-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ: গন্ধের রাজ্যে : দ্বিতীয় পর্ব
ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাঁটছেন। কোথাও পৌঁছানোটা খুবই জরুরী। কিন্তু এই ছুুটে চলার মাঝেই আপনার নাকে ইলিশ মাছ ভাঁজার গন্ধ নাকে আসলো। আপনি তৎক্ষণাৎ খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও ইলিশ খাওয়ার স্মৃতিতে চলে যাবেন। ঢুকে পরলেন গন্ধের রাজ্যে।
ইলিশ মাছের ভাঁজা নিয়ে আপনার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতিটা আপনার চোখের সামনে দৃশ্যমান হতে শুরু করবে। সেই ঘটনার সাথে যারা যারা জড়িয়ে আছে। কি কি ঘটেছিল। কি কি কথা হয়েছিল। কে কি বলেছিল। মাছের স্বাদ কেমন ছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি সকল কিছুই মুর্হূতের মাঝে আপনার সামনে উপস্থিত হবে।
আবার কাঁচা ইলিশের গন্ধ পেলে কিন্তু আপনি ভাজা ইলিশের স্মৃতির ঘটনায় চট করে ঢুকে পড়তে পারবেন না। আপনি তখন হয়তো চলে যাবেন কোনো বাজার থেকে বা জেলের কাছ থেকে তাজা ইলিশ কিনবার বা দেখবার ঘটনার ভেতরে।
এখানেই গন্ধের অভিজ্ঞতার খেলা। যাকে লীলাও বলা যায়। যদিও মানব জীবনে এই ঘ্রাণেন্দ্রিয় অন্য কয়েকটি ইন্দ্রিয় থেকেও আগে জাগ্রত হয়। তারপরও ক্রম ধারাবাহিকতায় এর আলোচনা সব শেষে। এর অবশ্য বেশ কয়েকটা কারণ আছে।
এর একটি অন্যতম কারণ হতে পারে, অন্য ইন্দ্রিয়গুলো সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞান না থাকলে এই ইন্দ্রিয় বোঝা একটু শক্ত। তাই অন্য আলোচনাগুলো পড়ে নিলে একে বোঝা কিছুটা সহজ হতে পারে।
এই গন্ধের সেতু ধরে হেঁটে হেঁটে কতটা দূরে যাওয়া যায়। তার সবচেয়ে সহজ-সাবলীল এবং একই সাথে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে যতীন্দ্র মোহন-এর অসামান্য সৃষ্টি ‘কাজলা দিদি’ কাব্যটি-
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁইচাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
এমনি করে মানুষ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে স্মৃতিতে অর্থাৎ সঞ্চিত সংস্কারের জগতে মুর্হূতের মাঝে প্রবেশ করে এবং বিরাজ করতে থাকে। একসময় যখনও পারিবারিক আড্ডা খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলো বর্তমানের মতো মেকি সাজানো বা লোক দেখানো হয়ে উঠেনি।
তখন যেমন চেয়ারের উপর পা উঠিয়ে ভুড়ি ভাসিয়ে খেতে খেতে বাপ-দাদা-চাচা-মেশো বা পিশে মশাই নিদ্বিধায় খাবারের গল্পে মেতে উঠতেন।
হয়তো বলে উঠতেন, ‘তোরা আর কি খাস। আমরা তো খেতাম কব্জি ডুবিয়ে। আমরা যা খেতুম না! আহ্!! সেই যে সেবার, উমুকের বাসায় পদ্মার ইলিশ মাছের পাতুরি যা খেয়েছিলাম না। আহ সে আর বলিস না। সেই গন্ধ আজও নাকে লেগে আছে রে। সেই গন্ধ মনে করে করে আজো দুই থাল সাদা ভাত খেয়ে নিতে পারি। বুঝলি?’
তাহলে সেই গন্ধ কোথা থেকে আসছে? কিসের গন্ধ? এর পেছনে আপনি সকল কাজ ছেড়ে মেতে উঠবেন। আপনি এতোক্ষণ যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন মুর্হূতে তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তা খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও। যদি আপনার ঘ্রাণেন্দ্রিয় সঠিক মাত্রায় সক্রিয় থাকে।
ঘ্রাণেন্দ্রিয় দেহের এমন এক ইন্দ্রিয় যা মানুষকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তির মধ্যে ফেলে। আবার সে ভাব জীব প্রকাশ না করে থাকতেও পারে না। অন্য সকল ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিতেও সংবেদনশীলতা। তবে সেগুলোর ক্ষেত্রে অনুভূতি নেয়ার পর জীব কিছুটা সময় হলেও মানিয়ে নেয়া বা সহ্য করার অর্থাৎ অন্যের সামনে ভাব প্রকাশ করার কিছুটা সময় পায়।
ঘ্রাণ বা গন্ধে এমন একটা বিমোহিত ব্যাপার আছে, যা আমাদেরকে সবচেয়ে দ্রুত তার মায়াজালে জড়িয়ে নেয়। ঘ্রাণেন্দ্রিয় অনুভূতির এই ভাষা প্রকাশে মানুষ কিছু তুলনামূলক রূপক শব্দের ব্যবহার করে। যেমন একটু রসালো-মিষ্টতা-মধুময় বুঝাতে ব্যবহার করে- ‘মৌ মৌ’ গন্ধ। ইত্যাদি।
আবার স্বাদের ভিত্তিতেও গন্ধ চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। যেমন- কটূ গন্ধ, ঝাঁঝালো গন্ধ, মিষ্টি গন্ধ, টক টক গন্ধ ইত্যাদি। তবে বেশিভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাকৃতিক গন্ধের সাথে তুলনা করেই গন্ধকে চিহ্নিত করা হয়। যেমন- গোলাপ ফুলের মতো গন্ধ, লেবুর মতো গন্ধ, চালের মতো গন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এভাবেই আসলে এটা সেটার সাথে তুলনা করেই গন্ধের প্রকারভেদ বুঝবার বা বোঝাবার চেষ্টা করে মানুষ। তবে বিজ্ঞান তার নিজস্ব কিছু টার্ম ব্যবহার করে। সেটা সাধারণের জন্য বোঝা বা মনে রাখা সহজ নয়। তাই সে পথে মানুষ তেমন মনোযোগী নয়।
প্রকারে ভাগ করতে গেলে গন্ধের অনেক প্রকরণ পাওয়া যাবে। আলোচনার এই সূচনা লগ্নে খুব গভীর না ঢুকে মোটাদাগে গন্ধকে দুই ভাগে অর্থাৎ সু-গন্ধ বা সৌরভ আর দুর্গন্ধ বা কটূ গন্ধ বলে ধরে নিলাম।
সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে হঠাৎ মনে পরেছিল, আমাদের বাসায় আসা এক আত্মীয় একবার বলেছিল, ইস্ তোমরা এখানে থাকো কি করে? তোমাদের এখানে কেমন সব সময় একটা আটা-ময়দা-মসলার ঝাঁঝালো গন্ধ। উল্লেখ্য যে, আমরা তখন যে বাসায় ভাড়া থাকতাম তার ঠিক পাশেই ছিল একটা আটার কল।
এবার ভেবে দেখুন, আপনি এই মুর্হূতে যে অবস্থায়, যে স্থানে, যাদের সাথে বা নিজের সাথে এই যে অবস্থান করছেন। ঠিক এখনি এই মুহূর্তে যদি কোনো সৌরভ আপনার আশপাশে ছড়িয়ে পরে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আপনি এর উৎস যদি আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত না হন।
তাহলে সেই গন্ধ কোথা থেকে আসছে? কিসের গন্ধ? এর পেছনে আপনি সকল কাজ ছেড়ে মেতে উঠবেন। আপনি এতোক্ষণ যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন মুর্হূতে তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তা খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও। যদি আপনার ঘ্রাণেন্দ্রিয় সঠিক মাত্রায় সক্রিয় থাকে।
ঘ্রাণেন্দ্রিয় সঠিক মাত্রায় সক্রিয় থাকলে আপনি আপনার অজ্ঞাতেই সশরীরে বা মনে মনে সেই গন্ধের উৎস সন্ধানে যেতে শুরু করবেন। কোন দিক থেকে ভেসে আসছে-কিসের গন্ধ এই ভাবনায় ডুব দেবেন। বুক ভরে সেই গন্ধ নিয়ে আরো পরিষ্কার করে তা বুঝবার চেষ্টা করতে থাকবেন।
আবার যদি কটূ গন্ধ ছড়িয়ে পরে, তাহলেও আপনার মাঝে তেমনি একটা বিপরতীমূখী ক্রিয়া শুরু হবে। আপনি যতদ্রুত সম্ভব এই দুর্গন্ধ থেকে দূরে সরে যেতে চাইবেন। আবার গন্ধের তীব্রতা যদি অত্যধিক হয় তাহলে তা সৌরভ হোক বা দুর্গন্ধই হোক তা আপনার সহ্যের বাইরে চলে যাবে।
সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে হঠাৎ মনে পরেছিল, আমাদের বাসায় আসা এক আত্মীয় একবার বলেছিল, ইস্ তোমরা এখানে থাকো কি করে? তোমাদের এখানে কেমন সব সময় একটা আটা-ময়দা-মসলার ঝাঁঝালো গন্ধ। উল্লেখ্য যে, আমরা তখন যে বাসায় ভাড়া থাকতাম তার ঠিক পাশেই ছিল একটা আটার কল।
যদিও তা আপনার সহ্য ক্ষমতার উপর নির্ভর করবে। কারণ যে গন্ধগুলো আপনি নিয়মিত পান তা হয়তো আপনার মধ্যে কোনো ক্রিয়া করে না। আপনি হয়তো তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিকৃয়া তাতে দেন না। কিন্তু যার কাছে সেই গন্ধের অভিজ্ঞতা নতুন সে হয়তো সেখানে এক মুর্হূতে দাঁড়াতেই পারবে না।
ঢাকার হাজারিবাগে ট্যানারী শিল্প এলাকায় প্রথম গিয়ে আমার তেমনি এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই পুরো এলাকায় এমন একটা চিমসে গন্ধ। যা সহ্য করা মুশকিল। পেটের ভেতর থেকে সব বেড়িয়ে আসতে চাইছিল আমার। মনে হচ্ছিল প্রতি নি:শ্বাসে গন্ধ খেয়ে ফেলছি।
বন্ধুর মা খুব যত্ন করে বহু কিছু খাওয়ার জন্য পরিবেশন করেছিল। ট্যানারি থেকে বন্ধুটির বাড়ি অনেকটা দূরে এবং বেশ উঁচুতে হলেও সেই সব লোভনীয় কোনো খাবারই আমি মুখে তুলতে পারিনি।
মনে হচ্ছিল সে সব খাবার থেকেও ট্যানারির গন্ধ আসছে। কোনমতে কুশলাদীর পাট চুকিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আসতে আসতে ভাবছিলাম, তারা কি করে সেখানে থাকে? কি করে নি:শ্বাস নেয়? কি করে খাওয়া দাওয়া করে?
সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে হঠাৎ মনে পরেছিল, আমাদের বাসায় আসা এক আত্মীয় একবার বলেছিল, ইস্ তোমরা এখানে থাকো কি করে? তোমাদের এখানে কেমন সব সময় একটা আটা-ময়দা-মসলার ঝাঁঝালো গন্ধ। উল্লেখ্য যে, আমরা তখন যে বাসায় ভাড়া থাকতাম তার ঠিক পাশেই ছিল একটা আটার কল।
সেই মেশিনে আটা বা মশলা পিষা হতো তখন তার গন্ধটা চারপাশে অনেকটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পরতো। কিন্তু তার গন্ধটাও যে একটা বিশেষ গন্ধ। ততদিনে সেটা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। সেই গন্ধটা আমাদের সঙ্গীর মতোই ছিল। আমরা তা নিয়ে খুব একটা সচেতন ছিলাম কিনা জানি না। তবে অভ্যস্ত ছিলাম সেটা মিথ্যা নয়।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯