লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
-মূর্শেদূল মেরাজ
আদতে সকলে ভক্তকে দেখেই তার গুরু সম্পর্কে ধারণা করার চেষ্টা করে। কারণ ভক্ত গুরুর জীবনাচার নিজ জীবনে ধারণ করার চেষ্টাই করে যায় জীবন ভর। আর তার মধ্য দিয়ে সাধনের যাত্রা করে। সাঁইজি বলেছেন-
ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন বলে জাতের বিচার নাই।।
ভক্ত কবির জেতে জোলা
শুদ্ধ ভক্তি মাতোয়ালা,
ধরেছে সেই ব্রজের কালা
দিয়ে সর্বস্ব ধন তাই।।
রামদাস মুচি ভবের পরে
ভক্তির বল সদাই করে,
সেবায় স্বর্গে ঘণ্টা পড়ে
সাধুর মুখে শুনতে পাই।।
এক চাঁদে হয় জগৎ আলো
এক বীজে সব জন্ম হলো,
লালন বলে মিছে কলহ
ভবে দেখতে পাই।।
গুরুবাদে বলা হয়, ভক্তের ভক্তির গুণেই সকল অসাধ্য সাধন হয়। ভক্তের ভক্তিগুণেই গুরু মহান হন। আর ভক্তিবাদে বলা হয়, ভক্তিহীন হৃদয়ে ভগবান ধরা দেয় না। ভক্তের জন্যই ভগবান। অর্থাৎ পরম। অর্থাৎ পরমেশ্বর। তাই বলা হয়, পরমকে জানতে হলে। নিজেকে জানতে হলে, প্রেমের পথ; ভক্তির পথই শ্রেষ্ঠ পথ।
শ্রীমদ্ভাগবতে কপিল মুনি উল্লেখ করেছেন- ভক্তি দু’প্রকার- শুদ্ধ ভক্তি ও মিশ্র ভক্তি।
পরমকে পেতে হলে, নিজেকে পেতে হলে, গুরুকে পেতে হলে প্রয়োজন শুদ্ধ ভক্তি। কর্মমিশ্রিত ভক্তিতে ভক্তির গুণ হারায়। এতে প্রাপ্তি মেলে না। যে ভক্তিতে প্রাপ্তির লেশমাত্র উপস্থিত তাকে শুদ্ধ ভক্তি বলা যায় না। আর শুদ্ধ ভক্তি না হলে ভক্তের ভক্তিতে পূর্ণতা আসে না।
আর ভক্তের ভক্তিতে পূর্ণতা আসলে তবে সেই ভক্তির গুণে মত-পথ সৌন্দর্যমণ্ডিত-নান্দনিক হয়। ভক্তের ভেতর দিয়েই মতাদর্শ প্রদর্শিত হয়। ভক্তের ভক্তি-নিষ্ঠা দেখেই মানুষজন সে সম্পর্কে আকৃষ্ট হয়। যদিও একটা মতাদর্শের পেছনে তার প্রবক্তা, তার শাস্ত্র, তার ভাষ্য অনেকবেশি গুরুত্ব বহন করে।
তারপরও মতাদর্শকে এগিয়ে নিতে ভক্তের জুড়ি মেলা ভার। ভক্তের শক্তিতেই মত-পথ এগিয়ে যায়। তাই ভক্তকে সবার আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। নিজে প্রস্তুত না হতে পারলে যে আলোতে সে ডুবেছে। সেই আলো উদ্ভাসের পথ পায় না।
কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হলো, লালন ঘরে এতো সৃজনশীল-মানি-গুণি ভক্তের আনাগোনা দেখা গেলেও। লালনকে নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে তার আশানুরূপ প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না। এই বিষয় নিয়ে কাজ করার ব্যাপক সম্ভাবনা অনেকের মাঝেই পরিলক্ষিত হলেও। শেষ পর্যন্ত সেই কাজ আর বাস্তবে রূপ নিতে দেখা যায় না।
তবে যারা গুরুরূপে আবির্ভাব হওয়ার বসনা রাখেন। তাদের অনেকে নিজেকে প্রস্তুতে মনোযোগী হন। তবে বর্তমানে বেশিরভাগ ভক্তই ভক্তির গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেয়ে ভেদের কথা জানবার প্রতিই বেশি আগ্রহী। বা বেশভূষায় বেশি মনোযোগী। তাই এখন প্রকৃত ভক্তের দেখা মেলা ভার।
যেহেতু ফকিরিতে ক্ষমাই মূল আদর্শ। তাই ভক্তরা ক্ষমা পেয়ে যাবেই এমন ভাবনাতেই হয়তো ভক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনা জ্ঞান করেন না। আবার অনেক গুরু ভক্ত ধরে রাখবার কামনায় কঠিন বিধি-নিষেধ, নিয়মকানুনের প্রচলনও করেন না। তাই অনেকে গুরু আশ্রিত হয়েও কামনা-বাসনা ত্যাগ করতে পারে না।
অনেকে লালন সাঁইজির গানের আসর। সাধুসঙ্গ সূচনা করেছেন নিজ নিজ গণ্ডির ভেতর। সেটা নি:সন্দেহে ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাঁইজির পদ যত বেশি গীত হবে। ততবেশি মানুষের কাছে যাবে। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী-সত্যের অনুসন্ধানী ভক্ত মেলা আজ বড়ই কঠিন। আর উপযুক্ত ভক্তের অভাবে যতটা মানবিক-সৌন্দর্যমণ্ডিত-নান্দিকভাবে লালন ভাব-ভাবনা প্রকাশ হবার কথা ছিল। তা এখনো সেভাবে শুরুই হয়নি বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়।
এটা আসলেই আক্ষেপের বিষয়। সাধুগুরুরা অনেকেই তাই আপসোস করে প্রায়শই বলেন, ‘বাপু আগে গুরু পাওয়া যাইতো না। আমরা গুরুর সন্ধানে কত ঘুরছি। আর এখন গুরু আছে ভুড়ি ভুড়ি। কিন্তু ভক্ত পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা কেবলই মোহাশক্ত।’
যদিও মোটা দাগে সকলেই ভক্ত। গুরু-শিষ্য সকলেই। তারপরও যেহেতু ভিন্ন আলোচনা হয়েছে। তাই এখানে ভক্ত বলতে কেবল দীক্ষাধারী ভক্তকুলকেই উল্লেখ করা হয়েছে।
লালনকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যত কাজ হয়েছে। তার সিংহভাগই লালন ঘরে দীক্ষাধারী ভক্তকুলের হাত ধরে হয় নি। যদিও লালন ফকিরকে নিয়ে মৌলিক কোনো কাজ হয়নি বললেই চলে। তারপরও যা হয়েছে তাতে ভক্তকুল তেমন কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখতে শুরু করেনি।
আবার অনেক কাজ দেখা যায়, যা অনুরাগী-অনুসারীকুল শুরু করেছিল। কিন্তু সেই অনুরাগী-অনুসারীই যখন ভক্তরূপে দীক্ষা নিয়েছে। তারপর আর তার থেকে বিশেষ কোনো কাজ পাওয়া যায় নি।
অনেকে লালন সাঁইজির গানের আসর। সাধুসঙ্গ সূচনা করেছেন নিজ নিজ গণ্ডির ভেতর। সেটা নি:সন্দেহে ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সাঁইজির পদ যত বেশি গীত হবে। ততবেশি মানুষের কাছে যাবে। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
একদিন নিশ্চয়ই ভক্তরা পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ভুলে। প্রাপ্তির বাসনা ছেড়ে সাঁইজিকে নিয়ে কাজ শুরু করবে। সমাজকে-সংসারকে সুন্দর করবে। সাঁইজির মত-পথকে জীবনবোধের মধ্য দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করবে। যা দেখে মানুষ সত্য-সুপথে চলা শিখে নিবে।
তবে গুটি কয়েক সাধুসঙ্গতেই আদি ভাবধারাকে তুলে ধরবার চেষ্টা দেখা যায়। বেশিভাগই সাঁইজির পদকে বিনোদনের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। যা দু:খজনক।
তবে এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও না বললেই নয়। যারা বাইরে থেকে অর্থাৎ লালন ঘরে দীক্ষা না নিয়ে লালন সাঁইজিকে নিয়ে কাজ করেন। তাদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। তারা সাঁইজির ঘরের দীক্ষাধারী ভক্ত নয় বলে তাদের ভুলচুক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় না।
কিন্তু দীক্ষাধারী ভক্তকুল কিছু করলে। তাতে ভুল ধরা পরলে। শুধু সেই নয়। তার গুরুর সুনামও লুণ্ঠিত হতে পারে। তাই হয়তো সাঁইজিকে নিয়ে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরবার যে কাজ। তা ভক্তরা করে থাকেন না। বা করতে চান না।
তবে একেবারে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। ভক্তকুল একদিন নিশ্চয়ই সকল অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে সাঁইজিকে নিয়ে কাজ করার শক্তি-সাহস-মনোবল পাবে। সাঁইজির জ্ঞানকে প্রকৃত ভক্তি ও প্রেমে নিজে গ্রহণ করবে। এবং অন্যদের জন্যও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবে বলেই বিশ্বাস।
তবে এ কথাও সত্য যে, মহৎ নিজে না চাইলে তার বাণী প্রচার করে। প্রসার করে এ সাধ্য কার। হয়তো ফকির লালন সাঁইজিই এখনো ভক্তদের হাত দিয়ে প্রচারের যাত্রা শুরু করান নি। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ভক্তকুলের মধ্যে দিয়ে সেই যাত্রা শুরু হবে।
একদিন নিশ্চয়ই ভক্তরা পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ভুলে। প্রাপ্তির বাসনা ছেড়ে সাঁইজিকে নিয়ে কাজ শুরু করবে। সমাজকে-সংসারকে সুন্দর করবে। সাঁইজির মত-পথকে জীবনবোধের মধ্য দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করবে। যা দেখে মানুষ সত্য-সুপথে চলা শিখে নিবে।
এমন মানব সমাজ গঠন করবে, যেখানে ইতর-আতরাফ বলে কেউ কাউকে দূরে ঠেলে দিবে না। ধর্মের পরিচয়ে নয়। বরং ব্যক্তি প্রেম-ভক্তি-নিষ্ঠা-বিণয়ের ভিত্তিতে মানুষকে মর্যাদা দেয়া হবে। ভক্তরাই পারে এই সুদিন আনতে। এবং একদিন তা তারা আনবেই আনবে। এমনটাই বিশ্বাস। জয়গুরু।।
লালন চর্চায় অনুরাগীকূল-
সম্ভবত ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজির অনুগামীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রেণী হচ্ছে তাঁর অনুরাগীকুল। ফকির লালন এমন একটি নাম। যাকে অস্বীকার করা মুশকিল। তিনি তার পদের প্রতি শব্দে শব্দে, অক্ষরে অক্ষরে, বাক্যে বাক্যে এমন রহস্যের অন্তহীন যাত্রার সন্ধান দিয়ে গেছেন।
যার সন্ধানে নামেনি এমন বঙ্গভাষী পাওয়া দুষ্কর। তারপরও অনেকে লালন ফকিরকে-লালন ফকিরের ফকিরিকে সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তাঁর গানকে অবজ্ঞা করে এমন বঙ্গ সন্তান পাওয়া দুর্লভ।
এমন কি যারা ফকির লালনকে-লালনের মতাদর্শকে পছন্দ করেন না। আমলে নেন না। উল্টো ঘোরতর বিরোধিতা করেন। তারাও নিজ মত প্রকাশ করতে গিয়ে, বা বিরোধিতা করতে গিয়ে হলেও লালনের বাণী ব্যবহার করে থাকেন।
একবার এক পালাগানের শিল্পী প্রসঙ্গক্রমে বলেছিল, “আগে আমরা লালন গান তেমন করতাম না। এখন পালা করতে গেলে দুই একটা গাই। আসলে আমরা যারা পালা করি। তাদের নিজেদের, নিজের গুরুরই প্রচুর গান আছে। তাই অন্য মহতদের বেশি গান করা হয় না।
তারপরও আজকাল দুই-একটা লালন করতেই হয়। কেন জানেন? ঐ যে কথায় বলে না, ‘স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘা!’ লালনের গান হইলো সেই ওষুধ। যখন আর অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তখন সাঁইজির এক গানে কাইত কইরা দেই।”
যদিও ফকিরি ধারাকে অনেকেই সহজভাবে মেনে নিতে বা মনে নিতে পারে না। তারপরও লালনকে ভালোবাসেন না এমন কথা শিল্প-সংস্কৃতি-দর্শন-সাহিত্য প্রেমীদের মুখে শোনা যাবে না। তাঁকে ভালোবেসে, তাঁর মতকে গ্রহণ করে সর্বস্ব ত্যাগ করে পথে নেমেছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়।
(চলবে…)
<<লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন ।। লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………………
আরো পড়ুন-
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এক
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দুই
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তিন
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব চার
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব পাঁচ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব ছয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব সাত
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব আট
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব নয়
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব দশ
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব এগারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব বারো
লালন চর্চা কোন পথে? : পর্ব তেরো