-দ্বীনো দাস
মনের ভাব বুঝার জন্য ভাষার সৃষ্টি, কিন্তু কোন বেদ বিধান, কোন কিতাবে, কোন ভাষা বাক্যে সেই অধর বা পরমআত্মাকে চিনা যাই না, এখানে এসবই রুদ্ধ। গুরু প্রদত্ত পথে আপনার সাথে আপনি ফানা হতে পারলেই সাঁই রাব্বানাকে পাওয়া যায়।
ইংরেজি, পারসি বা অন্য ভাষার দার্শনিকরা গবেষণা করে কি ভাবে আমাদের এই বাংলা ভাষার মর্ম ভেদ উদ্ধার করবে যা কিনা সম্ভব নয় বড়ই কঠি, বড়ই কঠিন।
সাধু ফকিররা বলে থাকেন- ‘মাতা পিতার শোনিত শুক্র (মল) সংযোগে উৎপন্ন মলমাংসময় শরীরকে অস্পৃশ্য জ্ঞানে ত্যাগ করে ব্রহ্মের বা পরম আত্মার সঙ্গে অভেদবোধ প্রাপ্তির ফলে ধন্য হও।’
বাউল বা ফকির তত্ত্বের ইতিবাচক দিকের পর্যালোচনায় জানা যায় যে দশ ইন্দ্রিয় ও ষড়রিপুর চক্রান্তে প্রকৃতি জীবজন্মের প্রবাহকে সচল রাখে। সন্তানের জন্ম প্রক্রিয়ার অনুসরণে সাধক দেখে যে, উচ্ছ্বসিত আনন্দের ক্রমভঙ্গ হয়ে সৃষ্টি হয়। প্রকৃতির জৈব চক্রান্তে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ এ আনন্দকে উপলব্ধি করতে পারে না।
বরং সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে নিজের দৈহিক ক্ষয়ের সূত্রে জরা এবং রোগকে স্বাগত জানায়। আনন্দ লোভে কামের দ্বারা সর্বস্বান্ত হয়। ইন্দ্রিয়ের পথে না পায় সুখ, না পায় তৃপ্ত। বরং সংসারে সন্তানাদির সংখ্যাবৃদ্ধিতে বেড়ে যায় অভাব ও দুশ্চিন্তা।
এ দুর্লভ মানবজন্মে সুখ, শান্তি, এবং পূর্ণ আনন্দকে উপলব্ধি করায় বাউল বা ফকিরি সাধনপন্থা। এ সাধনায় নিয়ন্ত্রিত নিয়ন্ত্রক মানুষে পরিণত হয়। রিপু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা, জৈব চক্রান্তে নিয়ন্ত্রিত মানুষ। গুরুমুখী সাধনায় ইন্দ্রিয়াদির পরিচালক প্রভুতে রূপান্তরিত হয়। সাধনায় সে সন্চয় করে অধিকতর মুলবস্তু। ফকিরি ভাব বা ভাষায়।
সন্তান জন্মে, অত্যধিক পরিশ্রমে, মূল বস্তুর ক্ষয়ে, জরা এবং মৃত্যুর ছায়া দেহে প্রসারিত হয়। মৃত্যুর পরপারে কোন স্বর্গ বা নরক নেই। বরং ইহা জীবনের সুখের আস্বাদনে আছে স্বর্গসুখ, দুঃখে নরক যন্ত্রণা। অথচ মানুষ এক বিরল ক্ষমতার অধিকারী। রিপু-ইন্দ্রিয়গুলিকে সে বশীভূত এবং পরিচালিত করতে পারে।
কামকে সে প্রসন্ন করে মহাকামে, কামিনীকে ভাবিনী প্রেমিকা রাধায় পরিণত করতে পারে। সে অনুভব করতে পারে সৃষ্টির মর্মমূলের পরমআত্মার আনন্দকে। এতে তার হয় তৃপ্তি। ক্ষয়, জরা-মৃত্যুকে বিলম্বিত করে সর্ববিধ ইন্দ্রিয়লব্ধ আনন্দকে পূর্ণভাবে উপভোগের পদ্ধতি মানুষের জানা আছে।
গুপ্ত গুরুমুখী বিদ্যায় এ তত্ত্ব সাধ্য-সাধনে পায় মানুষ। এ সাধনায় মানুষ পেতে পারে দীর্ঘ জীবন, সুখ ও শান্তি। জীবধর্ম এবং ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জীব যথার্থ মানুষ হতে পারে। অহম চেতনার তীব্রতা, স্বার্থবুদ্ধি, কামনার প্রাবল্যে মানুষ কুপথে গমন করে, সেখানে অতৃপ্তি, হিংসা, অশান্তি বিদ্যমান। বাউল বা ফকিরি সাধনপন্থায় সুখ, শান্তি, প্রেম লাভ হয়।
এ দুর্লভ মানবজন্মে সুখ, শান্তি, এবং পূর্ণ আনন্দকে উপলব্ধি করায় বাউল বা ফকিরি সাধনপন্থা। এ সাধনায় নিয়ন্ত্রিত নিয়ন্ত্রক মানুষে পরিণত হয়। রিপু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা, জৈব চক্রান্তে নিয়ন্ত্রিত মানুষ। গুরুমুখী সাধনায় ইন্দ্রিয়াদির পরিচালক প্রভুতে রূপান্তরিত হয়। সাধনায় সে সন্চয় করে অধিকতর মুলবস্তু। ফকিরি ভাব বা ভাষায়।
ফকির লালন সাঁইজি কি বললেন-
এনে মহাজনের ধন বিনাশ করলি ক্ষ্যাপা।
শুধু বাঁকির দায় যাবি যমালয়
হবে রে কপালে দায়মাল ছাপা।।
আনন্দবাজারে এলে
ব্যাপারে লাভ করব বলে
সারলে সে দফা
কুসঙ্গের সঙ্গে মজিয়ে কুরঙ্গে
হাতের তীর হারায়ে হলি রে ফ্যাপা।।
কীর্তিকর্মা সেহি ধনী
অমূল্য মানিক মণি
তোরে করেছিল কৃপা
সে ধন এখন হারালি রে মন
এমনি তোর কপাল ব’দফা।।
দেখলি নে মূল বস্তু ধুড়ে
কাঠের মালা নেড়ে চেড়ে
মুখে নাম জপা
লালন ফকির কয় কী হবে উপায়
বৈদিক রইল জ্ঞানচক্ষু ঝাপা।।
(সমাপ্ত)
………………..
আরো পড়ুন:
বাউল/ফকির : পর্ব-১
বাউল/ফকির : পর্ব-২
বাউল/ফকির : পর্ব-৩
বাউল/ফকির : পর্ব-৪
বাউল/ফকির : পর্ব-৫
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।