-জগদীশচন্দ্র রায়
উপরের ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর, গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপস্থিতিতে লক্ষ্মীখালীতে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীজনদের নিয়ে এক বিরাট জাগরণী সভা হয়, যে সভায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায়-
প্রভু বলে ‘শোন সবে নম:শূদ্রগণ।
ধর্ম্ম শক্তি বিনা জাতি জাগ না কখন।’
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫২৯)
তিনি সভায় উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো জাতিকে জাগাতে হলে ধর্মের সংগঠিত করার হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করলেও ধর্মের অলিক বা অযৌক্তিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেন নি। মানুষকে জাগ্রত করার শিক্ষার মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য ধর্মকে এক ধরনের ভাষা অর্থাৎ প্রকাশের মাধ্যমে হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
এরপর তিনি জানান যে, এই জাতির মঙ্গলের জন্য যা কিছু হয়েছে সবই হরিচাঁদ ঠাকুরের অবদান। আর তিনি যে কাজের দায়িত্ব আমাকে সমর্পণ করে গেছেন সেই কাজই আমি প্রতিনিয়ত করে চলেছি। তাই আপনাদের প্রধান কাজ হচ্ছে-
বিদ্যা ছাড়া এ জাতির দু;খ নাহি যাবে।
গ্রামে গ্রামে পাঠশালা কর তাই সবে।।
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে ‘মা’র গুণে ভাল হয় ছা’ও।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫২৯)
তিনি সকলকে জাতির দু:খ দূর করার জন্য বিদ্যা অর্জনের উপর জোর দেন। আর গ্রামে গ্রামে পাঠশালা করার আহ্বান জানান। নারীকেও শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেন। কারণ মা’ শিক্ষিত হলে সন্তানও শিক্ষিত হবে। তিনি আরো জানান, শুধু শিক্ষা অর্জনই নয়; তোমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যেতে হবে।
কৃষিকার্যকে অবহেলা করা যাবে না। আর মদ, গাঁজা খাওয়া ও জুয়া খেলার নিষেধ করেন। চারিত্রিক স্বচ্ছতার কথা বলে সকলকে অনুপ্রাণিত করেন। এরপর-
মতুয়াদেরকে কার পূজা করতে হবে আর কার পূজা করবে না; সে বিষয়ে তিনি এক অমোঘ বাণী দেন- যে বাণীকে প্রত্যেক মতুয়া অনুরাগী তথা সকল সমাজচিন্তকদের ভেবে দেখা দরকার। যে বাণী শুধু মতুয়াদের জন্যই নয়, সমগ্র মানবজাতির প্রগতির জন্য একান্ত আবশ্যক।
দেবতা-মন্দির সবে গড়’ ঘরে ঘরে।
নিত্য পূজা কর সেথা সকল অন্তরে।।
এইখানে আমি বলি’ এক সমাচার।
দেবতা-মন্দিরে পূজা করিবে কাহার?
বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫২৯)
পাঠকগণ খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করুণ, গুরুচাঁদ ঠাকুর ঘরে ঘরে দেবতার মন্দির গড়ার কথা বলছেন। কিন্তু তিনি আবার প্রশ্ন করছেন যে, সেই মন্দিরে কাঁর পূজা করা হবে? তিনি নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে এক অমোঘ নির্দেশ দিয়েছেন যে-
‘এই মন্দিরে এমন ঈশ্বরকে স্থাপন করে পূজা করবে, যে ঈশ্বর সারা বিশ্বময় বিরাজ করছে। যে ঈশ্বর মানুষকে তাদের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার, সামাজিক ধর্মীয় বিষয়ে জাতিভেদ ও সমস্ত অসমানতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে সংগ্রাম করেছেন। এই সব সমস্যা থেকে পীড়িতদের উদ্ধার করেছেন। সেই ঈশ্বরের পূজা করতে হবে।’
এখানে ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্দ্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, যে যাহাকে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন। ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধারকর্তা। আর এই উদ্ধারকর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন।
তবে সেই পূজা কেমন করে হবে? সেই মন্দির কেমন হবে? এখানে মন্দির অর্থ কিন্তু শুধু মূর্তি স্থাপনের জন্য নয়; শুধু ঘট ফুল পাতা ইত্যাদি প্রচলিত পূজাচার নয়। এখানে মন্দিরের আর একটি বৃহত্তর অর্থ হচ্ছে মন মন্দির, শিক্ষার উপকরণের মন্দির। যে মন মন্দির সুশিক্ষার উপকরণে পরিপূর্ণ হবে।
যে মন্দিরের অর্ঘ্য দেশ সমাজ ও জাতির মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে। প্রগতির ক্ষেত্রে জাগরণ ঘটাবে। যার জন্য তিনি বলেছেন- ‘বিশ্ব ভরে এই নীতি দেখি পরস্পর। যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।’
এখানে ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্দ্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, যে যাহাকে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন। ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধারকর্তা। আর এই উদ্ধারকর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন।
তো এই নিপীড়িত বঞ্চিতদের উদ্ধারকর্তার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাই- মহামানব গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বাবা সাহেব ড ভীম রাও আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা সাবিত্রীবাই ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, বেগম রোকেয়া, ফাতিমা শেখ, বীরশা মুণ্ডা ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম দেখতে পাই- যেমন মার্টিলুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন মেন্ডেলা ইত্যাদি।
এই মহামানবেরা নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই এই মহামানবেরা এই অর্থে ঈশ্বর বা উদ্ধারকর্তা। কর্মের মধ্য দিয়ে এঁদের জ্ঞান-আদর্শের পূজা করতে হবে।
……………………………
গুরুচাদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া
বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর