-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ: গন্ধের রাজ্যে : পঞ্চম পর্ব
গন্ধের রাজ্যে আতরের কথা বলতে গেলে পাশাপাশি যে নামটি চলে আসে তা হলো ‘আগর’। আগর এক প্রকারের সুগন্ধি প্রদানকারী উদ্ভিদ। এটি দক্ষিণ পূর্ব-এশীয় প্রজাতির বিশেষ একটি উদ্ভিদ। বাংলাদেশে সিলেটের টিলায় এই উদ্ভিদ জন্মে।
এছাড়াও ভুটান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়।
অ্যালকোহলমুক্ত সুগন্ধি হওয়ায় বিশেষ করে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এর চাহিদা আকাশচুম্বী। আগর গাছের কাঠকে বিশেষ প্রকৃয়ায় সুগন্ধিতে পরিণত করা হয়। আগর সুগন্ধি তেল ছাড়াও আগর গুড়ো বা আগর কাঠের টুকরো ধূপের মতো জ্বালিয়েও পরিবেশ সুরভিত করা হয়। পূর্ব এশিয়া ও জাপানে আগর কাঠ পূজার অর্ঘ্য উপকরণ।
মধ্যপ্রাচ্যে আগর কাঠের ধোয়ার সুগন্ধি ছড়ানোকে আভিজাত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধনাঢ্যরা এই আভিজাত্য প্রকাশের জন্য শুধু অনুষ্ঠানাদিতেই এই মূল্যবান আগর পোড়ায় তা নয়। তারা প্রায় সকল প্রকার আড্ডা ও অতিথির সম্মানার্থে এই আগর জ্বালিয়ে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যে যেমন আগরের ধোয়ার ব্যাপক প্রচলন। তেমনি ভারতবর্ষে ধোয়ার সুগন্ধি হিসেবে অধিক ব্যবহৃত হয় ‘ধূপ’। ভারতবর্ষে ‘ধূপ’ ব্যবহৃত হয় পবিত্র ধোয়া হিসেবে। যদিও যজ্ঞের অগ্নিতে অনেক কিছুর আহুতি দিয়ে পরিবেশ-প্রকৃতি পবিত্র করার নানা বিধিবিধান আছে।
তার প্রায় সবটাই প্রাকৃতিক। এরমধ্যে যেমন আছে গাছের ছাল, গাছের পাতা, শুকনো ফুল, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ইত্যাদি। তেমনি আছে বিভিন্ন তেল, ঘি সহ নানা তরল পদার্থ। এমনকি কি শষ্যদানা, ধান-দুর্ব্বা, তেজপাতা, নিমপাতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কি না পোড়ানো হয় সুগন্ধির জন্য।
আসলে এটা একটা চিকিৎসা পদ্ধতিও। একে বলা হয় ধোঁয়া বা ঘ্রাণ চিকিৎসা। ভারতবর্ষে আদিকাল থেকেই সংক্রাম রোগ থেকে বাঁচতে এবং পরিবেশকে শুদ্ধ করতে নানা উপাদান পুড়িয়ে ধোঁয়া করার রীতি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্মীয় আচারে বহুল ব্যবহৃত হওয়ায় অনেকে একে একমাত্র ধর্মীয় বিধি হিসেবেই চিহ্নিত করেন।
ভারতবর্ষের প্রাচীন রীতি হিসেবে সকল কিছুতেই দেখা যায় আগুনের ব্যবহার। বলা হয়ে থাকে আগুনে কিছু দিলে তা পবিত্র হয়ে যায়। এই পবিত্র আগুনকে সাক্ষী মেনেই এখানে সকল কিছু করবার বিধান। আর এই আগুনকে আরো নান্দনিক করতে এতে আহুতি দেয়া হয় নানান সুগন্ধি দ্রব্য বা উপকরণ।
এসব উপকরণ ব্যবহারের পেছনে কেবল সুগন্ধ তৈরিই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। তার পেছনে উদ্দেশ্য অনেকাংশেই ছিল সেই চিকিৎসা। মানুষিক থেকে শারীরিক রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি রোগ জীবাণু যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার জন্যও এর বহুল ব্যবহার ছিল।
সেকারণে দেখা যাবে বছরের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দিনের বিভিন্ন সময়ে আগুনে কি উপকরণ দিয়ে সুগন্ধি করা হবে তার বিধিও পাওয়া যায় বিভিন্ন পুজা-পার্বনের উপকরণের তালিকায়। পুজা-পার্বনের আচার পালনে বিচিত্র সব উপকরণের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
তার প্রায় সবটাই প্রাকৃতিক। এরমধ্যে যেমন আছে গাছের ছাল, গাছের পাতা, শুকনো ফুল, বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ইত্যাদি। তেমনি আছে বিভিন্ন তেল, ঘি সহ নানা তরল পদার্থ। এমনকি কি শষ্যদানা, ধান-দুর্ব্বা, তেজপাতা, নিমপাতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কি না পোড়ানো হয় সুগন্ধির জন্য।
আজকের প্রেক্ষাপটে ধূপকেও ধর্মীয় বেড়াজ্বালে আটকে রাখা হলেও। প্রকৃত বাঙালীর নাকে এর গন্ধ স্মৃতিকাতর করে দিতে বাধ্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে,
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ,
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি,
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা,
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।
ধূপের আভিধানিক অর্থ ‘সুগন্ধ ধোঁয়া উৎপাদনের গন্ধদ্রব্য’। বেশকিছু উপাদানের মিশ্রণে বিশেষ প্রকৃয়ায় প্রস্তুত করা হয় এই ধূপ। আর ধূপধুনো করার জন্য বহুল ব্যবহৃত হয় নারিকেলের ছোবা বা কাঠ কয়লা। প্রথম একটা পাত্রে আগুনের ফুলকিটা তুলে সেখানে ধূপের গুড়ো দিয়ে সুবাসিত করা হয়।
তারপর একটা কিছু দিয়ে বাতাস করে করে ধোঁয়া তুলে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ধূপ জ্বালাবার পাত্রকে বলা হয় ধূপাধার বা ধূপদানী।
একসময় বাংলার ঘরে ঘরে সন্ধ্যায় ধূপের ধোঁয়া দেয়ার একটা রীতি প্রচলিত ছিল। এখন কেবল তা উপসনালয় ও বিশেষ উৎসব-অনুষ্ঠানে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও অনেকে মনে করেন, ধূপের ধোঁয়ায় মানুষের দেহের ফুসফুসজনিত নানা রোগব্যাধির সৃষ্টি করে।
সুগন্ধি প্রস্তুতের একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে ভারতবর্ষের। আজ বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও একসময় জগৎ বিখ্যাত সব সুগন্ধি ভারতে প্রস্তুত করা হতো বলেও সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতের সুগন্ধির প্রসিদ্ধির ইতিহাস জানা যায়, সুলতান গিয়াস শাহর রচিত ‘নি’মাতনামা’ বা ‘দ্য বুক অব ডিলাইটস’ গ্রন্থ থেকে।
সূত্র মতে, গিয়াস শাহ ১৪৬৯ সালে মালওয়ার সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হন। পরবর্তীতে রাজকার্য থেকে অবসর নিয়ে তিনি রচনা করেন এই মহামূল্যবান গ্রন্থটি।
এই গ্রন্থের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে সুগন্ধি প্রস্তুত ও তার নানান ব্যবহারবিধি। গোলাপজলকে পরিশোধন থেকে বিভিন্ন ধূপ, দুর্গন্ধনাশক পদার্থ, সুগন্ধযুক্ত চূর্ণের আবিরের প্রস্তুত প্রণালী এবং সুগন্ধি মলম বানানোর পদ্ধতি পর্যন্ত। এই গন্ধ ব্যবসায়ীরা সমাজে পরিচিত ছিল ‘সৌগন্ধিক’, ‘গন্ধবেনে’, ‘গন্ধবণিক’ প্রভৃতি নামে।
আবিরের সুগন্ধকে আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য কি করে আম, অম্বর, জাফরান, কস্তুরী, সাদা চন্দন, তিলের তেলের নির্যাস, মিষ্টি পুদিনা, হলুদ, এলাচ ও চন্দনের নির্যাসসহ আরও বেশি কিছু উপাদান ব্যবহার করা হতো তার আছে বিশদ বিবরণ।
নি’মাতনামার সূত্র মতে, ভারতেই শুধুমাত্র সুগন্ধি ব্যবহার সংক্রান্ত জ্ঞানকে উন্নত জীবনের আবশ্যিক চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হতো, এবং সুগন্ধি সভ্যতার একটি অন্যতম প্রধান উপাদানও ছিল।
গাছের থেকে সুগন্ধি প্রস্তুতের কথা বললে ‘চন্দন’-এর কথা না বললেই নয়। রূপ বা সৌন্দর্য চর্চায় চন্দনের বহুল ব্যবহার হলেও সুগন্ধি হিসেবেও চন্দন অতুলনীয়। বিশেষ করে বিভিন্ন পূজা-অর্চনায় ও মৃতদেহ দাহ করতে ভারতবর্ষে সুগন্ধি চন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
সে সময় ভারতবর্ষের মসলাতেই ইউরোপীয় ভোজন সুবাসিত হতো। জানা যায়, মসলার খোঁজে বের হয়েই ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। যুগে যুগে বহু যুদ্ধ-সংর্ঘাত-ষড়যন্ত্র হয়েছে এই মসলার বাণির্জের কর্তৃতকে ধরে রাখবার জন্য।
ভারতবর্ষে শ্বেত ও রক্ত দুই ধরনের চন্দন পাওয়া যায়। চন্দনের নির্যাস বা সুগন্ধি পরিচিত ‘চুয়া’ নামে।
সাধারণত বাস্প পাতনের মাধ্যমে চন্দনের সুগন্ধি তেল সংগ্রহ করা হয়। চন্দন গাছের মূল ও কাণ্ডের সার অংশ ছোট ছোট টুকরা করে তারপর গুঁড়ো করা হয়। এই গুঁড়োগুলোকে বাম্প পতন করে চন্দন তেল নিষ্কাশন করা হয়।
নানান রাসায়নিক জটিল সব কম্বিনেশনে প্রস্তুতকৃত এসব সুগন্ধি আবার ব্যবহৃত হয় নানান খাবারেও। খাবারে ব্যবহারের জন্য প্রকৃতিক উৎস থেকে নিসৃত সুগন্ধিকেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানা হয়। এর জন্য নানা ধরনের মসলার ব্যবহার জগৎ জুড়েই আছে।
এক সময় মসলার বাণিজ্য নিয়ে দেশে দেশে কত কিই না হয়েছে। ভারতবর্ষের মসলার আকাশচুম্বী চাহিদার কারণে কত সওদাগরের নোঙ্গর যে এই অঞ্চলে হয়ে তা বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে।
মসলার যুদ্ধের বিস্তারিত জানা যায় সত্যেন সেনের ‘মসলার যুদ্ধ’ গ্রন্থ থেকে। গ্রন্থটিতে এই যুদ্ধের পেছনে ঘটে যাওয়া রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষিত সহ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের বিস্তারিত চিত্র ফুটে উঠেছে। এতোসব বিষয়ে না গিয়ে অল্পকথায় মসলার যুদ্ধটা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়-
ভারতবর্ষের বিচিত্র সব মসলার চাহিদা ছিল বিশ্বজুড়েই। আর তার বাজার দখল করার জন্য নানা সময় বিদেশী বণিকরা তাদের সমর্থ অনুযায়ী বিস্তার ঘটিয়েছে। মসলা সেসময় কেবল খাবারে ব্যবহারের জন্যই নয়, প্রসাধনী হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বলে এর চাহিদা ছিল বহুগুণ।
সে সময় ভারতবর্ষের মসলাতেই ইউরোপীয় ভোজন সুবাসিত হতো। জানা যায়, মসলার খোঁজে বের হয়েই ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। যুগে যুগে বহু যুদ্ধ-সংর্ঘাত-ষড়যন্ত্র হয়েছে এই মসলার বাণির্জের কর্তৃতকে ধরে রাখবার জন্য।
মসলার বাজার হিসেবে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ সকল বাণিকদের জন্যই ছিল উন্মুক্ত। তারপরও মসলাকে কেন্দ্র প্রথম যুদ্ধটি সংগঠিত হয় ভারতবর্ষেই। ভারতবর্ষ থেকে একসময় মসলার বাণিজ্যটা একচেটিয়া করতো আবরদেশগুলো। পর্তুগিজরা আরবদের এই মসলার ব্যবসায় নাক গলাতে শুরু করে।
ভারতবর্ষে সেসময় মসলার মূল বাণিজ্য পরিচালিত হতো যে সমুদ্রতীরের রাজ্য কালিকটে। সেখানেই পুর্তগিজরা প্রথমে হামলা করে। কালিকট রাজ্যের মানুষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও পুর্তগিজদের তৎকালীন আধুনিক সব মারণাস্ত্রের কাছে শেষ পর্যন্ত তারা পেরে উঠে নি।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯