অবসাদ
-বার্ট্রান্ড রাসেল
অবসাদ নানা রকমের। তাদের মধ্যে কয়েকটি আবার সুখের পথে অন্যগুলির তুলনায় অনেক বেশি অন্তরায় সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র শারীরিক অবসাদ, যদি মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, তা হলে তা সুখের একটা কারণ হতে পারে। এতে ভাল ঘুম হয়, ক্ষুধা বেড়ে যায় এবং ছুটির সম্ভাবিত আমোদসমূহকে মাধুর্যে ভরে তোলে। কিন্তু তা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
কৃষক রমণীরা উন্নত দেশসমূহের বাইরের সব দেশে ত্রিশেই বুড়ি হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে পড়ে। শিল্পায়ন প্রথার প্রথম যুগে অতি পরিশ্রমে ছোট ছোট ছেলেদের দৈহিক বৃদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যেত এবং প্রায় তারা মারা যেত। চীন এবং জাপানে এখনো তা হচ্ছে, যেখানে শিল্পায়ন নতুন। আমেরিকার দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলিতে এই প্রথা এখনো দেখা যায়।
শারীরিক শ্রম একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে চালাতে গেলে তা বর্বরোচিত অত্যাচারে পরিণত হয়। প্রায়ই এধরনের অত্যাচার করে শ্রমিকদের জীবনকে দুঃসহনীয় করে তোলা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অংশে, যা হোক, দৈহিক অবসাদ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে শিল্পব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে। বর্তমানকালে উন্নত সমাজে যে রকমের অবসাদ সবচেয়ে ভয়ানক তা হল স্নায়ুবিক অবসাদ।
একথা সত্যি যে, ধনীদের পুত্ররা রয়েছে, কিন্তু তারা ধনী হয়ে না জন্মালে যেসব উদ্বেগে ভুগত, ঠিক তার অনুরূপ উদ্বেগ নিজেদের জন্যে তৈরী করে নিতে তারা সফলকাম হয়। বাজি ধরে, জুয়া খেলে তারা তাদের পিতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে। প্রমোদে গা ভাসিয়ে ঘুমের সময় কমিয়ে দিয়ে শরীরকে দুর্বল করে এবং যখন তারা কিছুটা শান্ত হয়, তখন পিতারা তাদের জন্যে যে সুখের ব্যবস্থা করেছেন তা ভোগ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল এই যে, এই অবসাদ ধনবানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল এবং ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় শ্রমজীবীদের মধ্যে অনেক কম দেখা যায়।
আধুনিক জীবনে স্নায়বিক অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। প্রথমত পুরো কাজের সময়ে, কাজ করে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে শহরের কর্মীরা সব সময় নানারকম শব্দ দূষণের মুখোমুখি হয়। এটা সত্যি অধিকাংশ শব্দে সে মনোযোগ না দেওয়ার বিদ্যাটা শিখে নেয় কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই শব্দ তার শক্তিকে ক্ষয় করে দেয়।
তা তার জন্যে আরও ক্ষতির কারণ হয় এই জন্যে যে, ঐ শব্দ না শোনার জন্যে অবচেতন মনে একটা চেষ্টা চলতে থাকে, যা স্নায়ুকে পীড়িত করে। তাছাড়া আমাদের অজান্তে আরো একটি জিনিস আমাদের মনে অবসাদ তৈরী করে এবং তা হচ্ছে অবিরাম অজ্ঞাত পরিচয় লোকদের সাথে দেখা হওয়া।
অন্যান্য সব প্রাণীর মতো মানুষেরও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে স্বশ্রেণীর প্রত্যেক অপরিচিতকে মনে মনে পরীক্ষা করে নেওয়া, সেই আগন্তুকের সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করবে না শত্রুর মতো তা ঠিক করা। ভিড়ের সময় মাটির নিচে পাতাল রেলে যারা যাতায়াত করেন তাদের এই প্রবৃত্তিকে চেপে রাখতে হয় এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও যারা গায়ে গায়ে চাপাচাপি করে বসেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে এক অবরুদ্ধ ক্রোধ অনুভব করেন।
সকলের তাড়া থেকে সকালের গাড়ি ধরার এবং তার ফলে অজীর্ণতা। ফলশ্রুতিতে যতক্ষণে অফিসে পৌঁছে দিনে কাজ শুরু করা না যায়, ততক্ষণে কালো কোট পরিহিত কর্মীটির স্নায়ু ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। তখন সমগ্র মনুষ্যসমাজকেই তার আবর্জনা বলে মনে হয় তার মনিবও ঠিক একই অবস্থায় অফিসে আসেন। এবং কর্মীর মানসিক ক্ষতিপূরণ করার কোনও ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন না।
ছাঁটাই হওয়ার ভয় থেকেই সমপূর্ণ ব্যবহার দেখাতে বাধ্য হয় কর্মীটি, কিন্তু এই অস্বাভাবিক আচরণ তার স্নায়বিক চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়। যদি কর্মীরা সপ্তাহে একবার মনিবের নাক টেনে লম্বা করার সুযোগ পেতেন তাহলে তার সম্বন্ধে কর্মীরা কী ভাবেন তা প্রকাশ পেত এবং তাতে তাদের স্নায়বিক চাপ অনেক কমে যেতে পারত। কিন্তু মনিবের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ।
তাই এটা থেকে কোনও ফল লাভ করা যেত বলে মনে হয় না। কর্মচারীর কাছে ছাটাই হওয়ার ভয় যেমন, নিয়োগকর্তা মনিবের কাছে দেউলিয়া হওয়ার ভয়ও তেমন। অবশ্য একথা ঠিক, অনেকে এত বড় আসনে আছেন যে তাদের এই ভয় নেই। কিন্তু এই ধরনের উচ্চ অবস্থানে পৌঁছাতে তাদের বছরের পর বছর কঠিন সগ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে তাদের বিশ্বের সকল দেশের ঘটনাবলীর ওপর সক্রিয় দৃষ্টি রাখতে হয়েছে এবং তার সাথে তাদের প্রতিযোগীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। এইসব কিছুর মিলিত ফল হল, যখন সত্যিই সাফল্য এল, তখন দেখা গেল সাফল্যলাভকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। যখন আর দরকার নেই তখনো তিনি তাকে ছাড়তে পারছেন না।
একথা সত্যি যে, ধনীদের পুত্ররা রয়েছে, কিন্তু তারা ধনী হয়ে না জন্মালে যেসব উদ্বেগে ভুগত, ঠিক তার অনুরূপ উদ্বেগ নিজেদের জন্যে তৈরী করে নিতে তারা সফলকাম হয়। বাজি ধরে, জুয়া খেলে তারা তাদের পিতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে। প্রমোদে গা ভাসিয়ে ঘুমের সময় কমিয়ে দিয়ে শরীরকে দুর্বল করে এবং যখন তারা কিছুটা শান্ত হয়, তখন পিতারা তাদের জন্যে যে সুখের ব্যবস্থা করেছেন তা ভোগ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে।
তারপর ধীরে ধীরে আমি নিজেকে ভাবতে শেখালাম, আমি ভাল বলি বা খারাপ বলি, কোন ক্ষেত্রেই পৃথিবীর ক্ষতি বা লাভ কিছুই নেই। দেখা গেল ভাল বা খারাপ বলা নিয়ে দুশ্চিন্তা যত কমিয়ে আনলাম, ততই আমার ভাষণ তত কম খারাপ হতে লাগল। এমনিভাবে স্নায়ুযন্ত্রণা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গেল। এইভাবে অনেক স্নায়বিক অবসাদ সম্পর্কেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, পছন্দের অথবা প্রয়োজনের তাগিদ থেকে, অধিকাংশ আধুনিক মানুষ স্নায়ুর পক্ষে ক্ষতিকর জীবন কাটায় এবং সবসময় তারা এত পরিশ্রান্ত থাকে যে, সুরার সাহায্য ছাড়া কোনও আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।
যে সব ধনী বোধহীন তাদের কথা ছেড়ে দিয়ে সাধারণভাবে যাদের অবসাদ কঠিন জীবনসংগ্রামের সাথে যুক্ত, তাদের কথায় আসা যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এদের অবসাদ আসে দুশ্চিন্তা থেকে। দুশ্চিন্তা এড়ানো যায় উন্নততর জীবনদর্শন গ্রহণ করে এবং আর একটু মানসিক-শৃঙ্খলার সাহায্যে। অধিকাংশ নারী ও পুরুষ তাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিমাত্রায় অপারগ।
এ কথায় আমি বলতে চাই যে, যেখানে প্রতিকারের কোনও উপায় নেই সেখানেও তারা উদ্বেগজনক বিষয়ের চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারে না। মানুষ ব্যবসাবিষয়ক চিন্তাকে বিছানায় সঙ্গী করে নিয়ে যায়। যে সময়ে তাদের পরের দিনের ঝামেলা নিয়ন্ত্রণের জন্যে নতুন শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন, তখন তারা তখনকার প্রতিকারহীন দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে।
তারা পরবর্তী দিনে সঠিক চলার পথ কী হবে তা নিয়ে ভাবতে চায় না। তাদের ভাবনা হচ্ছে অর্ধ-উন্মাদের লক্ষণযুক্ত নিদ্রাহীনতার রোমন্থন। পরদিন সকাল পর্যন্ত এই মধ্যরাতের উন্মাদ-ভাব তাদের মনে জড়িয়ে থাকে। ফলে তাদের বিবেচনা-বোধ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মেজাজ খারাপ হয় এবং যে-কোনও বাধায় তা সহজে রেগে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। জ্ঞানী ব্যক্তি যন্ত্রণার কথা ভাবেন একা উদ্দেশ্য নিয়ে।
অন্য সময়ে তারা আলাদা কিছু নিয়ে ভাবেন এবং রাত্রিতে কিছুই ভাবেন না। আমি এমন কথা বলতে চাই না যে, গভীর সংকটে যেমন, যখন ধ্বংস আসন্ন অথবা একজন মানুষের সন্দেহ করার কারণ থাকে তার স্ত্রী তাকে প্রতারনা করছে, তখন তার পক্ষে কিছু চিন্তা না করা সম্ভব। অবশ্য কেউ যদি তার মনকে বিশেষভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে থাকে তা আলাদা কথা। তবে তারা সংখ্যায় বড় কম।
তারাই শুধু তাৎক্ষণিকভাবে যার প্রতিকার হবে না, তেমন বিষয়ে উদ্বেগহীন থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ দিনের সাধারণ সব অসুবিধা যদি তার সম্পর্কে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন না হয়, তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব। সাধারণ মনকে আবাদ করতে পারলে সুখ এবং কর্মদক্ষতা কী পরিমাণ বেড়ে যায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়। এই মন সঠিক সময়ে একটি বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবে, সবসময় অল্প চিন্তায় মগ্ন থাকবে না।
যখন কোনও কঠিন বা উদ্বেগাকুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়। যত তাড়াতাড়ি সব উপায় পাওয়া যাবে তাতেই সবচেয়ে গভীর চিন্তা প্রয়োগ করা উচিত এবং একবার সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তা সংশোধন করা ঠিক নয়, যদি না একবারে নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায়। অব্যবস্থিত চিত্ততার মতো ক্লান্তিকর আর কিছু নেই, এমন অর্থহীনও কিছু নেই।
যেসব বিষয় দুশ্চিন্তার কারণ তার অপ্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলে অনেক দুশ্চিন্তা কমে যায়। আমি অনেক সভায় ভাষণ দিয়েছি, প্রথমদিকে শ্রোতাদের দেখে আমি ভয় পেতাম এবং ঘাবড়ে গিয়ে ভালভাবে বলতে পারতাম না। এই কঠিন পরীক্ষাকে আমি এমনই ভয় পেতাম যে, সব সময় মনে ইচ্ছা হত বক্তৃতার আগেই যেন আমার পা ভেঙে যায়। বক্তৃতা যখন শেষ হত আমি স্নায়ুর যন্ত্রণায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়তাম।
তারপর ধীরে ধীরে আমি নিজেকে ভাবতে শেখালাম, আমি ভাল বলি বা খারাপ বলি, কোন ক্ষেত্রেই পৃথিবীর ক্ষতি বা লাভ কিছুই নেই। দেখা গেল ভাল বা খারাপ বলা নিয়ে দুশ্চিন্তা যত কমিয়ে আনলাম, ততই আমার ভাষণ তত কম খারাপ হতে লাগল। এমনিভাবে স্নায়ুযন্ত্রণা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে গেল। এইভাবে অনেক স্নায়বিক অবসাদ সম্পর্কেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
কিন্তু সেই অবস্থাতে তার বিচারশক্তি আচ্ছন্ন হয় এবং উদ্বেগের তাড়নায় তার দুশ্চিন্তা হয়তো তাকে কাজের দিকে ঠেলে দেয় এবং এইজন্যেই দেউলিয়া হওয়ার সর্বনাশ আগেই ঘটে যায়। যদি তিনি কাজ কম করতেন তাহলে তা দেরিতে ঘটত। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আবেগ উদ্ভুত উদ্বেগ স্নায়ুবৈকল্যের কারণ, কাজ নয়।
আমাদের কাজসমূহ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যা আমরা স্বাভাবিকভাবে ভাবি। আমাদের সাফল্য বা ব্যর্থতায়, মোট কথা, বিশেষ কিছুই আসে যায় না। এমন কী গভীর দুঃখও বাঁচতে পারে। যেসব বিপদকে একসময় মনে হয়েছে যে, তারা জীবনের সুখ চিরদিনের জন্যে নষ্ট করে দেবে, সময়ের সাথে সাথে তাদের তীব্রতা এতই কমে যায় যে মনে করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কিন্তু সব আত্মকেন্দ্রিক বিষয়ের ওপরের বাস্তব হচ্ছে কোনও মানুষের অহংবোধ জগতের খুব একটি বড় অংশ নয়। কোনও ব্যক্তি যদি ভাবনা এবং কামনাকে অহংবোধের অতীত বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন, তাহলে তিনি সব বিপদের মধ্যে অবস্থান করেও একটু শান্তি পেতে পারেন যা কোনও অহংসর্বস্ব ব্যক্তির পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
যাকে বলা হয় স্নায়ুর স্বাস্থ্যবিদ্যা, তা নিয়ে খুব কমই অনুশীলন করা হয়েছে। শিল্পকারখানা বিষয়ক মনস্তত্ত্ব অবশ্য অবসাদ নিয়ে বিষম অনুসন্ধান চালিয়েছে এবং একথা খুব সযত্নপ্রসূত পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি যদি দীর্ঘসময় ধরে কোনও কাজ করতে থাকে তা হলে শেষ পর্যন্ত তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু এই ফলাফলের জন্যে এত বৈজ্ঞানিক আড়ম্বরের প্রয়োজন ছিল না।
মনস্ততত্ত্ববিদরা অবসাদ দিয়ে অনেকে গবেষণা করেছেন। যার পরিধি বেশ ব্যাপক। যার মধ্যে স্কুলগামী শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কোনও পরীক্ষাই মূল সমস্যাকে স্পর্শ করেনি। অবসাদের গুরুত্বপুর্ণ কারণ হচ্ছে অবশ্যই আধুনিক জীবনের আবেগ। বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক অবসাদ বিশুদ্ধ পেশীজাত অবসাদের মতো ন্দ্রিার মধ্যেই তার ক্ষতিপূরণ করে নেয়।
কোনও ব্যক্তির যদি আবেগহীন বুদ্ধিজাত কাজ বেশি করতে হয়, যেমন দীর্ঘ গণনাসংক্রান্ত কাজ, তবে তিনি তার প্রতিদিনের অবসাদ দিনের শেষে নিয়মিত ঘুমিয়ে দূর করেন। অতিরিক্ত কাজের চাপে যে ক্ষতি হয়, তা শুধু সেই কাজের জন্যে নয়, সেই ক্ষতি হয় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের জন্যে। আবেগজাত অবসাদের অসুবিধা এই যে তা বিশ্রামের অন্তরায়।
লোকে যতই ক্লান্ত হয় ততই তার পক্ষে তা দূর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্নায়ুবৈকল্যের একটা লক্ষণ হচ্ছে নিজের কাজকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং কাজ থেকে ছুটি নিলে সব কিছু বরবাদ হয়ে যাবে এই ধারণা। আমি যদি চিকিৎসক হতাম, এরকম যার বিশ্বাস তাদের প্রত্যেককে ছুটি নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র দিতাম।
স্নায়ুবৈকল্যে যা মনে হয় কাজের চাপে ঘটেছে, আসলে তার প্রত্যেকটি আমি যতটা জানি তা ঘটেছে কিছু আবেগ থেকে উৎপন্ন উদ্বেগ থেকে, যা থেকে রোগী পালাবার জন্যে পথ খুঁজে নেন কাজের মধ্যে। কারণ তার যে দুর্ভাগ্য ঘটুক তার চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়ার মতো অন্য কোনও পথ খোলা থাকে না বলেই তিনি কাজ ছাড়তে চান না। অবশ্য এই দুশ্চিন্তা দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকেও হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তার কাজ আর দুশ্চিন্তা একসূত্রে বাঁধা।
কিন্তু সেই অবস্থাতে তার বিচারশক্তি আচ্ছন্ন হয় এবং উদ্বেগের তাড়নায় তার দুশ্চিন্তা হয়তো তাকে কাজের দিকে ঠেলে দেয় এবং এইজন্যেই দেউলিয়া হওয়ার সর্বনাশ আগেই ঘটে যায়। যদি তিনি কাজ কম করতেন তাহলে তা দেরিতে ঘটত। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আবেগ উদ্ভুত উদ্বেগ স্নায়ুবৈকল্যের কারণ, কাজ নয়।
তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা কমে গেছে আশাকেও ব্যাপকভাবে ছাড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকবার করার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু পরিশেষে যদি কঠিন দুর্ভাগ্যের মুখে দাঁড়াতে মানসিক প্রস্তুতিতে কোনও গলদ না থাকে, তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা বাতাসে উড়ে গেছে এবং তাকে প্রতিস্থাপন করেছে একধরনের উল্লাস।
উদ্বেগের মনস্তত্ত্ব কোনও ভাবেই সরল নয়। মানসিক শৃঙ্খলার কথা আগেই উল্লেখ করেছি, অর্থাৎ কোনও বিষয়ে ঠিক সময়ে চিন্তা করার অভ্যাসই হল সেই শৃঙ্খলা। ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত চিন্তার অপব্যয় কম করে দিনের কাজ শেষ করা যায়। দ্বিতীয়ত এটি নিদ্রাহীনতার প্রতিষেধক এবং তৃতীয়ত এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে তৎপরতা এবং দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে।
কিন্তু এই ধরনের ব্যবস্থা অবচেতন বা অচেতন মনকে স্পর্শ করতে পারে না এবং যখন কোনও ঝামেলা দেখা দেয় এই ধরনের ব্যবস্থা যদি চেতনার গভীরে প্রবেশ করতে না পারে তাতে কোনও ফল পাওয়া যায় না। মনোবিজ্ঞানীরা চেতনার ওপর অবচেতনার ক্রিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, কিন্তু অবচেতনার ওপর চেতনার ক্রিয়া নিয়ে তেমন কিছু করা হয়নি।
অথচ মানসিক স্বাস্থ্যবিদ্যায় শেষেরটির মূল্য অনেক বেশি এবং অবচেতনার সীমায় কখনো যদি যৌক্তিক বিশ্বাস গড়ে তুলতে হয় তাহলে এ বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে তা উদ্বেগ-সম্পর্কিত বিষয়ে প্রয়োগ করা যায়। একথা নিজেকে বলা খুব সহজ যে এই ধরনের দুর্ভাগ্য দেখা দিলে তা খুব ভয়ানক হবে না।
কিন্তু এটি শুধুমাত্র সচেতন বিশ্বাসরূপে থাকলে ততক্ষণ এটি রাত্রির অনিদ্রাও বন্ধ করবে না, দুঃস্বপ্নও বন্ধ করতে পারবে না। আমার নিজের বিশ্বাস হল, যথেষ্ট বেগ এবং তীব্রতা যোগ করলে সচেতন চিন্তা অবচেতনার মধ্যে রোপিত করা সম্ভব। অবচেতনার অধিকাংশ পূর্বের তীব্র আবেগসচেতন চিন্তা দিয়ে গঠিত, বর্তমানে তারা সমাহিত অবস্থায় রয়েছে।
এইভাবে সমাহিত করার কাজ স্বেচ্ছায় করা যায় এবং এইভাবে অবচেতনাকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। আমি দেখেছি যে, আমাকে যদি কখনো কোনও কঠিন বিষয়ের ওপর কিছু লিখতে হয়, তাহলে আমি একটি উৎকৃষ্ট পথ খুঁজে নিই। আমি খুব গভীরভাবে চিন্তা করি এবং আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই করি কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন ধরে।
এই সময় শেষ হলে আমি আদেশ করি যে কাজটি আপাতত বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ুক। তারপর কয়েকমাস পার হয়ে যাওয়ার পর আমি সচেতনভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা শুরু করি এবং তাতে দেখতে পাই যে আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এই কৌশল আবিষ্কারের আগে কাজ শেষ হওয়ার অন্তবর্তী মাসগুলিতে কাজের অগ্রগতি নেই বলে দুশ্চিন্তায় ভুগতাম।
সেই দুশ্চিন্তার জন্যে কাজ যে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত তা নয়, বরঞ্চ অন্তবর্তী মাসগুলিও অকারণে নষ্ট হয়ে যেত। অথচ আমি এখন এই সময়ে অন্য কাজে মন দিতে পারি। দুশ্চিন্তা নিয়ে সমরূপ নানারকম পথ খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। যখন কোনও দুর্ভাগ্য ভয় দেখায় তখন খুব গভীর এবং শান্তভাবে ভেবে দেখুন তা সবচেয়ে বেশি কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।
সম্ভাব্য এই চরম দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়ে ভেবে দেখুন বাস্তবে এই দুর্ভাগ্য সত্যিই ততটা ভয়ানক নয়। এইরকম যুক্তি সবসময় পেয়ে যাবেন, কারণ দুর্ভাগ্য চরমরূপ গ্রহণ করলেও এমন কিছু ঘটে না যার কোনও সৃষ্টিমূলক গুরুত্ব আছে। দুর্ভাগ্যের সম্ভাবনার মুখে, তার দিকে শান্তভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে যদি নিজেকে বলা যায়, বেশ তো, যাই ঘটুক তাতে আমার কিছুই এসে যায় না,
তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা কমে গেছে আশাকেও ব্যাপকভাবে ছাড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েকবার করার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু পরিশেষে যদি কঠিন দুর্ভাগ্যের মুখে দাঁড়াতে মানসিক প্রস্তুতিতে কোনও গলদ না থাকে, তা হলে দেখা যাবে দুশ্চিন্তা বাতাসে উড়ে গেছে এবং তাকে প্রতিস্থাপন করেছে একধরনের উল্লাস।
যুবকদের ভিতরকার দৈহিক সাহসের সাধারণত্ব একথার প্রমাণ দেয় যে, জনমতের দাবি এই সাহসের জন্ম দিতে পারে। সাহস বেশি হলে দুশ্চিন্তা কমে যায়। সুতরাং ক্লান্তিও কমে যায়। আধুনিক নারী-পুরুষ যে ধরনের স্নায়ুবিক অবসাদে ভুগছে তার অধিকাংশই সচেতন অথবা অবচেতন ভয় থেকে জন্ম নিচ্ছে।
ভয়কে দূরে রাখার ব্যাপক সাধারণ কৌশলের এটি একটা অংশমাত্র। দুশ্চিন্তা একপ্রকার ভয় এবং সব ধরনের ভয় থেকেই জন্ম হয় অবসাদের। যে ব্যক্তি ভয় অনুভব করতে শেখেননি তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় অবসাদ অতিমাত্রায় কমে যায়। যে ভয় সবচেয়ে ভয়ংকর তা সেইখানেই দেখা যায় যেখানে আমরা তার মুখোমুখি হতে চাই না। অসময়ের মুহূর্তে ভয়ংকর সব চিন্তা মনের মধ্যে হঠাৎ উদয় হয়।
সেসব কোন ধরনের হবে তা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির মনের কোণে কোন না কোন ভয় লুকিয়ে আছে। কারো কাছে এই ভয় ক্যানসার, কারো কাছে তা আর্থিক বিপর্যয়, তৃতীয় জনের কাছে তা কলঙ্কজনক গোপন কথা ফাঁস হওয়া, চতুর্থ জনের কাছে তা সন্দেহের দাহ, পঞ্চম জন ভেবে রাতে অস্থির হয়ে উঠছেন যে প্রথম বয়সে শোেনা নরকানলের কথা।
সম্ভবত সত্যি, মনে হয় এরা সকলেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে ভুল কৌশলের সাহায্য নিচ্ছেন। যখনই তাদের মনে ভয় দেখা দেয়, তারা অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করেন, আমোদ প্রমোদ অথবা কাজ অথবা যা খুশি নিয়ে মেতে উঠে চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে দেন। কিন্তু প্রত্যেক ধরনের ভয় মনোযোগ না দেওয়ার জন্যে আরো খারাপ হয়ে যায়। মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অর্থই হচ্ছে, যে ভূতের বিভীষিকা থেকে দৃষ্টি ফেরানো হচ্ছে, তাকে মান্যতা দেওয়া।
সব রকমের ভয় সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে তা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করা। গভীর মনঃসংযোগ করে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ভয়ের সাথে পরিচিত হওয়া না যায়, ততক্ষণ। অবশেষে এই পরিচয় তার বিভীষিকার ধারাকে ভোঁতা করে দেবে। বিষয়টাই বিরক্তিকর মনে হবে এবং আমাদের চিন্তাও তা থেকে দূরে চলে যাবে। কিন্তু আগের মতো তার জন্যে কোনও চেষ্টার প্রয়োজন হবে না, তা সরে যাবে তার সম্বন্ধে কোনও উৎস নেই বলে।
যখন আপনার কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করতে মন চাইবে, তা যাই হোক, সবচেয়ে ভাল পরিকল্পনা হল তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। স্বাভাবিকভাবে যা করা হত তার চেয়ে বেশি। যাতে শেষ পর্যন্ত সে বিষয়ে মোহটা দূর হয়ে যায়।
যে বিষয়ে আধুনিক নৈতিকতা অত্যন্ত ক্রটিপুর্ণ তা হল ভয়ের প্রশ্ন। একথা সত্যি যে দৈহিক সাহসিকতা, বিশেষ করে যুদ্ধের সময় পুরুষদের কাছে প্রত্যাশিত। কিন্তু অন্যান্য কারণে সেই সাহসিকতা প্রত্যাশিত নয় এবং নারীদের কাছ থেকে কোনও ধরনের সাহসিকতাই আশা করা হয় না। পুরুষ তাকে পছন্দ করুক, তা যদি কোনও নারী কামনা করে তাহলে সাহসী নারীকে তার সাহসের কথা গোপন করতে হয়।
দৈহিক বিপদভিন্ন অন্য বিষয়ে সাহসী লোক সম্পর্কে খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয়। জনমত সম্পর্কে নিস্পৃহ ঔদ্ধত্য বলে ভাবা হয় এবং সে পুরুষ জনগণের কর্তৃত্ব অস্বীকার করতে সাহসী হয় তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সবই যা হওয়া উচিত তার বিপরীত। প্রত্যেক ধরনের সাহস, তা নারী বা পুরুষ যার ক্ষেত্রেই হোক, সৈনিকের দৈহিক সাহসের তুল্য প্রশংসা পাওয়া উচিত।
যুবকদের ভিতরকার দৈহিক সাহসের সাধারণত্ব একথার প্রমাণ দেয় যে, জনমতের দাবি এই সাহসের জন্ম দিতে পারে। সাহস বেশি হলে দুশ্চিন্তা কমে যায়। সুতরাং ক্লান্তিও কমে যায়। আধুনিক নারী-পুরুষ যে ধরনের স্নায়ুবিক অবসাদে ভুগছে তার অধিকাংশই সচেতন অথবা অবচেতন ভয় থেকে জন্ম নিচ্ছে।
প্রায় সব ধরনের অবসাদের উৎস হচ্ছে উত্তেজনার প্রতি আকর্ষণ। যদি কোনও মানুষ অবসর সময় ঘুমিয়ে কাটাতে পারে, তা হলে তিনি সক্ষম থাকেন। কিন্তু কাজের সময়টা তার কাছে শুষ্ক লাগে এবং অবসর পেলেই তিনি আনন্দ উপভোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। অসুবিধা হচ্ছে এই যে, যে সব উপভোগের জিনিস সহজে পাওয়া যায়, যার বাইরের চাকচিক্য বেশি, সেসবের বেশিরভাগ স্নায়ুকে ক্ষয় করে।
উত্তেজক আমোদ একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে হয় তা বিকৃত মনোভাবের, না হয় কোনও সহজাত অতৃপ্তির পরিচয় দেয়। সুখীবিবাহের প্রথম অবস্থায় প্রায় ব্যক্তিই উদ্দীপক উপভোগের প্রয়োজন বোধ করেন না।
ফলে অবসাদ ধীরে ধীরে বেড়েই চলে এবং একসময় তা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, তখন তার চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয় এ সবই পূর্ব অধ্যায়ে আলোচিত, পৃথিবীর সাথে শূন্য হয়ে যাওয়া সম্পর্কের শাস্তি। কিন্তু আমাদের বর্তমান নগরাঞ্চলে যেভাবে জন-বিস্ফোরণ ঘটছে তাতে মাটির সাথে কী করে সংযোগ রক্ষা করা যাবে তা ভেবে পাওয়া সহজ নয়।
কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিশ্বে বিবাহ এত দীর্ঘদিন পর্যন্ত আটকে রাখতে হয় যে, শেষপর্যন্ত উপার্জনের দিক থেকে যখন আর কোনও অসুবিধা থাকে না, তখন দেখা যায় উদ্দীপক আমোদ উপভোগটা এর মধ্যেই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে এবং তা মাত্র স্বল্প সময়ের জন্যে আটকে রাখা সম্ভব।
বর্তমানে বিবাহের যে আর্থিক চাপ বহন করতে হয় তা এড়িয়ে যদি জনমত কোনও যুবককে একুশ বছর বয়সে বিবাহের অনুমতি দিত তা হলে অনেক মানুষই কাজের মতো অবসাদজনক আমোদ-প্রমোদের পথে পা বাড়াত না। এমনই হওয়া উচিত, এরকম সুপারিশ করা অবশ্য নীতিবিগর্হিত এবং বিচারক লিন্ডসের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা থেকেই অনুধাবন করা যাবে।
দীর্ঘকালের সম্মানজনক কর্মজীবন সত্ত্বেও তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল, তিনি বড়দের রক্ষণশীলতার জন্যে তরুণরা যেসব দুর্ভোগ ভোগ করে সেসব থেকে তাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন। আমি আর এ বিষয়ে বেশিদূর যাব না। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আরো কিছু আলোচনা করব।
সাধারণ ব্যক্তি যেসব আইন এবং বিধিবিধান বদলাতে পারেন না, কিন্তু তার মধ্যে তাকে বাঁচতে হয়, তার পক্ষে উৎপীড়ক নীতিবিদদের তৈরী এবং সুরক্ষিত পরিস্থিতির সাথে পেরে ওঠা কঠিন। কিন্তু এটা বুঝতে পারা উচিত যে, উদ্দীপক আমোদ-প্রমোেদ সুখের পথে এগিয়ে দেয় না।
যতদিন আরো তৃপ্তিদায়ক উপভোগ তার আয়ত্তের বাইরে থাকবে, ততদিন উদ্দীপক জিনিস ছাড়া তার পক্ষে জীবনকে সহ্য করাই প্রায় অসম্ভব মনে হবে। এই অবস্থায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি একটিমাত্র কাজ যা করতে পারেন তা হচ্ছে নিজের উপভোগের সীমা নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্বাস্থ্য ও কাজের পক্ষে ক্ষতিকারক অবসাদজনক প্রমোদে মত্ত না হওয়া। তরুণদের বাধাবিঘ্ন দূর করার প্রকৃত উপায় হচ্ছে সামাজিক নীতিমালার পরিবর্তন সাধন।
এর মধ্যে তরুণদের ভেবে দেখা উচিত যে, পরে তাদেরও বিয়ে করার মতো অবস্থা আসবে। অতএব যা সুখী বিবাহকে অসম্ভব করে তুলতে পারে এমনভাবে জীবন কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ এ থেকে বিপদ সহজেই ঘটে যেতে পারে স্নায়ু অবসন্ন হলে। তখন বিয়ে করাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে।
স্নায়বিক অবসাদের সবচেয়ে খারাপ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা ব্যক্তি এবং বাইরের জগতের মধ্যে একটা আবরণ টেনে দেয়। বাইরের পৃথিবীর ধারণা তার কাছে পৌঁছায় অপূর্ণ, অস্বচ্ছ এবং পরিবর্তিতরূপে। তিনি তখন অন্য কোনও ব্যক্তিকে সহ্য করতে পারেন না, আহারে তৃপ্তি পান না, সূর্যালোকে আনন্দ পান না। সামান্য কয়েকটি জিনিসের প্রতি তার তীব্র মনোযোগ থাকে। অন্য সব কিছুর প্রতি তিনি উদাসীন।
ফলে অবসাদ ধীরে ধীরে বেড়েই চলে এবং একসময় তা এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, তখন তার চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয় এ সবই পূর্ব অধ্যায়ে আলোচিত, পৃথিবীর সাথে শূন্য হয়ে যাওয়া সম্পর্কের শাস্তি। কিন্তু আমাদের বর্তমান নগরাঞ্চলে যেভাবে জন-বিস্ফোরণ ঘটছে তাতে মাটির সাথে কী করে সংযোগ রক্ষা করা যাবে তা ভেবে পাওয়া সহজ নয়।
যাই হোক, এখানে আবার আমরা সেই বিশাল সামাজিক সমস্যার কাছাকাছি চলে এসেছি যা নিয়ে এই গ্রন্থে কোনও আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………
সুখের সন্ধানে- বার্ট্রান্ড রাসেল।
অনুবাদক- আতা-ই-রাব্বি।
……………….
আরও পড়ুন-
মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
বায়রনীয় অ-সুখ
বিরক্তি এবং উত্তেজনা
অবসাদ
ঈর্ষা
পাপের চেতনা
সুখলাভ কি তবু সম্ভব?
উদ্দীপনা
স্নেহ-ভালবাসা
সুখী মানুষ