-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: গন্ধ : গন্ধের রাজ্যে : সপ্তম পর্ব
তেমনি খ্রিস্টানদের ব্যবহার করতে দেখা যায় পারফিউম। গন্ধের রাজ্যে আবার সনাতন বিশ্বাসে মৃতকে দাহ করা হয় সুগন্ধি কাঠ চন্দন দিয়ে।
গন্ধ বা ঘ্রাণশক্তি নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের পাশেপাশে থাকা একটা প্রাণীর নাম না করলে আক্ষেপ থেকে যাবে। সেই প্রভুভক্ত উপাধীধারী প্রাণীটির নাম ‘কুকুর’। জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৩০ হাজার পূর্বে কুকুর মানুষের পাশে বাস করতে শুরু করে। বলা হয়, কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি মানুষের চেয়ে ১০ হাজার গুণ বেশি।
মানুষের নাকে যেমন ষাট লক্ষ ঘ্রাণ রিসেপ্টর রয়েছে, কুকুরের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা তিরিশ কোটির মতো। মানুষের শ্বাস আর ঘ্রাণ গ্রহণের পথ একটাই। তাই শ্বাস ছাড়লে গ্রহণ করা ঘ্রাণ অণুগুলো বেড়িয়ে যায়। এতে ঘ্রাণ অণু সঞ্চয় হয় খুব কম।
অন্যদিকে কুকুর শ্বাসের সাথে যে বায়ু গ্রহণ করে তার বারো শতাংশ নাকের পেছনে ঘ্রাণ গ্রন্থিতে। আর অবশিষ্ট বায়ু প্রবেশ ফুসফুসে করে। কুকুরের ত্যাগ করা শ্বাস বায়ুর প্রবেশ পথ দিয়েই বেরিয়ে না গিয়ে নাসারন্ধ্রের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর মাঝখান দিয়ে শ্বাসবায়ু নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করতে থাকে।
এতে ঘ্রাণ গ্রহণ অবিরাম চলতেই থাকে। কুকুরের নাকের ডগা ক্রমাগত মিউকাস নিঃসরণের ফলে ভেজা থাকে। আর এই ভেজা নাকে ঘ্রাণ অণুগুলোও আটকে থাকে যা গন্ধ শুঁকে চিনতে সাহায্য করে। সে কারণে কুকুর এই ইন্দ্রিয়টিকে অধিক ব্যবহার করে।
এই ঘ্রাণেন্দ্রিয় তাকে দিক নির্দেশ করতে যেমন সহায়তা করে। তেমনি তার গন্ধের রাজ্যে সঞ্চিত সংস্কার ভাণ্ডার হয় অতুলনীয়। বহুবছর পরেও সে গন্ধ শনাক্ত করে প্রিয়জনকে চিনতে পারে। অনেক দূর থেকেও সে গন্ধ টের পায়। সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে কেবল তার মালিককে খুঁজে বের করে তাই নয়।
বাইরের পৃথিবী ও প্রাণীর দেহের আভ্যন্তরের ফুসফুসের মধ্যে প্রাথমিক সমন্বয় রক্ষাকারী হিসাবে নাক কাজ করে থাকে। অন্যান্য জীবের নাকের আরো কিছু ভিন্ন ব্যবহার আছে। সেটা এই আলোচনায় গুরুত্ব না থাকায় সে বিষয়ে নাই বা গেলাম।
যুগে যুগে মানুষ কুকুরের এই গন্ধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাধান করেছে নানা জটিল রহস্য। খুঁজে পেয়েছে ধ্বংসস্তুপের নিচের চাপা পরা প্রাণের অস্তিত্ব। আমাদের শত অবহেলা-অনাদরেও এই প্রভুভক্ত প্রাণীটি মানুষের পাশে পাশেই আরো রয়ে গেছে গন্ধ শুঁকে শুঁকে।
ইউনিভার্সিটি অব তোকিও’র মলিকুলার ইভোলেশনিস্ট গবেষক যোসিহিতো নিমুরা দাবী করেন, কুকুরের চেয়েও প্রখর ঘ্রাণ শক্তির অধিকারী প্রাণি হাতি। …হাতি তার শুঁড় হাতের মতো ব্যবহার করে খাবারসহ অন্যান্য বস্তু ধরে, যে কারণে ঘ্রাণ নেয়ার ক্ষেত্রেও শুঁড়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আবার অনেকে বলেন, ভাল্লুকের ঘ্রাণশক্তি মানুষের চেয়ে ২১০০ গুণ বেশি। একটি ভালুক প্রায় ২০ মাইল দূরের অপর একটি প্রাণীর শব সনাক্ত করতে পারে। অন্যদিকে পোলার বিয়ার ১০০ মাইল দূরে থাকা সঙ্গীকেও শনাক্ত করতে পারে।
বিজ্ঞানের ভাষায়, মেরুদণ্ডী প্রাণীর মুখের সামনে থাকা স্ফীত সংবেদক অঙ্গটি হলো ‘নাক’। নাকের ছিদ্র পথ দিয়ে জীবের শ্বাসের বায়ু প্রবেশ হয়। আবার একই পথে বেড়িয়ে যায়। মানুষ সাধারণত মিনিটে প্রায় ১৮বার, ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০ বার এবং দিনে ২৫ হাজার ৯২০ বার শ্বাস নেয়।
এটা বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন পরিস্থিতি, বিভিন্ন মনস্থিতিতে কম বেশি হয়ে থাকে। তবে সাধু মতে বলে, মানুষ দিনে গড়ে ২১ হাজার বার শ্বাস নেয়।
মেরুদণ্ডী প্রাণীরা সাধারণত শ্বাস নিয়ে বায়ুকে নাক থেকে ফুসফুসে প্রবেশ করায় আবার ফুসফুস থেকে নাক দিয়েই বের করে দেয়।
আরেকটু বিস্তারিত করে বলতে গেলে বলতে হয়, শ্বাসতন্ত্রের প্রথম অংশ নাক মূলত বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ এবং দেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশনের পথ।
বাইরের পৃথিবী ও প্রাণীর দেহের আভ্যন্তরের ফুসফুসের মধ্যে প্রাথমিক সমন্বয় রক্ষাকারী হিসাবে নাক কাজ করে থাকে। অন্যান্য জীবের নাকের আরো কিছু ভিন্ন ব্যবহার আছে। সেটা এই আলোচনায় গুরুত্ব না থাকায় সে বিষয়ে নাই বা গেলাম।
তবে একথা জেনে রাখলে মন্দ হবে না যে, জন্মের পর থেকেই শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ঘ্রাণশক্তি খুবই গুরুত্ববহ।
গবেষকরা বলেন, মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়ের প্রথম দিকেই শিশুর নাকের গঠন শুরু হয়। গর্ভে থাকাকালেই মানব শিশু ঘ্রাণ নিতে শুরু করে। আবার শিশু জন্মের পর থেকেই বুকের দুধের ঘ্রাণের প্রতি বেশ আকৃষ্ট থাকে।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব থেকেই যে ঘ্রাণেন্দ্রিয় শিশুর কাজ করতে শুরু করে। তা জন্মের পর থেকে দ্রুত আরো বেশি সংবেদনশীল হতে শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যেই শিশু আলাদা আলাদা ঘ্রাণ নির্দিষ্ট করতে শিখে যায়। ঘ্রাণ শক্তি তাকে সচেতন করে তোলে।
আবার ভূতের গায়ের গন্ধ নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’ গল্পে লিখেছেন- “…তা এইরকম সব হত দোমোহানীতে। কেউ গা করত না। কেবল দাদামশাইয়ের বাবা বাতাস শুঁকতেন, লোকের গা শুঁকতেন।
গন্ধ দিয়ে আলাদা করতে শিখে যায় প্রিয়জনদের। পছন্দের ব্স্তুকে। ভালোলাগার গন্ধকে।
গন্ধের কথা বলা হবে আর যারা ‘গন্ধে গন্ধে এসে ঠিক হাজির হয়’ তাদের কথা হবে না তা তো হবে না। হ্যা বাঙালীর অতি আদরের সেই মেছোভূতের কথাই বলছি। বাঙালীর ভূতের গল্পে মাছের গন্ধে বেচারা ভূত চলে আসবে না তা হবার নয়।
সেই মাছ মা-মাসী-বৌদির হাতে ভাজা মাছই হোক। কিংবা সদ্য বাজার থেকে কিনে নতুন বর শ্বশুর বাড়িতে রওনা দেয়ার গল্পই হোক। মাছের আঁষটে গন্ধে ভূত পাগল হয়ে ছুটে আসবেই আসবে। আবার মাঝে মধ্যে রান্নাঘর বা জেলে নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খাওয়ার কাহিনী শোনা যায়।
এই সংস্কারবশত একসময় গ্রামবাংলার অনেক বাড়িতে রাতে মাছই রান্না হতো না। বিশেষ প্রয়োজনে রান্না করতেই হলে। আগে তাদের উদ্দেশ্যে মাছ নিবেদন করে তবেই মাছ কাটাকুটি-রান্নাবান্না-খাওয়া দাওয়া হতো।
ভূতের উদ্দেশ্যে না বলে এই যে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম। এটারও একটা কারণ আছে। কারণটি হলো, রাতে সেসময় ভূতের নামও নেয়া ছিল বারণ।
আবার ভূতের গায়ের গন্ধ নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’ গল্পে লিখেছেন- “…তা এইরকম সব হত দোমোহানীতে। কেউ গা করত না। কেবল দাদামশাইয়ের বাবা বাতাস শুঁকতেন, লোকের গা শুঁকতেন।
একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে তাঁর হাতে মাছের ছোট্ট খালুই, তাতে শিঙিমাছ নিয়ে আসছিলেন, তো একটা মাছ মাঝপথে খালুই বেয়ে উঠে রাস্তায় পড়ে পালাচ্ছে।
দাদামশাইয়ের বাবা সেই মাছ ধরতে হিমশিম খাচ্ছেন, ধরলেই কাঁটা দেয় যদি। এমন সময়ে একটা লোক খুব সহৃদয়ভাবে এসে মাছটাকে ধরে খালুইতে ভরে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। দাদামশাইয়ের বাবা তাকে থামিয়ে গা এঁকেই বললেন, এ তো ভালো কথা নয়! গন্ধটা খুব সন্দেহজনক। তুমি কে হে! অ্যাঁ! কারা তোমরা?
এই বলে দাদামশাইয়ের বাবা তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। লোকটা কিন্তু ঘাবড়াল না। হঠাৎ একটু ঝুঁকে দাদামশাইয়ের বাবার গা এঁকে সে-ও বলল, এ তো ভালো কথা নয়। গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক। আপনি কে বলুন তো! অ্যাঁ! কে? এই বলে লোকটা হাসতে হাসতে বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেল।”
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী সম্পাদিত বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ একে বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করেছে- “গন্ধমাদন শব্দটির অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। গন্ধ + মাদন, যা গন্ধে মাদয়িত (মত্ত) করে বা গন্ধ যার মাদয়িতা, গন্ধ দ্বারা মাদয়িতা, সুগন্ধি বন-যুক্ত পর্বতবিশেষ।
অন্যদিকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তার ‘তেরো ভূতের কবলে’ গল্পে লিখেছেন- “ঘুরে দেখি, সেই লোকটার মতোই কালো কুচকুচে লম্বানেকো একদল লোক এসে হাজির। তারা মাছ-মাছ-বলে চাঁচেমেচি করছে। …প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললুম,–চুপ সব। চুপ! পেয়েছ কী তোমরা? এখানে হইচই করছ কেন অত?
…শুনুন বাবুমশাই, আমরা মোটমাট বারোজন আছি। বেশি নয়, মাথাপিছু একটা করে টুকরো দেবেন। ব্যাস। বলে সে ঠোঁট চেটে নিল! আহা! কতকাল আমরা মাছ খাইনি!
…একটু পরে ওদের দেখার জন্য পেছনে তাকালুম। অবাক হয়ে দেখলুম ধেড়ে লোকগুলো বাচ্চা ছেলেদের মতো বটগাছটার ঝুরি বেয়ে উঠছে কেউ, কেউ ডালে চড়ে বসেছে, কেউ ডাল থেকে ধুপ করে পড়ছে। আবার ঝুরি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একপাল হনুমান যেন। বয়স্ক লোকেরা এমন কেন খেলে, কম্মিনকালে তো দেখিনি।
…তারপর দেখি, ওরা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। অমনি ঝোলাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলুম। ওরা বিদঘুঁটে চ্যাঁচামেচি করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝোলাটার ওপর। আর সেই সুযোগে আমি দৌড় দিলুম। দৌড়-দৌড়-দৌড়! একেবারে স্টেশনে পৌঁছে সোজা স্টেশনঘরে ঢুকে পড়লুম।”
আবার গন্ধের আলোচনায় যে শব্দটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না তা হলো- ‘গন্ধমাদন’। বলা হয়ে থাকে, হিমালয় পর্বতের একটি অজ্ঞাত অংশের পৌরাণিক নাম হলো এই ‘গন্ধমাদন’। পৌরাণিক শাস্ত্র মতে, এটি ঋষভ পর্বত ও কৈলাস পর্বতের মাঝামাঝি কোনো স্থানে অবস্থিত একটি ঔষধি পর্বত।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী সম্পাদিত বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ একে বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করেছে- “গন্ধমাদন শব্দটির অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। গন্ধ + মাদন, যা গন্ধে মাদয়িত (মত্ত) করে বা গন্ধ যার মাদয়িতা, গন্ধ দ্বারা মাদয়িতা, সুগন্ধি বন-যুক্ত পর্বতবিশেষ।
এটি ইলাবৃত ও ভদ্রাশ্ব বর্ষের সীমাপর্বত এবং মেরুর পূর্বে অবস্থিত। অধিকন্তু ভ্রমর, রামসৈন্যস্থ বানরবিশেষ, গন্ধমাদনস্থ বনবিশেষ। হিমালয়ে স্বর্ণময় ঋষভপর্বত ও কৈলাসপর্বতের মধ্যস্থিত দীপ্তিমান ঔষধিপর্বত বুঝাতেও গন্ধমাদন প্রচলিত। এ পর্বতের শীর্ষদেশে মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী ও সন্ধানী- এ চার প্রকার মহৌষধি জন্মাত।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-১
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-২
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৩
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৪
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৫
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৬
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৭
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৮
গন্ধের রাজ্যে: পর্ব-৯