-আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসি
তিনিই সমুদ্রকে অধীন করেছেন যাতে তোমরা তা থেকে তাজা মাছ খেতে পার এবং যাতে তা থেকে আহরণ করতে পার রত্নাবলী, যা তোমরা ভূষণরূপে পরতে পার এবং তোমরা দেখতে পাও, তার বুক চিরে নীেযান চলাচল করে এবং তা এ জন্য যে, তোমরা যেন তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তােমাদের নিয়ে আন্দােলিত না হয় এবং স্থাপন করেছেন নদ-নদী ও পথ, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্য স্থলে পৌছুতে পার; এবং পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহও। আর তারা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথের নির্দেশ পায়।
সুতরাং যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তারই মত, যে সৃষ্টি করে না? তবুও কি তােমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু। (১৬- ১৪-১৮)
সমুদ্র দু’টো একরূপ নয়- একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়, অপরটির পানি লোনা, খর। প্রত্যেকটি থেকে তোমরা তাজা গোশত আহার কর এবং অলংকার যা তোমরা পরিধান কর এবং রত্নাবলী আহরণ কর এবং তোমরা দেখ। তার বুক চিরে নীেযান চলাচল করে যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। (৩৫- ১২)
অর্থাৎ-তিনিই দাদরিয়াকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট সুপেয় এবং অপরটি লোনা, খরা; উভয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন এক অন্তরায়, এক অনতিক্রম্য ব্যবধান।
অর্থাৎ- তিনি প্রবাহিত করেন দু’দরিয়া, যারা পরস্পর মিলিত হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। (৫৫- ১৯, ২০)
মোটকথা, দু’দরিয়া দ্বারা লোনা, খর দরিয়া এবং সুমিষ্ট দরিয়া বুঝানো হয়েছে। ইবন। জুরায়জ প্রমুখ ইমাম বলেন, সুমিষ্ট দরিয়া হলো, সৃষ্টিকুলের স্বার্থে দেশের আনাচে-কানাচে যে সব নদ-নদী প্রবহমান রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
তাঁর অন্যতম নিদর্শন সমুদ্রে পর্বততুল্য চলমান নীেযানসমূহ। তিনি ইচ্ছা করলে বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন, ফলে নীেযানসমূহ নিশ্চল হয়ে পড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠে। নিশ্চয় তাতে নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।
অথবা তিনি তাদের কৃতকর্মের জন্য সেগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিতে পারেন এবং অনেককে তিনি ক্ষমাও করেন। (৪২- ৩২-৩৪)
তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহর অনুগ্রহে নীেযানগুলো সমুদ্রে বিচরণ করে, যা দিয়ে তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলীর কিছুটা প্রদৰ্শন করেন। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।
যখন তরঙ্গ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘের ছায়ার মত, তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তার আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে পৌছান, তখন তাদের কেউ কেউ সরলপথে থাকে; কেবল বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিরাই তাঁর নিদর্শনাবলী অস্বীকৃার করে।
ইমাম আহমদ (র) উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন- উদ্বেলিত হয়ে সবকিছু ডুবিয়ে দেয়ার জন্য সমুদ্র প্রতি রাতে তিনবার করে আল্লাহর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাকে সংযত করে রাখেন।’
আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে, যা মানুষের হিতসাধন করে তা সহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে বারিবর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনজীবিত করেন তাতে এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীব-জন্তুর বিস্তারণে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (২- ১৬৪)
এসব আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাদের জন্য যে সাগরমালা ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মহাসাগর ও তার শাখা-প্রশাখা সবই লোনা ও খর। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ব্যাপারে এতে বিরাট হিকমত রয়েছে।
কারণ যদি তা মিঠা হতো; তাহলে তাতে যে সব প্রাণী আছে তা মরে পরিবেশ দূষিত এবং আবহাওয়া কলুষিত হয়ে যেত এবং তা মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিত। তাই পরিপক্ক প্রজ্ঞার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষের স্বার্থে তা এমন হয়েছে। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে সমুদ্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে ‘…’ হালাল।’
পক্ষান্তরে নদীর পানি পানকারীর জন্যে সুমিষ্ট ও সুপেয়। আল্লাহ তাকে প্রবহমান করেছেন এবং এক স্থানে তা উৎসারিত করে মানুষের জীবিকার সুবিধার্থে তা অন্যান্য স্থানে পরিচালিত করেন। মানুষের প্রয়োজন ও উপকারের চাহিদা অনুপাতে নদ-নদীর কোনটা বড়, আবার কোনটা ছোট হয়ে থাকে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও তাফসীর বিশারদগণ সমুদ্র ও বড় বড় নদ-নদীর সংখ্যা, তার উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন, যাতে মহান সৃষ্টিকর্তার কুদরতের অনেক নিদর্শন রয়েছে এবং এ প্রমাণও রয়েছে যে, তিনি নিজ এখতিয়ার ও হিকমত মোতাবেক কাজ করেন।
সূরা তুর-এর ষষ্ঠ আয়াত- ৩১ (এবং শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের) সম্পর্কে দুটি অভিমত রয়েছে। প্রথমত, এর দ্বারা পাহাড়ী মেষ সংক্রান্ত হাদীসে উল্লেখিত ঐ সমুদ্রই বুঝানো হয়েছে, যা আরশের নিচে অবস্থিত এবং যা সপ্ত আকাশের উপরে রয়েছে এবং যার নিচ ও উপরের মধ্যে এতটুকু ব্যবধান, যতটুকু এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের।
পুনরুত্থানের পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলা এ সমুদ্র থেকেই বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তাতে দেহসমূহ কবর থেকে পুনজীবিত হয়ে উঠবে। রবী ইব্ন আনাস এ অভিমতটিই গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয়ত, জাতিবাচক বিশেষ্য। পৃথিবীর সব সমুদ্রই এর আওতাভুক্ত। এটাই অধিকাংশ আলিমের অভিমত। *
‘…’ এর অর্থ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন- ‘…’ অর্থ পরিপূর্ণ। কেউ বলেন, সমুদ্রটি কিয়ামতের দিন প্রজ্বলিত আগুনে পরিণত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত সকলকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। যেমনটি আলী, ইব্ন আব্বাস, সাঈদ ইব্ন জুবায়র (রা) ও ইব্ন মুজাহিদ (র) প্রমুখ থেকে তাফসীর গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি।
কারো কারো মতে, ‘…’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সংযত ও প্রহরাধীন বুঝানো হয়েছে। যাতে তা উদ্বেলিত হয়ে পৃথিবী ও তাতে বসবাসকারী প্রাণীদেরকে ডুবিয়ে মারতে না পারে। ওয়ালিবী (র) তা ইব্ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এটাই সুদী (র) প্রমুখেরও অভিমত। নিচের হাদীসটিতে এর সমর্থন মিলে।
ইমাম আহমদ (র) উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন- উদ্বেলিত হয়ে সবকিছু ডুবিয়ে দেয়ার জন্য সমুদ্র প্রতি রাতে তিনবার করে আল্লাহর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাকে সংযত করে রাখেন।’
এ হাদীসের সনদে এক পর্যায়ে এমন একজন রাবী এককভাবে রয়েছেন- যিনি মুনকারুল হাদীস।* আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা) সূত্রেও মওকুফ পদ্ধতিতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আমার মতে, এটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, তিনিই ইয়ারমুকের যুদ্ধের দিন আহলি কিতাবদের কিতাব বোঝাই দু’টো বাহন পেয়েছিলেন।
ইসহাক ইব্ন রাহওয়ে (র) এক বয়োঃবৃদ্ধ সীমান্ত প্রহরীর বরাতে বলেন, এক রাতে আমি পাহারার জন্য বের হই। তখন আমি ছাড়া আর কোন প্রহরী বের হয়নি। এক সময়ে আমি বন্দরে পৌঁছে উপরে উঠে তাকাতেই আমার কাছে মনে হচ্ছিলো সমুদ্র যেন পাহাড়ের চূড়ায় উচু ঢেউ রূপে এগিয়ে আসছে।
কয়েকবারই এরূপ ঘটলো। আমি তখন জাগ্রত। তারপর হযরত উমর (রা)-এর আযাদকৃত গোলাম আবু সালিহ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি বললেন, উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-
উদ্বেলিত হয়ে সব তলিয়ে দেয়ার জন্য সমুদ্র প্রতি রাতে তিন বার আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে কিন্তু আল্লাহ তাকে সংযত করে রাখেন।’ এ সনদে একজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী আছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। এটা বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে সমুদ্রের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন।
তাকে তাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, ফলে নৌযানে চড়ে তারা তার উপর দিয়ে ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদির উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত দেশে ভ্রমণ করে থাকে এবং আকাশ ও পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্ট নক্ষত্ররাজি ও পর্বতমালা তাতে পথের দিশা লাভ করে থাকে।
আরো তারা উপকৃত হয় সমুদ্রে সৃষ্ট অতি উত্তম ও মূল্যবান মণিমুক্তা দ্বারা যা তিনি সমুদ্রে সৃষ্টি করে রেখেছেন এবং মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন, এমনকি তার মৃত প্রাণীগুলো পর্যন্ত। যেমন- তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও তা ভক্ষণ হালাল করা হয়েছে। (৫- ৯৬)
অর্থাৎ- সমুদ্রের পানি পবিত্র ও মৃত জীব হালাল।
অন্য হাদীসে আছে- ‘আমাদের জন্য দু’টো মৃত প্রাণী ও দু’টো রক্ত হালাল করা হয়েছে। মাছ ও পঙ্গপাল এবং কলিজা ও প্লীহা।’ এটি আহমদ ও ইব্ন মাজাহ (র) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সনদ প্রশ্নাতীত নয়।
হাফিজ আবু বকর বাযযার তাঁর মুসনাদে বলেছেন যে, আমি মুহাম্মদ ইব্ন মু’আবিয়া আল-বাগদাদী (র) রচিত একটি কিতাবে পেয়েছি, আবু হুরায়রা (রা) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- পশ্চিমের ও পূর্বের এ সমুদ্রগুলোর সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন।
তিনি পশ্চিমের সমুদ্রকে বলেন, তোমাতে আমি আমার কতিপয় বান্দাকে বহন করাতে চাই, তাদের সঙ্গে তুমি কিরূপ আচরণ করবে? সমুদ্র বলল, আমি তাদেরকে ডুবিয়ে মারব। আল্লাহ বললেন- ‘তোমার অকল্যাণ হোক’ এবং তাকে অলংকার ও শিকার থেকে তিনি বঞ্চিত করে দেন।
পক্ষান্তরে পূর্বের সমুদ্রকে যখন বললেন, ‘আমি তোমাতে আমার কতিপয় বান্দাকে বহন করাব, তাদের সঙ্গে তুমি কিরূপ আচরণ করবে?’ তখন সে বলল, আমি তাদেরকে আমার নিজ হাতে করে বহন করব এবং সন্তানের জন্য মায়ের মত হবো।
ফলে পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তাকে অলংকার ও শিকার সম্ভার দান করেন। তারপর বলেছেন যে, একথা কাউকে জানতে দিও না।
এ হাদীসের সনদে এক পর্যায়ে এমন একজন রাবী এককভাবে রয়েছেন- যিনি মুনকারুল হাদীস।* আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা) সূত্রেও মওকুফ পদ্ধতিতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আমার মতে, এটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, তিনিই ইয়ারমুকের যুদ্ধের দিন আহলি কিতাবদের কিতাব বোঝাই দু’টো বাহন পেয়েছিলেন।
দক্ষিণ দিক ঘেষে এটি কামার পর্বতমালার দিকে চলে গেছে। এ কামার পর্বতমালাই মিসরের নীল নদের উৎসস্থল। তারপর বিষুবরেখা অতিক্রম করে তা চলে গেছে। পূর্ব দিকে। তারপর আরও পূর্ব দিকে মহাসাগরটি অগ্রসর হয়ে তাই পৃথিবীর সর্বদক্ষিণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
ফলে সেগুলো থেকে তিনি ইসরাঈলিয়াতের অনেক তথ্য বর্ণনা করতেন, যার কতকটা সাধারণভাবে জ্ঞাত ও প্রসিদ্ধ এবং কতকটা প্রক্ষিপ্ত ও প্রত্যাখ্যাত। আবদুর রহমান ইব্ন আবদুল্লাহ ইব্ন ‘আমর ইব্ন হাফস-ইব্ন আসিম ইব্ন উমর ইব্ন খাত্তাব আবুল কাসিম আল-মাদানী এককভাবে তার গ্রহণযোগ্য অংশগুলো বর্ণনা করেছেন।
তার সম্পর্কে ইমাম আহমদ (র) বলেছেন, লোকটি আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়। আমি তার থেকে হাদীস শুনেছিলাম। কিন্তু পরে তা ছিড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলি। সে ছিল একজন ডাহা মিথুক এবং তার হাদীছসমূহ মুনকার পর্যায়ের।
অদ্রপ ইব্ন মাঈন, আবু যুর’আ’, আবু হাতিম, জাওয়জনী, বুখারী, আবু দাউদ ও নাসাঈ তাকে দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। ধ্ৰু সুদী বলেছেন, তার হাদীসগুলাে মুনকার। তন্মধ্যে দুর্বলতম হলো সমুদ্র সংক্রান্ত দৈর্ঘ্য-প্রস্ত, সমুদ্র, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, প্রান্তরাদি, পৃথিবীর শহর-বন্দর,
বিজনভূমি ও জনবসতিপূর্ণ এলাকাসমূহ, পারিভাষিক অর্থের সাত মহাদেশ, সুবিদিত দেশসমূহ এবং বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত, খনিজ ও বাণিজ্যিক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোকপাতকারী তাফসীরবিদগণ বলেন, গোটা পৃথিবীর একভাগ স্থল এবং তিনভাগ পানি।
এ ভূ-ভাগের পরিমাপ হচ্ছে নব্বই ডিগ্রী। আল্লাহ তা’আলা অনুগ্রহ করেই এ বিশাল পানি রাশিকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত রেখেছেন যাতে করে প্রাণীকুল জীবন যাপন করতে পারে এবং শস্যাদি এবং ফলমূল উৎপন্ন হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন-
তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য, এতে আছে। ফলমূল এবং খেজুর গাছ, যার ফল আবরণযুক্ত এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধ গুল্ম। অতএব, তোমরা (জিন ও মানবজাতি) উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (৫৫- ১০-১৩)
তাঁরা বলেন, পৃথিবীর স্থল ভাগের তিন ভাগের দু’ভাগ বা তদপেক্ষা একটু বেশিতে মানুষের বসবাস রয়েছে। এর পরিমাপ ৯৫ ডিগ্রী।
তারা আরো বলেন, সমুদ্রসমূহের মধ্যে একটি হলো, পশ্চিম মহাসাগর যাকে আটলান্টিক মহাসাগরও বলা হয়। এ মহাসাগরই পশ্চিমের দেশগুলোকে ঘিরে আছে। এর পশ্চিম ভাগে আছে ছ’টি দ্বীপ। এ মহাসাগরও এর উপকূলের মাঝে প্রায় এক মাসের পথে দশটি ডিগ্রী রয়েছে।
এটি এমন এক সাগর অধিক ঢেউ এবং আবহাওয়া ও তরঙ্গ সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এতে চলাচল করা অসম্ভব প্রায়। তাতে কোন শিকারও নেই এবং তা থেকে কোন কিছু আহরণও করা হয় না এবং বাণিজ্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে তাতে ভ্রমণও করা যায় না।
দক্ষিণ দিক ঘেষে এটি কামার পর্বতমালার দিকে চলে গেছে। এ কামার পর্বতমালাই মিসরের নীল নদের উৎসস্থল। তারপর বিষুবরেখা অতিক্রম করে তা চলে গেছে। পূর্ব দিকে। তারপর আরও পূর্ব দিকে মহাসাগরটি অগ্রসর হয়ে তাই পৃথিবীর সর্বদক্ষিণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
সেখানে কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে যা আযযাবিজ দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এ মহাসাগরটির উপকূল অঞ্চলে প্রচুর অনাবাদী এলাকা রয়েছে। তারপর পূর্ব দিকে গিয়ে তা চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
তারপর পূর্ব-উত্তর দিকে গিয়ে পৃথিবীর পূর্ব দিকের শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। সেখানেই চীন সাগরের অবস্থান। তারপর চীনের পূর্বে মোড় নিয়ে তা উত্তর দিকে চলে গিয়ে চীন দেশ অতিক্রম করে চলে গেছে। য়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর পর্যন্ত।
আর এটি পৃথিবীর একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কারণ, যত প্রবহমান পানি আছে সবই মিষ্ট, কিন্তু এটি তার ব্যতিক্রম আর সকল স্থির সমুদ্রের পানি লোনা, খর। কিন্তু কাস্পিয়ান সাগর তার ব্যতিক্রম। একে জুরজান সাগর ও তাবারিস্তান সাগরও বলা হয়। পর্যটকদের বর্ণনা, এর বিরাট এক অংশের পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়।
সেখান থেকে আবার এমন একদিকে মোড় নিয়েছে যার অবস্থা কারো জানা নেই। তারপর পৃথিবীর উত্তর-প্রান্তে পশ্চিম দিকে রাশিয়া পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে এবং তা অতিক্রম করে আবার পশ্চিম-দক্ষিণে মােড় নিয়ে পৃথিবী ঘুরে এসে পুনরায় সােজা পশ্চিম দিকে গিয়ে পশ্চিম থেকে প্রণালী ২ অঞ্চলের দিকে চলে যায়।
যার শেষ প্রান্ত সিরিয়ার দিকে গিয়ে ঠেকেছে। তারপর রোমের পথ ধরে তা কনস্টান্টিনিপল প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে মিলিত হয়েছে।
পূর্ব মহাসাগর থেকে আরো কয়েকটি সমুদ্র প্রবাহিত হয়েছে। সেগুলোতে অনেক দ্বীপ আছে। এমনকি কথিত আছে যে, কেবল ভারত সাগরেই জনশূন্য দ্বীপসমূহের কথা বাদ দিলেও শহর-বন্দর ও অট্টালিকাদি বিশিষ্ট দ্বীপের সংখ্যা এক হাজার সাতশ’।
এই সাগরসমূহকে বাহরে আখসারও বলা হয়ে থাকে। এর পূর্বাংশে চীন সাগর, পশ্চিমে ইয়ামান সাগর, উত্তরে ভারত সাগর এবং দক্ষিণে কী আছে তা অজ্ঞাত।
বিশেষজ্ঞগণ বলেন, ভারত সাগর ও চীন সাগরের মধ্যখানে দুয়ের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টিকারী কয়েকটি পাহাড় আছে এবং তাতে স্থলপথের ন্যায় কয়েকটি প্রশস্ত পথ আছে যা দিয়ে নীেযানসমূহ চলাচল করতে পারে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন- এবং আমি পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছি। সুদৃঢ় পর্বত যাতে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে
এদিক-ওদিক ঢলে না যায় এবং আমি তাতে করেছি। প্রশস্ত পথ যাতে তারা গন্তব্যস্থলে পৌছুতে পারে। (২১- ৩১)
ভারত উপমহাদেশের বাতিলীমূস নামক জনৈক রাজা তার ‘মিজেসতী’ নামক গ্রন্থে খলীফা মামুনের আমলে যা আরবীতে অনূদিত হয়েছিল, যা এ সংক্রান্ত বিদ্যার উৎস বলে পরিগণিততাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম, পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর মহাসাগর থেকে প্রবহমান সমুদ্রের সংখ্যা অনেক।
এগুলোর মধ্যে এমনও রয়েছে যা আসলে একই সাগর, তবে পার্শ্ববতীর্ণ জনপদের নামানুসারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো, বাহরে কুলযুম বা লোহিত সাগর। কুলযুম হচ্ছে আয়লার কাছাকাছি সমুদ্রের উপকূলবর্তী একটি গ্রাম।
আরো আছে পারস্য সাগর, কাস্পিয়ান সাগর, অরনক সাগর, রোম সাগর, বানতাশ সাগর ও আযরােক সাগর। আযরােক উপকূলবর্তী একটি শহরের নাম। একে কারম সাগরও বলা হয়। এটি সংকীর্ণ হয়ে দক্ষিণ কনস্টান্টিনিপলের নিকট ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে।
এটি কনস্টান্টিনিপলের উপসাগর। আর এ কারণেই কারম সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। আর এ কারণেই কারম সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে আসার সময় নীেযানসমূহ দ্রুত চলে কিন্তু পানির বিপরীতে প্রবাহের কারণে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কারমে আসার সময় চলে ধীর গতিতে।
আর এটি পৃথিবীর একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কারণ, যত প্রবহমান পানি আছে সবই মিষ্ট, কিন্তু এটি তার ব্যতিক্রম আর সকল স্থির সমুদ্রের পানি লোনা, খর। কিন্তু কাস্পিয়ান সাগর তার ব্যতিক্রম। একে জুরজান সাগর ও তাবারিস্তান সাগরও বলা হয়। পর্যটকদের বর্ণনা, এর বিরাট এক অংশের পানি সুমিষ্ট ও সুপেয়।
আমু দরিয়া ও শির দরিয়া ফোরাত ও নীল সব ক’টিই জান্নাতের নদী। ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- জান্নাত থেকে চারটি নদী প্রবাহিত করা হয়েছে। ফোরাত, নীল, আমু দরিয়া ও শির দরিয়া। ইমাম মুসলিমের শর্ত মোতাবেক এ হাদীসের সনদ সহীহ।
জ্যোতির্বিদগণ বলেন, এ সাগরটি প্রায় গোলাকার। কেউ কেউ বলেন, তা নীেকার পালের ন্যায় ত্রিকোণা বিশিষ্ট। মহাসাগরের কোন অংশের সঙ্গে তার সংযোগ নেই বরং তা সম্পূর্ণ আলাদা। তার দৈর্ঘ্য আটশ’ মাইল ও প্রস্থ ছয়শ’ মাইল। কেউ কেউ এর বেশিও বলেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।
ঐ সমুদ্রগুলোর আরেকটি হলো বসরার নিকটবতী সাগর, যাতে জোয়ার-ভাটা হয়। সাগরের এলাকার দেশগুলোতেও১ এর অনুরূপ সাগর রয়েছে। চান্দ্র মাসের শুরু থেকে পানি বাড়তে শুরু করে এবং পূর্ণিমা রাতের শেষ পর্যন্ত, তা অব্যাহত থাকে।
এ হলো জোয়ার। তারপর কমতে শুরু করে মাসের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ হলো ভাটা। বিশেষজ্ঞগণ এসব সাগরের সীমারেখা এবং এগুলোর উৎস ও মোহনাসমূহের উল্লেখ করেছেন এবং পৃথিবীর
ছোট ছোট নদ-নদী এবং খাল-নালার আলোচনাও তারা করেছেন। আবার বড় বড় প্রসিদ্ধ নদ-নদী এবং সেগুলোর উৎস ও মোহনাসমূহের কথাও তারা উল্লেখ করেছেন। আমরা এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না- আমরা কেবলমাত্ৰ হাদীসে বর্ণিত নদীসমূহ সম্পর্কেই আলোকপাত করব।
আল্লাহ তা’আলা বলেন- তিনিই আল্লাহ্ যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন, যিনি নীেযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর বিধানে তা সমুদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়ােজিত করেছেন নদীসমূহকে।
তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়ােজিত করেছেন। সূর্য ও চন্দ্রকে যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবতী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে। এবং তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তোমরা তার নিকট যা চেয়েছ তা থেকে।
তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতিমাত্রায় জালিম, অকৃতজ্ঞ। (১৪- ৩২-৩৪)
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে কাতাদা (র) সূত্রে আনাস ইব্ন মালিক ও মালিক ইব্ন সা’সা’আ থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) সিন্দরাতুল মুনতাহার আলোচনাকালে বলেছিলেন-
অর্থাৎ-আমি দেখতে পেলাম যে, তার মূলদেশ থেকে দু’টো অদৃশ্য নদী ও দু’টো দৃশ্যমান নদী বেরিয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য দু’টো জান্নাতে আর দৃশ্যমান দু’টো হলো নীল ও ফোরাত। সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-
আমু দরিয়া ও শির দরিয়া ফোরাত ও নীল সব ক’টিই জান্নাতের নদী। ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- জান্নাত থেকে চারটি নদী প্রবাহিত করা হয়েছে। ফোরাত, নীল, আমু দরিয়া ও শির দরিয়া। ইমাম মুসলিমের শর্ত মোতাবেক এ হাদীসের সনদ সহীহ।
নওবার প্রধান শহর হচ্ছে দামীকালা। হাবশার বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি এবং তার পলিমাটি মিসরে গড়িয়ে আসে। মিসরের এ দু’টো বস্তুরই প্রয়োজন রযেছে। কারণ মিসরে বৃষ্টি এত কম হয় যে, তা ফসলাদি ও গাছ-গাছালির জন্য যথেষ্ট নয়।
সম্ভবত এর দ্বারা পরিচ্ছন্নতা, স্বাদ ও প্রবাহের ক্ষেত্রে এ নদীগুলো জান্নাতের নদ-নদীর সাথে সাদৃশ্য রাখে বলে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। এ ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা আবু হুরায়রা সূত্রে ইমাম তিরমিয়ী (র) বর্ণিত ও তার দ্বারা সহীহ বলে আখ্যায়িত- হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সেই হাদীসে রয়েছে যাতে তিনি বলেছেন-
‘আজওয়া (উন্নতমানের এক প্রকার খেজুর) জান্নাতী খেজুর এবং তাতে বিষ-এর উপশম রয়েছে।’ অর্থাৎ-আজওয়া জান্নাতের ফল-ফলাদির সাথে সাদৃশ্য রাখে। এর অর্থ এ নয় যে, এটি জান্নাত থেকে আহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছে, কেননা, বাস্তবে এর বিপরীতটিই পরিলক্ষিত হয়।
সুতরাং এটা যে শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, তা স্পষ্ট। অনুরূপ অন্য হাদীসে তিনি বলেছেন- জুর হলো জাহান্নামের তাপ। কাজেই তাকে তোমরা পানি দ্বারা ঠাণ্ডা কর। অপর একটি হাদীসে আছে-
জুর তীব্র আকার ধারণ করলে তাকে তোমরা পানি দ্বারা ঠাণ্ডা করে নিও। কেননা গরমের তীব্ৰতা জাহান্নামের তাপ বিশেষ। অদ্রুপ এসব নদ-নদীর মূল উৎসও পৃথিবীতেই।
নীল নদী- স্রোতের তীব্রতা, পানির স্বচ্ছতা এবং গতিপথের দৈর্ঘের দিক থেকে গোটা পৃথিবীতে এটি অতুলনীয় নদী। এর শুরু হলো জিবালুল কামার বা শুভ্র পর্বতমালা থেকে। কারো কারো মতে, জিবালুল কামার দ্বারা চন্দ্রের পাহাড় বুঝানো হয়েছে।
এটি পৃথিবীর পশ্চিমাংশে বিষুবরেখার পেছনে দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। কারো কারো মতে, তাহলো যার মধ্য থেকে উৎসারিত হয়েছে একাধিক ঝরনা। তারপর দূরে দূরে অবস্থিত দশটি স্রোতধারার সম্মিলন ঘটেছে। তারপর তার প্রতি পাচটি গিয়ে একত্রিত হয় একটি সাগরে।
তারপর তা থেকে বেরিয়ে আসে ছ’টি নদী। তারপর তার প্রতিটি গিয়ে মিলিত হয়। অন্য এক হন্দে। তারপর তা থেকে বেরিয়ে আসে আরেকটি নদী। এটাই হলো নীল নদ। এ নদটি সুদান, নওবা ও আসওয়ান হয়ে অবশেষে মিসরে গিয়ে উপনীত হয়েছে।
নওবার প্রধান শহর হচ্ছে দামীকালা। হাবশার বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি এবং তার পলিমাটি মিসরে গড়িয়ে আসে। মিসরের এ দু’টো বস্তুরই প্রয়োজন রযেছে। কারণ মিসরে বৃষ্টি এত কম হয় যে, তা ফসলাদি ও গাছ-গাছালির জন্য যথেষ্ট নয়।
আর তার মাটি হলো বালুময়। যাতে কোন ফসলই উৎপন্ন হয় না। নীল নদ হয়ে যে পানি ও মাটি আসে তা থেকেই মিসরবাসীর প্রয়োজনীয় ফসলাদি উৎপন্ন হয়।
আল্লাহ তা’আলার বাণী- তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি উষর ভূমির উপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য যা হতে খাদ্য গ্রহণ করে তাদের গবাদি পশু এবং তারাও? তারা কি লক্ষ্য করে না? (সাজদা- ২৭)
এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা দেশ ত্যাগ করতে মনস্থ করে। অবশেষে আমর (রা:) খলীফা উমর ইব্ন খাত্তাব (রা)-এর নিকট এ ব্যাপারে পত্র লিখেন। জবাবে উমর (রা) লিখে পাঠান যে, তুমি যা’ করেছ ঠিকই করেছ। আর তোমার নিকট একটি লিপি প্রেরণ করছি, তুমি তা নীল নদে ফেলে দিও।
মিসরের ক্ষেত্রেই সর্বাধিক প্রযোজ্য। তারপর মিসরের কিছু অংশ অতিক্রম করে উপকূলবর্তী শান্তনুফ নামক একটি গ্রামের নিকট গিয়ে নীল নদ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে তার পশ্চিমের শাখাটি রশীদ অঞ্চল অতিক্রম করে লোনা সমুদ্রে পড়েছে, অপরদিকে পূর্ব দিকের শাখাটি জাওজার-এর নিকট গিয়ে দু’ভাগ হয়ে শাখাদ্বয়ের পশ্চিম ভাগ দুমিয়াত হয়ে সাগরে গিয়ে পড়েছে।
আর পূর্বভাগ আশমূনতান্নাহ হয়ে দুমিয়াতের পূর্বে অবস্থিত তামীস এহদ ও দুমিয়াত হ্রদে পড়েছে। নীল নদের উৎপত্তিস্থল ও সঙ্গম স্থলের মধ্যে এভাবে বিরাট দূরত্ব রয়েছে। আর এ কারণেই এর পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ।
ইব্ন সীনা বলেন, নীল নদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা পৃথিবীর অন্য কোন নদ-নদীর নেই। প্রথমত, উৎপত্তিস্থল থেকে শেষ প্রান্তের মাঝে এর দূরত্ব সর্বাধিক। দ্বিতীয়ত, তা প্রবাহিত হয় বড় বড় পাথর ও বালুময় প্রান্তরের উপর দিয়ে, যাতে কোন শ্যাওলা ও ময়লা-আবর্জনা নেই।
তৃতীয়ত, তার মধ্যে কোন পাথর বা কংকর সবুজ হয় না। বলা বাহুল্য যে, নদীটির পানির স্বচ্ছতার কারণেই এরূপ হয়ে থাকে। চতুর্থত, আর সব নদ-নদীর পানি যখন হাস পায়, এর পানি তখন বৃদ্ধি পায় আর অন্যসব নদীর পানি যখন বৃদ্ধি পায়, এর পানি তখন হ্রাস পায়।
পক্ষান্তরে কেউ কেউ বলে যে, নীল নদের উৎস হলো কোন এক উচু স্থান, কেউ কেউ যার সন্ধান পেয়েছেন এবং তাতে ভীষণ এক ভয়ানক বস্তু কতিপয় রূপসী নারী এবং আরো অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেয়েছেন; এর সবই ঐতিহাসিকদের ভিত্তিহীন বর্ণনা এবং মিথ্যাচারীদের কল্পকাহিনী মাত্র।
কায়স ইব্ন হাজ্জাজ সূত্রে জনৈক ব্যক্তি থেকে আবদুল্লাহ ইব্ন লাহীয়া বর্ণনা করেন যে, জনৈক ব্যক্তি বলেন, মিসর জয় করে আমর ইব্ন আস (রা) যখন অনারব কিবতী ক্যালেন্ডারের বুনা নামক মাসে তাতে প্রবেশ করেন তখন মিসরের লোকজন তার নিকট এসে বলল, মাননীয় আমীর!
আমাদের এ নীল নদের একটি প্রথা আছে, যা পালন না করলে তা প্রবাহিত হয় না। তিনি বললেন- কী সে প্রথাটি?
তারা বলল, এ মাসের বার তারিখের রাত শেষ হলে আমরা বাবা-মার নিকট থেকে তাদের সম্মতিক্রমে একটি কুমারী মেয়ে নিয়ে আসি এবং উন্নতমানের অলংকারাদি ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিয়ে তাকে এ নীল নদে ফেলে দেই। শুনে আমর ইব্ন আস (রা) তাদেরকে বললেনঃ
অর্থাৎ- ইসলামে এটা চলবে না। পূর্বের সব কুসংস্কারকে ইসলাম নির্মূল করে দেয়। অগত্যা বুনা মাসটা তারা এভাবেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু নীল নদে কোন পানি আসলো না। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, তারা বুনা, আবীব ও মাসরা এ তিন মাস অপেক্ষা করলো কিন্তু নীল আর প্রবাহিত হয় না।
এমনকি শেষ পর্যন্ত তারা দেশ ত্যাগ করতে মনস্থ করে। অবশেষে আমর (রা:) খলীফা উমর ইব্ন খাত্তাব (রা)-এর নিকট এ ব্যাপারে পত্র লিখেন। জবাবে উমর (রা) লিখে পাঠান যে, তুমি যা’ করেছ ঠিকই করেছ। আর তোমার নিকট একটি লিপি প্রেরণ করছি, তুমি তা নীল নদে ফেলে দিও।
পত্রটি এসে পৌছুলে আমার (রা) লিপিটি খুলে দেখতে পেলেন যে, তাতে লিখা রয়েছে- ‘আল্লাহর বান্দা আমীরুল মুমিনীন উমর-এর পক্ষ থেকে মিসরের নীল নদের প্রতিহামদ ও সালাতের পর- যদি তুমি নিজ ক্ষমতায় প্রবাহিত হয়ে থাকে, তাহলে তুমি প্রবাহিত হয়ে না। আর যদি প্রার্থনা করছি যেন তিনি তোমাকে প্রবাহিত করেন।’
এখন পর্যন্ত তা তাদের দখলেই রয়েছে। আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা, যেন আপনি ক্ষমতাবলে তিনি আবার আমাদের হাতে তা ফিরিয়ে দেন। তারপর সায়হান ও জায়হান উযানার নিকট মিলিত হয়ে একই স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে। অবশেষে আরাস ও তার সূস-এর মধ্যবতী স্থানে তা সাগরে পতিত হয়েছে।
আমর (রা)-এর চিঠিটি নীল নদে ফেলে দিলে শনিবার দিন সকালে দেখা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা নীল নদকে এমনভাবে প্রবাহিত করে দিয়েছেন যে, এক রাতে ষোল হাত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে আল্লাহ মিসরবাসী থেকে সে কুপ্রথা চিরতরে বন্ধ করে দেন।
ফোরাত ৪ বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্ত হলো এর উৎপত্তিস্থল। সেখান থেকে মালতিয়ার নিকট দিয়ে অতিক্রম করে শমীশাত ও বয়রা হয়ে তারপর পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে বালেস ও জা’বার কেল্লায় চলে গেছে। তারপর রিককা, রহবা, ‘আনা, হায়ত ও কৃফা হয়ে ইরাকের দিকে গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। এ নদীটির অনেক প্রসিদ্ধ উপনদী, শাখা নদী রয়েছে।
সায়হান (আমু দরিয়া)- একে সায়হুনও বলা হয। বাইজানটাইন এলাকা থেকে এর উৎপত্তি। উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এর প্রবাহ। জায়হানের পশ্চিমে এর অবস্থান এবং আকারে তারচেয়ে ছোট। যে ভূখণ্ডে এর অবস্থান, বর্তমানে তা সীস নামে পরিচিত।
ইসলামী রাজত্বের প্রথমে তা মুসলমানদের হাতে ছিল। তারপর ফাতেমীগণ যখন মিসরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং সিরিয়া ও তার আশপাশের অধিকার লাভ করেন, তখন তারা তাকে শক্ৰদের থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তিনশ’ হিজরীর গোড়ার দিকে আর্মেনিয়ার অধিবাসী তাকফুর এ সীস নগরী দখল করে নেয়।
এখন পর্যন্ত তা তাদের দখলেই রয়েছে। আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা, যেন আপনি ক্ষমতাবলে তিনি আবার আমাদের হাতে তা ফিরিয়ে দেন। তারপর সায়হান ও জায়হান উযানার নিকট মিলিত হয়ে একই স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে। অবশেষে আরাস ও তার সূস-এর মধ্যবতী স্থানে তা সাগরে পতিত হয়েছে।
জায়হান (শির দরিয়া)- একে জায়হুনও বলা হয়, সাধারণ্যে এর নাম হলো জাহান। এর উৎস হলো বাইজানটাইন এলাকা এবং সীস নগরীতে তা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এটি আকারেও প্রায় ফোরাতের সমান।
তারপর একটি সায়হান উযানার নিকট মিলিত হয়ে দুটো এক স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে। আয়াস ও তারসূস-এর মধ্যবতী স্থানে সাগরে গিয়ে পড়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
………………………
বি.দ্র: লেখার আরবী অংশগুলো ভুলত্রুটি হতে পারে এই বিবেচনায় এই পর্যায়ে উল্লেখ করা হয়নি। ভবিষ্যতে বিষয়টি উল্লেখ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এই জন্য সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………..
আরও পড়ুন-
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : প্রথম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : দ্বিতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : তৃতীয় কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : চতুর্থ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : পঞ্চম কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : ষষ্ঠ কিস্তি
মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি : সপ্তম কিস্তি
সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে প্লাতনের মতবাদ
মহাবিশ্বের সৃষ্টি কাহিনী
পবিত্র কোরানে সৃষ্টিতত্ত্ব
আরশ ও কুরসী সৃষ্টির বিবরণ
সাত যমীন প্রসঙ্গ
সাগর ও নদ-নদী
পরিচ্ছেদ : আকাশমণ্ডলী
ফেরেশতা সৃষ্টি ও তাঁদের গুণাবলীর আলোচনা
পরিচ্ছেদ : ফেরেশতাগণ
জিন সৃষ্টি ও শয়তানের কাহিনী
সীরাত বিশ্বকোষে বিশ্ব সৃষ্টির বিবরণ
আদম (আ) পৃথিবীর আদি মানব
আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য
আদম (আ)-এর সালাম
আদম (আ)-এর অধস্তন বংশধরগণ
হাদীসে আদম (আ)-এর সৃষ্টি প্রসঙ্গ
আদম (আ)-এর সৃষ্টি