-ফিরোজ এহতেশাম
ঢাকার পান্থপথে অবস্থিত একটি বাড়িতে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টুনটুন ফকিরের সাথে কথা হয়। যথাসম্ভব তাঁর ভাষা অক্ষুণ্ণ রেখে কথপোকথনটি এখানে তুলে দিচ্ছি-
ফিরোজ এহতেশাম: বাউলদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘আপন ভজন কথা, না কহিবে যথা-তথা, আপনাতে আপনি সাবধান’- ভজন কথা কহিলে সমস্যা কী?
টুনটুন ফকির: আসলে সাধনের যে কথা সে বড় গুপ্ত কথা, গোপন কথা। যে লোক, গোপনে সাধন করার যার ইচ্ছা জাগবে তার কাছে বলা যায়। বলা যাবে না এমন কোনো কথা না। ইশারা-ইঙ্গিতে ওটাকে বুঝায়ে দেয়া যায়। এবং সাধারণ মানুষকে ইশারা-ইঙ্গিতের ওপরই বোঝানো হয়।
যেমন, ধর্মটা কী? বাউল মানে- বাও মানে বাতাস, উল মানে সন্ধান। বাউল বাতাসের সন্ধান করে। নাসিকাতে চলে ফেরে। বাউল, ফকির এসব একই স্তরেরই জিনিস। তো, আপন ধর্মকথা না কহিও যথা-তথা, তার মানে কী? আমার গুরু আমাকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেই পথে আমি হইছি কিনা জানার পর তখন তিনি যোগ্য পাত্র পাইল একটা, যোগ্য পাত্র তিনি খুঁজে পান।
ফিরোজ: যোগ্য পাত্র ছাড়া এটা কাউকে বলা যাবে না?
টুনটুন: না। গুরুতে মনুষ্য জ্ঞান যার, অধপতন গতি হয় তার। গুরু কখনও মানুষ না। যে গুরুকে মানুষ ভাবে সে কখনও আল্লাহ পাবে না। কোনো কিছু পাবার আশায় প্রভুকে ডাকা বা আল্লাহকে ডাকা, ধর্ম করা… হ্যাঁ, পাবার আশায়, সব কিছু তো প্রভু তোমায় দিয়ে রেখেছে।
তুমি আসার পূর্বে প্রভু তোমায় দিয়েছে। তুমি জানো না তাই। জ্ঞান প্রসারে দেখতে পাবে তুমি তোমার কী ক্ষমতা আছে। তুমি যে আমি আমি করছ, সেই আমির কী ক্ষমতা আছে। সব ক্ষমতার উৎসই হচ্ছে প্রভু।
ফিরোজ: এখানে কি গুরুকে আপনারা বলতেছেন প্রভু?
টুনটুন: গুরু মানে স্রষ্টা। তো সেই স্রষ্টাকে পেতে হলে, যেমন বলছে যে, ‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়, রূপকাষ্ঠের এই নৌকাখানি নাই ডোবার ভয়।’ রূপকাষ্ঠের নৌকা মানে রূপ, রূপের মানুষ। যে ভালো মানুষ সে রূপকাষ্ঠের একটা ভালো মানুষের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে তুমি… গুরুকর্ম যখন তুমি শিখে ফেলবে… তুমি যদি গুরুকর্ম না শিখেই গুরুকর্ম আরেকজনের কাছে ব্যক্ত করো এটাতে তোমার আরও ক্ষতি হবে।
ফিরোজ: পাপের পর্যায়ে চলে যাবে?
টুনটুন: মানে গুরুতে তোমার বিশ্বাস নাই।
ফিরোজ: বিশ্বাস নাই, আস্থা নাই…
টুনটুন: গুরুতে যার আস্থা নাই সে তো এরকম কথা বলতেই পারবে। আর যার গুরুতে আস্থা আছে সে কখনওই বলবে না।
ফিরোজ: আচ্ছা, এরকম একটা কথা আছে না যে, গুরুকে ধরলে সবকিছু জানা যায়?
টুনটুন: বাহ!
ফিরোজ: তো, গুরু কে, তাকে কীভাবে চিনব?
টুনটুন: গুরু হচ্ছে একজন মানুষ। ভজন পথে একজন মানুষ হয় গুরু। সাধন-ভজনের পথে একজন মানুষ হয় একজন মানুষের গুরু। সেই জানলেওয়ালা মানুষ ভক্তকে জানায় দিবে কী রূপ সাধনা করতে হয়, কীভাবে সাধনা করলে তুমি সেই স্তরে পৌঁছাতে পারবে। এগুলো গুরুকর্ম। এসব মানুষের কাছ থেকেই শিখতে হয়।
এই মানুষই আল্লাহ, এই মানুষকে যে বিশ্বাস করেছে সে মানুষই আল্লাহ দেখবে। একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হলে যেমন বাবা একবার দেখে আসে, মা একবার দেখে আসে, বোন একবার দেখে আসে, পাড়া প্রতিবেশী একবার দেখে আসে, তারপর তুমি নিজেও দু-একবার দেখে আসলে, তারপর না বিয়ে হয়? গুরুও এমন একটা জিনিস।
ফিরোজ: উনার সাথে মিশলে আমি বুঝতে পারব যে…
টুনটুন: হ্যাঁ, তুমি মিশবে যাকে তোমার ভালো লাগবে, তার সাথে তুমি মিশে দেখবে যে ইনার কাছে কিছু পাওয়ার যোগ্য বা ইনি জ্ঞানের অধিকারী কিনা। তখন তুমি বুঝতে পারবে।
ফিরোজ: বাউল, সাধু, ফকির- এসবের কি কোনো স্তর আছে? মানে, সাধনার কোনো স্তর অতিক্রম করলে তাকে বাউল বলে, আবার অন্য স্তর পার হলে তাকে সাধু বলে- এরকম কি ব্যাপারটা?
টুনটুন: এসবের একই স্তর- ত্যাগ।
ফিরোজ: ত্যাগ?
টুনটুন: ত্যাগ। ত্যাগই ধর্ম। যেহেতু পৃথিবীতে তুমি তোমার না, পৃথিবীটাও তোমার না, এটা একজনের। সেই একজনই তোমার কাছে অনন্ত হয়ে বাস করে। তোমার কাছে যখন বাস করে তো তোমাকে দেখতে হবে চোখ-মুখ বন্ধ করে যে প্রভু কোন জায়গায় থাকে।
তুমি না দেখতে শিখলে তো তোমাকে জোর করে কেউ দেখাতে পারবে না এই জিনিস। তোমার উদ্দীপ্ত বাসনা হতে হবে, যে বাসনা দ্বারা তুমি, তোমার হৃদয় স্পন্দন করবে, আল্লাহ রাব্বুলালামিন তোমাকে মেহের করবে, গ্রহণ করবে।
আল্লাহর দয়া তো একজন মানুষের ঈমান দেখেই হয়। একজন ভক্ত কতটুকু তার গুরুকে রক্ষা করতে পারবে, তার গুরুকর্ম করতে কতটুকু সে সক্ষম হবে- এসবের ওপরই তো নির্ভর করে।
ফিরোজ: ফকির, বাউল, সাঁই- এইসব কি তাহলে একই?
টুনটুন: একই। সুফিজম। সুফিজম হচ্ছে ইসলামিক একটা ফাউন্ডেশন।
ফিরোজ: ইসলামের একটা ধারা?
টুনটুন: ধারা। লালন ফকির ওই সুফিজমের কথা বলেছেন। যেমন-
ভুল না মন কারো ভোলে।
রাছুলের দ্বীন সত্য মান
ডাক সদায় আল্লাহ বলে।।
খোদা প্রাপ্ত মূল সাধনা
রাছুল বিনে কেউ জানে না,
জাহের বাতুন উপাসনা
রাছুল দ্বারা প্রকাশিলে।।
দেখাদেখি সাধিলে যোগ
বিপদ ঘটবে বাড়িবে রোগ,
যে জন হয় শুদ্ধ সাধক
সেই রাছুলের ফারমানে চলে।।
অপরকে বুঝাইতে তামাম
করেন রাছুল জাহের কাম,
বাতুন মশগুল মুদাম
কারো করো জানাইলে।।
যেরূপ মুর্শিদ সেইরূপ রাছুল
যে ভজে সে হবে মকবুল,
সিরাজ সাঁই কয় লালন কি কূল
পাবি মুর্শিদ না ভজিলে।।
সে ভেদ কারো কারো জানাইলে। বাতুনে যে মশগুল মুদাম, যার ভিতর তাজা হয়ে গেছে সে দেখতে পায়।
ফিরোজ: কারো কারো জানাইলে। সবাইকে না?
টুনটুন: কারো কারো জানাইলে। সবাইকে না। আবার বললেন দেখাদেখি সাধিলে যোগ… দেখাদেখি তুমি সাংবাদিকতা শিখলে হবে না। সাংবাদিকতা আগে তোমাকে প্রাকটিক্যাল গুরুর কাছে শিখে নিতে হবে। কোন অক্ষর দিয়ে কতগুলা ভাষা, কোথায় পয়েন্ট আছে, কি দিলে পয়েন্ট কমে যায়, দীর্ঘ ঈ তে কি হয়, কতগুলা শব্দ আসে, এভাবে জানতে হবে লেখার মাধ্যমে। শর্টহ্যান্ড। শর্টহ্যান্ড কেমন করে শিখবা?
ফিরোজ: শর্টহ্যান্ড শিখতে হইলে তো প্রাকটিক্যালি…
টুনটুন: আগে করে আসতে হবে। প্রাকটিক্যালি করে তারপর শর্টহ্যান্ড…
ফিরোজ: নোট লিখতে হবে।
টুনটুন: নোট লিখতে হবে। এইটা আমার অমুক কথা, এইটা অমুক কথা।
ফিরোজ: প্রতীকগুলা জানলে তখন আমরা লিখতে পারব।
টুনটুন: হ্যাঁ। ঠিক ওই শর্টহ্যান্ড।
ফিরোজ: ঠিক একইরকমভাবে সাধন পদ্ধতিগুলা…
টুনটুন: হ্যাঁ, পদ্ধতি। সবচেয়ে বড় কথা হলো সাধন কোথায় করবা? সাধন তো মায়ের কাছে। বৌ মা। বৌও মা, মাও মা, সবই মা। জাতিটাই মায়ের জাতি। মায়ের জাতিকে পেতে আদমের খুব লোভ। আল্লাহ একটা লোভ দিয়ে দিছে আদমের। ওকে তুমি লোভেই সারা জনম ভজবে।
ওকে তুমি অপমান করবে না, খাওয়াবে-দাওয়াবে। আল্লাহ এটা করে পাঠিয়েছে। যেমন মেয়েলোক তোমার ব্যবহারের জিনিস না। সাধন-ভজন কিন্তু এইখানে। মেয়েছেলে হচ্ছে, ও হচ্ছে, ও খালি সুখ নিতে এসছে। ও দুখের ধার ধারে না।
মা জাতির কোনো হিসাব নাই। তাই যে মা জাতিকে জয় করতে পেরেছে সে-ই কিছুটা অনুভব করে যাবে পৃথিবীতে আল্লাহ কে, গুরু কে। আপনাকে আপনি চেনা যায় কিসে? আপনাকে চেনাই ধর্ম। যেহেতু আমি যখন আমি না তখন আমাকে চিনতেই হবে যে আমি কে।
ফিরোজ: আপনাকে চেনাই ধর্ম?
টুনটুন: আপনাকে চেনাই ধর্ম।
ফিরোজ: যেমন সক্রেটিস বলছে ‘নো দাই সেলফ’, নিজেকে জানো।
টুনটুন: হুঁ, নিজেকে জানতে পারলে তোমার সব কিছু জানা হয়ে যাবে। তুমি আজকে আসছ, আসা লাগত না, দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারতে আমি কী বলতে চাচ্ছি। এমনটাই।
ফিরোজ: আচ্ছা, ‘যাহা আছে ভাণ্ডে (দেহভাণ্ডে), তা-ই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’ এই কথাটা যখন বাউলরা বলে তখন কী বোঝাতে চায়?
টুনটুন: যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে মানবভাণ্ডে। যেমন ব্রহ্মাণ্ডে চাঁদি, রূপা, সোনা, গহনা সব কিছু আছে। কী নেই? জ্ঞান নেই।
ফিরোজ: মানবভাণ্ডে সেই জ্ঞানটাও আছে।
টুনটুন: বাহ!
ফিরোজ: মানে, ব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও বেশি আছে?
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………..
আরো পড়ুন:
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: এক
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: দুই
প্রকাশের অপেক্ষায়
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: তিন
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: চার
…………
সাক্ষাৎকারটি ফিরোজ এহতেশামের ‘সাধুকথা: ১৩ বাউল-ফকিরের সাথে কথাবার্তা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রিত।
স্থিরচিত্র: সংগৃহিত