-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ
কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া সামিয়ানার নিচে চলছে সাধুসঙ্গ। শীতের সঙ্গে যখন আর পেরে উঠছি না তখন সাধুর বাড়ির আঙিনা মেঠো পথ পেরিয়ে সংকীর্ণ পাকা রাস্তাটায় দিকে চললাম চা পান করতে। সেখানে গুটি কয়েক দোকান, নাগরদোলা, মিষ্টি, মুড়কি, জিলেপির দোকান মেলায় রূপ নিয়েছে।
আরেকটু এগিয়ে একটা ফাঁকা চায়ের দোকানে টুপ করে ঢুকে পরলাম। রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে। দোকানি চা বানিয়েই যাচ্ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে লোকে চা-বিস্কুট খাচ্ছে। ভেতরটা প্রায় ফাঁকা। এক কোণে দোকানীর শিশুপুত্র তার ছাগলছানা নিয়ে ঘুমাচ্ছে; আরেক কোণে মাঁচার উপর এক সাধু আসন করে বসে আছেন। আমি ঢুকতেই তিনি স্মিত হাসির সাথে দুই হাত বুকে তুলে নিলেন।
আসার পর থেকেই এই সাধুকে দেখছি। সকলের মাঝে থেকেও উনি যেন একটু আলাদা। একা একাই থাকেন। বিশালদেহি সাধুর পোষাকে মলিনতা থাকলেও তারমাঝে কেমন যেন একটা আভিজাত্যের লক্ষ্যণ রয়ে গেছে। যে সকল সাধুর মধ্যে আভিজাত্যের ছোঁয়া দেখা যায় তারা সাধারণত লোকজন নিয়ে চলাচল করেন।
একটু জাঁকজমক থেকে যায় তাদের ব্যবহারে। কিন্তু এই সাধুকে একাই দেখেছি বরাবর। আগেও দু-একটা সাধুসঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু কথা হয়নি। একটু হাসি আর হাত বুক পর্যন্ত এনে ভক্তি পর্যন্তই। বেঞ্চিতে বসতেই সাধু আমাকে দেখিয়ে দোকানীকে বললেন, ‘বাপের শীত লাগছে কড়া কইরা একটা চা দাও।’
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জটাধারী সাধু আরেক প্রস্থ হাসলেন। চোখে চোখ পরতেই সাধুর সাথে প্রেম হয়ে গেল। চা পান করতে করতে টুকটাক কথা শুরু হলো। কথায় কথায় কিছুটা ধৃষ্টতা করে সাধুকে বলেই ফেললাম, ‘আপনি কতদিন ধরে আছেন এই পথে?’
আমার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এতোকথা শোনার মতো আপনার হাতে কি সময় আছে বাপ?’ আমি খুশিতে বলে উঠলাম, ‘সময়ের কোনো সমস্যা নাই বলেন। সাধু উঠে দাঁড়িয়ে চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বললো, ‘চলেন তাইলে বাপ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।’
যে বাবার সুনামে আমাদের পুরো জ্ঞাতিগুষ্ঠি করে কেটে খাচ্ছিল তারাই নানান কথা বলে বেড়াতে লাগলো। বাবার জন্য নাকি পরিবারের মানসম্মান সব ধুলায় মিশে যাচ্ছে। কেউ মুখ দেখাতে পারছে না। আমি তখন বিলেত যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছি। তেমন কোনো কাজ নেই।
শেষ হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা দোকানিকে দিয়ে সাধুর পেছনে হাঁটা দিলাম। সাধুর হাতের দুই ব্যাটারির চিকন টর্চের আলোতে আমরা এগিয়ে চলতে লাগলাম। মাইকের শব্দ যেখানে মিলিয়ে গেছে এমন একটা কুয়াশায় ডুবে যাওয়া রাস্তার মোড়ে সাধু দাঁড়িয়ে পরলো; পাশে আমি।
কানে যখন একটানা ডেকে যাওয়া ঝিঁঝির শব্দটা মানিয়ে গেল তখন সাধু বলতে শুরু করলেন, ‘কথাগুলি শুনলে আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না বাপ। কাউরে বলিও না। আপনেরে কেন বলতেছি তাও জানি না। তাও বলতেছি।
আমার বাপ দাদা সকলেই ব্যারিস্টার; আমার বড় দাদাকে ব্রিটিশ সরকারের রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল। তিনি সেই সময় খোলা ছাদের গাড়ি চালাতেন। আমাদের পরিবারের খ্যাতি বাড়তে শুরু করে তার হাত ধরেই। সেই থেকে আমাদের বাড়ির অলিখিত নিয়ম হয়ে যায় পরিবারের সকল ছেলেকে অবশ্যই বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে আসতে হবে।
বাবা আইন ব্যবসায় আমাদের পরিবারে সবচেয়ে বেশি সুনাম অর্জন করেন। বাবা আমাদের বিশাল যৌথ পরিবার একা হাতে সামলাতেন। পরিবারের নিয়মানুযায়ী সে সময় আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি বিলেত যাব ব্যারিস্টারি পড়তে। কাউকে কিছু না বলে বাবা হঠাৎ করে রিটায়ার্ড করলেন। সব কিছু কাকাবাবুর হাতে ছেড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।
সেইসব দামী দামী পোশাক, চাকরবাকর বেষ্টিত পরিবেশ থেকে বের হয়ে সাধারণ জীবনযাপন শুরু করলেন। গাড়ি চড়তেন না। মাঝেমধ্যে বাড়িও ফিরতেন না। সকলেই ভাবতে লাগলো বাবার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাবাকে ঘাটানোর সাহস তখনো কারো ছিল না।
কাঁদা মারিয়ে নদী-খাল পার হয়ে যখন সেখানে পৌঁছাই তখন শুনি আগেরদিনই বাবা অন্য কোথাও চলে গেছেন। এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে দিন দশেকের মাথায় মেহেরপুরে এক আখড়ায় বাবাকে আবিষ্কার করলাম। বাবা মাটিতে খড়ের উপর চট বিছানো জায়গায় বাউল ফকিরদের মাঝে ঘুমিয়ে আছে।
কিছুদিন পর আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শুনতে শুরু করলাম বাবা নাকি কুষ্টিয়া মেহেপুরের বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ান। ফকির-ফকরার সাথে থাকেন খান। কেউ কেউ বাড়ি এসে বলে যায় বাবাকে নাকি অমুক সাধুর বাড়িতে তুমুক সাধুর আখড়ায় মাটিতে বসে গান বাজনা শুনতে দেখা যাচ্ছে। এইসব খবর চড়াও হতে তো আর সময় লাগে না।
যে বাবার সুনামে আমাদের পুরো জ্ঞাতিগুষ্ঠি করে কেটে খাচ্ছিল তারাই নানান কথা বলে বেড়াতে লাগলো। বাবার জন্য নাকি পরিবারের মানসম্মান সব ধুলায় মিশে যাচ্ছে। কেউ মুখ দেখাতে পারছে না। আমি তখন বিলেত যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছি। তেমন কোনো কাজ নেই।
তাই বাড়ির সকলে মিলে আমাকে রাজি করাতে শুরু করলো আমি যাতে যেয়ে বাবাকে খুঁজে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসি। তখন যুবক বয়স মন উড়ু উড়ু। বাবাকে খুঁজতে বাউল ফকিরের আখড়ায় আখড়ায় ঘুরবো সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। আর চিরকাল বাবার ভয়ে কোনোদিন মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারিনি। সেই বাবাকে আমি কি করে ফিরিয়ে আনবো সেটাও ভেবে পাই না।
আসলে কেউই বাবার সামনে দাঁড়াতে সাহস রাখে না। তাই কৌশলে আমাকে আগে করে দিতে চাচ্ছিল। যদি বাবা তার একমাত্র পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসে। শেষে মা-চাচির কান্নাকাটি আর সহ্য করতে না পেরে বিলেতি জামাকাপড় পরে দুই বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম পিতৃদেব উদ্ধার অভিযানে।
অভিযান করতে হবে গোপনে যাতে লোকে না জানে। যদিও সকলেই জানে। তাও এমন একটা কাহিনী করা হলো যেনো আমি দেশ ভ্রমণে বের হচ্ছি। কিন্তু চাইলেই কি আর কাউকে সহজে খুঁজে বের করা সম্ভব? এমন হলো যে, খবর পাই বাবাকে ঐ আখড়ায় দেখা গেছে।
কাঁদা মারিয়ে নদী-খাল পার হয়ে যখন সেখানে পৌঁছাই। তখন শুনি আগেরদিনই বাবা অন্য কোথাও চলে গেছেন। এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে দিন দশেকের মাথায় মেহেরপুরে এক আখড়ায় বাবাকে আবিষ্কার করলাম। বাবা মাটিতে খড়ের উপর চট বিছানো জায়গায় বাউল ফকিরদের মাঝে ঘুমিয়ে আছে।
আমাকে দেখে বাবা অবাক না হয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘তোমার কাছে টাকা আছে? কিছু টাকা দিয়ে যেও তো। এতো লোক চলে এসেছে রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই সাধুর ঘরে।’ আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না বাবাকে দেখে। তার রাশভারী ভাবটা রয়ে গেলেও কণ্ঠে চরিত্রে কোথাও সেই তেজ আর নেই।
কিছুতেই বুঝছিলাম না তিনি কি করে এই নোংরার মাঝে শুয়ে আছেন। এই সব ফকিরদের সাথে খাচ্ছে। আমি কিছুতেই জীবনভর দেখা সেই সৌখিন বাবার সাথে এই বাবাকে মিলাতে পারছিলাম না। বাবাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে বাসায় নিয়ে আসা হলো সেই যাত্রায়।
গৃহবন্দী করা হলো বাবাকে। পালা করে চাচারা পাহারা দেয় বোঝায় বাবাকে। পরিবারের মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে যেন তিনি ঐসব আর না করেন। প্রয়োজন হলে আমাদের বাংলো বাড়িতে বাউলগানের আসর করুক। তা না হলে ইউরোপ ট্যুরে যান। কিন্তু বাউল ফকিরদের আখড়ায় যাওয়া চলবে না।
যা হয় আর কি, সেই বয়সে জেদ ঢুকে গেল রক্তে; বাবাকে চ্যালেঞ্জ করলাম আমি যদি উত্তর আনতে পারি তাহলে আপনি আর যাবেন না বা সেই নিয়ে কোনো কথা হবে না এই বাড়িতে, ঠিক আছে? বাবা চকচকে চোখে বলেছিলেন, যাও বাপ তুমি যাও। এই পর্যন্ত বলে সাধু থামলেন।
বাবা খাওয়াদাওয়া-কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দিলেন। দফায় দফায় বড় বড় ডাক্তাররা বাসায় আসছেন। বাবা কিছুই শুনছেন না। তার একটাই কথা তিনি বাউল-ফকিরদের কাছেই থাকতে চান। কি সব তত্ত্ব কথা বলা শুরু করলেন; সেসবে আমরা সকলেই মহাবিরক্ত বাবার উপর।
ততদিনে আমার বিলেত থেকে কাগজপত্র চলে এসেছে। মাসখানেক পরেই যাওয়ার ডেট ফাইনাল। সকলে বোঝালো বাবাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। সেই পরিবেশে কিছুদিন থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সকলের চাপে বাবাকে বোঝাতে শুরু করলাম। কথায় কথায় বাবাকে প্রশ্ন করলাম, কি পান ঐ নোংরা পরিবেশে? আপনি ঐখানে যান কেনো? এখনো মনে আছে বাবা আমার দিকে শীতল করে দেয়া চোখে অনেকটা সময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর তার হুংকার করা কণ্ঠস্বরকে সর্বোচ্চ কোমল করে বলেছিলেন, ‘আমি কেনো ঐখানে যাই’ এই প্রশ্নের উত্তরটা তুমি ঐখানে যেয়ে আমার জন্য নিয়ে আসতে পারবে?
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, আমি কেনো ঐখানে যাব? আর আপনি কেনো যান সেটা তো আপনারই জানার কথা। আমাকে যেয়ে জানতে হবে কেন? আর আমি জানবোই বা কি করে? কথায় কথায় অনেক কথা। শেষে বাবা বললো, তোমার হাতে তো এখন কোনো কাজ নেই।
সেই মানুষগুলার কাছে যেয়ে কয়টা দিন থেকে একটু জেনে আসো না কেন মানুষ তাদের কাছে যায়? কেনো আমি তাদের কাছে যাই? কেনো নিজের বাড়িতে বন্দি থেকেও মনটা তাদের কাছেই পরে থাকে?
যা হয় আর কি, সেই বয়সে জেদ ঢুকে গেল রক্তে; বাবাকে চ্যালেঞ্জ করলাম আমি। যদি উত্তর আনতে পারি তাহলে আপনি আর যাবেন না। বা সেই নিয়ে কোনো কথা হবে না এই বাড়িতে, ঠিক আছে? বাবা চকচকে চোখে বলেছিলেন, ‘যাও বাপ তুমি যাও।’ এই পর্যন্ত বলে সাধু থামলেন।
আমিও অনেকটা সময় অপেক্ষা করলাম কান খাড়া করে। অনেকটা সময় পরে বললাম, ‘তারপর আপনি কি করলেন সাধু?’ সাধু আমার দিকে ফিরে একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘বাপ সেই থেকে প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে চলেছি। উত্তরও পাইনি আর ৪৮ বছর বাড়িও ফিরা যাইনি। বাবার মতো আমাকেও লোকে ধরে নিয়ে যাইতে আসছিল কিন্তু পারে নাই। আমি আছি এইখানেই।’
শীত ততক্ষণে জমিয়ে দিয়েছে আমাদের হাত পা। চায়ের তীব্র নেশা পাচ্ছিল কিন্তু আমরা সেইভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। সাধু সেই ফেলে আসা ৪৮ বছরের ইতিহাস ভাবছিলেন নাকি অন্যকিছু আমি জানি না। আমি কেবল ভাবছিলাম একটা প্রশ্ন মাথায় আসার পর কত সহজে তা গিলে ফেলি আমরা তাই না।
কিন্তু সাধুগুরু একটা প্রশ্নের পেছনে সমগ্র জীবন সমগ্র অর্জন লাগিয়ে দেয়। এইজন্যই তারা সাধু-গুরু। একটা বিষয়কে একটা প্রশ্নকে কতটা গভীর থেকে দেখতে হয়, কতটা ডুবতে হয় তা যে জানে সেই তো সাধু। আমার মতো মানুষ যারা বসে বসে ভাবি উত্তরও তো জানি; তাদের কেবল অহমিকা জন্মায় এর বেশি কিছু না।
উত্তর জানার পরও যে ডুবে ডুবে সেই উত্তরের অতলে পৌঁছার যাত্রাতে বেড়িয়ে পরতে পারে, তার কাছেই উত্তরের যথার্থতা ধরা হয়। নাইলে তা কেবল কথা বা শব্দ হিসেবেই থেকে যায়; মাথায় নয়তো বইয়ের পাতায়।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে আর সাধুকে পাইনি। মনে মনে আমি সেই সাধুকে সবসময়ই খুঁজে বেড়াই। সাধুসঙ্গে গেলেই চোখ জোড়া নিজের অজান্তেই সেই নাম না জানা সাধুকে খুঁজি আর ভাবি-
পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবেরে।
দেখ দেখ মনরায় হয়েছে উদয়
কি আনন্দময় এই সাধবাজারে।।
যথা রে সাধুর বাজার
তথা সাঁইর বারাম নিরন্তর,
এনে সাধ-সভায় তবে মন আময়
আবার যেন ফেরে ফেলাস নারে।।
সাধু-গুরু কি মহিমা
দেবে দিতে নাইরে সীমা,
হেন পদে যার নিষ্ঠা না হয় তার
না জানি কপালে কি আছেরে।।
সাধুর বাতাসেরে মন
বনের কাষ্ঠ হয়রে চন্দন,
লালন বলে মন, খোঁজ কি আর ধন
সাধুর সঙ্গে রঙ্গে দেশ করবে।।
ভারি ভারি শাস্ত্র বোঝার মতো বিদ্যা আমার নেই। সেইসব ভারি ভারি কথা, মত-পথ-দর্শন কিছুই বুঝি না। তারপরও মন তো মানে না। সময় সুযোগ পেলে পড়ার চেষ্টা যে করি নাই তা কিন্তু নয়। সবই অবশ্য মাথার উপর দিয়েই যায়। তারপরও কৈশরে লাল মলাটের কিছু বই পড়ে তার প্রেমেও পরেছিলাম।
সেই সব বইয়ের সহজ অনুবাদ গোগ্রাসে গিলার চেষ্টাও করেছি নিজে নিজে। মিথ্যা বলবো না মশাই কঠিন মোহে পরে গিয়েছিলাম। দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেল। কঠিন কঠিন সেই সব শব্দ মুখে চলে আসলো। কোনো ঘটনাকে বিচার করার ভিন্ন একটা ডাইমেনশন যেন আবিস্কার করতে শুরু কলাম। সবকিছুতেই ভিন্নতা খুঁজে পাচ্ছিলাম। ব্যাখ্যার পেছনেও ব্যাখ্যা থাকে জানতে শিখছিলাম। বহুদিন সেই আবেশ ছিল।
পড়তে পড়েই একদিন হঠাৎ মাথায় প্রশ্নটা আসলো, এইসব বই পড়ে আমি কি ভালোবাসার বদলে মানুষকে ঘৃণা করতে শিখছি? এক মানুষকে ভালোবাসতে গেলে আরেক মানুষকে ঘৃণা করতে হবে এ কেমন কথা? নতুন প্রশ্ন। তার মানে নতুন যন্ত্রণা।
বৌদ্ধ আর লালন আমাকে ততদিনে শিখাতে শুরু করেছে মানুষকে ভালোবাসতে হবে শর্তহীনভাবে। যে যেমন তাকে তেমন করেই ভালোবাসতে হবে। নইলে তাকে ভালোবাসো একথা বলো না। সেক্ষেত্রে তুমি আসলে চাহিদার একটা তালিকা তৈরি করে পছন্দের মানুষটির পেছন পেছন ছুঁটছো মাত্র।
লাল বই না লালন? ধাক্কা খেলাম, এতোদিন মনে মনে যে বিশ্বাসকে লালন করছি তা কি তবে ভুল পথ? বিপথ? যে পথ আমার নয় আমি কি সেই পথেই হাঁটছিলাম? পাশাপাশি আরেকটি কথা স্মরণে এলো; এমনো তো হতেই পারে আমি পড়ে হয়তো তার ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি।
হয়তো সবই প্রেমের কথাই লেখা ছিল আমিই ভেবেছি বিপ্লব? তাই হয়তো হবে। নইলে এতো মহান জ্ঞানের স্বরূপ এমন হয় কি করে? কি করি মাথা খারাপ অবস্থা। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম এ বিষয়ে যারা জ্ঞান রাখে বা যারা জীবন দিয়ে এ বিষয় চর্চা করে, তাদের মনোভাব কেমন তা একটু দেখা যাক।
বিষয়টা গোলমেলে আমার মতো স্বল্প চিন্তার-স্বল্প বুদ্ধির; বিশেষ করে স্বল্পবিদ্যার মানুষের মাথায় ধরবে না সাফ জানিয়ে দিলো পরিচিত এক বড় ভাই। আসলেই তাই অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। আমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে এমনটাই ভেবে আমি ভাবলাম মানে মানে কেটে পরাই ভালো।
কিন্তু আমার দৌড় তো আর তোমাদের রাজপ্রাসাদ বা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত নয়। তাই খুঁজে খুঁজে কিছু তথাকথিত সফল মানুষ আর কিছু ব্যর্থ মানুষের কাছে গেলাম। যারা এখনো বিশ্বাস থেকেই তা চর্চা করেন।
খুঁজতে গিয়ে কাছেপিঠেই পেয়ে গেলাম গুটি কয়েকজনকে। তাদের সাথে সাক্ষাতে তো আমি আরো গভীর চিন্তায় পরে গেলাম। যতটা তারা এক শ্রেণীর মানুষকে ভালোবাসে। তারচেয়ে অধিক ঘৃণা করে অন্য শ্রেণীকে। একই মনে ঘৃণা আর ভালোবাসা পাশাপাশি কি করে বাস করে? মনে ঘৃণা পুষে কি ভালোবাসা যায়? আমি ডোবা থেকে সমুদ্রে গিয়ে ডুবলাম।
এক নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভাই এই ঘৃণার চাষবাস না করে এমন কিছু করার করা যায় না। যাতে মানুষ কেবল ভালোবাসতে শিখবে। তিনি কঠিন চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘কবুতরের কলিজা নিয়ে এসব আলোচনা করতে লজ্জা লাগে না আপনার? আরে সমষ্টির কল্যাণের জন্য কিছু মানুষকে যদি ঘৃণা করতেই হয়; সেটাতো ঠিকই আছে।
আরে যারা মানুষকে পিষে মারছে আপনি তাদের ভালোবাসা মারাতে বলছেন?’
আমি মিন মিন গলায় বললাম, ‘তা জনাব তারাও তো আমার ধারণা এমনি ভাবে, তাই না? তারাও ভাবে তাদের কল্যাণের জন্য বাকিদের অকল্যাণে হলে কিছু আসে যায় না। তাহলে তাদের পক্ষে তো তাদের যুক্তিও যথাযথ।’
এরপর তিনি ঘণ্টা দুয়েক পৃথিবীর বিভিন্ন বিপ্লবের ইতিহাস ব্যক্ত করলেন। বলতে বলতে উনি আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন। বর্ণনা এতোটাই প্রাঞ্জল ছিল যে আমিও ছবির মতো তা দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে।
শেষে শুধু বলেছিলাম, ‘মশাই আপনার পার্টির প্রধানেরও তো এখন অনেক অর্থ বৃত্ত তাকেও কি আপনি শ্রেণী শত্রু মনে করেন?
যতদূর জানি আপনি নিজেও বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন।’
তিনি কপাল, ভ্রূ, চোখ সবকিছু কুঁচকে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আজ আসুন। আমার মিটিং আছে।’
আমাকে চায়ের দোকানে রেখে উনি চলে গেলেন। আমি বিল মিটাতে মিটাতে ভাবছিলাম- আচ্ছা যে অভাবী মানুষটার জন্য এতো ভালোবাসা এতো আবেগ; সেই লোকই যদি ধনি হয়ে যায় তাহলে কি সে আমার শত্রু হয়ে যাবে?
তুমি কি সকল মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করছো? নাকি তোমার মত যারা মেনেছে তাদের জন্য লড়াই করতে চাচ্ছ? তুমি ক্ষমতায় গেলে যারা তোমার আইন মানবে না তাদের কি ক্ষমা করে দিবে? নাকি তাদের মতোই শাস্তির বিধান রাখবে? তুমি কি আদৌ মানুষের জন্য লড়াই করতে চাও? নাকি অন্যদের মতোই তোমার মত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইটা চালাতে চাও?
বিষয়টা গোলমেলে। বেশ গোলমেলে। এসব কথা আমার মতো স্বল্প চিন্তার-স্বল্প বুদ্ধির; বিশেষ করে স্বল্পবিদ্যার মানুষের মাথায় ধরবে না। সাফ জানিয়ে দিলো পরিচিত এক বড় ভাই। আসলেই তাই অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। আমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে এমনটাই ভেবে আমি ভাবলাম মানে মানে কেটে পরাই ভালো।
তারচেয়ে এমন বিদ্যাই ভালো যেখানে ভালোবাসা মানে কেবল ভালোবাসা; কোনো ছলাকলা নেই কোনো শর্ত নেই। এই এই গুণ থাকলে তোমাকে ভালোবাসতে পারবো। এই এই দোষ থাকলে পারবো না ভালোবাসার এমন পথ আমার নয়। তালিকা করে ভালোবাসতে পারবো না তোমায়।
কিন্তু মশাই একথাও সত্য যে শর্ত সকল জায়গাতেই আছে। তবে সেই শর্ত ছল বা কপটতা নেই এমন হলেই ভালো; এই আর কি। এর বেশি কি ই বা চাইবার আছে। শেষ পর্যন্ত বিদ্যার স্বল্পতায় লাল বই ছেড়ে লালন ফকিরেই খুঁজি মুক্তির পথ। সাঁইজির কথা সাঁইজিকেই বলি-
পার করো দয়াল আমায় কেশে ধরে।
পড়েছি এবার আমি ঘোর সাগরে।।
ছয়জনা মন্ত্রী সদাই
অশেষ কুকাণ্ড বাঁধায়
ডুবালো ঘাট অঘাটায় আজ আমারে।।
এ ভবকূপেতে আমি
ডুবে হলাম পাতালগামী
অপারের কাণ্ডারি তুমি লও কিনারে।।
আমি বা কার কে বা আমার
বুঝে ও বুঝলাম না এবার
অসার কে ভাবিয়ে সার প’লাম ফেরে।।
হারিয়ে সকল উপায়
শেষ কালে তোর দিলাম দোহাই।
লালন কয় দয়াল নাম সাঁই জানবো তোরে।।
তখনো পুরান ঢাকায় অর্থবৃত্ত বা ক্ষমতাই মানুষকে মূল্যয়নের একমাত্র চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায়নি। শিল্প-সংস্কৃতি বলে একটা বিষয় ছিল। পাড়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিটির সাথে গলায়গলায় পীড়িত থাকার চেয়ে হানিফ ভাইয়ের সাথে সামান্য পরিচয় আছে এটাও অনেক বেশি গর্বের ছিল আমাদের কাছে।
আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন হানিফ ভাইয়ের চিলেকোঠায় প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই গান-বাজনার আসর বসত। কখন কেমন করে যে আমিও এই আসরে দর্শক হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে যাই তা আজ আর মনে নেই।
হানিফ ভাইদের পারিবারিক বনেদিয়ানা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আসলেও সেই চিলেকোঠার ঘরখানায় বনেদী সোফাসেটের মাঝে নরম কার্পেটের একপাশে হারমোনিয়াম, খোল, তবলা, মন্দিরাসহ আরো কিছু দেশীয় বাদ্যযন্ত্র শোভা পেত। উত্তরের দেয়ালে ছিল ফ্রেমে বাঁধাই রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত, স্বামী বিবেকানন্দ ও সত্যজিৎ রায়ের ছবি।
অন্যপাশে হানিফ ভাইয়ের দাদার তেলরঙে আঁকা বিশাল বাঁধানো ছবি। ছবির একপাশে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বেলজিয়াম আয়না; অন্যপাশে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লোক। চতুর্থ দেয়ালে বইয়ের আলমারীর পাশে মোটা ফ্রেমের একটা বোর্ড ছিল। তাতে প্রথা অনুযায়ী প্রতি আসরের তোলা ছবি প্রিন্ট করে বোর্ড পিন দিয়ে লাগানো হতো। প্রতিবারই অতিউৎসাহে আমরা সেই সব ছবি দেখতাম।
ঐ আসরে গান বাজনা ছাড়াও আরেকটা আকর্ষণ ছিল। তা হলো এলাকার মনু বাবুর্চির হাতের মজাদার সব বাহারি খাবারদাবার। ফুল গাছে সাজানো বিশাল ছাদের যে পাশে বিশেষ রান্নাঘর ছিল। সেখানে কারো যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
সেই দেয়াল ঘেরা রান্নাঘরে মনু বাবুর্চি নানান পদ রান্না করতেন আসরের দিন সন্ধ্যা থেকেই। সেই সব বাহারি খাবারের মৌ মৌ সৌরভ পেয়ে আমরা আন্দাজ লাগাতাম বটে কিন্তু সেইসব খাবারের দর্শনের সৌভাগ্য হতো গান-আড্ডা শেষে খাওয়াদাওয়ার সময়েই।
রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত গান, কবিতা, আড্ডা। তারপর সকলে গোল হয়ে বসে রাতের খাওয়াদাওয়া। এই ছিল অনুষ্ঠান সূচি। এরমাঝে অবশ্য কয়েক দফা জল-খাবারের ব্যবস্থাও হতো। সবই চলতো চিলেকোঠার আসরের নিয়মানুসারে। কেউ কোনো নিয়ম ভাঙলে পরের আসর থেকে তাকে আর দেখা যেত না।
তবে হানিফ ভাইয়ের বড় চাচা যেদিন পাইপ টানতে টানতে ছাদে উঠে আসতেন সেদিন সব পাল্টে যেতো। তিনি বাংলা সিনেমার অসাধারণ সব ক্লাসিক গান শোনাতেন। শুধুমাত্র তিনি আসলেই হানিফ ভাই আসরের নেতৃত্ব চাচার হাতে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে শুনতেন। অন্যসময় পুরো অনুষ্ঠানের এক আনা কাজের কর্তৃত্বও অন্য কাউকে দিতেন না। কার কি লাগবে বা কি কি লাগতে পারে সবদিকে তার নজর ছিল তীক্ষ্ণ।
ছোট পরিসরে আয়োজন হলেও অতিথি শিল্পী হিসেবে অনেক গুণীমানীজন আসতেন এই আড্ডায়। হানিফ ভাইয়ের পরিবার সঙ্গীতে সমঝদার ছিলেন; কোনোদিন যদি ফাঁক গলে কোনো আনাড়ি শিল্পী চলে আসতো সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হানিফ ভাইয়ের প্রায় শতবর্ষী দাদী বলতেন, ‘কে গাইছে রে আজকা, দেখি খোমাটা দেখায়া যা।’
মানুষের প্রতি তার মমত্ব দেখে চোখ ভিজে আসছিল। হঠাৎ করেই কেনো যেন সেই হানিফ ভাইয়ের ছাদ, সেই চিলেকোঠা, সেই রোমানিয়ান শিল্পী, তার গান, তার কথা সব মনে পরে গেল। বাড়ি ফিরে রাতের খাবারের বাহারি আয়োজন দেখে খেতে পারছিলাম না। হানিফ ভাইয়ের মতো হাউ মাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
লাকীয়াখন্দ, হ্যাপীয়াখন্দ, শেখ ইসতিয়াক, আযম খানসহ বহুশিল্পী সঙ্গীতগুরুকে সেখানে পেয়েছি আমরা। এমনকি দেশ বিদেশের শিল্পীরাও এই শহরে আসলে হানিফভাই তাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতেন; প্রায় ভেঙ্গে পরা বাড়ির সেই চিলেকোঠার আড্ডায়। সেদিন অবশ্য খাবারের আয়োজনে পদের সংখ্যা কয়েক গুন বেড়ে যেত। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে চীনের এক শিল্পী তো মাসখানেক থেকে ছিলেন সেই বাড়িতে।
এরকমই এক সন্ধ্যায় আমরা তন্ময় হয়ে বসে আছি। রোমানিয়ান এক ফোক শিল্পী আসবে বলে। জানলাম তিনি আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে গান সংগ্রহ করেন। এই প্রথম এশিয়ায় এসেছেন, বাংলাদেশে আছেন সপ্তাহ দুয়েক ধরে।
এদেশের বাউল শিল্পীদের জীবন ও গান দেখতে এসেছেন। এসে তার এতোই ভালো লেগেছে যে কোনো একটা বাউল দলের সাথে অনুষ্ঠান থেকে অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেদিন সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ের অনেকটা পরে তিনি উপস্থিত হলেন। যদিও তার দোষ ছিল না। তারপরও তিনি বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলেন, তাকে পথ দেখিয়ে যার আনার কথা ছিল তিনি তাকে খুঁজে পাননি।
বিভিন্ন জনপদে ভ্রমণ করে ঘামে নেয়ে সেই শিল্পী ঢাকায় এসেছেন; সেখান থেকে সোজা চিলেকোঠায়। এসেই লম্বা গোসল দিয়ে আজব স্টাইলে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে গান গাইতে বসে গেলেন। ভায়োলিন বাজিয়ে বিভিন্ন ভাষার লোকো গান একের পর এক গাইতে লাগলেন।
সাথে কোথা থেকে কোন গান কিভাবে সংগ্রহ করেছেন সেই ফিরিস্তি। ভাষা বেশিভাগ না বুঝলেও ওর গানে যে কান্না আছে তার সাথে আমাদের মাটির গানের কোনো পার্থক্য আমি খুঁজে পাইনি। শিল্পী গান গেয়েই চলছেন একটানা। দু’চোখে অশ্রু। আমাদেরও ভেতরটাও আবেগের জলে ভিজে চপচপে।
শিল্পীকে খুবই ক্লান্ত ও ক্ষুদার্থ দেখাচ্ছিল। সেকারণে সময়ের আগেই খাবারের আয়োজন করা হলো। প্রতিবারের চাইতে সেবার প্রায় দ্বিগুণ আয়োজন। বিদেশী শিল্পী বলে কথা। আমরা পনের ষোল জন মানুষ কিন্তু খাবারের পদে ঘর প্রায় ভরে গেলো। খাবারের পদে চোখ বুলাতে বুলাতে রোমানিয়ান শিল্পী জানালো সে কিছুই খাবে না।
কেনো খাবে না জানতে চাইলে সে ছলছল চোখে বলতে শুরু করলো, আমি এই কয়দিন তোমাদের দেশ ঘুরে ঘুরে দেখেছি। এখানে শুধু গ্রামে না শহরেও প্রচুর মানুষ না খেয়ে থাকে। আমি দেখেছি ডাস্টবিন থেকেও মানুষ খাবার সংগ্রহ করে খাচ্ছে।
মানুষের প্রতি তার মমত্ব দেখে চোখ ভিজে আসছিল। হঠাৎ করেই কেনো যেন সেই হানিফ ভাইয়ের ছাদ, সেই চিলেকোঠা, সেই রোমানিয়ান শিল্পী, তার গান, তার কথা সব মনে পরে গেল। বাড়ি ফিরে রাতের খাবারের বাহারি আয়োজন দেখে খেতে পারছিলাম না। হানিফ ভাইয়ের মতো হাউ মাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
সেসব দেখার পর আমি এতো আয়োজন করে এতো খাবার কিভাবে খাই তোমরাই বলো? তোমরা এগুলো খেয়ে রাতে ঘুমাতে পারবে? এতো এতো পদ দিয়ে খাওয়ার সময় তোমাদের একবারও সেই সব না খেয়ে থাকা মানুষের কথা মনে পরবে না? এই কয়জন মানুষের জন্য এতো আয়োজন এতো অপচয় তোমরা করো কি ভাবে? তোমরা কি মানুষ!!!
মনে পরে এক পর্যায়ে হানিফ ভাই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অনুনয় বিনয় যা বলছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, আমাকে মাফ করে দেন দাদা। বাকি জীবনে আমি আর খাবারের এমন আয়োজন করবো না। খাবারের অপচয় করবো না, আমি কথা দিচ্ছি। যদি পারি না খেয়ে থাকা মানুষজনকে খাওয়াবো। আমি কথা দিচ্ছি। আপনি ক্ষুদার্থ কিছু মুখে দিন। আমার বাসায় এসে না খেয়ে যাবেন না।
রোমানিয়ান শিল্পী তার ভায়োলিন বাক্সে ঢুকাতে ঢুকাতে বলেছিল, তোমরা নিষ্ঠুর মানুষ। তোমাদের সাথে একসাথে বসে খাওয়ার আমার রুচি নাই। এরপরে সেই চিলেকোঠায় আর সেই আসর বসেনি। হানিফ ভাই এরপর কতজন নিরন্ন মানুষকে খাইয়েছিলেন জানি না।
আদৌ খাইয়েছিলেন কিনা তাও জানি না। তবে তিনি যেদিন মারা যান সেদিন এলাকার ভিক্ষুকেরা তার খাটিয়া ঘিরে হাউমাউ করে কেঁদে পাড়া মাথায় তুলেছিল। সেই দৃশ্য মনে হলে আজো গায়ে কাঁটা দেয়। এমন অকৃত্রিম কান্না আর কি দেখেছি কখনো?
রোমানিয়ান সেই শিল্পীর কথা ভুলে গিয়েছিলাম সেই কবে। কিন্তু অল্পকিছু দিন আগে বাড়ি ফিরছি হঠাৎ দেখি গুলিস্তানের ফুটপাথে এক ভদ্রলোক বসে বসে কি যেনো করছে। একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখি তিনি ফুটপাথে শুয়ে থাকা অসুস্থ এক ভিক্ষুককে পরম যত্নে খাওয়াচ্ছেন।
মানুষের প্রতি তার মমত্ব দেখে চোখ ভিজে আসছিল। হঠাৎ করেই কেনো যেন সেই হানিফ ভাইয়ের ছাদ, সেই চিলেকোঠা, সেই রোমানিয়ান শিল্পী, তার গান, তার কথা সব মনে পরে গেল। বাড়ি ফিরে রাতের খাবারের বাহারি আয়োজন দেখে খেতে পারছিলাম না। হানিফ ভাইয়ের মতো হাউ মাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। তারপরও আমরা অসভ্য-নির্লজ্জের মতো খেয়েই যাই। খেয়েই যাই। করি বাহারি আয়োজন। আমরা এসব কাহিনী মানুষকে বলার জন্য তুলে রাখি মাত্র। এই সব মানুষিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে লালনে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে বহুবার ভেবেছি সাঁইজি কি অদ্ভুতভাবে সহজে কত কত কথা বলে দিয়েছেন। যা হাজার হাজার লাইন লক্ষ লক্ষ শব্দ লিখেও বলতে পারি না-
জানগে মানুষের করণ কিসে হয়।
ভুল না মন বৈদিক রাগের ভোলে
আগে অনুরাগের ঘরে বয়।।
ভাটির স্রোত যদি বয় উজান
তা কী হয় মানুষের করণ,
পরশন না হলেরে মন
দর্শনে কী হয়।।
টলমল করণ হয় যার
স্পর্শ গুণ কৈ মিলে তার,
গুরু শিষ্য যুগ যুগান্তর
ফাঁকে ফাঁকে রয়।।
লোহা সোনা হয় পরশে
যেমনি করণ তেমনি সে,
লালন বলে হলে দিশে
জ্বর জ্বালা যায়।।
নারায়ণগঞ্জে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। প্লাটফর্মের ভিড় ঠেলে লালসালু পরিহিত জটাধারী হনহন করে সকলকে পাশ কাটিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘দশ টেকা দে।’ সাধারণত এসব আমি এড়িয়ে যাই। কিন্তু জটাধরীর ভঙ্গিটা বেশ ভালো লাগলো। তাই কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে আধ ময়লা দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলাম।
সাধু গনগনে রক্তচক্ষুতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, কি চাস বল্ এক্ষুণী দিয়া দিবো। কিছু চাই না বলতে গিয়েও ভাবলাম এমন কিছু একটা চইলে কেমন হয় যাতে সাধু প্যাঁচে পরে যায়? এমন অবস্থায় মাথায় কিছুই আসে না। কি চাই কি চাই ভাবছি। তারপর আমিও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম, আমি যা পাই তা আমি চাই না… যা চাই তা পাই না… এর একটা সমাধান করে দিতে পারবেন সাধু?
জটাধারীর চোখের আগুন দ্বিগুণ হলো। রক্তচক্ষুতে ক্ষণিকের বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেন। সাধু আমার হাতে দশটাকা ফেরৎ দিয়ে ভিড়ে হারিয়ে গেলো। আমি পকেটে সেই আধ ময়লা দশটাকা নিয়ে বহুদিন ঘুরেছি।
কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে তা খরচ করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু তা আর হয় নি। সাধুর মতো সেই টাকাখানাও হারিয়ে গেছে সকলের ভিড়ে। এভাবেই তোমাকে হারিয়ে ফেলি সকলের মাঝে। যা রাখার কথা ছিল যত্নে। এ দোষ কারো নয় এ দোষ আমারি-
আমি কি দোষ দিব কারে রে।
আপন মনের দোষে পালম রে ফেরে।।
সুবুদ্ধি সুস্বভাব গেল
কালের স্বভাব মনে হ’ল,
ত্যাজিয়ে অমৃত ফল
মাকাল ফলে মন মজিল রে।।
যে আশায় এই ভবে আসা
ভাঙ্গিলরে আশার বাসা,
ঘটিল রে কি দুর্দশা
ঠাকুর গড়তে বানর হলরে।।
গুরু বস্তু চিনলি না মন
অসময় কি করবি তখন,
বিনয় করে বলছে লালন
যজ্ঞের ঘৃত কুত্তায় খেলরে।।
আমি কি দোষ দিব কারে রে: ভিডিও
(চলবে…)
…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই
মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
1 Comment