-স্বামী সৌমেশ্বরানন্দ
মৃত্যুকে মানুষ ভয় করে কেন? মৃত্যুর পরে কি অবস্থা হবে, সে তা জানে না। জীবনে যে নিশ্চিত নিরাপত্তা গড়ে উঠেছে, তাকে ছেড়ে সে মৃত্যু-পরবর্তী অনিশ্চিত অবস্থায় যেতে রাজি নয়। আস্তিকেরা যখন মরতে ভয় পায় তখন তার মধ্যে একটা যুক্তি থাকতে পারে। মৃত্যুর পর স্বর্গে না নরকে যাবে, এই ভেবে আস্তিকেরা ভয় পেতে পারে।
কিন্তু নাস্তিকেরা কেন মরতে ভয় পায়? তারা তো বলে যে, মৃত্যুর পর কিছু থাকে না।
আস্তিক-নাস্তিক সবাই মৃত্যুকে ভয় পায় কেন? শারীরিক কষ্টের জন্যে? তা তো সব সময় নয়! আসলে মানুষ তার জীবনে নিরাপত্তার খোঁজে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। তার স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-বন্ধু-বাড়ি-ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদির অজস্র মানুষ ও বিষয়ের ওপর সে নির্ভর (depend) করছে।
দীর্ঘকাল ধরে এই নির্ভরতা অভ্যাস করার ফলে তার জীবনে এক বিশেষ রকম ছন্দ (rythm) এসেছে। মৃত্যু এসে তার এই ছন্দ নষ্ট করে দেবে, এটি ভেবেই মানুষ ভয় পায়। মানুষের সবচেয়ে বড় ত্রুটি তার মানসিক নির্ভরতা (psychological dependence) এবং এই নির্ভরতারই অন্য নাম আসক্তি (attachment)।
সে আসক্ত তার স্ত্রী-সন্তানে, বাড়ি গাড়ি-সম্পত্তিতে, বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজনে। সে এতদিন যাদের ওপর নির্ভর করছিল, যে বিষয়ে আসক্ত ছিল, মৃত্যু সেগুলিকে কেড়ে নেবে। জীবনের ছন্দ হারানোর এই যে অনিশ্চয়তা, এটি তার চেতন ও অবচেতন মনে কাজ করে। আর, এরই নাম ‘ভয়’।
মানুষ সবসময় নিরাপত্তা (security) খোঁজে এবং নিজের জীবনে সে এক ধরনের কাল্পনিক নিরাপত্তা গড়েও তোলে। ‘কাল্পনিক’ শব্দটি ব্যবহার করলাম, কারণ স্থায়ী নিরাপদ (permanently secured) বলে এ-জগতে কিছু নেই। চাকুরি যাবার ভয়, রাজভয় ইত্যাদিও এ-রকম।
অপমান বা মানহানিকে মানুষ ভয় করে, কারণ সমাজে বা পরিবারে সে এতদিন যে সত্তা (image) বা স্থান (status) নিয়ে নিরাপত্তা গড়ে তুলেছিল, অপমানের ফলে সেই দুটি বিলীন হয়ে তাকে নতুন সত্তা ও স্থানে সরিয়ে দিতে পারে।
ভূতের ভয় মানুষ কেন পায়? কারণ ভূতের মুখোমুখি হলে সে কোন্ পরিস্থিতিতে পড়বে, তা জানে না; এই নতুন পরিস্থিতিতে কিভাবে সে আত্মরক্ষা করবে, তাও তার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, সব রকম ভয়ের কারণই হলো নিরাপদ অবস্থা থেকে অনিশ্চিত অবস্থায় যাওয়ার আশংকা।
ভয় ব্যাপারটি যদিও বর্তমান কালে হয়, তবুও এর বিষয় ভবিষ্যৎ কালের। বর্তমানকে আমি জানি, ভবিষ্যতকে জানি না। কি বিপদ ঘটবে তা যদি আমার জানা থাকে, তবে তার জন্যে আমি প্রস্তুত হতে পারি।
কিন্তু আমি জানি না, মৃত্যু হলে কি হবে, ভূত দেখলে কি হবে, চাকুরি গেলে কি হবে, পুলিশ ধরলে কি করবে। এই যে ‘না জানা’ এটিই আমার মনে ভয় সৃষ্টি করে।
যে-কোনো ভয়ের কারণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মানুষ সব সময় নিরাপত্তা খুঁজছে, দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে। তার চিন্তা এই নিরাপত্তা খোঁজায় অভ্যস্ত। এই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার উপক্রম হলেই সে ভয় পায়।
আমি যদি মনে মনে বিচার করি- কেন আমি নিরাপত্তার জন্যে বিশেষ বিশেষ মানুষে ও বিষয়ে আসক্ত-তবে দেখবো যে আমি কতকগুলি কাল্পনিক ব্যাপারকে বাস্তব বলে ধরছি। এবং এটিই আমার জীবনে বড় বড় সমস্যা নিয়ে এসেছে।
তাত্ত্বিক দিক ভয়ের কারণ বুঝলেও যেটি প্রয়োজন তা হলো, আমি যখন ভয় পাচ্ছি তখন নিজে নিজে চিন্তা করা- কেন ভয় পাচ্ছি। এভাবে নিজের ভয়ের কারণ নিজেকেই আবিষ্কার করতে হয়, সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নিজেকে।
গান্ধীজী লিখছেন যে, ছোটবেলা ভূতের ভয় পেলে তিনি রাম-নাম করতেন। রাম-নাম করলে কি ভূতের ভয় যায়? আসলে ভয় ব্যাপারটি হলো মনের এক বিশেষ অনুভূতি।
(চলবে…)
……………
আরো পড়ুন:
ধ্যান ও শান্তি : এক
ধ্যান ও শান্তি : দুই
…………………………………
স্বামী সৌমেশ্বরানন্দের ‘দৈনন্দিন জীবনে ধ্যান ও শান্তি’
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সকল সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত- প্রণয় সেন