আদম (আ)-এর সন্তান-সন্তুতির আলোচনা প্রসঙ্গে কথিত তাওরাতের (বাইবেলের) বর্ণনা উল্লেখ করিয়া ইব্ন কাছীর (র) বলেন:শীছ-এর জন্মকালে আদম (আ)-এর বয়স ছিল ১৩০ বৎসর। তারপর তিনি আরও ৮০০ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন।
তাঁহার ১৬৫ বৎসর বয়সে তাঁহার পুত্র আনুশের জন্ম হয়, তারপর তিনি আরও ৮০৭ বৎসর জীবিত ছিলেন। আনুশের ৯০ বৎসর বয়সে তৎপুত্র কীনানের জন্ম হয়। তারপর আনুশ আরও ৮১৫ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। কীনানের ৭০ বৎসর বয়সে তৎপুত্র মালাঈলের জন্ম হয়।
তারপরও কীনান আরও ৮৪০ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। মাহলাইলের ৬৫ বৎসর বয়সে তৎপুত্র আরদ-এর জন্ম হয়। তারপর মাহলাঈল আরও ৮৩০ বৎসর জীবিত ছিলেন। যার ১৬২ বৎসর বয়সে উপনীত হইলে তৎপুত্র খানূখ জন্মগ্রহণ করেন।
তারপরও য়াদ আরও ৮০০ বৎসর বাঁচিয়াছিলেন। খানূখের ৬৫ বৎসর বয়সে মালিহ-এর জন্মগ্রহণ করেন। তারপর খানূখ আরও ৮০০ বৎসর জীবিত ছিলেন। মালিহের ১৮৭ বৎসর বয়সে তৎপুত্র লামাকের জন্ম হয়। তারপরও মাশালিহ আরও ৭৮২ বৎসর জীবিত থাকেন।
লামাকের ১৮২ বৎসর বয়সে তৎপুত্র নূহ (আ)-এর জন্ম হয়। লামাক তাহার পরেও ৫৯৫ বৎসর জীবিত ছিলেন। নূহ (আ) ৫০০ বৎসরে উপনীত হইলে তদীয় তিন পুত্র সাম, হাম ও আফিছ-এর জন্ম হয় (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., পৃ. ৮৮-৮৯)
উক্ত হিসাবকে যথার্থ বলিয়া ধরিয়া নিলে আদম (আ)-এর জন্ম সাল হইতে নূহ (আ)-এর ৫০০ বৎসর বয়স পর্যন্ত সময়কাল ছিল:১৩০+১৬৫+৯০+৭০+৫+১৬২+৬+১৮৭+১৮+ ৫০০= ১৬১৬ বৎসর। নূহ (আ) যেহেতু আয়ু পাইয়াছিলেন আরও চারি শত পঞ্চাশ বৎসর, তাই উহাও হিসাবে ধরিয়া হয় মোট ২০৬৬ বৎসর।
বাইবেলের বর্ণনা বলিয়া কথিত উক্ত বিবরণটি উদ্ধৃত করিয়া আল্লামা ইবন কাছীর (র) মন্তব্য করেন:“উক্ত ইতিহাসপঞ্জী আসমানী কিতাবের বর্ণনারূপে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রহিয়াছে। বহু সীরাতবিদ এরূপ অভিমত ব্যক্ত করিয়া এ ব্যাপারে আহলি কিতাবদের বক্তব্যের সমালোচনা করিয়াছেন।
উক্ত বর্ণনায় যে অবিবেচনাপ্রলূত অতিরঞ্জন রহিয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য। অনেকে এই বর্ণনাটিতে ব্যাখ্যাস্থলে অনেক সংযোজন করিয়াছেন এবং তাহাতে প্রচুর ভুল রহিয়াছে”(প্রাগুক্ত)
বাইবেলের আদিপুস্তকের ৪, ৫, ১১, ২১ ও ২৫তম অধ্যায়ে প্রদত্ত বর্ণনার ভিত্তিতে বিখ্যাত ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলী হযরত ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত কুড়ি পুরুষের নাম, তাহাদের জন্মসন, আয়ুষ্কাল এবং তৎকালে আদম (আ)-এর জন্মের পর কত বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে তাহার যে ছক আঁকিয়াছেন,
তাহা নিম্নরূপ (নামগুলি যেহেতু আমদের একান্তই অপরিচিত ভাষার, তাই মরিস বুকাইলীর পুস্তকে উদ্ধৃত রোমান হরফে লিখিত নামগুলির সাথে অনুবাদক আখতার- উল-আলমের অনুবাদ পুস্তকে ব্যবহৃত বাংলা প্রতিবর্ণায়নকেই বাছিয়া নেওয়া নিরাপদ বিবেচনা করিয়াছি)
আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত কুড়ি পুরুষ নাম – হযরত আদমের সৃষ্টির কত কত বৎসর পর জন্ম – আয়ুষ্কাল – হযরত আদমের সৃষ্টির কত বৎসর পর মৃত্যু
১. হযরত আদম – * – ৯৩০ – ৯৩০।
২. শেথ (শীছ আ) – ১০৩ – ৯১২ – ১০৪২।
৩. ইনোশ – ২৩৫ – ৯০৫ – ১১৪০।
৪. কৈনন – ৩২৫ – ৯১০ – ১২৩৫।
৫. মহলে – ৩৯৫ – ৮৯৫ – ১২৯০।
৬. জেদ – ৪৬০ – ৯৬২ – ১৪২২।
৭. ইনোক – ৬২২ – ৩৬৫ – ৯৮৭।
৮. মধুশেলহ্ – ৬৮৭ – ৯৬৯ – ১৬৫৬।
৯. লামাক – ৮৭৪ – ৭৭৭ – ১৬৫১।
১০. হযরত নূহ (আ) – ১০৫৬ – ৯৫০ – ২০০৬।
১১. শেম (শাম) – ১০৫৬ – ৬০০ – ২১৫৬।
১২. অর্ফকষদ – ১৬৫৮ – ৪৩৮ – ২০৯৬।
১৩. শেলহ – ১৬৯৩ – ৪৩৮ – ২১২২।
১৪. এবার – ১৭২৩ – ৪৬৪ -২১৮৭।
১৫. পেলেগ – ১৭৫৭ – ২৩৯ – ১৯৯৬।
১৬. রিয়ু – ১৭৮৭ – ২৩৯ – ২০২৬।
১৭. স্বরূগ – ১৮১৯ – ২৩০ – ২০৪৯।
১৮. নাহোর – ১৮৪৯ – ২৩০ – ১৯৯৭।
১৯. তেরহ – ১৮৭৮ – ২০৫ -২০৮৩।
২০. হযরত ইবরাহীম – ১৯৪৮ – ১৭৫ – ২১২৩।
এই ছকটি পেশ করার পর মরিস বুকাইলি সুস্পষ্টভাবে লিখেন- উল্লেখ্য যে, এই ছকে ব্যবহৃত পরিসংখ্যান বাইবেলের আদিপুস্তকের পুরোহিতদের রচিত পাঠ হইতেই প্রাপ্ত, এই জাতীয় তথ্যাদির যাহা একমাত্র উৎস.
বাইবেলের বর্ণনানুসারে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ইবরাহীম (আ) আদম (আ)-এর ১৯৪৮ বৎসর পর জন্মগ্রহণ করেন (The Bible the Quran and Science, তাজ কোম্পানী, দিল্লী, পৃ. ৪৭).
লূক লিখিত সুসমাচারের বর্ণনা মোটামুটি উক্তরূপ। তবে তাহাতে ১৩ নং ক্রমিকে কৈননের নাম উক্ত হইয়াছে এবং তৎপরবর্তী শেলহ-এর নাম ১৪ নম্বরে আসিয়াছে। ফলে লূকের বর্ণনায় ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত বংশলতিকা ২১ পুরুষে পৌঁছিয়া গিয়াছে। মথি লিখিত সুসমাচারের ইবরাহীম (আ)-এর পূর্ববর্তী বংশলতিকা অনুপস্থিত।
কিন্তু লূক ও মথি উভয়ের বর্ণনার মধ্যে ইবরাহীম (আ) হইতে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত বংশলতিকার ব্যাপারে যথেষ্ট গরমিল পরিলক্ষিত হয়। ঐ বংশলতিকা বর্ণনায় দুইটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপে ইবরাহীম (আ) হইতে দাউদ (আ) পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ধাপে হযরত দাউদ (আ)-এর পর হইতে ঈসা (আ) পর্যন্ত বিবৃত হইয়াছে।
তুলনামূলকভাকে পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করিয়া তুলিয়া ধরার মানসে মরিস বুকাইলি পাশাপাশি ছক আঁকিয়াছেন নিম্নরূপ-
প্রাক-দাউদ বংশতালিকা মথির বর্ণনানুসারে:মথি ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বের কোন নাম উল্লেখ করেন নাই।
লুকের বর্ণনানুসারে-
১. আদম ২. শীছ ৩. ইনোস ৪. কৈনান ৫. মাহালালীল ৬. জেরদ ৭. ইনোক ৮. মেথুশেলহ ৯. লামেক ১০. নূহ ১১. শেম শাম. ১২. অকষদ ১৩. কৈনান ১৪. শেলহ ১৫. ইবর ১৬. পেলেগ ১৭. রিয়ু। ১৮. স্বরূপ ১৯. নাহুর ২০. তেরহ ২১.
ইবরাহীম দাউদ (আ)-উত্তর ঈসা আ)-এর বংশতালিকা
মখির বর্ণনানুসারে
১। ইবরাহীম (আ) ২। ইসহাক (আ) ৩। ইয়াকূব (আ) ৪। এহুদা ৫। পেস ৬। হেযরন ৭। রাম ৮। আমীনাদব ৯। নহশোন ১০। সলমোন ১১। বোয়স ১২। ওবেদ ১৩। যিশয় ১৪। দাউদ (আ)
লূক-এর বর্ণনানুসারে
২২. ইসহাক আ. ২৩. ইয়াকূব আ. ২৪. ইহুদা ২৫. পেরস ২৬. হেযরন ২৭. অর্নি ২৮. অদমান ২৯. আম্মীনাদব ৩০. নহশোন ৩১. সালা ৩২. বোয়স ৩৩. ওবেদ ৩৪. যিশয় ৩৫. দাউদ (আ. লক্ষণীয়, উক্ত ছকে উভয় বর্ণনার মধ্যে যেমন নামগত বিস্তর ফারাক রহিয়াছে, তেমনি রীতিমত একটি পুরুষেরও তারতম্য হইয়া গিয়াছে। মথির বর্ণনায় যেখানে ইবরাহীম (আ) হইতে দাউদ (আ) পর্যন্ত ১৪ পুরুষ দেখান হইয়াছে, সেখানে লূকের বর্ণনায় তাহা ১৫ পুরুষ।
দাউদ (আ) হইতে ঈসা (আ) পর্যন্ত বংশতালিকা-
মথির বর্ণনানুসারে- ১৪. দাউদ (আ) ১৫. সুলায়মান (আ) ১৬. রহবিয়াম ১৭. আবিয় ১৮. আসা ১৯. যিহোশাফ্ট ২০. যোরাম ২১. উযিয় ২২. যোথম ২৩. আহস ২৪. যিকনিয় ২৫. মনঃশি ২৬. আমোস ২৭. যোশিয় ২৮. যিকনিয় (ইয়াহূদীদের বাবিল দেশে নির্বাসন) ২৯. শলটিয়েল ৩০. সরুব্বাবিল ৩১. অবীহূদ ৩২. ইলীয়াকিম ৩৩. আসোর ৩৪. সাদেক ৩৫. আখীম ৩৬. ইলীদ ৩৭. ইলিয়াসর ৩৮. মওন ৩৯. ইয়াকূব ৪০. ইউসুফ ৪১. যীশু (ঈসা আ)
লূকের বর্ণনানুসারে- ৩৫. দাউদ (আ) ৩৬. নাথান ৩৭. মওথ ৩৮. মিন্না ৩৯. মিলিয়া ৪০. ইলিয়াকিম ৪১. যোনম ৪২. ইউসুফ ৪৩. যুদা ৪৪. শামাউন ৪৫. লেবি ৪৬. মওত ৪৭. যোরীম ৪৮. ইলীয়েশর ৪৯. ইউসা ৫০. এর ৫১. ইলমাদস ৫২. কোষম ৫৩. আদ্দী ৫৪. মল্কি ৫৫. নেরি ৫৬. শল্টিয়েন ৫৭. সরুব্বাবিল ৫৮. রীষা ৫৯. যোহানা ৬০. যুদা ৬১. যোশেখ ৬২. শিমিয়ি ৬৩. মওপিয় ৬৪. মাট ৬৫. নাগ ৬৬. ইলি ৬৭. নহুম ৬৮. আমোষ ৬৯. মওযিয় ৭০. ইউসুফ ৭১. যান্নায় ৭২. মলকি ৭৩. লেবি ৭৪. মওত ৭৫. এলি ৭৬. ইউসুফ ৭৭. যীশু (হযরত ঈসা)
উক্ত বংশলতিকাটি একান্তই ইসরাঈলী উৎস তথা বাইবেলের পুরাতন নিয়ম ও লূতন নিয়ম হইতে প্রাপ্ত। এতদ্ব্যতীত এই সংক্রান্ত অন্য কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। লোক পরম্পরার গড়পড়তা বয়স অনুমান করিয়া আদম (আ)-এর যুগ নির্ণয়ের প্রয়াস পাইবার কোনই উপায় নাই। তাই ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলী উক্ত ছকগুলি উদ্ধৃত করার পর বিভিন্ন পর্যায়ের উপর বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক তাহার বিখ্যাত The Bible The Quran & Science পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে মন্তব্য করিয়াছেন-
“বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এতদসংক্রান্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান যে আধুনিক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে একেবারে অগ্রহণযোগ্য তা অন্যরা তো বটেই খোদ ভ্যাটিকান কাউন্সিলও স্বীকার করে নিয়েছে। তারা বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এই ধরনের তথ্য পরিসংখ্যানকে সেকেলে বলে সর্বসম্মত অভিমত প্রকাশ করেছেন।
অথচ দেখা যাচ্ছে বাইবেলের নতুন নিয়মের (ইঞ্জিল) সুসমাচারগুলিতেঅবলীলায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে সঙ্গতিবিহীন এইসব সেকেলে তথ্য ও পরিসংখ্যান গ্রহণ করা হইয়াছে। সুতরাং যারা মনে করেন যে, সুসমাচারসমূহের বর্ণনা ঐতিহাসিকভাবে সঠিকত্বের দাবিদার, তাদের সে দাবি যে কতটা ভিত্তিহীন, এই থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।” (বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান, পৃ. ১৫০, আখতার-উল-আলম অনূদিত)
“লূক তদীয় সুসমাচারে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বপুরুষের যে তালিকা তুলিয়া ধরিয়াছেন, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচারে তাহা আদৌ গ্রহণযোগ্য নহে।” (Bible Quran & Science, পৃ. ১০০)
১৮৬৩ সালে ইয়াহুদী-খৃস্টধর্ম ও তাহাদের শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ভারতীয় আলিম মওলানা রহমতুল্লাহ কীরানভী (১২৩৩ হি.-১৩০৮ হি./১৮১৮ খৃ.-১৮৯১ খৃ.) কর্তৃক লিখিত বিখ্যাত ইযহারুল হক গ্রন্থের চারটি খণ্ডে বাইবেলের পুরাতন ও লূতন নিয়মে যে অসংখ্য বিকৃতি এবং বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংস্করণে যে অসংখ্য তারতম্য পরিলক্ষিত হয় তাহা বিস্তারিতভাবে তুলিয়া ধরেন, যাহাতে বাইবেলের অনির্ভরযোগ্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও স্বীকৃত হইয়াছে। সেই গ্রন্থ হইতে এই সংক্রান্ত কেবল দুইটি ছকই নিম্নে উদ্ধৃত করা হইতেছে।
ইতোপূর্বে আমরা আল্লামা ইবন কাছীর (র)-এর আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া এবং মরিস বুকাইলীর বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান গ্রন্থে উদ্ধৃত বাইবেলের পুরাতন ও লূতন নিয়মের বরাতে আদম (আ) হইতে পরবর্তী দশ পুরুষ নূহ (আ) পর্যন্ত অধস্তন পুরুষগণের কাহার কোন বয়সে সন্তানের জন্ম হইয়াছিল তাহার বর্ণনা দিয়া আসিয়াছি। এবার নিম্নে ছকটি লক্ষ্য করুন-
আদম (আ) হইতে নূহ (আ) (প্লাবন) পর্যন্ত কাহার কত বৎসর বয়সে সন্তানের জন্ম হয়
নাম – বাইবেলের হিব্রু ভাষ্যমতে – সামারিয়ান ভাষ্যমতে – গ্রীক ভাষ্যমতে
১. হযরত আদম (আ) ১৩০ বৎসর – ১৩০ বৎসর – ২৩০ বৎসর।
২. হযরত শীছ (আ) ১০৫ – ১০৫ – ২০৫।
৩. কৈনান ৭০ – ৭০ – ১৭০।
৪. সাবালাবীল ৬৫ – ৬৫ – ১৬৫।
৫. য়ারদ – ১৬২ – ৬২ – ১৬৫।
৬. ইনূক (ইদরীস আ) ৬৫ – ৬৫ – ১৬৫।
৭. মেধু শালেহ ১৮৭ – ৬৭ – ১৮৭।
৮. লামাক – ১৮২ – ৫৩ – ১৮৮।
৯. নূহ (আ) ৬০০ – ৬০০ – ৬০০।
মোটঃ ১৬৫০ – ১৩০৭ – ২২৬২।
(টীকা ও ইযহারুল হক, আরবী, ২খ, পৃ. ৪৩১, রিয়াদ মুদ্রণ ১৯৮৯ খৃ.; ঐ, ইংরেজী ভাষ্য, ওলী রাযীকৃত, রিয়াদ ১৯৯২ খৃ., ২খ, পৃ. ৬২)
নূহ (আ)-এর প্লাবন হইতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত।
নাম – হিব্রু বাইবেলের ভাষ্যমতে – সামানিয়ান বাইবেলের ভাষ্যমতে – গ্রীক বাইবেলের ভাষ্যমতে
সাম – ২ বৎসর – ২ বৎসর – ২ বৎসর
আখশদ – ৩৫ – ১৩৫ – ১৩৫।
কৈনান -? -? – ১৩০।
সালাহ – ৩০ – ১৩০ – ১৩০।
ইবর – ৩৪ – ১৩৪ – ১৩৪ -।
পেলেগ – ২৩০ – ১৩০ – ২৩০।
রিযূ – ০২ – ১৩২ – ১৩২
সরূগ – ৩০ – ১৩০ – ১৩০।
নহুর – ২৯ – ৭৯ – ৭৯।
তারেহ (ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর) – ৭০ – ৭০ – ৭০।
মোট: ২৯০ – ৯৪২ – ১০৭২
উক্ত ছকটি আপন কিতাবে সন্নিবেশিত করিয়া মওলানা রহমতুল্লাহ কীরানভী (র) লিখেন:“এই মতপার্থক্যও এতই অধিক যে, উক্ত ভাষ্যগুলির মধ্যে সাযুজ্য বিধান কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে এবং যেহেতু হিব্রু ভাষ্যমতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম মহাপ্লাবনের ২৯২ বৎসর পর বলিয়া প্রতীয়মান হয় এবং নূহ (আ) মহাপ্লাবনের পর ৩৫০ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন, যাহার সুস্পষ্ট উল্লেখ আদিপুস্তক,
নবম পরিচ্ছেদ-এর ২৮তম শ্লোকে রহিয়াছে, এই হিসাবে নূহ (আ)-এর ওফাতের সময় ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ৫৮ বৎসর হইতে হয়, যাহা ঐতিহাসিকগণের সর্ববাদীসম্মত মতের বিরোধী। গ্রীক এবং সামারিয়ান ভাষ্যও উহাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কেননা প্রথমোক্ত ভাষ্যমতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম নূহ (আ)-এর ইন্তিকালের ৭২২ বৎসর পূর্বেকার ঘটনা এবং দ্বিতীয়োক্ত ভাষ্যমতে উহা ছিল ৫৯২ বৎসর পূর্বের কথা। ছক আঁকিলে দাঁড়ায় এইরূপঃ
গ্রীক ভাষ্য – সামেরিয়ান ভাষ্য – হিব্রু ভাষ্য
ক. নূহ (আ)-এর মহাপ্লাবন হইতে তাহার ইনতিকাল পর্যন্ত – ৩৫০ – ৩৫০ – ৩৫০।
খ. মহাপ্লাবন হইতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত – ১০৭২ – ৯৪২ – ২৯২।
অতএব (গ) নূহ (আ)-এর ইনতিকাল হইতে ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম পর্যন্ত – ১০৭২-৩৫০ / ৯৪২-৩৫০ / ২৯২-৩৫০
৭২২ বৎসর – ৫৯২ বৎসর – ৫৮ বৎসর
অর্থাৎ ঐ সময় ইবরাহীম (আ)-এর বয়স ছিল ৫৮ বৎসর (ইযহারুল হক, আরবী, ২য় খণ্ডের পাদটীকায়, যাহা ডঃ মুহাম্মাদ আবদুল কাদির খলীল মালাক্কায়ী কর্তৃক লিখিত, পৃ. ৪৩৫)
উপরন্তু গ্রীক ভাষ্যে অষদ ও শালেহ-এর মধ্যে এক পুরুষ বর্ধিত করা হইয়াছে (তিনি হইলেন কৈনান, যাহার কথা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হইয়াছে), হিব্রু ও সামেরিয়ান ভাষ্যে তাহার কোন উল্লেখ নাই।
লূক তদীয় সুসমাচার গ্রন্থে গ্রীক বর্ণনার উপর নির্ভর করিয়াছেন, তাই ঈসা (আ)-এর বংশলতিকার বর্ণনায় তিনি কৈনানের নাম বর্ধিত করিয়াছেন। উক্ত অসঙ্গত মতানৈক্যের দরুন খৃস্টীয় পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে।
ঐতিহাসিকগণ ঐ কারণেই উক্ত ভাষ্যত্রয়কে উপেক্ষা করিয়াছেন এবং অনির্ভরযোগ্য ঠাওরাইয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন, উক্ত সময়ের ব্যবধান ছিল ৩৫২ বৎসরের। অনুরূপভাবে বিখ্যাত ইয়াহুদী ঐতিহাসিক ইউসীকস উহার উপর আস্থা স্থাপন করেন নাই।
তিনি বলেন, উক্ত মেয়াদ ছিল ৯৯৩ বৎসর, যেমনটি হেনরী স্কট-এর বাইবেলের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে (ইযহারুল হক, আরবী, ২, পৃ. ৪৩৫-৪৩৬; কুরআন ছে বাইবেল তক, মওলানা তকী উছমানী কৃত উর্দু ভাষ্য, ২খ, পৃ. ১৮, ৭ম সং, ১৪১০ হি., করাচী; ঐ, ইংরেজী ভাষ্য, ওলী রাযীকৃত, ২খ, পৃ. ৬৩-৬৪, ২য় সং, রিয়াদ, ১৪১২/১৯৯২)
আদম (আ)-এর বয়স বা সময়কাল নির্ণয় অথবা তাঁহার বংশধরদের তালিকা বর্ণনায় বাইবেলের বর্ণনা যে আদৌ গ্রহণযোগ্য নহে, উপরিউক্ত আলোচনার দ্বারা তাহা সুস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। গোটা খৃস্টান জগতের সম্মুখে উপরিউক্ত পুস্তক দুইখানা-ইযহারুল হক ও The Bible The Quran & Science চ্যালেঞ্জরূপে বিদ্যমান রহিয়াছে।
ইবন হিশাম (মৃত্যু ২১৮ হি./৮২৮ খৃ.) তাঁহার সীরাত গ্রন্থে আদম (আ) হইতে মুহাম্মাদ (স) পর্যন্ত নিম্নরূপ বংশতালিকা উল্লেখ করিয়াছেন-
১. আদি পিতা হযরত আদম (আ)
২. হযরত শীছ (আ)
৩. ইয়ানিশ (আশ)
৪. কায়নাথ।
৫. মাহলীল।
৬. ইয়াদ।
৭. আখন্মুখ অর্থাৎ (হযরত ইদরীস (আ)
৮. মাতুলালাখ।
৯. লামাক।
১০. নূহ (আ)
১১. সাম।
১২. আর ফাখশাজ।
১৩. শালেখ।
১৪. আয়বার (পূর্বোক্ত তালিকায় ইবরবা এর নামে যিনি উক্ত হইয়াছেন; অন্যমতে ইহার নাম আবে) তাবারীর মতে ফালেগ ও আবেরের মাঝখানে কায়আন নামক আরেক পুরুষ ছিলেন। তবে তিনি যাদুকর ছিলেন বলিয়া তওরাতে তাহার নাম বাদ দেওয়া হইয়াছে।” পাদটীকা সীরাতুন্নবী, ইবন হিশাম, ইফা, প্রকাশিত, ১খ, পৃ.৫)
১৫. ফালেখ (মতারে (ফালেগ)
১৬. রাউ (রিয়ু)
১৭. সাগ।
১৮. নাহূর।
১৯. তারেহ (আর)
২০. ইবরাহীম (আ)
২১. ইসমাঈল (আ)
২২. নাবিত।
২৩. ইয়াশজাব।
২৪. ইয়াকুব।
২৫. তায়রাহ।
২৬. নাহুর।
২৭. মুকাওয়াম।
২৮. উদাদ।
২৯. উদ্।
৩০. আদনান।
৩১. মাআদ।
৩২. নিযার।
৩৩. মুদার।
৩৪. ইলয়াস।
৩৫. মুদরাকা (আসল নাম আমির)
৩৬. খুযায়মা।
৩৭. কিনানা।
৩৮. নাদর।
৩৯. মালিক।
৪০. ফির (আসল নাম কুরায়শ, মতান্তরে ফিহর, উপাদি কুরায়শ; কুরায়শ বংশের আদি পুরুষ)
৪১. গালিব।
৪২. লুআই।
৪৩. কাব।
৪৪. মুররা।
৪৫. কিলাব।
৪৬. কুসাই।
৪৭. মুগীরা (আব্দ মানাফ)
৪৮. হাশিম (আসল নাম আমর)
৪৯. শায়বা (আসল নাম আবদুল মুত্তালিব)
৫০. আবদুল্লাহ।
৫১. মুহাম্মাদ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম (ইবন হিশাম, সীরাতুন নবী, পৃ. ৩-৭)
লক্ষণীয়, হযরত আদম (আ) হইতে ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত বিশ পুরুষের বংশতালিকায় উক্ত সময়ের ব্যবধান দেখান হইয়াছে প্রায় ২০০০ বৎসর।
মোটামুটি যতদূর জানা যায়, ঈসা (আ)-এর ১৮০০ বৎসর পূর্বে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আগমন ঘটে। বাইবেলের আদিপুস্তকের তথ্যানুসারে আদম (আ) কমবেশী ঈসা (আ)-এর ৩৮০০ বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন (The Bible The Quran & Science, P. 47)
লূকের বর্ণনানুসারে ঈসা (আ) আদম (আ)-এর ৭৭তম অধস্তন পুরুষ; অথচ ইবন হিশামের উদ্ধৃত বংশতালিকায় তাঁহার ৫৭০ বৎসর পরে জন্মগ্রহণকারী আমাদের নবী করীম (স)-কে ৫১তম অধস্তন পুরুষরূপে দেখান হইয়াছে।
সূরা বাকারার ৩৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র) বলেন, “আদম (আ)-কে বিশেষ গাছ বা উহার ফল খাইতে নিষেধ করা হইয়াছিল এবং তাহাকে এ ব্যাপারেও সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। কাজেই সে যেন তোমাদেরকে পাপে লিপ্ত করিয়া না দেয়।
অথচ হিসাবমতে ৭৭ পুরুষ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান ৩৮০০ বৎসর হইলে ৫১তম পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছিতে লাগে ৩৮০০-৭৬=৫০x৫০=২৫০০ বৎসর। কিন্তু কার্যত আমরা এই ব্যবধান পাইতেছি ৩৮০০+৫৭০=৪৩৭০ বৎসরের।
অপরদিকে যদি আমরা লুকের পরিবর্তে মথির বর্ণনার উপর নির্ভর করি, তাহা হইলে ঈসা (আ) পর্যন্ত ৪১ প্রতি দুই পুরুষের ব্যবধান গড়ে প্রায় ৯৫ বৎসর (৩৮০০-৪০) এই হিসাবে ৫১তম পুরুষ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ৪৭৫ বৎসর।
পক্ষান্তরে লূকের বর্ণনামতে আমাদের নবী করীম (স)-এর জন্মসাল হওয়া কথা ছিল, তাহার প্রকৃত জন্মসাল (৫৭০)-এর ১৮৭০ বৎসর পূর্বে, অন্যদিকে মথির বর্ণনা অনুসারে তাহার জন্মসাল হওয়া উচিত ছিল আরও ৩৮০ বৎসর পরে। সুতরাং বাইবেলের কোন বর্ণনাই যথার্থ বলিয়া মানিয়া লওয়া যায় না।
এখানে আরেকটি কথা প্রণিধানযোগ্য। প্রথম দিকের বংশধরগণ যত দীর্ঘ আয়ু লাভ করিয়াছেন, শেষ দিকের বংশধরগণ তেমনটি লাভ করেন নাই। সুতরাং মথির বর্ণনানুসারে ঈসা (আ) ৪১তম পুরুষ হইলে আমাদের নবী (স)-এর জন্মগ্রহণের বক্তব্যকে কোনমতেই মানিয়া নেওয়া যায় না।
এই কারণেই “ফাদার কানেসগিয়েসার তাঁর পুস্তকে এ মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, “কেউ যেন যীশুখৃস্ট সংক্রান্ত বাইবেলের কোন সুসমাচারের বর্ণনাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করেন।
কেননা বাইবেলের লেখকগণ কোন বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অথবা কোন বিশেষ বিষয়ের মোকাবেলা করার প্রয়োজনেই হয়তো বা নিজ নিজ জনপদে প্রচলিত লোককাহিনীকে এভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।” (The Bible The Quran & Science, P. 47 পৃ. ৬৪)
ফরাসী পণ্ডিত মরিস বুকাইলীর পুস্তকের অসংখ্য স্থানে তাই বাইবেলের পুরাতন ও লূতন নিয়মকে “আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত নহে, বরং পণ্ডিত ও ধর্মশাস্ত্রজ্ঞদের রচনা।” অবৈজ্ঞানিক ও অনির্ভরযোগ্য বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। এই কারণেই মহানবী (স) ইসরাঈলীদের রিওয়ায়াত সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন-
“আহলি কিতাবদের বর্ণনাকে সত্য বা মিথ্যা বলিতে যাইও না।” (মিশকাত, বুখারী, পৃ. ২৮; বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান-আখতার-উল-আলম অনূদিত, পৃ. ৮২)
সূরা বাকারার ৩৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতী মুহাম্মাদ শফী (র) বলেন, “আদম (আ)-কে বিশেষ গাছ বা উহার ফল খাইতে নিষেধ করা হইয়াছিল এবং তাহাকে এ ব্যাপারেও সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। কাজেই সে যেন তোমাদেরকে পাপে লিপ্ত করিয়া না দেয়।
এতদসত্ত্বেও হযরত আদম (আ)-এর তাহা খাওয়া আপাতদৃষ্টিতে পাপ বলিয়া মনে হয়। অথচ নবীগণ পাপ হইতে মুক্ত ও পবিত্র। সঠিক তথ্য এই যে, নবীগণের যাবতীয় পাপ হইতে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ থাকার কথা যুক্তি ও রিওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত।
এ কথা সুস্পষ্ট যে, শুধু ঐ বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখণ্ড ব্যবহারই হারাম ছিল না যে দুইটি হুযুর (সা)-এর হাতে ছিল, বরং যাবতীয় রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ সম্পর্কেই ছিল এই হুকুম, কিন্তু এখানে হয়তো এ ধারণাও হইতে পারে যে, এ নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক সেই বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণ খণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যেগুলি সে সময় তাহার হাতে ছিল।
চার ইমাম ও উম্মতের সর্বসম্মত অভিমতেও নবীগণ ছোটবড় যাবতীয় পাপ হইতে মুক্ত ও পবিত্র। কারণ নবীগণকে গোটা মানবজাতির অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে প্রেরণ করা হইয়াছিল। যদি তাঁহাদের দ্বারাও আল্লাহ পাকের ইচ্ছার পরিপন্থী ছোট-বড় কোন পাপকাজ সম্পন্ন হইত, তবে নবীগণের বাণী ও কার্যাবলীর উপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়া যাইত।
যদি নবীগণের উপর আস্থা ও বিশ্বাস না থাকে তবে দীন ও শরীআতের স্থান কোথায় অবশ্য কুরআন পাকের অনেক আয়াতে কতক নবী (আ) সম্পর্কে এ ধরনের ঘটনার বর্ণনা রহিয়াছে যাহাতে মনে হয় যে, তাহাদের দ্বারাও পাপ সংঘটিত হইয়াছে এবং আল্লাহ পাকের পক্ষ হইতে এজন্য তাহাদেরকে সর্তক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। হযরত আদম (আ)-এর ঘটনাও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
এ ধরনের ঘটনাবলী সম্পর্কে উম্মতের সর্বসম্মত মত এই যে, ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃত কারণে নবীদের দ্বারা এ ধরনের কাজ সংঘটিত হইয়া থাকে। কোন নবী জানিয়া শুনিয়া বা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ পাকের হুকুমের পরিপন্থী কোন কাজ করেন নাই।
এ ক্রটি ইজতিহাদগত ও অনিচ্ছাকৃত এবং তাহা ক্ষমার যোগ্য। শরীআতের পরিভাষায় ইহাকে পাপ বলা চলে না এবং এ ধরনের ভুল ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সেসব বিষয়ে হইতেই পারে না যাহার সম্পর্ক ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রচার এবং শরীআতের বিধি-বিধানের সহিত রহিয়াছে এবং তাঁহাদের ব্যক্তিগত কাজকর্মে এ ধরনের ভুল-ত্রুটি হইতে পারে।
হযরত আদম (আ)-এর এই ঘটনা সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়াছেন। (১) হযরত আদম (আ) কে যখন নিষেধ করা হইয়াছিল, তখন এক নির্দিষ্ট গাছের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াই তাহা করা হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে শুধুমাত্র সে গাছটিই উদ্দিষ্ট ছিল না, বরং সে জাতীয় যাবতীয় গাছই ইহার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
যেমন হাদীছে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (স) একখণ্ড রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ হাতে নিয়া ইরশাদ করিলেন, “এ বস্তু দুইটি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্য হারাম।”
এ কথা সুস্পষ্ট যে, শুধু ঐ বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখণ্ড ব্যবহারই হারাম ছিল না যে দুইটি হুযুর (সা)-এর হাতে ছিল, বরং যাবতীয় রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ সম্পর্কেই ছিল এই হুকুম, কিন্তু এখানে হয়তো এ ধারণাও হইতে পারে যে, এ নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক সেই বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণ খণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল যেগুলি সে সময় তাহার হাতে ছিল।
অনুরূপভাবে হযরত আদম (আ)-এর হয়তো এ ধারণা হইয়াছিল যে, যে গাছের প্রতি ইঙ্গিত করিয়া নিষেধ করা হইয়াছিল, এ নিষেধের সম্পর্ক ঐ গাছটিতেই সীমাবদ্ধ। শয়তান এ ধারণা তার অন্তরে বদ্ধমূল করিয়া দিয়াছিল এবং কসম খাইয়া বিশ্বাস জন্মাইল যে, আমি তোমাদের হিতাকাঙ্খী। তোমাদেরকে এমন কোন কাজের পরামর্শ দেই না যাহা তোমাদের পক্ষে ক্ষতিকর হইতে পারে। যে গাছ সম্পর্কে নিষেধ করা হইয়াছিল তাহা অন্য গাছ।
“তোমরা সকলেই এখান হইতে নামিয়া যাও। পরে যখন আমার পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট হেদায়াত আসিবে তখন যাহারা আমার হেদায়াত অনুসরণ করিবে তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না। যাহারা কুফরী করিবে ও আমার নির্দেশসমূহ অমান্য করিবে, তাহারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে।”
তাহা ছাড়া এমনও হইতে পারে যে, শয়তান এ কুমন্ত্রণা তাঁহার অন্তঃকরণে সঞ্চারিত করিয়াছিল যে, এ গাছ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আপনার সৃষ্টির সূচনা পর্বের সহিত সম্পৃক্ত ছিল। যেমন সদ্যজাত শিশুকে জীবনের প্রথম পর্যায়ে শক্ত ও গুরুপাক আহার হইতে বিরত রাখা হয়, কিন্তু সময় ও শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে সব ধরনের আহার্য গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। সুতরাং এখানে আপনি শক্ত সমর্থ হইয়াছেন। এখন সে বিধিনিষেধ কার্যকর নয়।
আবার এ সম্ভাবনাও রহিয়াছে যে, শয়তান যখন আদম (আ)-কে সেই গাছের উপকারিতা ও গুণাবলীর বর্ণনা দিতেছিল, যেমন সেই গাছের ফল খাইলে আপনি অনন্তকাল নিশ্চিন্তে জান্নাতের নেয়ামতাদি ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ভোগ করিতে পারিবেন।
তখন তাঁহার সৃষ্টির প্রথম পর্বে সে গাছ সম্পর্কে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা তাহার মনে ছিল না। কুরআন শরীফের উল্লেখ,- (আদম ভুলিয়া গেল এবং আমি তাহার মধ্যে সংকল্পের দৃঢ়তা পাই নাই) আয়াতও এ সম্ভাবতা সমর্থন করে। যাহাতে এ ধরনের বহু সম্ভাবনা থাকিতে পারে।
তবে সারকথা এই যে, হযরত আদম (আ) বুঝিয়া শুনিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে এ হুকুম অমান্য করেন নাই, বরং তাহার দ্বারা ভুল হইয়া গিয়াছিল, যাহা প্রকৃতপক্ষে কোন পাপ নয়। অবশ্য আদম (আ) স্বীয় ভুলের জন্য তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার পর তাঁহাকে মাফ করিয়া দেওয়া হয়ে (তাফসীর মাআরিফুল কুরআন, মাদীনা মুনাওয়ারা থেকে মুদ্রিত, পৃ. ৩১)
উপরন্তু আল্লাহ তাআলা এ ঘটনার জন্য আদম (আ)-এর চেয়ে ইবলীসকেই অধিকতর দায়ী করিয়াছেন (দ্র. ২:১২০, ২: ৩৬, ৭:২১, ২২) উপরিউক্ত আয়াতসমূহের প্রত্যেকটিতেই শয়তানকে আদম (আ)-কে প্ররোচিত করার জন্য দায়ী করা হইয়াছে এবং আদম (আ)-এর পদস্খলন বলিয়া ঐ ঘটনাকে অবিহিত করা হইয়াছে, পাপ বলা হয় নাই। আদম ও হাওয়ার দুনিয়ায় অবতরণ
পূর্ব সতর্কীকরণ সত্ত্বেও নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের জন্য আল্লাহ আদম (আ)-কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন- “আমি কি তোমাদেরকে এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইতে বারণ করি নাই এবং আমি কি তোমাদেরকে বলি নাই যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (৭:২২)?
আদম (আ) ও হাওয়া (আ) তাঁহাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হইয়া আল্লাহর শিখানো তওবার বাণী দ্বারা দোআ করিলেন। “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করিয়াছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে আমরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হইব।” (৭:২৩)
“তোমরা সকলেই এখান হইতে নামিয়া যাও। পরে যখন আমার পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট হেদায়াত আসিবে তখন যাহারা আমার হেদায়াত অনুসরণ করিবে তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না। যাহারা কুফরী করিবে ও আমার নির্দেশসমূহ অমান্য করিবে, তাহারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে।” (২:৩৮-৯)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমূদুল হাসান (র) লিখিয়াছেন, আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ)-এর তওবা তো কবুল করিলেন কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে জান্নাতে পুনর্গমনের নির্দেশ দিলেন না, বরং পৃথিবীতে বসবাসের যে হুকুম দিয়াছিলেন তাহাই বহাল রাখিলেন।
সহীহ মুসলিমে উল্লিখিত হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে:“সর্বোত্তম দিন, যাহাতে সূর্যোদয় হয়, জুমুআর দিন। কেননা এই দিনেই আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এই দিনেই তাঁহাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এই দিনেই তাঁহাকে জান্নাত হইতে বাহির করা হয়”।
কেননা উহাই ছিল তাঁহার হিকমতের অনুকূল। যেহেতু আদম (আ)-কে দুনিয়ার খলীফা মনোনীত করা হইয়াছিল, বেহেশতের জন্য নহে, সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা বলিয়া দিলেন, যাহারা আমার আদেশ পালনকারী হইবে, পৃথিবীতে বসবাস তাহাদের জন্য ক্ষতিকর হইবে না বরং লাভজনকই হইবে।
তবে যাহারা নাফরমান তথা আম্লাহর আদেশ অমান্যকারী হইবে, তাহাদের জন্য জাহান্নাম, আর এই পার্থক্য বিধানের জন্য সমুচিত ক্ষেত্রও এই পৃথিবীই (ফাওয়াইদে শায়খুল হিন্দ, তাফসীর উছমানী, টীকা নং ৬১, ২ ও ৩৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা) এই ব্যাখ্যায় উল্লিখিত প্রথম নির্দেশটি ছিল এইরূপঃ-
“আমি বলিলম, তোমরা একে অন্যের শক্ররূপে নামিয়া যাও, পৃথিবীতে কিছু কালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল।” (২: ৩৬)
লক্ষণীয়, এখানে তোমরা নামিয়া যাও আদেশে বহুবচন বোধক ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হইয়াছে। অন্যত্র বলা হইয়াছে- “তিনি বলিলেন, তোমরা উভয়ে একই সঙ্গে জান্নাত হইতে নামিয়া যাও। তোমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু।” (২০১২৩)
এখানে দ্বিবাচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করিয়া আদম (আ) ও ইবলীসকে বুঝান হইয়াছে। ইব্ন আবী হাতিম হযরত ইব্ন আব্বাস (র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন:“আদম (আ)-কে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী দানা নামক স্থানে নামাইয়া দেওয়া হয়।
পক্ষান্তরে হাসান হইতে বর্ণিত আছে:“আদম (আ)-কে ভারতবর্ষে, হাওয়াকে জিদ্দায়, ইবলীসকে দাক্তিমসানে, যাহা বসরা হইতে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত এবং সর্পকে ইসফাহানে নামাইয়া দেওয়া হয়।” ইবন আবী হাতিমেরও অনুরূপ একটি বর্ণনা রহিয়াছে।
আস-সুদ্দী (র) বলেন, “আদম (আ) ভারতবর্ষে অবতরণ করেন এবং তাহার সহিত হাজরে আসওয়াদ অবতীর্ণ হয়। আদম (আ)-এর হাতের মুষ্টিতে তখন জান্নাতের লতাপাতা ছিল যাহা তিনি ভারতবর্ষে রোপণ করেন, ফলে সেখানে সুগন্ধি বৃক্ষ উৎপন্ন হয়।” (কাসাসুল আম্বিয়া, ইব্ন কাছীর, পৃ. ২৯)
ইব্ন উমার (রা)-এর বর্ণনায় আদম (আ) সাফায় এবং হাওয়া মারওয়ায় অবতরণ করিয়াছিলেন বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। ইবন আবু হাতিমও অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১)
আবদুর রাযযাক হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা)-এর বরাতে বর্ণনা করেন:“আল্লাহ তাআলা যখন আদম (আ)-কে জান্নাত হইতে পৃথিবীতে নামাইয়া দিলেন তখন তাঁহাকে সর্বপ্রকার কাজ শিক্ষা দেন। তিনি তাঁহাকে জান্নাতের ফলমূল পাথেয়স্বরূপ সাথে দিয়া দেন।
তোমাদের এইসব ফলমূল হইতেছে জান্নাতের সেই ফলমূলেরই অংশ। তবে হাঁ, তোমাদের এই ফলমূলগুলি পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়, কিন্তু সেগুলি ছিল অপরিবর্তিত ও অবিকৃত।” (হাকিম, ২খ, পৃ. ৪৫৩)
সহীহ মুসলিমে উল্লিখিত হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীছে আছে:“সর্বোত্তম দিন, যাহাতে সূর্যোদয় হয়, জুমুআর দিন। কেননা এই দিনেই আদম (আ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এই দিনেই তাঁহাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং এই দিনেই তাঁহাকে জান্নাত হইতে বাহির করা হয়”।
…………………………
সীরাত বিশ্বকোষ থেকে
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………..
আরও পড়ুন-
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : তৃতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : চতুর্থ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : পঞ্চম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : ষষ্ঠ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : সপ্তম কিস্তি
সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে প্লাতনের মতবাদ
মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী
পবিত্র কোরানে সৃষ্টিতত্ত্ব
আরশ ও কুরসী সৃষ্টির বিবরণ
সাত যমীন প্রসঙ্গ
সাগর ও নদ-নদী
পরিচ্ছেদ : আকাশমণ্ডলী
ফেরেশতা সৃষ্টি ও তাঁদের গুণাবলীর আলোচনা
পরিচ্ছেদ : ফেরেশতাগণ
জিন সৃষ্টি ও শয়তানের কাহিনী
সীরাত বিশ্বকোষে বিশ্ব সৃষ্টির বিবরণ
আদম (আ) পৃথিবীর আদি মানব
আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আদম (আ)-এর সালাম
আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ
হাদীসে আদম (আ)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গ
আদম (আ)-এর সৃষ্টি