ভবঘুরেকথা
গন্ধের রাজ্যে

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ: গন্ধের রাজ্যে : ষষ্ঠ পর্ব

মসলার বাণিজ্য চলে যায় পুর্তগিজদের হাতে। ভারতবর্ষের মসলার বাণিজ্যটা হাতিয়ে নিলেও দুর্লভ সব মসলার উৎপাদনে জগতখ্যাত ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোও আরব বণিকদের কাছ থেকে দখল করতে চাইলেও পর্তুগিজরা সেখানে বেশি দিন টিকতে পারেনি।

এরপর পুর্তগিজদের হাত থেকে এই পুরো অঞ্চলের মসলার বাণিজ্যটা ডাচদের দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলো ছাড়া পুরো অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য চলে যায় ইংরেজদের হাতে।

মসলার কথা যখন বলছি তখন গোটা কয়েকটি সুগন্ধি মসলার কথা তো উল্লেখ করতেই হয়। আর তা করতে গিয়ে যে নামগুলো উঠে আসে তার মধ্যে অন্যতম- দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, মৌরি, ধনিয়া, তেজপাতা ইত্যাদি। পাশাপাশি বলতে গেলে বলতে হবে পেয়াজ ও রসুনের নাম।

আবার গন্ধের জন্য সবজির শাক-সবজি লতাপাতার ব্যবহারও দেখা যায়। এরমধ্যে বলতে গেলে বলতে হয়- ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, পোলাও পাতা, কারিপাতা ইত্যাদি।

প্রত্যেক খাবারেরই নিজস্ব এক ধরনের গন্ধ থাকে। মাত্রার বিচারে কোনটার গন্ধ তীব্র, কোনটার গন্ধ মৃদু আবার কোনটার গন্ধ উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু না। আবার স্বাদের বিচারে কোনটা মিষ্টি গন্ধ, কোনটা টকটক গন্ধ, কোনটা তেতো, কোনোটা ঝাঁঝালো ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিছু কিছু প্রাকৃতিক খাবার বিশেষ করে ফলমূল-ফুল-শাকসবজির লোভনীয় সব মৌ মৌ গন্ধ ছড়ায়। যখন তা গাছে পাকতে শুরু করে তখন তার সৌরভ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে।

তার কোনো কোনোটার গন্ধ এতো মায়া-মোহময় যে পথিককেও থামিয়ে দেয়। সেই সৌরভের অনুসন্ধান করতে বাধ্য করে। অর্থাৎ গন্ধের একটা নিজস্ব আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে। আবার যে গন্ধ নিচ্ছে সেও গন্ধের প্রতি একটা আকষর্ণের সংস্কারের ভাণ্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জনশ্রুতি আছে, জুঁই ফুল রাতে তার সুবাস সবচেয়ে তীব্রভাবে ছড়িয়ে দেয়। সেকারণে একে সূর্যোদয়ের আগে ক্ষেত থেকে তুলে আনতে হয়। যাতে গন্ধটার সঠিক স্বরূপ ধরে রাখা যায়। তাই ভোরে সূর্য উঠবার অনেক আগেই পরিশোধনাগারে নিয়ে আসতে হয়।

আমাদের পরিচিত সবচেয়ে তীব্র গন্ধযুক্ত ফলের নাম বলতে গেলে বলতেই হয়- আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, কমলার নাম। আবার মধুময় ফুলের গন্ধের তালিকা দিতে গেলে এই লেখা কখনো শেষই হবে না।

কারণ জগৎ জুড়ে এতো সব বাহারি গন্ধের ফুল জন্মায় যে তার তালিকা করাও দুষ্কর। তবে আমাদের পরিচিত কয়েকটা ভিন্নধর্মী গন্ধের ফুলের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। যারা তাদের গন্ধের জন্য অধিক পরিচিত।

আর এই তালিকায় যাদের নাম করতে হয়, তারা হলো- হাসনাহেনা, বকুল, মহুয়া, ছাতিম, জুঁই, কামিনী, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, গোলাপ, বেলী, চামেলী, কুসুম প্রভৃতি।

বলা হয়ে থাকে, ফুল থেকে সুবাস সংগ্রহ করা বেশ জটিল। এরজন্য মানতে হয় অনেক নিয়মকানুন। এমনকি সময় জ্ঞানও থাকতে হয় চূড়ান্ত রূপে। তাহলেই সঠিক সুগন্ধিটা প্রস্তুত করা যায়।

জনশ্রুতি আছে, জুঁই ফুল রাতে তার সুবাস সবচেয়ে তীব্রভাবে ছড়িয়ে দেয়। সেকারণে একে সূর্যোদয়ের আগে ক্ষেত থেকে তুলে আনতে হয়। যাতে গন্ধটার সঠিক স্বরূপ ধরে রাখা যায়। তাই ভোরে সূর্য উঠবার অনেক আগেই পরিশোধনাগারে নিয়ে আসতে হয়।

ফুলের মধ্যে আমাদের অঞ্চলে ছাতিম বেশ অদ্ভুত ও তীব্র গন্ধযুক্ত একটা বিশেষ ফুল। বহুদূর থেকে এর গন্ধ পাওয়া যায়। এর গন্ধ এতোটাই তীব্র যে, যখন এর বিশাল আকারের গাছে ফুলে ফুলে রঞ্জিত হয়ে যায়। তখন সে গাছের খুব কাছাকাছি যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠে এর গন্ধের তীব্রতায়।

আবার গোলাপের মতো জনপ্রিয় ফুলের গন্ধ নিতে চাইলে নাকের খুব কাছাকাছি এনে গন্ধ নিতে হয়। আবার অনেক ফুল আছে যা দেখতে অনেক নান্দনিক কিন্তু কোনো সৌরভ নেই। এরমধ্যে অন্যতম হলো- অর্কিড, ক্যাকটাস জাতীয় ফুল।

আহারের সময় খাবারের সৌরভ যদি মন মতো না হয় তাহলে সেই খাবার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া বেশ কঠিন। আবার রান্না করার সময়ও যিনি রান্না করছেন তিনিও এই ঘ্রাণ নিয়ে নিয়েই রান্নাকে এগিয়ে নিয়ে যান। খাবারের স্বাদ কেমন হয়েছে তার অনেকটাই নির্ভর করে তার গন্ধের উপর।

আবার কিছু গাছ আছে যার পাতায় থাকে তীব্র গন্ধ। এরমধ্যে- গন্ধভাদাল বা গন্ধভাদুলি, ইউক্যালিওপটাসের নাম বলা যেতে পারে। আবার কোনো কোনো গাছের গায়ে অর্থাৎ ছালে থাকে অভিনব কোনো গন্ধ।

গন্ধ পাতার প্রসঙ্গে আরেকটা নাম চলেই আসে। যদিও আজ বেশিভাগ মানুষ স্বাদের জন্যই তা থেকে প্রস্তুতকৃত তরল পান করে থাকে। কিন্তু দার্জেলিং টি কিন্তু তার গন্ধকে বৈশিষ্ট্য করেই টিকে আছে। চা খাওয়ার সময় ভোজন রসিক বাঙালী আজো সেই কবে দার্জেলিং টি পান করেছিল সেই গল্পটা ফাঁক তালে বলবেই বলবে।

আজ আমরা যে তরলটা চা বলে পান করি। অনেকে তা চা হিসেবে মানতেই চান না। তারা বলেন, চা হতে হবে তাই, যার সৌরভ পাওয়া যাবে আগে। সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে চোখ বন্ধ করে গরম গরম পাতা ভেজানো জল খেতে হবে সেটাই প্রকৃত চা। দুধ-চিনি মিশিয়ে আমরা যেটা পান করি, সেটা চা পাতার একটা ভিন্ন এক্সপ্রিমেন্ট মাত্র।

তাই তো বলা হয়- ‘ঘ্রানং অর্ধনং ভোজনং’। যার সহজ অর্থ গন্ধেই অর্ধেক ভোজনের স্বাদ পাওয়া যায়।

ঘ্রাণ নেয়ার মধ্যে দিয়ে আহারের তৃপ্তি লাভ করার একটা সম্পর্ক যে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পরলে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই সেই সৌরভ আগে নিয়ে পরে খাবারে মনোযোগী হই।

আহারের সময় খাবারের সৌরভ যদি মন মতো না হয় তাহলে সেই খাবার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া বেশ কঠিন। আবার রান্না করার সময়ও যিনি রান্না করছেন তিনিও এই ঘ্রাণ নিয়ে নিয়েই রান্নাকে এগিয়ে নিয়ে যান। খাবারের স্বাদ কেমন হয়েছে তার অনেকটাই নির্ভর করে তার গন্ধের উপর।

খাবারের গন্ধের রাজ্যে গন্ধের সাথে মানুষের সম্পর্ক এমন যে, অনেকে বলেন- ‘আরে আমি তো গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি এটা কার হাতের রান্না।’ মানুষ এই ভাবে গন্ধের সূত্র ধরে সেই হাতের পরশ খুঁজে বেড়ান। যে হাতের পরশে এই রান্না হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলের ‘গন্ধ বিচার’ সৃষ্টিটা না বললে অন্যায় হয়ে যাবে-

সিংহাসনে বস্‌ল রাজা বাজল কাঁসর ঘণ্টা,
ছট্ফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা।
বললে রাজা, “মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?”
মন্ত্রী বলে, “এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!”
রাজা বলেন, “মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,”

বদ্যি বলে, “আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।”
রাজা হাঁকেন, “বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।”
পাত্র বলে, “নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?”
রাজা বলেন, “কোটাল তবে এগিয়ে এস শুক্‌বে।”

কোটাল বলে, “পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর,
গন্ধে তারি মুন্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।”
রাজা বলেন, “আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,”
ভমি বলে, “আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্
রাত্রে আমার বোখার হল, বলছি হুজুর ঠিক বাৎ”-

ব’লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত।
রাজার শালা চন্দ্রেকেতু তারেই ধ’রে শেষটা
বল্ল রাজা, “তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা।”
চন্দ্র বলেন, “মারতে চাও ত ডাকাও নাকো জল্লাদ,
গন্ধ শুকে মর্‌তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?”

ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই,
ভাব্‌ল মনে, “ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-”
সাহস করে বল্লে বুড়ো, “মিথ্যে সবাই বকছিস,
শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্‌শিস।”
রাজা বলেন, “হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,”

তাই না শুনে উৎসাহতে উঠ্ল বুড়ো মদ্দ।
জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুক্‌ল কত গন্ধ,
রইল অটল, দেখ্ল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ।
রাজ্য হল জয় জয়কার বাজ্‌ল কাঁসর ঢক্কা,
বাপ্‌রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা!

এইভাবে একটা ইন্দ্রিয় দিয়ে আরেকটা ইন্দ্রিয়কে ধরবার চেষ্টা। যেমন চোখ দিয়ে দেখে, নাক দিয়ে শুঁকে, ত্বক দিয়ে ছুঁয়ে, কান দিয়ে শুনে, জিহ্বা দিয়ে স্বাদ নিয়ে প্রকৃত স্বরূপে পৌঁছানো। আসলে বিষয়টা প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে, আদি সংগৃহীত তথ্যের সাথে মিল-অমিল খুঁজে প্রতিকৃয়া দেয়ার চেষ্টা।

গন্ধের ভিত্তিতেই বেশিভাগ মানুষ খাবার তুলে নেয় পাতে। আবার বাজার থেকে সজীব কিছু কিনবার সময় আমরা যেমন তাকে ছুঁয়ে দেখি। তেমনি তার মাঝে গন্ধ ব্যাপারটা থাকলে অবশ্যই নাকের কাছ এনে শুঁকে শুঁকে তার বৈশিষ্ট্য বা ভালো মন্দ বুঝে নেয়ার চেষ্টা করি।

অন্যদিকে মৃতের সাথেও জড়িয়ে আছে সুগন্ধির ব্যবহার। মৃতের পাশে সকল ধর্ম-মতাদর্শেই দেখা যায় সুগন্ধি ব্যবহার করতে। এতে মৃতের দেহ থেকে যেমন গন্ধ ছড়াতে না পারে সে বিষয়টা লক্ষ্য রাখা হয়। তেমনি সুগন্ধি একটা পবিত্র আবহ তৈরিতেও ভূমিকা রাখে।

সাধারণ ভাবে আগরবাতি, ধূপকাটি, ধূপ, আগর ইত্যাদি মৃতের পাশে জ্বালানো হয়। গোলাপ জল ছিটানো হয়। আবার মৃতের দেহে মাখানো হয় নানান সুগন্ধি। মুসলমানরা যেমন আতর, কর্পূর ব্যবহার করে।

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব >>

……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫

গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!