তারকের পরশে কাটা গাছ বাড়ে
হরিচাঁদ লীলা খেলা কে বোঝে ধরায়।
কার দ্বারা কিবা করে হরি দয়াময়।।
হরি হতে নাম বড় এ ভব সংসারে।
নাম হতে ভক্ত বড় জানাই সবারে।।
হরিভক্ত গুণ কথা কহন না যায়।
হরিভক্ত দরশনে প্রেমের উদয়।।
তার কিছু তত্ত্ব কথা কহিব এখন।
ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্ণন।।
হরিভক্ত শিরোমণি তারক গোঁসাই।
লীলামৃত গ্রন্থখানি যার দ্বারা পাই।।
কবিগান করে তিনি দেশ দেশান্তর।
হরিচাঁদ গুণ কথা করেন প্রচার।।
একদিন চলিলেন খুলনা জেলায়।
রামপাল থানা মধ্যে হলেন উদয়।।
দল বল সঙ্গে করে হাটিতে হাটিতে।
উদয় হইল গিয়ে হুকড়া গ্রামেতে।।
পথিমধ্যে চারিজন লোক বসা ছিল।
তারকে হেরিয়া তারা কান্দিয়া কহিল।।
এই দেশে আমাদের চেনা জানা নাই।
বিপদে পরিয়া মোরা তোমাকে জানাই।।
আমাদের বাড়ী হয় ঘৃতকান্দি গায়।
করাতির কাজে মোরা এসেছি হেথায়।।
হরিচাঁদ ভক্ত তুমি তারক গোঁসাই।
তুমি বিনে এ বিপদে আর কেহ নাই।।
রূপচাঁন্দ নামে এই গ্রামে একজন।
তার বাড়ী কাজ করি শুন বিবরণ।।
দশদিন এই বাড়ী কাজ করিতেছি।
একগাছ ছেও দিয়ে বিপদে পড়েছি।।
কথাছিল দশ ফুট ছেও দিতে হবে।
ঠিকমত গাছখানি চেরাই করিবে।।
ঠিকমত মাপ দিয়ে কাটা হয়ে গেল।
হেন কালে রূপচাঁন্দ তথায় আসিল।।
নিজ হাতে রূপচাঁন্দ মাপিয়া দেখিল।
চারি ইঞ্চি গাছখানি কম পড়ে গেল।।
নিজে রাও মেপে দিখে চারি ইঞ্চি কম।
বারে বারে মাপিলাম হয় ব্যাতিক্রম।।
তাই দেখে রূপচাঁন্দ গালাগালি দিয়া।
আমাদের অস্ত্র গুলি রাখে ঘরে নিয়া।।
আমাদের টাকা কড়ি কিছু নাহি দেয়।
তাই মোরা বসে আছি হয়ে নিরুপায়।।
তাই শুনে সে তারক তাহাদের নিয়ে।
কাটা গাছ যথা আছে উত্তরিল গিয়ে।।
হরিচাঁদ ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
সেই গাছে হাত দিয়া কহিছে কান্দিয়া।।
শুন শুন গাছ তুমি মোর কথা লও।
চারি ইঞ্চি বেড়ে তুমি ঠিক মত হও।।
বলা মাত্র সেই গাছ বাড়িতে লাগিল।
চারি ইঞ্চি বেড়ে গাছ ঠিকমত হল।।
এত বলি শ্রীতারক তাদের কহিল।
মাপকাঠি আন দেখি কত কম পল।।
তাই শুনে করাতিরা মাপ কাঠি নিয়ে।
ঠিকমত গাছখানি দেখিল মাপিয়ে।।
দেখিলেন সকলেতে গাছ কম নাই।
তারকের পদে পড়ে কেন্দে ছাড়ে হাই।।
তারক বলেছে সব সুস্থ্য কর মন।
মালিকেরে ডেকে আন গিয়ে একজন।।
তাই শুনে একজন গমন করিল।
দ্রুত গতি গিয়ে তারে ডাকিয়ে আনিল।।
রূপচাঁন্দে ডেকে বলে তারক গোঁসাই।
কিবা অপরাধ করে ইহারা সবাই।।
চারি ইঞ্চি কম গাছ ইহারা কেটেছে।
তব মাপ মনে হয় ভুল হয়ে গেছে।।
তাই শুনে রূপচাঁন্দ কি যেন ভাবিয়া।
মাপ কাঠি দিয়ে গাছ দেখিল মাপিয়া।।
বারে বারে মেপে দেখে ঠিক মত হয়।
তারকের কাছে এসে পদে ক্ষমা চায়।।
মনে হয় আগে আমি ভুল মাপিয়াছি।
সকলের কাছে আমি ক্ষমা চাহিয়াছি।।
তাই শুনে শ্রীতারক কহিল তখন।
শুন সবে মন দিয়া আমার বচন।।
দয়া ছাড়া ধর্ম নাই এভব সংসারে।
ক্ষমা যদি চায় কেহ ক্ষমা কর তারে।।
তাই শুনে রূপচাঁন্দ কহিল তখন।
শুন ভাই করাতিরা আমার বচন।।
মোর এই গাছ খানি করহে চেরাই।
তোমাদের টাকাকড়ি সব দিব ভাই।।
তারকেরে কহিলেন করিয়া বিনয়।
মম গৃহে চল তুমি ওগো মহাশয়।।
তারক বলেছে আমি দেরি না করিব।
এই গ্রামে আমি আজ কবিগান গাব।।
এত বলি শ্রীতারক গমন করিল।
রূপচাঁন্দ তারকের পদে প্রণমিল।।
তারকের পদে যেই পরশ করিল।
কি যেন কি আকর্ষণে প্রেম সঞ্চারিল।।
সেই হতে গৃহে গিয়ে ভাবিতে লাগিল।
তারকের ছবিখানি হৃদয় জাগিল।।
কবিগান হবে সেথা দক্ষিণ পাড়ায়।
মন বড় উচাটন চলিল তথায়।।
তারকের গান শুনে ঝরে আখি জল।
মহাভাব উথলিল বলে হরি বল।।
সবে দেখে রূপচাঁন্দ দুর্জয় মানুষ।
গান শুনে কান্দিতেছে হইয়া বেহুষ।।
ধরা ধরি করে সবে সান্তনা করিল।
তীর বেগে ছুটে গিয়ে চরণে পড়িল।।
তারকের পদে পড়ে কান্দিয়া ভাষায়।
অপরাধ করিয়াছি রেখ রাঙ্গা পায়।।
তোমাকে চিনিতে মোর সাধ্য কিছু নাই।
আমার মনের কথা তোমাকে জনাই।।
তোমার পরশে কাটাগাছ বেড়ে যায়।
আমা হতে সেই কথা হইল প্রত্যয়।।
আগে আমি না জানিয়া ভুল করিয়াছি।
আজ হতে তব পায় শরণ নিয়েছি।।
দস্যু মন ছিল মোর আসিয়া সংসারে।
তোমার পরশে আজ সব গেল দুরে।।
এত বলি রূপচাঁন্দ কান্দিতে লাগিল।
তারক ধরিয়া তাকে সান্তনা করিল।।
সান্তনা করিয়া বলে শুন বাছাধন।
মোর প্রতি সদা যেন থাকে তব মন।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদে স্মরণ করিবে।
হাতে কাম মুখে নাম সত্য পথে রবে।।
হেন কথা রূপচাঁন্দ যখন শুনিল।
তারকের চরণেতে প্রণাম করিল।।
পদ ধুলি অঙ্গে মেখে গুহেতে চলির।
গান শেষে শ্রীতারক বিদায় হইল।।
এইভাবে কতদিন গত হয়ে যায়।
রূপচাঁন্দ মনে প্রাণে ভাবিত হৃদয়।।
আর কবে হেরিব সে মানুষ রতন।
দিবানিশি সদা করে মন উচাটন।।
সংসার বন্ধন হতে কবে মুক্ত হব।
তারকের পদে গিয়ে আত্ম সমর্পিব।।
একদিন রূপচাঁন্দ প্রভাতে জাগিয়া।
তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।।
জয়পুর যাব বলে করিল গমন।
ভাবে গদগদ চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
চারিদিন পরে গিয়ে হইল উদয়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা করি নিবেদন।
কৃপা করে অধমের কর হে গ্রহণ।।
তারক ধরিয়া তবে রূপচাঁন্দে কয়।
হরিনাম মহামন্ত্র দিলাম তোমায়।।
হাতে কাম মুখে দাম্পত্য কথা কবে।
পবিত্র চরিত্র রেখে সংসার করিবে।।
তারপর শ্রীতারক কত শিক্ষা দিল।
ভোজন করিয়া সবে নিশি কাটাইল।।
পর দিন তথা হতে ভোজন করিয়া।
ওড়াকান্দি করে যাত্রা রূপচান্দে নিয়া।।
রূপচাঁদ কাছে গিয়ে দিল দরশন।।
গুরুচাঁদ চরণেতে প্রণাম করিল।
হাসি মুখে গুরুচাঁদ কহিতে লাগিল।।
শুন বলি রসরাজ তোমাকে জানাই।
রূপচান্দ হবে পরে রমণী গোঁসাই।।
তাই শুনে রুপচান্দ চরণে পড়িল।
গুরুচাঁদ পদ ধরি কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
চিরদিন তব পদে থাকে যেন মন।।
আমি অতি মুঢ়মতি কোন গুণ নাই।
তব পদ আমি যেন ভুলিয়া না যাই।।
অহংকারে মত্ত হয়ে কত কি করেছি।
গুরু পদ পরশেতে কি যেন হয়েছি।।
পরশ পরশে যেন লৌহ সোনা হয়।
সে মত হয়েছে মোর পাষাণ হৃদয়।।
এইভাবে রূপচাঁন্দ কান্দিতে লাগিল।
গুরুচাঁদ ধরে তুলে সান্তনা করিল।।
গুরুচাঁদ বলে শুন ওগে বাছা ধন।
ভক্তি পথে থাকে যেন সদা তব মন।।
হাতে কাম মুখে নাম মন খাটি চাই।
পরনারী মাতৃরূপ দেখিবে সদাই।।
প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম পালন করিবে।
চরিত্র পবিত্র রেখে সত্য কথা কবে।।
এইভাবে গুরুচান্দ কত বুঝাইল।
দু’জনারে ল’য়ে শেষে বাড়ী মধ্যে গেল।।
সত্য ভাষা চরণেতে প্রণাম করিয়া।
যার যার দেশে সবে গেলেন চলিয়া।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
গুরুচাঁদ ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।