ভবঘুরেকথা
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি

-দীপঙ্কর মজুমদার

তখন পঞ্চদশবর্ষী রাম বলল, ‘না সাধুজী আমি শৈব্য। বাবা বিশ্বনাথই আমার ইষ্ট দেবতা। আমি সেই বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হতে চাই।’ সত্যসত্যই রাম একদিন মহাযোগী ভোলাগিরির মন্ত্রশিষ্য মহামণ্ডলেম্বর স্বামী মহাদেবানন্দ গিরির একনিষ্ঠ শিষ্য স্বামী ভাবাত্মানন্দ গিরির নিকট দীক্ষা লাভ করল।

দীক্ষার আগের দিন গুরুজী আশ্রমের এক সাধুকে বলে দিলেন রামকে একটা ঘর দাও। রাতে রাম এখানে থাকবে আর সঙ্গে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করো। গুরুজীর কথা মতো তাই করা হল। পরদিন প্রত্যুষে রাম স্নানাদি সেরে দীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হল।

দিনটা ছিল অগ্রহায়ণ মাসের রাস পূর্ণিমা সত্যিই এক মহামিলনের পূর্ণলগ্ন। অত্যাশ্চর্য ভোলাগিরি যে মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সেই মন্ত্রেই রামও দীক্ষিত হয়ে পূর্ণাত্মা পেল। ধীরে ধীরে রাম বিশুদ্ধ হয়ে উঠল আর অন্তর থেকে বীজমন্ত্র উচ্চারিত হল-

গুরুব্রাহ্মা গুরুবিষ্ণু: গুরুর্দেবো মহেশ্বর:।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নম:।।

ভোলাগিরি খুব উচ্চ কোটির সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বয়ং শিব। আর রাম হল তাঁরই পরমপরা। ভোলাগিরি নিজে তাঁর আশ্রমে এক স্থানে মাটি খনন করে ছোট্টবাণলিঙ্গ পেয়েছিলেন। তাঁকে তিনি গৌরীশঙ্কর রূপে পুজো করতেন।

তিনি বলতেন, ‘গৌরীশঙ্কর সীতারাম মুখে বল চারি নাম, গুরু দিল হরকা নাম… খালি জিহ্বার কি কাম।’ রামের জীবনেও প্রায় হুবহু একই ঘটনা ঘটেছিল সেই কথা পূর্বে বর্ণিত।

সত্যি কথা বলতে, ‘এ-যুগ মহাজাগরণের যুগ, এ যুগ মহামিলনের যুগ, এ যুগ মহামুক্তির যুগ।’ ভক্তসাধক জানেন- ঈশ্বরই তার প্রেমাস্পদ, তার একমাত্র আপনজন। সংসারের দু:খ-কষ্ট-শোক-বেদনার অগ্নিকুণ্ডে জ্বলেপুড়ে ভক্ত এই কথা মরমে মরমে অনুভব করে থাকেন-

সকল দুয়ার হইতে ফিরিয়া
তোমারই দুয়ারে এসেছি,
সকলের প্রেমে বিমুখ হইয়া
তোমারই ভারোবেসেছি।।

রাম অনেক ছোট বয়স থেকে ঈশ্বরপ্রেমী হয়ে পড়ে। বাড়িতে কিছুতেই তার মন টিকতো না। কথায় আছে, ‘রমতা সাধু, বহতা পানি।’ অর্থাৎ চলমান নদীতে যেমন আগাছা জমে না, তেমনি ভবঘুরে সাধুর মনেও মলিনতা আসার সম্ভাবনা কম থাকে।

রামও এর ব্যাতিক্রম ছিল না। হেতমপুর কলেজ কিম্বা শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় বিভিন্ন মঠ-মিশন-আশ্রমে সাধুসঙ্গ করত। সব সময় বাইরে থাকতে ভালোবাসত। বাবা-মা ভীষণ ভাবে বিচিন্তিত হয়ে স্থির সিন্ধান্ত নিলেন ঝাড়খণ্ড সীমান্তের গ্রাম্য পরিবেশ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মল্লারপুরে জায়গা কিনে বাড়ি করার।

সেখানে বাড়ি তৈরি করার সময় ওখানকার এক প্রতাপশালী ব্যক্তির উত্তাপে রামের বাবা অর্ধেক বাড়ি তৈরি হতেই বাধাপ্রাপ্ত হন। অতি ভদ্র, সৎজন রামের বাবার প্রতি এল নানান হুমকি আর গালিগালাজ।

বাড়ি ফিরে রাম সব শুনে বাবাকে আশ্বাস দেয়, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না বাবা, ঈশ্বর আছেন- তিনিই বিচার করবেন।’ রাম সিদ্ধপুরুষ, মন-মুখ এক হয়ে গেলে যা বলে তাই ঘটে।

প্রতাপশালী মানুষটাকে বলল, ‘আমার বাবার মতো সৎ-ধার্মিক মানুষকে আপনি এত কষ্ট দিলেন, সামনে আপনার জন্য এক ভয়ঙ্কর দিন আসছে অপেক্ষায় থাকুন।’ এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই প্রতাপশালীর উত্তাপের আগুন চিরকালের মতো নিভে গেল।

রামের বাবা একদিকে নিশ্চিত হলেও পুত্রের পলাতক ভাবে ক্রমশ বৃদ্ধিতে আরও চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। আর কোনো কথা নয়, ২০০২ সালে রামের বিয়ে সুনিশ্চিত করে সতীর একান্নপীঠের একপীঠ মা নন্দিকেশ্বরীকে সাক্ষী রেখে বিবাহ সম্পন্ন হয় শ্রীমতী মিতাদেবীর সাথে।

তারপর টানা পঁচিশ বছর রামের বাবা মল্লারপুর বাসভবনে জীবন কাটান। পিতার মৃত্যুর পর রাম সেখান থেকে চলে আসে বোলপুরে এক দ্বি-তল বাড়ি ক্রয় করে। বাড়ি কেনার সময় রাম দেখল দরজায় শ্বেতপাথরে খোদিত রয়েছে ‘রামকৃষ্ণায়ন’ নামকরণ।

গভীর ধ্যানে উপলব্ধি করে রাম জানতে পারল এই সেই বাড়ি যা সে খুঁজছে। আর ওই নামকরণই হল রামের পূর্বজন্মের সন্ন্যাস নাম অর্থাৎ ‘রামকৃষ্ণায়ণ গিরি’। বর্তমানে একমাত্র কন্যা প্রকৃতি (রোহিনী নক্ষত্রে জন্ম), জন্মদাত্রী মা এবং সস্ত্রীক রাম শান্তিনিকেতনের পশ্চিম পুরুপল্লীতে এই বাসভবনে বাস করছে।

সেখানে গড়ে উঠেছে আধ্যাত্ম-সাধনা আর ভাবসঙ্গীতের চর্চাক্ষেত্র। বহু সাধুসন্ন্যাসীর মতে, ‘রামের গান শুনলে বৈরাগ্য আসবেই, তবে বৈরাগ্যকে ধরে রাখার ক্ষমতা নিজ নিজ আধারের ওপর নির্ভর করে।’

রাম যখনই যে তীর্থে যায়, সেখানে কোনো-না-কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে। একবার ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন মা ত্রিপুরা সুন্দরীকে দর্শন করতে। সতীর একান্নপীঠের একপীঠ ত্রিপুরেশ্বরী মা। রামের সহচরী ছিল উদয়পুরের এক ব্রহ্মচারী আর তার বাড়ির গৃহকর্মী।

রাম ওদের নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবার জন্য গাড়ি ধরার অপেক্ষারত, হঠাৎ প্রায় ১৫০ জনের দল এসে ওদের ঘিরে ফেলে। তারপর নানান কটূকথা এবং ভয়ভীতির প্রদর্শন চলতে থাকে।

আসলে রাম ওদের কাছ যে ভিন্নদেশি। এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি আপত্তির কারণ। নির্বিকার রাম একেবারে শান্ত-স্তব্ধ। শুধুমাত্র রাম তার ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হল। আশ্চর্য! এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি আপত্তির কারণ।

নির্বিকার রাম একেবারে শান্ত-স্তব্ধ। শুধুমাত্র রাম তার ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হল। আশ্চর্য! হঠাৎ কোথা থেকে এক যুবক প্রায় ছুটে এসে বলল, ‘ওনাকে ছেড়ে দাও, উনি এখানে অতিথি হয়ে এসেছেন একজন সত্যিকারের সাধক।’

এই কথা বলতেই পরিস্থিতি শিথিল হয়ে গেল এবং রামের কাছে সকলে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকল। ঘটনাটা ঘটেছিল মা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের থেকে অর্ধ-কিলোমিটার দূরত্বে। দু-পাশে ঘন বনানীতে ঘেরা সরস জঙ্গল এ-ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

প্রসঙ্গক্রমে এমনি আরেকটি ঘটনার কথা অবগত করি। সালটা ২০০৫। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের কন্যা রাণু মুখোপাধ্যায়ের ননদের বাড়ি রাম ভাড়া থাকত। একদিন রাম রাত প্রায় ১টা নাগাদ রাসবিহারী এভিনিউয়ের ওই ভাড়া বাসায় ফিরছিল।

খিদেতে আর শরীর টানছিল না, এদিকে কোনো দোকান খোলা নেই যে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে খাবে। অসহায় মন বলতে থাকে আজ হয়তো জল খেয়েই রাত রাত কাটাতে হবে। বাবনার সাথে চলনও একই গতিতে চালিত। শ্রীচৈতন্য রিসার্চ ইন্সটিটিউট পার হতেই হঠাৎ খালি গায়ে একচেনা ব্যক্তি এক শালপাতা খিচুরি এনে রামকে বলল, ‘এই নাও শেষ প্রসাদটা তোমার জন্য।’ রামের মন তীব্র আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠল।

এই গ্রন্থের প্রণেতা আমি নিজেও এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ২০১৯ সালের বৈশাখ মাসে রামনাথকে নিয়ে হালিশহরে যাই। শাক্ত সাধক রামপ্রসাদের জন্মভিটা পরিদর্শনের জন্য। রাম সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখে এক গেরুয়াধারী ব্রাহ্মণ মন্দিরে মায়ের সেবা করছেন এবং অনেক ভক্ত সেখানে সমাহিত।

মন্দিরের স্থান সুসজ্জিত নানান ফুল-ফল, মিষ্টান্ন আর পূজার্ঘ্যে। মাকে ভক্তিসহ প্রণাম জানাতে গিয়ে রাম দেখল সবার পুজো থালায় নিবেদিত কিন্তু প্যাকেটের পুজোটা তবে কার? নি:শব্দ পরমাত্মার আকাশবাণী রামের অন্তর আত্মাকে বলতে থাকল, ‘এটা তোমারই পুজো… রাম।’

ঠিক তাই ঘটল রামনাথ প্রণাম সেরে যেই দ্বার বর্হিমুখী অমনি সেই ব্রাহ্মণ রামকে বলে উঠলেন, ‘ও সাধুবাবা এই নাও তোমার পুজো।’ রাম দেখল আরে সেই প্যাকেটটা যেটা আমার মনে প্রবল জিজ্ঞাসা ছিল- ওটার কার পুজো। রামের দু-চোখে তখন মহাভাবের জলোচ্ছ্বাস। আসলে সাধক যেখানে যান ঈশ্বরের লীলা তাঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।

ছোটো একটা চারা গাছ থেকে ধীরে ধীরে যেমন অরণ্যের সৃষ্টি, তেমনি কাহিনীর পর কাহিনী সজ্জিত হয়ে এক মহাজীবনের সৃষ্টি। সত্যিই তো জীবন থেকে মহাজীবনের উত্তরণে হৃদয়-মন ব্যাকুল হয়ে উঠবেই। রামনাথের জীবনও এর ব্যাতিক্রম নয়।

একবার এক আত্মীয়ের সঙ্গে কালীঘাট যায় একজন ব্রহ্মচারীর আশ্রমে। সেখানে মা মঙ্গলেশ্বরী, সারদা মা আর ঠাকুরের নিত্যপুজো হয়। রামের মন সেদিন যেন একটু বেশি চঞ্চল-অস্থির। আশ্রমের ঘরে ব্রহ্মচারীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপ চলে রামনাথের।

চমকপ্রদভাবে হঠাৎ মা সারদার ছবি থেকে গাঁদা ফুরের মালাটি তীর বেগে রামের গলায় আর্শীবাদস্বরূপ ঢুকে পড়ে। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ব্রহ্মচারী এবং রামনাথ উভয় একদম হতবাক। সমস্ত পরিবেশ একেবারে শান্ত-স্নিগ্ধ। মুহূর্তের মধ্যে রামের মনও স্থির হয়ে গেল শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরুর মতো।

অন্তর থেকে শব্দব্রহ্মস্বরূপ প্রকাশ পেল-

নমোহস্তু পুরবে তুভ্যং দিব্যভাব প্রকাশিনে।
জঞানানন্দ স্বরূপায় বিভাবায় নমো নম:।।

ধ্যানমগ্ন হয়ে জ্ঞানচক্ষু দ্বারা রামনাথ নিজের অস্তিত্ব অনুভব করল। ভবিষ্যৎ পার্থিব জগতে তার অনেক কর্মকাণ্ড অপেক্ষমান। কাজেই, ইতি টানার পূর্বে অনির্বাণ শিখায় প্রজ্বলিত হয়ে বিশ্ব লীলাময় হয়ে উঠুক এই মহাজীবনের সমাপ্তি।

শিবাস্তে সন্তু পন্থান:।

(সমাপ্ত)

…………………………
আরো পড়ুন:
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি: এক
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি: দুই
রাম নাথ কৃষ্ণমূর্তি: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!