-জগদীশচন্দ্র রায়
১৮৮১ সালে বর্তমানে বাংলাদেশের খুলনা জেলার অন্তর্গত দত্তডাঙা গ্রামের ঈশ্বর গাইনের বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষে বহু দূরদূরান্ত থেকে যে অসংখ্য জ্ঞানী গুণীজন আসেন, তাদের উপস্থিতিতে গুরুচাঁদ ঠাকুর সভাপতির ভাষণে প্রথমেই জানান-
তাই বলি সভাজন সবে হয়ে এক মন
নম:শূদ্র জাতি কথা শুন মন দিয়া।
নম:শূদ্র কবে হল পূর্ব্বে তারা কিবা ছিল
সংক্ষেপেতে সেই কথা বলিব সভায়।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৩)
সুধী সভাসদগণ, আপনারা ধৈর্য্য ধরে শান্ত হয়ে শুনন কীভাবে এই নম:শূদ্র জাতির উদ্ভব হ’ল। আর এর পূর্বে এই জাতির পরিচয় ও ধর্ম কী ছিল? সেসব কথা আমি সংক্ষেপে বলত চেষ্টা করছি-
আচার বিচার যত সব ব্রাহ্মণের মত
শুধুমাত্র যজ্ঞসূত্র গলে নাহি রয়।
সবে করে কৃষি কাজ তা’তে নাহি কোন লাজ
পূর্ব্বকালে আর্য জাতি করিত সবাই।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৩)
নম:শূদ্র জাতির আচার-অনুষ্ঠান
আমাদের এই নম:জাতির আচার অনুষ্ঠান, বিচারধারা এরকম অনেক কিছুই ব্রাহ্মণদের মত ছিল। (যেমন- ব্রাহ্মণরা শ্রাদ্ধ কার্য দশ দিনে করে। নম:শূদ্ররা কেউ মারা গেলে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য দশ দিনে পালন করে। অন্য জাতির লোকেরা কিন্তু কেউ ৩০ দিন বা ১৫ দিন করে)।
যদিও আমাদের লোকদের গলায় কোন পৈতা ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সকলে কৃষিকাজ করতেন। যে কাজ সেই সময়ে আর্যরা করতেন।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কোন প্রকার ছল-চাতুরি তাদের মধ্যে ছিল না। আর কোন বিলাসিতার জীবন যাপন করতেন না। তাদের মধ্যে কোন ভোগের লালসা ছিল না। কৃষিকার্য করে যেটা উৎপাদন করতেন সেটা দিয়েই সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতেন।
আমাদের এই লোকেরা প্রকৃতির পূজক ছিলেন। অন্য কোন দেবদেবীর পূজা করতেন না। এঁরা দীন-দু:খীকে উদার হস্তে দান করতেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে-
এমন সরল যারা তারা কেন সর্ব্বহারা
সেই কথা সভা মাঝে বলিবারে চাই।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৩)
আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন এত সহজ সরল ছিলেন, সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতেন, তাঁরা কেন সর্বহারায় পরিণত হলেন? সেই ইতিহাস আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই। এই ইতিহাস ভীষণ দু:খের। সেটা মনে পড়তেই আমার হৃদয় বেদনায় ভরে ওঠে।
সে দু:খের কাহিনী ছবির মতো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। যেসব কথা আমি আমার পিতা অনন্ত করুণাসিন্দু শ্রীহরির কাছ থেকে জেনেছি-
চরাচর এ ব্রহ্মাণ্ড কোথা মূল কোথা কাণ্ড
কেবা সৃষ্টি করে তারে কোন বিধিমতে।
জড়-অচেতন সাথে কিবা ভাবে কোন মতে
চেতনা রূপিণী শক্তি আছে বসি তা’তে।।
স্রষ্টা-সৃষ্টি কি সম্বন্ধ সুখ দু:খ ভালমন্দ
চেতনাচেতনে রহে কোন সূত্র ধরি।
কেবা দেহে কথা কয় কেবা সুখ-দু:খ বয়
কেবা গেলে জড় দেহ রহে ভূমে পড়ি।।
জীবন মরণ কিবা কিবা রাত্রি কিবা দিবা
কোন সূত্রে গাঁথা আছে জীবের জীবন।
জীবন প্রভাত হ’তে নরজাতি এ ধরাতে
করিয়াছে অবিরত এ সব চিন্তন।।
অধরে ধরিবে বলে দিনে দিনে পলে পলে
চেতনারে ভর করি করেছে সমর।
জড় দেহ করি ক্ষয় লভিবারে সুবিজয়
করেছে সাধনা কত যুগ যুগান্তর।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৩)
ব্রহ্মাণ্ড কথা
এই যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এর কোথায় শুরু আর এর শেষ বা কোথায়? কীভাবে এর জড় পদার্থের (পঞ্চভূত) থেকে জীবের সৃষ্টি হ’ল? যে জীবের মধ্যে নিরন্তর চেতনার বিকাশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন্ সূত্রে এই স্রষ্টা ও তার সৃষ্টির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সম্বন্ধ গড়ে উঠেছে?
যে সম্বন্ধ উৎপত্তি ও বিনাশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে?
আমাদের এই যে দেহ, এর মধ্যে যে চেতনার প্রবাহ চলছে, সেই চেতনার প্রকাশ আমরা ব্যক্ত করতে পারছি। এসব কীভাবে ঘটছে? কোন সূত্রের ফলে এই জীবন মরণের খেলা চলছে? আর অমানিশার অন্ধকার দূরে গিয়ে প্রভাতে কিরণ উদ্ভাসিত হচ্ছে?
অর্থাৎ এই সমস্ত কিছু একটা নিয়মে নিরন্তর ঘটে চলেছে। কেন এত দু:খ? দু:খের কারণ কি? এর থেকে মুক্তির পথ কি? আর এই সব প্রশ্নের সমাধানের জন্য-
জীবন প্রভাত হ’তে নরজাতি এ ধরাতে
করিয়াছে অবিরত এ সব চিন্তন।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ- ১২৩)
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষেরা অবিরাম ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অধরাকে ধরার জন্য। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে চেতনার উপর অর্থাৎ জ্ঞানের বিকাশের উপর নির্ভর করে যেন যুদ্ধক্ষেত্রে সংগ্রাম করে চলেছে। কত মুনিরা এর জ্ঞান পিপাসায় ডুবে গিয়ে ধ্যানমগ্ন চিত্তে সাধনা করে চলেছে।
তারা এইসব রহস্যকে উদ্ধার করার জন্য ধ্যানের মাধ্যমে সাধনায় মগ্ন থেকে তার থেকে জ্ঞান আহরণ করে বিজ্ঞানের বিকাশ সাধন করেছে। এরকমই আমাদের ভরত ভূমিতে পূর্বের ২৭ জন মুনির ন্যায় আর একজন মুনি জন্মগ্রহণ করেন-
একদা ভারত খণ্ডে আসিয়া উত্তর বঙ্গে
রাজার আলয় জন্মে জ্ঞান-অবতার।
বুদ্ধ নামে পরিচিত করিলেন জীব-হিত
ভেদাভেদ ভুলি সবে হল একাকার।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)
তিনি রাজ পরিবারে জন্মগ্রণ করেন। যদিও সেই রাজা নিজে হাল চালাতেন। কৃষি কাজ করতেন। সে কথা আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা চাষাবাদ করতেন। তো সেই রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন একজন ‘জ্ঞান-অবতার’ অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতিমূর্তি। তিনি উপরের ঐসব প্রশ্নের উত্তর কঠোর ধ্যানের মাধ্যমে খুঁজে পান।
যাকে বুদ্ধ (জ্ঞান-knowledge) বলা হয়। তিনি এই মানবকুল তথা জীবকুলের হিত সাধনের জন্য সমস্ত রকমের ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে সাম্য মৈত্রী ও অহিংসার বাণী প্রচার করেন। তাঁর এই সাম্য মৈত্রীর বাণীতে মুগ্ধ হয়ে সমাজের এক শ্রেণীর জনগণ যেন হাতের মধ্যে স্বর্গকে পেয়ে গেলেন।
সারা বিশ্ব এই মহান বুদ্ধের নীতিতে প্রভাবিত হয়ে মুক্তির আনন্দে জেগে উঠল। অর্থাৎ তার এই সাম্য মৈত্রী বাণী আর শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বিশ্বের কাছে তুলে ধরলেন এই-
জন্ম-মৃত্যু-দু:খ জ্বরা নিখিল-অখিল-জোড়া
অভিনব ব্যাখ্যা তার করিল ডাকিয়া।
জীবে শক্তি পায় বুকে ত্রিতাপ জ্বালার মুখে
অহিংসা পরম সত্য জাগিল হৃদয়ে।
নাহি হিংসা নাহি দ্বেষ এক জাতি এক দেশ
দলে দলে বৌদ্ধ ছুটে সে ধর্ম বিজয়ে।।
ভারত বিজয় হল তবে ভুভারতে গেল
মানব মনের বাঁধা গেল যে টুটিয়া।
কিবা শিল্প কি সাহিত্য কিবা ধর্ম্ম কিবা তত্ত্ব
শাশ্বত রূপের ছবি উঠিল ফুটিয়া।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)
জন্ম হলে মৃত্যু হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। এই প্রকৃতির পাঁচটি উপাদান ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। যাকে পঞ্চভূত বলা হয়। এই পঞ্চভূতের চার ভূত (ব্যোম বাদে) নিয়ে প্রথম জীবের সৃষ্টি হয়েছে। আর বিবর্তনের ফলে এবং প্রজননের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
এই প্রকৃতি হচ্ছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড। এর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। প্রকৃতি নিজেই স্বয়ম্ভু। বিবর্তনের মাধ্যমে এই সৃষ্টি ও বিনাশের সূত্র নিরন্তর ঘটে চলেছে। জীবের যে চেতনা ঘটছে, সেটা এই প্রকৃতির চারটি উপাদানের জন্য। এর একটি উপাদানের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে জীবের চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়।
জীবের মৃত্য ঘটে। আর জড় শরীর বা পদার্থ আবার ধীরে ধীরে প্রকৃতির উপাদানে মিলে যায়। আর মানুষের যে দু:খকষ্ট -এসব আসে বাসনা বা লোভ থেকে। মানুষ যদি তার ইন্দ্রিয়গত লোভ ও হিংসাকে পরিত্যাগ করতে পারে তাহলে তার মধ্যে আর কোন দু:খ থাকবে না।
কোন হিংসা-দ্বেষ থাকবে না কোন জাতিভেদ থাকবে না। তখন একজাতি (মানব জাতি) একদেশ (বিশ্বব্রহ্মাণ্ড) গড়ে উঠবে। মানুষ এক অনন্ত শান্তি লাভ করতে পারবে।
তো বুদ্ধের এই নীতি সারা ভারতকে বিজয় করল। মানুষের মনের গ্লানি দূর হয়ে গেল। আর বুদ্ধের এই অহিংসা, সাম্য, মৈত্রীর বিচারধারা দিকে দিকে শান্তির বাণী বইয়ে দিতে লাগল। এই নীতির প্রবাহে ভারতবর্ষের শিল্প, সাহিত্য ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটল।
মানুষকে মুক্তির দরজা খুলে দিল। ভারতবর্ষ এক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠল।
কিন্তু এই গৌরবগাঁথা যেন একশ্রেণীর মানুষের কাছে সহ্য হল না। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকল এর বিনাশ করার জন্য।
দিনে দিনে দিন যায় প্রকৃতির কি খেয়াল
জীব কুল পুন: পুন: ভুল করিল ভুলিয়া।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নামে ভারতের পুণ্য ভূমে
বৌদ্ধ ধর্ম্ম নাশ করে সবলে পিষিয়া।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)
ভারতভূমি যখন পুণ্যভূমিতে রূপান্তরিত হল, সমস্ত হিংসা দূর হয়ে শান্তির সমীরণ বইতে শুরু করল, বিশ্বের দরবারে ভারত এক উচ্চ আসন লাভ করল। যার ফলে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এদেশে এসে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে লাগল, তখন বৌদ্ধ ধর্মের এই ধ্বজাকে চক্রান্ত করে (প্রথমে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বান্দে সম্রাট অশোকের বংশধর বৃহদ্রথকে ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ প্রকাশ্য রাজসভায় হত্যা করে শাসন ভার দখল করে ব্রাহ্মণ্য শাসন স্থাপন করে, পরে আবার বল্লাল সেন একই পদ্ধতিতে পালবংশের বৌদ্ধদের নাশ করে) ধুলায় মিশিয়ে দেয়।
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন
তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর
……………………………
আরো পড়ুন:
মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া
বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
…………………….
সূত্র:
অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূল নিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা (যুদ্ধ: আর্য বনাম আর্য, দাস ও দস্যু)-মনি মোহন বৈরাগী (মতুয়া গবেষক) পৃ- ১২, ২৩, ২৮ ও ২৯।
পূর্বে ছিল মুনিগণ করিতেন ধ্যান।
এবে সেই ধ্যান হয় জ্ঞানেতে বিজ্ঞান।।
(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত-তারক সরকার।
পৃ- ৩৬, প্রথম প্রকাশ ১৯১৬; বাংলা ১৩২৩ বঙ্গাব্দ।
5 Comments