ভবঘুরেকথা
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া

-জগদীশচন্দ্র রায়

জাতিভেদ প্রথা হচ্ছে বৈদিকবাদী ব্যবস্থার প্রাণ ভোমরা। এই ব্যবস্থা যত সুদৃঢ় হবে বৈদিকবাদীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিনাশ্রমে অর্থ উপার্জনের পথও সুগম হবে। মানুষ তাদের কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য জাতিভেদ প্রথা। যার জন্য এই ব্যবস্থা নির্মূলের জন্য আজ পর্যন্ত তেমন ভাবে কোনো ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্থা এগিয়ে আসে নি।

যদিও সামান্য কিছু থেকে থাকে সেটা লোক দেখানো মাত্র, আন্তরিক ভাবে নয়। ব্রাহ্মণবাদী ব্যবস্থার অঙ্গ হচ্ছে অন্ধ-কুসংস্কার, পাপ পুণ্য, মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব, পারলৌকিকতা, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি। কিন্তু এসব কিছুর মূল হচ্ছে এই জাতিভেদ প্রথা।

মতুয়া ধর্ম-দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুর যেমন প্রথমেই এই প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ‘বেদ বিধি শৌচাচার মানেন না’। তেমনি গুরুচাঁদ ঠাকুরও ব্রাহ্মণ্যবাদের অসারতাকে উপলব্ধি করতে পেরে বলেছিলেন-

‘ব্রাহ্মণ রচিত অভিনব গ্রন্থ হচ্ছে- ব্রাহ্মণ প্রধান মার্কা ‘বিজ্ঞাপন যন্ত্র, এরা, স্বার্থবশে অর্থলোভী ও ভণ্ড।’

তাই তিনি মতুয়া ধর্ম-দর্শনের সামাজিক নীতি হিসাবে জানিয়ে দিয়েছেন- বিশ্বের সকল মানুষ এক জাতি। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই।

যে কথার প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই বাবা সাহেবের বিচার ধারায়- ‘জাতব্যবস্থা নির্মূলের প্রকৃত ঔষধ হল শাস্ত্রের প্রতি অন্ধবিশ্বাস ও ভক্তির মূলোচ্ছেদ করা।’ (The real remedy is to destory the belief in the sanctity of the shastras. -Annihiletaion of Caste)

গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজে জাতিভেদ প্রথার উপর কুঠারাঘাত করে বলেছেন-

নম:শূদ্র কুলে জন্ম হয়েছে আমার।
তবু বলি আমি নাহি নম:র একার।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১৪৪)

কোনো মহামানবের জন্ম নয়, কর্মই প্রধান। আর সেই কর্ম কোনো বিশেষ শ্রেণির জন্য নয়। সেটা গভীর দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করলে বোঝা যাবে যে, সেসব কর্ম সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য। কিন্তু এখানে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে কেন এই কথা পরিস্কার করতে হচ্ছে-

তিনি শুধু নম:র নন? কারণ বৈদিকবাদীরা কখনোই চায় না অন্য সমাজ থেকে কেউ উপরে উঠে আসুক। তাই হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাঁরা শুধুমাত্র নম:দের জন্য কাজ করেছেন। অতএব তাঁরা নম:র ভগবান।

এখানেও জাতিবাদের মোহর লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা হরি-গুরুচাঁদের জীবনদর্শন ও কর্মের যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো- তাদের কর্মধারা সমহ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য ছিল। কোনো বিশেষ এক জাতির জন্য নয়। তার প্রমাণ আমরা পরের লাইনেই পাই-

নরাকারে ভূমণ্ডলে যত জন আছে।
‘এক জাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-২০১)

এই বিশ্বে যত মানুষ আছে তারা সকলে আমার কাছে এক জাতি। অর্থাৎ মানবজাতি বলে মান্যতা পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে এই স্বীকারোক্তি বারবার কেন করতে হচ্ছে? কারণ বৈদিক বাণী জাত ব্যবস্থা দেশ ও সমাজকে এমনভাবে বিভক্ত করেছে যে, কারো পরিচয় জানার পূর্বে তার জাত (Caste) সম্পর্কে জানা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গুরুচাঁদ ঠাকুর বৈদিকবাদীদের এই জাতিভেদ ব্যবস্থার উপর কুঠারাঘাত করে জানিয়ে দিয়েছেন- বিশ্বের সকল মানুষ তাঁর কাছে একজাতি হিসাবেই মান্যতা পাবে।

মতুয়া সকলে এক, জাতি ভেদ নাই।
বিশেষত: কন্যা হ’লে নাহিক বালাই।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-২০১)

তিনি তার মতাদর্শের অনুরাগী ও ভক্তদেরও নির্দেশ দিয়েছেন- মতুয়ারা সকলে এক, তাদের মধ্যে কোনো জাতিভেদ যেন না থাকে। আর মতুয়া ধর্মে কন্যা বা নারীর স্থান সবার ঊর্ধ্বে। সেখানে কোনো প্রকার নারী-পুরুষ বা জাতিগত বৈষম্য চলবে না।

সামাজিক নীতি সব শোন ভক্তজন।
‘জাতিভেদ’ প্রথা নাহি মানিবে কখন।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৫৭০)

মতুয়া ধর্মে ১২টি আজ্ঞা ও ৭টি নিষেধাজ্ঞাসহ সকল মতুয়াদের এই সামাজিক নীতিকেও মেনে চলতে হবে যে, মতুয়া ধর্ম-দর্শনে অনুপ্রাণিতদের আচরণে যেন কোনো প্রকার জাতিগত ভেদাভেদ বিন্দুমাত্রও প্রকাশ না পায়।

কারণ গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজে যে জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, বৈদিক বিধানকে অস্বীকার করেছিলেন, ‘বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি’-এর মধ্যে দিয়ে। কারণ মতুয়া দর্শনের মূল নীতি হচ্ছে- ‘জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা। ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।’ (লীলামৃত, পৃ-১১)।

গুরুচাঁদ ঠাকুরও পিতার আজ্ঞা ও আর্দশকে শিরোধার্য করে দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। কারণ জাতিভেদ প্রথা হচ্ছে কোনো সমাজ ও দেশের ক্ষেত্রে মরণব্যাধি স্বরূপ। তাই সকলকে এই ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে হবে-

মানুষে মানুষে বল ভিন্ন জাতি কোথা?
নরজাতি এক জাতি ভেদ করা বৃথা।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-৩৬০)

জাতিভেদ হয় পশুদের মধ্যে। কিন্তু মানুষের মধ্যে জাতিভেদ যারা করেছে, তারা কি মানুষের যোগ্য? মানুষের মধ্যে তো ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রশ্নই আসে না। সকল মানুষ সমান। মানুষেল একটাই জাতি- সেটা হচ্ছে ‘মানবজাতি’।

……………………………
গুরুচাদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন

শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন

তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর

……………………………
আরো পড়ুন:

মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া

বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!