ভবঘুরেকথা
হুমায়ুন সাধু

-দ্বীনো দাস

(পূর্বে প্রকাশের পর…)
তিনি বাউল সাধনাতে যোগতত্ত্বের এবং যোগাভ্যাসের গুরুত্ব আলোচনা করেছেন। বঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য দার্শনিক ও কান্ট এর সঙ্গে পাশাপাশি অবস্থানে। বাউল-কান্ট সম্বন্ধে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন পীযুষকান্তি মহাপাত্র, তার ‘The Folk Cults of Bengal’ নামক গ্রন্থে। বাউল দর্শনের ব্যাখ্যাও তিনি করেছেন।

কোন কোন বাউল গোষ্ঠীতে ক্রমবর্ধমান গবেষণার খবর আসে। তাদের তরফ থেকে এমনও বলা হয় যে, পণ্ডিত গবেষকেরা তদের গ্রন্থে বাউল সাধ্য সাধনা সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, তাহার সহিত তাদের সাধনার কোন যোগাযোগ বা মিল নাই।

এই সমস্ত গ্রন্থের অধিকাংশই লেখকদের স্বকপোলকল্পিত ব্যাপার। এই অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। এইরূপ স্বকপোলকল্পনা অনুসারে সুধীন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন-

প্রকৃত বাউল এবং এই সব আউলে বাউল বা কর্তাভজা বাউলদের মধ্যে প্রভেদের দূরত্ব আছে। এ বাউল সে বাউল নয়, এদের প্রাণমন এবং বুদ্ধিবৃত্তি এমনভাবে মার্জিত এবং শিক্ষিত, যাতে জীবনের শ্রেষ্ঠ মরমীদের সঙ্গে এরা একই পংক্তি হয়েছে। এরা সত্যিকারের ভাবুক, কবি, দার্শনিক এবং যোগী।

বাউল ধর্মের আনুপূর্বিক ইতিহাস, তত্ত্ব, তত্ত্বের প্রকৃত অর্থ, ধর্মাভ্যাস এবং সাম্প্রদায়িক চরিত্র কেবল গভীর ও পরিব্যাপ্ত গবেষণাতেই উদ্ঘাটিত হতে পারত। বাউলের তত্ত্ব এবং বাউলের ধর্মাভ্যাস বাগর্থের মতো, পার্বতী-ধুর্জটির মতো সংশ্লিষ্ট।

এইরূপ গবেষণার সঙ্গে সংকলিত হয়েছে সাকুল্যে ৬৮০টি বাউল গান এবং অর্থ সঙ্কেত (লালন ফকির ছাড়া)। বাউল গান সংগ্রহ করা হয়েছে, নদীয়া, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, নরসিংদি, শ্রীহট্ট (সিলেট), ময়মনসিংহ, কেদুলির মেলা, বর্ধমানের বেতাল বন, বীরভুম আরো অনেক জায়গা থেকে।

কিন্তু প্রধান লালন ফকির ও অনান্য বাউলদের দ্বারা নির্মিত বহু প্রযৌক্তিক শব্দের অর্থ অজ্ঞাত হয়ে রইল। (লালন ফকির ছাড়া) আরও যে সকল বাউল গুরু ছিলেন, তারা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকলেন। হাউড়ে গোঁসাই, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, মদন বাউল, যাদুবিন্দু, হাসন রাজা, কুবির গোসাই, দীন শরৎ বাউল, গোঁসাই গোপাল, জালালুদ্দিন, পাগলা কানাই, বেহাল শাহ, রাজ খ্যাপা, রাধাশ্যাম, চণ্ডি গোঁসাই, রশীদ, পদ্মলোচন, ফটিক গোঁসাই, দূরবীন শাহ, বাউল আব্দুল করিম, এরফান শাহ সহ আরো অনেকে- এদের কথা কেউ মনে রাখেনি।

অবশেষে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিরচিত বাংলার বাউল ও বাউল গান প্রকাশিত হল এই সব হারিয়ে যাওয়া পদকর্তাদের পদ নিয়ে। ব্যাপক পড়াশুনা ও সংগ্রহের ক্ষেত্রকর্মের সুফল এই গ্রন্থ। গ্রন্থের দুইটি বিশিষ্ট মাত্রা – বাউল ধর্মের নিবিড় অধ্যয়ন এবং বাউল ধর্মাভ্যাসের প্রামানিক বিবরণ।

এইরূপ গবেষণার সঙ্গে সংকলিত হয়েছে সাকুল্যে ৬৮০টি বাউল গান এবং অর্থ সঙ্কেত (লালন ফকির ছাড়া)। বাউল গান সংগ্রহ করা হয়েছে, নদীয়া, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, নরসিংদি, শ্রীহট্ট (সিলেট), ময়মনসিংহ, কেদুলির মেলা, বর্ধমানের বেতাল বন, বীরভুম আরো অনেক জায়গা থেকে।

উপেন্দ্রনাথের মতে, আনুমানিক ১৬২৫ খৃষ্টাব্দ থকে ১৬৭৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বাংলায় বাউল ধর্ম পূর্ণরূপে আবির্ভূত হয়। প্রচলিত বাউল ধর্মের পাচটি উপাদান-

-বেদ বহির্ভূত ধর্ম।
-গুরুবাদ।
-স্থূল মানবদেহের গৌরব।
-ভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডবাদ মনের মানুষ।
-রূপ -স্বরূপ তত্ত্ব।

বাউলদের মূল সাধনা সারা বাংলায় এক প্রকার। ইহাদিগকে মোটামুটি তিনটি সম্প্রদায়ে ভাগ করা যায়-

১. মুসলমান বাউল বা ফকির সম্প্রদায়- উভয় বঙ্গে উভয়ের পদ্ধতি সমান সমান।
২. নবদ্বীপ সম্প্রদায়- ইহাদের মধ্যে প্রায় সকলি হিন্দু জাতির বাউল। রসিক বৈষ্ণব নামেও এদেরকে বলা হয়।
৩. রাঢ় সম্প্রদায়- পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভুম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এই বাউলদের দেখা মেলে।

সহজিয়া বৈষ্ণবদের যে পরিভাষার ব্যাবহার প্রবণতা তাতে ফকির মতের প্রভাব দেখা যায়।

সংরক্ষণশীল উচ্চবিত্ত কবি, সাহিত্যিক, লেখক সমাজ কখনো এই হতদারিদ্র নির্লোভ আত্মভোলা বাউল ও ফকিরদের মেনে নিতে পারেনি। তারা আগেও ঘোর বিরোধী ছিল, এখনো বিরোধীই হয়ে আছে।

সংরক্ষণশীল উচ্চবিত্ত সমাজ ও ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজের রক্তচক্ষু এবং নাসিকাকুঞ্জন যখন গরিব ঐ বাউল ফকিরদের নিজস্ব চিন্তাকে, নিজেস্ব অনুভবকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করে। তখন তো তাদের পক্ষে কোন কোন বিষয়ে Motivated Language রূপক শব্দ ব্যবহার করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তার অর্থ কিতাব পড়ে জানা যায় না।

বৃত্তিহুদা গ্রাম, সাহেব ধনীদের গুরুপাঠ, তেহট্ট থানার নিশ্চিন্তপুর গ্রাম-হাড়ি সম্প্রদায়ের কেন্দ্র; ছেঁউড়িয়া গ্রাম, লালন ফকিরের আখড়া। মধ্যবঙ্গের নদী বিধৌত, ছায়াসুনিবিড়, পাখির কাকলি মুখর, সবুজাভ গ্রামে সাধকদের গানে যে বৈরাগ্য, তার প্রধান উপাদান দুঃখ, হৃদয়ের অশান্তি, খেদ- কেন এমন হয়? এর কারণ শুধু প্রাতিস্বিক অসম্পূর্ণতার উপলব্ধি এমন বলা যায় না।

এর বৃহত্তর, গুরুতর কারণ ছিল স্মার্ত মতের প্রাধান্য, অসহনীয় বর্ণজাতিভেদ, ধনী বড় মানুষদের অত্যাচার এবং পরিবেশজাত সমস্যা ও প্রতিকূলতা।

লালন ফকিরের যে মরমী গান শুনে কবিগুরুর কবিহৃদয় ভাবে উদ্বেলিত, সে গান শুনে মোল্লারা তার সাধনাকেই ধ্বংস করতে চায়।

জাতিতত্ত্বের বজ্জাতিতে ডংকা মেরে, স্পষ্ট গায়ের জোর চাপিয়ে উচ্চারিত ব্রাহ্মণরা, ফকির বিরোধিতা করে তবু হাড়িরামীরা স্বধর্মে নিধন বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন।

যে লালন ফকির উনিশ শতকে বিখ্যাত মহাত্মা উপাধি পায় (ভারতের মহাত্মা গান্ধিরও আগে) সেই খ্যাতি সত্বেও কি তাকে প্রকৃত অর্থে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে?

(চলবে…)

………………..
আরো পড়ুন:
বাউল/ফকির : পর্ব-১
বাউল/ফকির : পর্ব-২
বাউল/ফকির : পর্ব-৩
বাউল/ফকির : পর্ব-৪
বাউল/ফকির : পর্ব-৫

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!