ভবঘুরেকথা
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই

-জগদীশচন্দ্র রায়

সমস্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে মেরে ফেলার হুমুম জারি করে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়। অনেক বৌদ্ধ মারা যান। অনেকে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করার জন্য নিজ ধর্মকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আবার অনেকে ব্রাহ্মণ্য শাসনের প্রবল অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দেশান্তরী হন।

কেহ কেহ জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে কোন মতে প্রাণ রক্ষা করেন। এইভাবে ভারত ভূখণ্ড থেকে বুদ্ধের অহিংসা, সাম্য, মৈত্রীর বিচারধারাকে নির্মূল করে দেয়।

তার যত বংশধর দূরে থাকি পরস্পর
নিরালয়ে বসিয়অ কিছু পালে রীতিনীতি।
ধনবান বলবান করিবারে হতমান
আখ্যা দিল তা সবারে অপবিত্র জাতি।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)

এই বুদ্ধ ধর্মাবলবম্বী এক শ্রেণীর বংশধরগণ কিন্তু এই ব্রাহ্মণী শাসন ব্যবস্থাকে স্বীকার না করে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে থাকেন। বৌদ্ধধর্মীয় শাসনকালের ধনবান বলবান গোষ্ঠী তাদের সমস্ত বিষয় সম্পত্তিকে হারিয়ে নি:স্ব হয়ে গেলেও তাদের আদর্শকে ব্রাহ্মণ্য শাসকের কাছে বিলিয়ে দিতে রাজি হননি।

তখন এই বৌদ্ধ মতাদর্শের জনগণকে আরো মানসিকভাবে দুর্বল করে দেবার জন্য অপমান জনক শব্দ বা ঘৃণা মূলক কথা দিয়ে ব্রাহ্মণ্য শাসনব্যবস্থা এঁদেরকে ‘অপবিত্র জাতি’ বলে ঘোষণা করে।

কালচক্র ঘুরে আসে নিরূপায় অবশেষে
হিন্দুধর্ম্ম কবলেতে বৌদ্ধ আসে ফিরে।
ভারতের ইতিহাসে বঙ্গ বা অপর দেশে
হিন্দুরূপী বৌদ্ধ দেখা যায় ঘরে ঘরে।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)

কালের চক্রে এক সময়ের ধনবান বলবান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের ধর্মকে হারিয়ে ‘অপবিত্র জাতি’তে পরিণত হয়ে অবশেষে ব্রাহ্মণ্য শাসনকে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মেনে নিতে বাধ্য হন; যার ফলে তাঁরা নামে হিন্দু হন, কিন্তু তাঁরা তাদের আচার-বিচার-রীতিনীতি সবই পূর্বের বৌদ্ধমতানুসারে করতে থাকেন।

তাই দেখি সর্বদেশে যা’ দিগে অস্পৃশ্য ভাষে’
হিন্দুর সকল নীতি নাহি জানে তারা।
কিছু হিন্দু কিছু বৌদ্ধ এই নীতি দেশশুদ্ধ
বৌদ্ধ সবে মানি লয় হয়ে দিশেহারা।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)

তার জন্য আমরা সারা ভারতবর্ষে দেখতে পাই যাদেরকে অস্পৃশ্য বলা হয়, তাদের উপর হিন্দু ধর্মের নাম চাপিয়ে দিলেও তাঁরা হিন্দু ধর্মের কোন রীতিনীতি জানেন না। কারণ তাঁরা তো গতকালের বৌদ্ধ; আর আজকের হিন্দু। তাই তাঁরা আধা হিন্দু বৌদ্ধ রীতিনীতি নিয়ে দিশেহারা হয়ে জীবন যাপন করছেন।

বঙ্গদেশে নিষ্ঠাবান ছিল যত মতিমান
ধর্ম ছাড়ি প্রাণ রক্ষা করিতে না চাহে।
ধর্ম তরে দূরে যায় কত অত্যাচার সয়
ধর্ম তরে বনমধ্যে হীন হয়ে রহে।।


এই ধর্ম্মবীর যারা সেই বংশে জন্মি মোরা
কালের কুটিল চক্রে হয়ে আছি হীন।
বহু দিন গত হয় সবে মহা দু:খ সয়
এই ঘরে এল তাই হরি ভক্থাধীন।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)

সারা ভারতবর্ষে যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অস্পৃশ্য নাম দিয়ে হিন্দু ধর্মের খোঁয়াড়ে প্রবেশ করায় ব্রাহ্মণ্য শাসনব্যবস্থা; সেই খোঁয়াড়ে প্রবেশ না করার জন্য জীবনকে বাজি রাখেন বঙ্গের এক শ্রেণীর নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।

তাঁরা নিজেদের ধর্ম ও আত্মমর্যাদাকে ব্রাহ্মণ্য শাসকদের কাছে সমর্পণ করতে কিছুতেই রাজি হয়নি; যাঁদের মাথার উপর হীন্ সূচক ‘অপবিত্র জাতি’র কলঙ্ক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও তাঁরা জীবনের থেকে ধর্ম ও আত্মমর্যাদাকে বেশি সম্মানের মনে করে। তাই তাঁরা জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করেন।

‘এই ধর্মবীর যারা সেই বংশে জন্মি মোরা’ -এই যে ধর্মবীরেরা যাঁরা নিজেদের ধর্ম ও আত্ম মর্যাদাকে রক্ষা করার জন্য শত অত্যাচার সহ্য করেও সংগ্রাম করেছিলেন, কিন্তু কখনও মাথা নত করেন নি ব্রাহ্মণ্য শাসকজাতির কাছে। সেই ধর্মবীরেরা হচ্ছেন আমাদের পূর্বপুরুষ।

যাঁরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। আমরা তাঁদের বংশধর। আর আজ কালের কুটিলচক্রে আমরা এখনও হীন্ হয়ে বেঁচে আছি। পতিত হয়ে আছি।

কিন্তু এই হীন্ অবস্থা বা নিজ ধর্ম থেকে বিতাড়িত পতিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য বহুকাল পরে এই ঘরে (বংশে) জন্মগ্রহণ করেন এমন একজন মহামানব, যিনি এই ধর্মহীন পতিত জাতিকে পূর্বপুরুষদের মতো মানসম্মান শৌর্য-বীর্য উদ্ধারের জন্য সত্য প্রেম পবিত্রতা স্থাপনের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন; তিনি হচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুর।

ঘরে এল ভগবান জাগিল জাতির প্রাণ
নম:শূদ্র জাতি জন্ম হল সেই দিনে।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৪)

এই হ’ল নম:জাতির প্রকৃত ইতিহাস। এই নম:শূদ্রের স্বীয় শক্তিতে প্রাণ ফিরে দেওয়ার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর এই ধর্মহীন পতিত জাতিকে উদ্ধার করে বৌদ্ধধর্মের মতাদর্শে নতুন ধর্মের স্থাপন করে নাম দেন ‘মতুয়া ধর্ম’- যে ধর্মের রীতিনীতি আচারব্যবহার সেই পূর্বপুরুষের মতই। তাই-

ধর্ম্ম নহে দূরে কোথা ঘর ছেঁড়ে খোঁজ বৃথা
আপনার ঘরে ধর্ম্ম আছে ঘুমাইয়া।
পবিত্র চরিত্র রেখে সত্য বাক্য বলে মুখে
হরি বলে ধর্ম্ম বাতি লহ জাগাইয়া।।
(গুরুচাঁদ চরিত, পৃ-১২৫)

আপনাদের ধর্ম আপনাদের ঘরের মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে। কারণ ব্রাহ্মণ্য শোষকদের অত্যাচারের ফলে সেই ধর্ম জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে। আপনাদের আচার বিচার রীতিনীতির মধ্যে সেই ধর্ম লুকিয়ে আছে। তাই আপনারা নিজেদের মনে পবিত্রতা গ্রহণ করে সত্য বাক্যকে সাথে নিয়ে আবার আপনাদের পূর্বপুরুষদের অহিংসার ধর্ম, সাম্য-মৈত্রীর ধর্মকে জাগিয়ে তুলুন, এটাই হরিচাঁদ ঠাকুরের আদেশ-

‘হরি বলে ধর্ম্মবাতি লহ জাগাইয়া’

সূত্র নং ১: ‘আর্য হচ্ছে একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম। আর একাধিক মানবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাগত দিক দিয়ে ভারতবর্ষে দু’টি আর্য জাতির অস্তিত্ব মেলে। আর গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যাদের একটি হ’ল- আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যটি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত।

এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেমন অসুর নামে পরিচিত, তেমনি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা ছিল ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। নর্ডিক আর্য অগমনপূর্ব ভারতীয় আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর ভাষাও ছিল আর্য। এই দিক দিয়ে অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠী হিসাবে এরাও আর্য বলে গণ্য।

ঋগবেদে এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে। অন্যদিকে নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর বৈদিক ব্রাহ্মণদের ভাষা যেহেতু আর্য ছিল তাই তারা আর্যজাতি হিসাবেই পরিচিত। অতএব ভাষাগত দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতবর্ষে দুটি আর্য জাতির সন্ধান মেলে।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যে, নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণেরা এবং আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুরেরা যেহেতু আর্য ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত তাই সম্ভবত ব্রাহ্মণেরা অসুরদের ইতিহাস চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য নিজেদের আর্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার দিয়ে দেশীয় অসুরদের অনার্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার করেছেন।

প্রথমটি হল আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত প্রাগার্যজাতি এবং অন্যটি হল- নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত বৈদিক ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃত বৈদিক যুগের আর্য জাতি।

‘অনেক চিন্তাশীল লেখকরাই ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা বলেন, ড আম্বেদকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নয়। আসলে ড আম্বেদকর বলেছেন, আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর আর্য ভাষীরা বহিরাগত নয়।

কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যভাষীরা হলেন বহিরাগত। যদিও বর্তমানে আর্য বলতে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকি। যারা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত। বেদে আর্যজাতি নামে প্রকৃত পক্ষে কোন জাতি নেই।

কারণ বেদে আর্য শব্দটি কখনই জাতি অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। তাই বেদে দুটি মানবগোষ্ঠীর ভাষাকেই আর্য হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে, যার একটা হল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী ব্রাহ্মণ এবং অন্যটা আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর- যা ড. আম্বেদকর তাঁর গবেষণা দ্বারাই প্রমাণ করেছেন।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যে, নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণেরা এবং আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুরেরা যেহেতু আর্য ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত তাই সম্ভবত ব্রাহ্মণেরা অসুরদের ইতিহাস চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য নিজেদের আর্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার দিয়ে দেশীয় অসুরদের অনার্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার করেছেন।

আর অসুররা অনার্য মানবগোষ্ঠী হিসাবে প্রচার পাওয়ার সাথে সাথে একেবারেই মাটিচাপা পড়ে গেছে আসল সত্যটি হচ্ছে, ‘দেশীয় অসুররাও প্রকৃতপক্ষে আর্য ভাষাগোষ্ঠীরই মানুষ।’ যদিও উভয়ের মধ্যে অর্থাৎ আলপাইন ও নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।’

(সমাপ্ত)

…………………….
অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূল নিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা (যুদ্ধ: আর্য বনাম আর্য, দাস ও দস্যু)-মনি মোহন বৈরাগী (মতুয়া গবেষক) পৃ- ১২, ২৩, ২৮ ও ২৯।

পূর্বে ছিল মুনিগণ করিতেন ধ্যান।
এবে সেই ধ্যান হয় জ্ঞানেতে বিজ্ঞান।।
(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত-তারক সরকার। পৃ- ৩৬, প্রথম প্রকাশ ১৯১৬; বাংলা ১৩২৩ বঙ্গাব্দ।)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন

শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন

তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর

……………………………
আরো পড়ুন:

মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া

বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!