তাঁর বস্ত্র আরো শুভ্র। এবারে তিনি যেন আরো পরিপাটি। যেন যুবক পুত্র অন্তিম শয়নে শায়িত পিতাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছেন। কোকিল সাঁই-এর সমাধির কাছে দাঁড়িয়ে তিনি কী বললেন আমি জানি না। তবে আমার মনে হল, গভীর বিরহের ভার তিনি দীর্ঘদিন বহন করেছেন; আর বইতে পারছেন না।

সেবার বিদায়ের সময় তিনি আমাকে আর প্রতিরোধ করতে পারলেন না। ভগবান আমাকে সাধুর চরণধুলো গ্রহণের যে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তিনি আর তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারেন নি। স্থলত তাঁর সাথে আমার সেই শেষ দেখা।

সূক্ষ্মত কী- সেটা আমি বলব না। শুধু এটুকু বলব, অনেক গাঁজাখোর, কিছু পথবাসী ব্রাত্য ফকিক দরবেশ, একজন রবীন্দ্রনাথ এবং এই উদ্ভান্ত আমি, এই আমরা সবাই বিশ্বাস করি যে, ‘কোথাও দু:খ, কোথাও মৃত্যু কোথাও বিচ্ছেদ নাই।’

আমাদের কী দোষ বলুন? প্রাণের এই প্রবাহকে আদিঅন্তহীন বিবেচনা করেই তো লোকে সকল ভাল কাজে প্রবৃত্ত হয়; ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, সত্য অনুসন্ধান করে। মৃত্যুকে তাই চূড়ান্ত ফয়সালা হিসেবে গ্রহণ করেননি আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই। তবে সেবার তাঁকে বেশ সাব্যস্ত মনে হল। যেন বাক্স-পেটরা বাঁধা শেষ। এখন অন্য রণাঙ্গনে যাবেন… পদস্থ সৈনিক…।

শেষ করবো একটি কথা বলে। সাঁইজির সৎ এবং নিষ্ঠাবান অনুসারীবৃন্দের মধ্যে কবিরাজ গোঁসাই অন্যতম যিনি শুদ্ধগদ্যে পরম্পরাগত মরমী তত্বের নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। ভবিষ্যতে সে বিষয়ে দুটো কথা বলার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করব না।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………
লেখক পরিচিতি:
স্বপন কুমার রায়
অধ্যক্ষ
সরকারি মুজিবনগর ডিগ্রী কলেজ
মেহেরপুর, বাংলাদেশ।

…………………………………….
আরো পড়ুন:
ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই
আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই

মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
একজন লালন সাধকের কথা
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর দর্শন

মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -এক
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -দুই
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -তিন

মনোরঞ্জন গোঁসাই: স্বরূপ সন্ধানী দার্শনিক
মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর জীবন দর্শন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!