ভবঘুরেকথা
দোতারা বাউল ফকির সাধু গুরু

-দ্বীনো দাস

বাউল বা ফকিরদের সাধনাকে গুরুমুখী সাধনা বললে নিশ্চয় ভুল কিছু হবে না। সুফিদের মতেতো বটেই। সমগ্র ভারতীয় ও বাংলায় সাধনার ধারাতেও দেখা যায় গুরুর ভূমিকা অর্থাৎ পরম এবং প্রার্থীর ভেতর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বা সংযোগসূত্র হিসাবে অপরিসীম।

গৌতম বুদ্ধ এই ধারায় তার নিজের অবস্থানকে ব্যতিক্রমের অন্তর্ভুক্ত করলেও, অন্তর্দীপনকে বেশি গুরুত্ব দিলেও, পরবর্তীকালের বৌদ্ধরা গুরুমুখী হন। সন্তরাও গুরুকে অপরিসীম মূল্য দিয়েছেন। পরম এবং প্রার্থীর মাঝখানে সেতুবন্ধনে গুরুর ভূমিকা কমবেশি ভারত ও বাংলার সব ধরনের সাধনাতেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

আর্যদের আগমনের পর থেকে এই ধারাবাহিকতায় যেমন ধর্মমত সৃষ্টি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটিতে অদৃশ্যের মিলনাকাঙ্খিরা দৃশ্যমান গুরুকে আঁকড়ে ধরে ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। গুরু সম্পর্কে ভারত, বাংলায় অধ্যাত্মচিন্তার জগতে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং গুরুদের নানা শ্রেণীবিভাজন আছে।

আপাতত আমরা সেই বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলব, গুরু যিনি- শিষ্যের ভেতর সৎকার্য উদ্বোধন করে সঠিক পথে চালিত করেন এবং নিরবচ্ছেদ মুক্তির পথের সন্ধান দেন… তিনিই সদগুরু।

যে ব্যক্তির ভেতর সৎতর্ক, স্বতঃস্ফূর্ত হয়, তার জন্য বাহ্যদীক্ষা, অভিষেক ইত্যাদির প্রয়োজন হয় না। অন্তর্দীপন যার স্বতঃস্ফূর্ত নয় তার ক্ষেত্রেই সদ্গুরুর মধ্যস্থতা প্রয়োজন। যাহোক এবার আমরা সুফি, সন্ত, ফকির ও বাউলের ভেতর গুরুবাদী মতের কয়েকটি উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করব।

বাউলরা গুরু ও মুর্শিদ উভয় শব্দ তাদের গানে ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে মুর্শিদ শব্দটি ফকিরি মতের ধারাবাহিকতায় এসেছে। সুফি জলালুদ্দিন রুমি বলছেন-

রহনুমাই লায়েক আঁ কামিলাসত্
কে অজ খুদি ফানি বা জানাঁ বস্লসত্
রহ্বার রাহে্ তরিকৎ আঁ বুদ
কি ব অহকামে শরিয়ৎ মি রওয়াদ
ইঁ চুনিঁ কামিল বাজো গর রাহ্ রাওঈ
তা জে বস্লে দোসত্ ব বহরা শওঈ।।

অর্থাৎ-

পথ দেখাবে লায়েক যে হয় ষোলো আনা
খোদ মলে যে তবেই প্রাণের অভেদ জানা
তরিকতের পথটি দেখায় পথিকগুরু যে
শরিয়তের হুকুমে এই পথের চলাতে
এমন পথে চলতে গেলে পথিক খুঁজে নাও
তখন তোমার ঐ রাস্তায় বঁধূর দেখা পাও।।

এবার সন্ত কবীর বলছেন-

গুরু অজর সিদ্ধিঘোটা খাইয়ে দিল ভাই
গুরু আমায় সিদ্ধিঘোটা খাওয়ান যবে ভাই
সেদিন থেকে মিটলো আমার সকল দোটানাই।।

এবার ফকির লালন সাঁইজি কি বললো-

মুর্শিদের ঠাঁই নে নারে তা ভেদ বুঝে।
এ দুনিয়ায় ছিনায় ছিনায়
কি ভেদ নবী বিলিয়েছে।।

ছিনার ভেদ ছিনায় ছিনায়
যে পথে যার মন হল ভাই
সেই সে পথে দাড়িছে।।

অন্য পদে বলেছেন-

মুর্শিদ যার আছে নিহার
ধরিতে পরে অধর সেই অনাসে,
মুর্শিদ খোদা ভাবলে যুদা পড়বি প্যাঁচে।।

মুর্শিদের প্রয়োজন হয় কেন? এর উত্তর লালন সাঁইজি যা বললেন তা আমাদের বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে ফকিরি মত, কিন্তু তার প্রেরনায় তো সেই সুফিরা। দেখা যাক এবার-

নিরাকার রয় অচিন দেশে
আকার ছাড়া চলে না সে,
নিরন্ত সাঁই অন্ত যার নাই
যা ভাবে তাই হয়।।

বঙ্গে যোগ-ধর্ম সংস্কৃতির সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের ধারা জানাও প্রয়োজন। এইসব প্রয়োজনীয় গবেষণা অনেকে করেছেন তার মধ্যে শশিভূষন দাশগুপ্ত ‘Obscure Religious cults’ নামে একটি অশেষ পাণ্ডিত্য পূর্ণ গ্রন্থ লেখেন।

এই গ্রন্থে ত্রিশ পৃষ্ঠা ধরে প্রামাণিক আলোচনায় শশিভূষন বাউল ধর্মের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে এটা সুস্পষ্ট যে, বহুকাল ধরে, নানাবিধ ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতির কারণে, লোকধর্মের কোনও স্তরে, বিবিধ তত্ত্ব-উপনিষদ, যোগতত্ত্ব, তান্ত্রিক মত, বৌদ্ধ সহজ মত, গৌড়ীয় বৈষ্ণব মত, সুফি মত-সংমিশ্রিত হয়। এইরূপ এক অসামান্য সংমিশ্রণকেই বাউল ধর্মতত্ত্বরূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

(চলবে…)

………………..
আরো পড়ুন:
বাউল/ফকির : পর্ব-১
বাউল/ফকির : পর্ব-২
বাউল/ফকির : পর্ব-৩
বাউল/ফকির : পর্ব-৪
বাউল/ফকির : পর্ব-৫

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!