ভবঘুরেকথা
গুরুকুল গুরুশিষ্য সাধুগুরু পরম্পরা সুফি

গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার

-মূর্শেদূল মেরাজ

নয়

গুরু শিষ্য পরম্পরায় ‘দীক্ষাকরণ’ একটা বিশেষ ক্রিয়া। গুরু হিসেবে কাউকে শুধু নির্বাচন করলেই কার্য সমাপ্ত হয় না। গুরুকে রীতিমতো নিজগুণ অর্থাৎ বিশ্বাস-ভক্তি-বিনয়-শ্রদ্ধা প্রমাণ করে দীক্ষা দেয়ার জন্য রাজি করতে হয়। আর গুরু সম্মত হলেই শুরু হয় নব যাত্রা।

গুরুবাদীরা বলেন, দীক্ষায় ভক্তের নবজন্ম হয়। দীক্ষিত হলে গুরু শিষ্যের পূর্বের সকল পাপ নাশ করে দেন। তাই দীক্ষাগ্রহণ গুরুবাদে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মা সারদা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভয় নেই, এই তোমার জন্মান্তর হয়ে গেল। জন্মান্তরে যতকিছু করেছিলে, সব আমি নিয়ে নিলুম। এখন তুমি পবিত্র, কোন পাপ নেই।’

বিভিন্ন মত-পথ-দর্শনে দীক্ষা প্রথার রীতিনীতিতে পার্থক্য দেখা গেলেও মূল বিষয় একই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিশ্বাসের জগৎগুরু বা সর্বপ্রথম গুরুকে স্মরণ করে শ্রীগুরুর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে থাকে। সনাতন মতে, শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত প্রধানত এই তিন প্রথায় গুরুর দীক্ষা হয়ে থাকে। শৈবমতে সর্বপ্রথম শুরু শিব। বৈষ্ণব মতে শ্রীকৃষ্ণ এবং শাক্তমতে শ্রীচণ্ডী।

সুফিমতে সর্বপ্রথম গুরু হজরত মোহাম্মদ, হজরত আলী এবং বিভিন্ন তরিকার প্রধানগণ। নাথ মতে শিব, মীননাথ ও গোরক্ষনাথ; লালন মতাদর্শে প্রথমগুরু লালন সাঁইজি, পাঞ্জুশাহ্ মতাদর্শে প্রথমগুরু পাঞ্জু শাহ্ ফকির, সতীমাতার ঘরে প্রথম গুরু সতীমাতা। এভাবেই প্রত্যেক মত-পথ-দর্শনে আপন আপন প্রথমগুরুকে স্মরণ করা হয় দীক্ষাপর্বে।

গুরু হলেন আত্মজ্ঞানী, দ্বিব্যজ্ঞানী, ব্রহ্মজ্ঞানী। গুরু হলেন গুজ্জাতি গুজ্জ অন্ধকার। যার তল খুঁজে পাওয়া কারো কর্ম নয়। গুরুকে বোঝার সাধ্য নেই শিষ্যের। গুরুর মহিমা অপার। তিনি কৃপা করলেই কেবল শিষ্য ভবতরী নির্বিঘ্নে পারি দিয়ে মোক্ষ লাভ করতে পারে।

‘কলেমা’ বা ‘গুরুমন্ত্র’ প্রাপ্তির পর নব্য শিষ্য গুরুকে ভক্তি দিয়ে তার নবজন্মে প্রবেশ করে। প্রথমগুরু এবং নিজগুরুকে স্মরণ করে উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করে ভক্তি নিবেদন করে। উপস্থিত সকলেও পরিবারের নতুন সদস্য হিসেবে স্বাগত জানায়।

দীক্ষা পর্বে গুরু নিজ মতবাদের সর্বপ্রথম গুরুকে-নিজ গুরুকে স্মরণ করে শিষ্যের কানে ‘গুরুমন্ত্র’ দিয়ে দীক্ষার প্রাথমিক কাজটি সম্পাদন করেন। বেশিভাগ সময়ই দুই বা চারজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে দীক্ষা ক্রিয়া হয়। দীক্ষা মূলত গুরু আর শিষ্যের মধ্যে বিশ্বাসের এক আত্মিক শপথ না চুক্তিনামা।

যার ফলে শিষ্য তার নিজস্বতাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করে গুরুর চরণে নিবেদিত হয়। অনেক প্রথায় দীক্ষার সময় ভক্তের নতুন নামকরণ করেন গুরু। নতুন পোশাক পরিধান করতে হয়। প্রথমগুরুর বা সম্প্রদায়ের উপাধিতে ভূষিতও করা হয় অনেক প্রথায়।

শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুর বলেছেন, ‘আমি যেসব কাজ পারি, তার ভিতর-দিয়ে তাঁর সেবা করব অনুরাগের সহিত। সেজন্য ইষ্টের কাছে দীক্ষা নিতে হয়। দীক্ষার ভিতরে দক্ষ আছে। দীক্ষাবিধি ঠিকমত অনুশীলন করে চলতে-চলতে আমরা দক্ষ হয়ে উঠি।’

স্বামী সারদানন্দ বলেছেন, ‘যাহা ধীরে ধীরে কর্মের ক্ষয় করিয়া বিমল জ্ঞান (স্রষ্টার) মনে আনিয়া দেয় তাহাকেই দীক্ষা বলে।’

‘কলেমা’ বা ‘গুরুমন্ত্র’ প্রাপ্তির পর নব্য শিষ্য গুরুকে ভক্তি দিয়ে তার নবজন্মে প্রবেশ করে। প্রথমগুরু এবং নিজগুরুকে স্মরণ করে উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করে ভক্তি নিবেদন করে। উপস্থিত সকলেও পরিবারের নতুন সদস্য হিসেবে স্বাগত জানায়।

দীক্ষা প্রসঙ্গে রুদ্রযামল ও যোগিনী তন্ত্রে বলা হয়েছে-

দীয়ন্তে জ্ঞানমত্যন্তং ক্ষীয়তে পাপসঞ্চয়ঃ।
তস্মাদ্‌ দীক্ষেতি সা প্রোক্তা মুনির্ভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।
দিব্যজ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কৃত্যা পাপস্য সংক্ষয়ম্‌।
তস্মাদীক্ষেতি সা প্রোক্তা মুনির্ভিস্তত্ত্ববেদিভিঃ।।

অর্থাৎ যে কাজে পাপক্ষয় করে দিব্য জ্ঞান প্রকাশ করে, তাই দীক্ষা। প্রকৃতপক্ষে দীক্ষার অর্থ বর্ণ বা শব্দ বিশেষ, শ্রবণ করা নয়। বর্ণ বা বর্ণগুলি শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম বলে প্রকীর্তিত আছে। সেই শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্মই বর্ণ। সেই বর্ণই স্রষ্টার নাম।

নাম এবং নামী অভেদ, কিছুই প্রভেদ নাই। এইভাবে যেই নাম বা মন্ত্র গ্রহণ করা হয় তাই দীক্ষা। যিনি নামে এবং মন্ত্র এ মন্ত্রের অভীষ্ট দেবতাকে এক ভাবেন, তিনি প্রকৃত দীক্ষিত। দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করলে শব্দব্রহ্ম বা নাদব্রহ্ম অভীষ্ট দেবতার না হয় এবং হৃদয়ে নিজ ইষ্ট দেবতার ভাব উদ্দীপন না হয়, তবে সেইরূপে মন্ত্র বা দীক্ষা গ্রহণ করে দীক্ষা বা মন্ত্র গ্রহণ শব্দ প্রয়োগ না করাই শ্রেয়ঃ। দৃঢ় বিশ্বাস বা ভক্তিই মূল।

এরপর গুরু একান্তে নব্যভক্তকে তার নতুন পথচলার রীতি বুঝিয়ে দেন। ভক্তের ভক্তি-বিনয়-যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে মোক্ষের পথে এগিয়ে যাওয়ার কারণকারণ শিখিয়ে দেয়। জীবনের সকল জটিলতা-সমস্যা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে অস্থির না হয়ে গুরুকে স্মরণের বাক্য মনে করিয়ে দেন।

গুরু নানক বলেছেন, ‘এক হাজার চন্দ্রসূর্যও হৃদয়ের অন্ধকার দূরীভূত করতে পারে না; কেবলমাত্র গুরুর কৃপাতেই এই অন্ধকার দূর করা সম্ভব।’

গুরুর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে গুরুর হাতে হাত রেখে দীক্ষা নেয়া ছাড়াও; গুরুর প্রতিকৃতি-প্রতিমূর্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্বয়ং দীক্ষা নেয়ার একটি বিধিও প্রচলিত আছে। এটাকে অনেকে পণ দীক্ষা বা শপথ দীক্ষা বলেও উল্লেখ করেছেন। আদৌতে দেখা যায় নতুন মত-পথ যারা প্রবর্তন করেছেন তাদের অনেকেই এই মতে দীক্ষা নিয়েছেন।

এই শপথ মতে দীক্ষা অন্য যে কোনো মতে দীক্ষা নেয়ার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। কারণ এতে নিদের্শনা দেয়ার জন্য সম্মুখ গুরু থাকেন না। কঠিন তপস্যা, কৃচ্ছতা, দৃঢ়মনোবলই একমাত্র সাধককে এই মতে মোক্ষ বা নির্বানের দিয়ে পথ দেখায়।

এই মতে বহু সাধক-মহাত্মা দীক্ষা গ্রহণ করলেও গৌতমবুদ্ধের কথাই অধিক প্রচলিত। যখন গৌতম বুদ্ধ সকল গুরু-শাস্ত্র মত-পথ ঘুরেও নিজের প্রশ্নের সমাধান পেলেন না। তখন তিনি সকল কিছু ত্যাগ করে নিজেকে নিজেই বললেন-

ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।

অর্থাৎ আমার দেহ শুকিয়ে যায় যাক। ত্বক, অস্থি, মাংস, ধ্বংস হোক। তাও বোধিপ্রাপ্ত না হয়ে আমার দেহ এই আসন ত্যাগ করবে না।

গুরুবাদে প্রবেশের পর ভক্তকে গুরুই পরম জ্ঞান-গুরুই ভক্তির আধার মেনে পথ চলা শুরু করতে হয়। গুরুর কৃপা পাওয়ার আশায় শিষ্যকে তার সর্বোস্য গুরুর চরণে নিবেদন করতে হয়। ভক্তের নিজের বলে দাবী করবার আর কিছুই থাকে না। সবই গুরুর হয়ে যায়। সকাল কাজই গুরুর আজ্ঞায় সম্পাদন করতে হয়। গুরুকে স্মরণে রাখতে হয়।

অবশ্য সদগুরু শিষ্যের শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রেম ব্যাতিত অন্য আর কিছুরই আশায় থাকেন না। তিনি কেবল উপযুক্ত শিষ্যকে নিজ জ্ঞান দান করে স্বরূপের সন্ধান বা আত্মজ্ঞানী হওয়ার পথ দেখান মাত্র। এটুকুই তার কর্তব্য বলে মানেন।

কিন্তু কারো যদি বিশেষ কারণে গুরু বদলের আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন প্রকৃত কারণ বুঝিয়ে আগের গুরুর পূর্ণ সম্মতি নিয়ে তবেই নতুন গুরুর কাছে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। সেটাই সঠিক বিধি। আর প্রকৃত গুরুও শিষ্যের পূর্বের গুরুর সম্মতি ছাড়া ভক্ত করে নিয়ে রাজি হন না। এর বিধানও নেই।

চাণক্য বলেছেন, ‘গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।’

অনেক গুরু যেমন দীক্ষা দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। ভক্ত পেলেই দীক্ষা দিয়ে দেন। তেমনি আবার অনেক গুরু আছেন যারা সহজে কাউকে দীক্ষিত করতে সম্মত হন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের সম্মতি আদায় করতে হয়। ভক্তের মনে প্রকৃত ভাব-বৈরাগ্য-ভক্তির ভাব দেখতে পেলে তবেই তারা শিষ্য করে নিতে সম্মত হন। নচেৎ নয়।

শ্রী শ্রী ঠাকুর রামচন্দ্রদেব বলেছেন, ‘দীক্ষা- (দ ঈ ক্ষ আ) ঈষ অর্থাৎ দর্শন অর্থাৎ জ্ঞান।নাম করিতে করিতে যখন জ্ঞান হয় তখনই দীক্ষা হয়।দীক্ষার কাল আছে।নারী রজস্বলা হইলে যেমন পতিসঙ্গ আবশ্যক, তেমনি শিষ্যের ভিতরের প্রকৃতি যতক্ষণ রজস্বলা না হয় ততক্ষণ গুরু তাহাতে বীজ বপন করেন না।’

অনেকে আবার এক গুরু থেকে অন্য গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে বেড়াতেই আনন্দ পায়। তারা নতুন গুরুর সন্ধান পেলেই আগের গুরুকে ত্যাগ করে নতুন গুরুর স্মরণাপন্ন হন। তারা নিত্য নতুন গুরুর সান্নিধ্যে ঘুড়ে বেড়ান। তারা চঞ্চলমতি। দ্রুত গতি।

কিন্তু কারো যদি বিশেষ কারণে গুরু বদলের আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন প্রকৃত কারণ বুঝিয়ে আগের গুরুর পূর্ণ সম্মতি নিয়ে তবেই নতুন গুরুর কাছে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। সেটাই সঠিক বিধি। আর প্রকৃত গুরুও শিষ্যের পূর্বের গুরুর সম্মতি ছাড়া ভক্ত করে নিয়ে রাজি হন না। এর বিধানও নেই।

মুক্তি বা নির্বাণের লক্ষ্যে নিঃশর্ত বিশ্বাসে গুরুর দেয়া বীজমন্ত্র বা গুরুবাক্য পালনই শিষ্যের কর্তব্য বলে ধরা হয়। সুস্থ, নির্মল ও দিব্য জীবনের জন্য শিষ্যকে করতে হয় গুরুকরণ। চলতে হয় গুরুর বাতলে দেয়া পথে। মানতে হয় গুরুজ্ঞান। ভক্তি করতে হয় পরম্পরাকে। ফকির লালন সাঁইজি নিবেদিত হয়ে বলছেন-

আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী।
ইতরপনা কার্য আমার ঘটে অহর্নিশি।।

জঠর যন্ত্রণা পেয়ে
এসেছিলাম কড়ার দিয়ে।
সে সকল গিয়াছি ভুলে ভবে তে আসি।।

চিনলাম না সে গুরু কি ধন
করলাম না তার সেবা সাধন।
ঘুরতে বুঝি হলো রে মন আবার চুরাশি।।

গুরুরূপ যার বাঁধা হৃদয়
শমন বলে তার কিসের ভয়।
লালন বলে মন তুই আমায় করিলি দোষী।।

 

দশ

সবাই গুরু হতে পারে না। গুরু হতে হলেও হতে হয় বিশেষ গুণের অধিকারী। তবে বিভিন্ন মত-পথ-দর্শনে গুরু হয়ে উঠবার কিছু কাঠামোগত রীতি রয়েছে। যেমন সুফিবাদের পীর প্রথায় দেখা যায় গুরু হন বংশগতভাবে। বংশে একজন পীরের আবির্ভাব হলে সেই সিলসিলা তার বংশে চলমান থাকে। এই ধারায় পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র এই সিলসিলার প্রধান হওয়ার অধিকারী হয়।

আবার অনেক ধর্ম-দর্শনে বিশেষ জাতের মানুষই কেবল গুরু হওয়ার অধিকার রাখে। তন্ত্র-হটযোগে যারা সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে তারা গুরু হতে পারে। ফকিরিতে উপযুক্ত শিষ্যকে গুরু খিলাফত প্রদান করে গুরু হিসেবে বরণ করে নেন। এবং তাকে নিজ শিষ্য করার অধিকার দেন।

গুরুবাদীদের মধ্যে সিলসিলা বা গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারাবাহিকতা মানার একটা বিষয় আছে। সর্বপ্রথম গুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে দীক্ষার মধ্য দিয়ে গুরু নির্বাচনের ইতিহাস যথাযথ রাখাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে অনেক সাধুগুরুর জীবনীতে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে দীক্ষা গ্রহণের বিষয়টিও পাওয়া যায়।

আবার গুরু একটি ধারার প্রবর্তক আর শিষ্য নতুন আরেকটি নতুন ধারার প্রবর্তক এমনটাও দেখা যায়। সেক্ষেত্রে শিষ্য থেকে নতুন সিলসিলার যাত্রা শুরু হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, গুরুর সাথে মতবিরোধের জেরে কোনো কোনো শিষ্য নিজেই গুরু হয়ে বসেন। সাধু মতে বলা হয়, উপযুক্ত ভক্ত হতে পারলেই যোগ্য গুরু হওয়া যায়। ভক্ত হতে না পারলে গুরু হওয়া মুশকিল।

শ্রীমদ্ভগবতে বলা হয়েছে, ‘যিনি তার আশ্রিত জনকে জন্ম-মৃত্যুর সংসার আবর্ত থেকে উদ্ধার করতে না পারেন, তার গুরু হওয়া উচিত নয়।’

জগতে যেমন সদগুরুর উদাহরণ আছে। তেমনি আছে উপযুক্ত ভক্তের নামও। সেই সকল গুরু-শিষ্য, ভক্তি ও প্রেমের উদাহরণ হয়ে ভক্তের হৃদয়েই কেবল বাসা বাঁধেই রয়ে যায় নি । জগৎবাসী সেসকল গুরু-শিষ্যের যুগলবন্দী স্মরণ করে সর্বযুগে সর্বকালে।

তাই সাধুগুরুরা বলেন, গুরুর দোষ-গুণ অনুসন্ধান না করে নিজ ইন্দ্রিয়ের শুদ্ধতা চর্চা জরুরী। নিজে শুদ্ধ হলেই শুদ্ধ গুরুর সন্ধান মিলে। মনে অশুদ্ধতা-কৃপণতা-সংর্কীণতা-স্বার্থপরতা থাকলে সঠিক গুরুর সন্ধান পাওয়া সহজ সম্ভবনা থাকে না। গুরু বিনে পরিত্রাণের উপায় নাই। তাই শুদ্ধ হয়ে সদগুরুর সন্ধান করতে হয়।

বশিষ্ঠ্য মুনি- শ্রীরাম, শ্রীরাম- হনুমান, বাল্মীকি- লব-কুশ, পরশুরাম- কর্ণ, অষ্টবক্র- রাজা জনক, শ্রীগোবিন্দ- শঙ্করাচার্য, সান্দীপন- শ্রীকৃষ্ণ, দ্রোণাচার্য- অর্জুন, দ্রোণাচার্য- একলব্য, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবস্বামী বিবেকানন্দ, শামস তাবরিজি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, নিজামুদ্দিন আউলিয়াআমির খসরু, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী– কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী জগতের উপযুক্ত গুরু-শিষ্যের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছেন।

আবার উপযুক্ত গুরু-শিষ্যের পাশাপাশি ইতিহাসে অসৎ-অসাধু গুরুদের নামও যে পাওয়া যায় না তা নয়। অনেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে গুরু সেজে বসে। আবার বিত্ত-বৈভবের মায়াজ্বালে আবদ্ধ হয়েও অনেক গুরু বা শিষ্য ভারসাম্য হারিয়ে, সাধন-ভজন ত্যাগ করে সম্পদের পেছনে ছুঁটতে শুরু করে। বিষয়বাসনায় মত্ত হয়ে যায়।

গুরুবাদীরা বলেন, যার যেমন স্বভাব-চরিত্র, দোষ-গুণ। সে তেমন স্বভাব-চরিত্র, দোষ-গুণের গুরুই সন্ধান করে বেড়ায়। যে লোভী সে লোভী গুরুর সন্ধান করে, যে কামী সে কামুক গুরুই সন্ধান করে। আবার যে জ্ঞানী সে জ্ঞানী গুরুর সন্ধান করে। যে অনুগামী সে ভক্তি প্রবণ গুরুর সন্ধান করে।

তাই সাধুগুরুরা বলেন, গুরুর দোষ-গুণ অনুসন্ধান না করে নিজ ইন্দ্রিয়ের শুদ্ধতা চর্চা জরুরী। নিজে শুদ্ধ হলেই শুদ্ধ গুরুর সন্ধান মিলে। মনে অশুদ্ধতা-কৃপণতা-সংর্কীণতা-স্বার্থপরতা থাকলে সঠিক গুরুর সন্ধান পাওয়া সহজ সম্ভবনা থাকে না। গুরু বিনে পরিত্রাণের উপায় নাই। তাই শুদ্ধ হয়ে সদগুরুর সন্ধান করতে হয়।

তুলসী দাস তাঁর রামচরিত মানস গ্রন্থে লিখেছেন-

গুরু বিনু ভবিনিধি তরহ ন কোই।
জো বিরঞ্জি শংকর সম হোই।।

অর্থাৎ এই সংসার সাগর কারও একার পক্ষে পার হওয়া সম্ভব নয়। তা তিনি ব্রহ্মার মতো সৃষ্টিকর্তাই হন আর শিবের মতো লয়কর্তাই হন। তাকে মনের মায়াজাল এবং অবধারণার জঙ্গল থেকে বের হবার জন্য প্রয়োজন একজন সদ্গুরুর।

গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়

গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!