-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ: গন্ধের রাজ্যে : চতুর্থ পর্ব
নানাবিধ পশুপাখি-কীটপতঙ্গ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যও মানুষ আমাদের এই গন্ধের রাজ্যে গন্ধকে ব্যবহার করে এসেছে যুগে যুগে। ক্ষতিকারক বা হিংস্র পশুপাখি-কীটপতঙ্গ যে সব গন্ধে কাছে ঘেঁষতে চায় না। সেগুলো সাধারণত মানুষ নিজের নিরাপত্তা ও বিভিন্ন সংক্রমক রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
যেমন মশা-মাছি তাড়াতে ধূপধোনো ব্যবহার করা হয়। আধুনিক কালে নানা স্প্রে, মশার কয়েল ব্যবহার করে। অনেকে আবার নারিকেল তেল, কর্পূর, নিম তেল ইত্যাদি গায়ে মাখে যাতে এডিস জাতীয় মশা কাছে ভিড়তে না পারে।
পোকামাকড় তাড়াতে নিমপাতা ব্যবহার করে অনেকে। অনেকে আবার পিঁপড়া তাড়াতে ব্যবহার করে কেরোসিন তেলের গন্ধ। ছোট ছোট পোকা শষ্যদানায় যাতে আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য দারুচিনি, লবঙ্গের ব্যবহারও দেখতে পাওয়া যায়। আবার পোকা দূর করতে পুদিনা পাতা বেশ কার্যকর।
এভাবে যেমন গন্ধ দিয়ে মানুষ বিভিন্ন জীবকে তাড়ায়। তেমনি আবার গন্ধের ফাঁদ পেতে নানান পশুপাখি শিকার করে। আবার বনের প্রাণী নিজের এলাকা বা অবস্থান নির্ধারণ করতে বা নিজের উপস্থিতি জানান দিতে নিজের দেহের গন্ধ ঘুরে ঘুরে চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। যাতে অন্য প্রাণী তার অবস্থানের মায়ে ঢুকে না পরে।
আসলে সৌরভ বা গন্ধ বিষয়টাই এমন যা প্রকাশ পেয়েই যায়। আর এই সকল জাগতিক নানান প্রকারের গন্ধের ঘ্রাণ নিয়ে যেমন মানুষ তাৎক্ষণিক পুলোকিত হয়। তা আবার ধরেও রাখতে চায়। সংরক্ষণ করতে চায়। যাতে করে চাহিদা মতো এই সব গন্ধ বিভিন্ন সময় ব্যবহার করতে পারে।
তাই যুগে যুগে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উৎস থেকে মানুষ গন্ধ সংগ্রহ করার নানাবিদ পদ্ধতির আবিষ্কার করেছে। এসব সংরক্ষণ পদ্ধতির যত উন্নত হয়েছে সৌরভকে ধরে রাখবার সক্ষমতাও মানুষের তত বেড়েছে। আর তা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সম্প্রদায়ের ব্যবহারের গণ্ডি পেরিয়ে পেয়েছে বাণিজ্যিক রূপ।
কোথাও আবার এই সৌরভ ছড়ানো হয় ধোঁয়ার মাধ্যমে। প্রাচীন সংস্কৃতিতে ধোঁয়ার মাধ্যমই সৌরভ ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি অধিক লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতিক বিভিন্ন উপাদান থেকে এই সুগন্ধি সংগ্রহের ইতিহাস আছে। অনেক সময় সরাসরি সুগন্ধি বৃক্ষের ছাল, কাঠ, শিকড় বা পাতা পুড়িয়ে যেমন সৌরভ ছাড়াতে দেখা যায়।
একেবারে কুটিরশিল্প থেকে বিশ্বের নামীদামী বিশাল বিশাল শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এই সুগন্ধিকে ঘিরে। সভ্য সমাজের অভিজাত মানুষ যেমন এসব দামী দামী ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহার করে নিজের আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তুলতে চায়।
পাশাপাশি বিশেষ সৌরভ দিয়ে নিজের অবস্থানকেও নিশ্চিত করতে চায়। সকল বৃত্তের মানুষই নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকে জীবনের বিভিন্ন অংশে। অনেকে নিত্যদিন ব্যবহার করে। অনেকে আবার পালা পার্বনে ব্যবহার করে।
এই সুগন্ধি কেবল একটা গন্ধ ঢেকে অন্য একটা গন্ধ প্রদর্শন করতেই নয়। গন্ধ অনেক সময় বিভিন্ন ইঙ্গিতও বহন করে। যেমন আনন্দ উৎসবে এক ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়। বিরহ অনুষ্ঠানে অন্য রকম। আবার ঘরোয়া অনুষ্ঠানে একরকম। আবার বৃহৎ পরিসরের উৎসবে ভিন্ন রকম।
এই সুগন্ধির ব্যবহার যে কেবল সৌন্দর্য বর্ধনেই ব্যবহৃত হয় তাই নয়। সুগন্ধিকে পবিত্র বলেও ধরা হয়। আর এই সৌরভের পবিত্রতা কেবল ধর্মেই নয় সকল মহলেই স্বীকৃত।
প্রায় প্রত্যেক ধর্মেই আরাধনা, উপাসনা, ইবাদতের স্থলে পবিত্র সৌরভ ছড়িয়ে দেয়ার বিধান দেখতে পাওয়া যায়। সেই সৌরভের ধরন, প্রকারে ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু সৌরভ অত্যাবশ্যক। কোথাও এই সৌরভ তরল হিসেবে ছিটিয়ে দেয়া হয়। যেমন- গোলাপ জল, কেওরার জল ইত্যাদি।
কোথাও আবার এই সৌরভ ছড়ানো হয় ধোঁয়ার মাধ্যমে। প্রাচীন সংস্কৃতিতে ধোঁয়ার মাধ্যমই সৌরভ ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়টি অধিক লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতিক বিভিন্ন উপাদান থেকে এই সুগন্ধি সংগ্রহের ইতিহাস আছে। অনেক সময় সরাসরি সুগন্ধি বৃক্ষের ছাল, কাঠ, শিকড় বা পাতা পুড়িয়ে যেমন সৌরভ ছাড়াতে দেখা যায়।
তেমনি বিভিন্ন খনিজ পদার্থকেও জ্বালিয়ে সুগন্ধি ছড়ানোর ইতিহাস পাওয়া যায়। আবার বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ প্রতঙ্গ-হাড়-গোড়কে বিশেষ প্রকৃয়ায় সংরক্ষণ করে তা পুড়িয়ে গন্ধ ছড়ানোর বিষয়টিও পাওয়া যায়।
আবার কিছু কিছু উৎসবে সুগন্ধের পরিবর্তে দুর্গন্ধ তৈরি করতেও দেখা যায়। বিশেষ করে যারা তন্ত্র-মন্ত্র বা অশুভ আত্মা নিয়ে চর্চা করে তাদের মধ্যে এর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
বিভিন্ন ফুল, গাছের পাতা, গাছের শিকড়, গাছের ছাল, পশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি থেকে এই সব সৌরভ প্রস্তুত করা হয়। এটাই গন্ধ প্রস্তুতের আদি ও কৃত্রিম ধারা। আর এইভাবে প্রস্তুতকৃত গন্ধদ্রব্য আজো বাজারদরে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।
ধূপ ধোঁয়ার প্রচলন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বহু জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। যা এখনো প্রচলিত আছে। আবার তার আধুনিক সংস্কারণ হিসেবে আগরবাতি, ধুপকাঠির প্রচলনও হয়েছে বহুদিন।
অন্যদিকে তরল পদার্থকে বিশেষ করে নানাবিধ তেলকে পুড়িয়ে সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয়ার রেওয়াজের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। আদিতে তরলকে আগুনে সরাসরি পুড়িয়ে বা জ্বাল দিয়ে সৌরভ ছড়ানো ব্যবস্থা বহুল প্রচলিত ছিল। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে সুগন্ধি তেল পুড়িয়ে সৌরভ ছড়িয়ে দেয়ার নানা পণ্য বাজার দখল করেছে।
এগুলোর অনেকগুলো যেমন আদি ধারাকে বজায়ে রেখে বানানো হয়েছে। আবার একেবারে ইলেকট্রনিক সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও আছে।
আবার সুগন্ধির জন্য বিভিন্ন সুগন্ধ দ্রব্যের গুড়োর ব্যবহারও দেখা যায় নানা সংস্কৃতিতে। ভারতবর্ষে যেমন সুগন্ধি আবিরের প্রচলন আছে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ বিশ্বের আদিবাসী সমাজে এরকম নানা বিচিত্র সব গুড়ো সুগন্ধির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
এর কোনো কোনোটা তরলের সাথে গুলিয়ে যেমন দেহে মাখা হয়। তেমনি আবার গুড়ো পদার্থও অনেকে সরাসরি দেহে লাগায়ে বিচিত্র সব বর্ণ তৈরি করে।
পাশাপাশি তরল থেকে বায়ু হয়ে যাওয়া সৌরভের ব্যবহারও রয়েছে। তরল একটা পদার্থ গায়ে বা পোশাকে ছুঁইয়ে দেয়া হলো সেটা হাওয়ায় মিশে গিয়েও একটা গন্ধ হয়ে রয়ে গেলো অনেকটা সময় ধরে। একটু গভীরে ভাবলে সেটাও একটা চমৎকার অনুভূতি।
বিভিন্ন ফুল, গাছের পাতা, গাছের শিকড়, গাছের ছাল, পশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি থেকে এই সব সৌরভ প্রস্তুত করা হয়। এটাই গন্ধ প্রস্তুতের আদি ও কৃত্রিম ধারা। আর এইভাবে প্রস্তুতকৃত গন্ধদ্রব্য আজো বাজারদরে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।
তবে বাহারি সব ঘ্রাণের জন্য আধুনিককালে কৃত্রিম নানা সৌরভও ব্যবহৃত হয়। ক্ষতিকর হলেও এর ব্যবহার, উৎপাদন ও বিক্রি সবচাইতে বেশি।
গায়ে বা পোশাকে ব্যবহারের জন্য বর্তমানে সর্বমহলে বিভিন্ন স্প্রে পারফিউমের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। তার কোনোটা কেবলই বাতাসে গন্ধ যেমন ছড়ায়, কোনো প্রকার তরল ছাড়া। আবার অনেকগুলো তরল ছিটিয়ে বাতাস করে দেয়া সুগন্ধিও তেমন আছে।
বলা হয়ে থাকে, শামামা নামের বিশেষ আতর বানানোর জন্য প্রত্যেক সুগন্ধি কারিগরের রয়েছে নিজস্ব ও গোপন পদ্ধতি। সাধারণত এ আতরের বানাতে ব্যবহার হয় শৈবাল, ওক কাঠের শ্যাওলা, জুনিপার বেরি, জায়ফল, জৈত্রী, হলুদ, দারুচিনি, লবঙ্গ লতা, লরেল বেরি, ভ্যালেরিয়ান গুল্ম, লাল চন্দন কাঠ প্রভৃতি।
মধ্যপ্রাচ্য সহ মুসলিম বিশ্বে তরল পারফিউমের ব্যবহার অধিক লক্ষ্য করা যায়। মুসলমানদের মাঝে তরল সুগন্ধি উৎপাদন ও ব্যবহারের ইতিহাস যেমন প্রাচীন-তেমনি জনপ্রিয়ও। এই তরল পারফিউম অধিক পরিচিত ‘আতর’ নামে।
ভেষজ উৎস থেকে উৎপাদিত সুগন্ধি বলে আতরকে পবিত্র মানা হয়। ফারসি ‘ইতির’ বা ‘আত্তার’ থেকে আগত ‘আতর’ শব্দের অর্থ সুগন্ধি। মুসলমানরা এই সুগন্ধি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেমন বিশেষভাবে ব্যবহার করে। তেমনি অনেকে প্রতিনিয়তও ব্যবহার করে।
সুফি সাধক ও ইসলামের বিভিন্ন তরিকাতেও আতরের বহুল ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। অনেকক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকও। অজু করে দেহ পবিত্র করে সুগন্ধি মেখে তবে ইবাদতে করবার রেওয়াজ। পবিত্র স্থান বা স্থাপনায় প্রবেশের আগে আতর ব্যবহারের নানাবিধ বিধিও প্রচলিত আছে বিভিন্ন বিশ্বাসে।
প্রাচীনকালে মিশরীয়দের সুগন্ধি তৈরিতে বেশ প্রসিদ্ধি ছিল। বিভিন্ন গাছপালা, লতাপাতা ও ফুলের নির্যাসের সাথে তেলের মিশ্রণে তারা আতর তৈরি করত। পরবর্তীতে বিখ্যাত চিকিৎসক আল শেখ আল-রইস পাতন পদ্ধতিতে নানরকম সুগন্ধি তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন।
এরপর থেকে আতর তৈরিতে এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অনেকেই এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করে। তবে আতর প্রস্তুতকারীরা বংশ পরম্পরায় তাদের আতর তৈরির প্রকৃয়া ও পদ্ধতি গোপন রাখে। এই প্রথা এখনো অনেক প্রাচীন আতর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মেনে চলে।
বলা হয়ে থাকে, শামামা নামের বিশেষ আতর বানানোর জন্য প্রত্যেক সুগন্ধি কারিগরের রয়েছে নিজস্ব ও গোপন পদ্ধতি। সাধারণত এ আতরের বানাতে ব্যবহার হয় শৈবাল, ওক কাঠের শ্যাওলা, জুনিপার বেরি, জায়ফল, জৈত্রী, হলুদ, দারুচিনি, লবঙ্গ লতা, লরেল বেরি, ভ্যালেরিয়ান গুল্ম, লাল চন্দন কাঠ প্রভৃতি।
এর প্রস্তুত প্রণালীও বেশ অভিনব। প্রথমে উপাদানগুলোকে বিশেষ প্রকৃয়ায় এবং দিনের বিশেষ নির্দিষ্ট সময়ে চূর্ণ করা হয়। তারপর চূর্ণগুলোকে তামার পাত্রে দ্রুত সংরক্ষণ করা হয়। চুল্লির আগুনে পানি গনগনে গরম হলে তাতে প্রথমে শৈবাল মিশ্রণ করে বেশ কয়েক ঘণ্টা বিশেষ পদ্ধতিতে পরিশোধন করা হয়।
এরপর একের পর এক ধারাবাহিকভাবে নিয়ম মেনে অন্যান্য উপাদানগুলো সেই পানিতে দিয়ে প্রতিবার পরিশোধিত করা হয়। এভাবে জটিল ও দীর্ঘ সময় ধরে চলা প্রকৃয়ার ভেতর দিয়ে এই শামামা আতর প্রস্তুত করা হয়। যার মূল্যমান বাজারদরে বেশ চড়া।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯