প্রসঙ্গ ‘শ্রীচৈতন্যদেব’
স্বামীজীর কাছে অনেক লোক। শ্রীচৈতন্যদেবের কথা হইতেছে। হাসি-তামাসাও চলিতেছে। একজন বলিয়া উঠিলেন, ‘মহাপ্রভুর কথা নিয়ে এত রঙ্গরসের কারণ কি? আপনার কি মনে করেন, তিনি মহাপুরুষ ছিলেন না, তিনি জীবের মঙ্গলের জন্য কোন কাজ করেননি ?’
স্বামী বিবেকানন্দ : কে বাবা তুমি ? কাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে হবে? তোমাকে নিয়ে নাকি? মহাপ্রভুকে নিয়ে রঙ্গ-তামাসা করাটাই দেখছ বুঝি! তাঁর কাম-কাঞ্চন ত্যাগের জ্বলন্ত আদর্শ নিয়ে এতদিন যে জীবনটা গড়বার ও লোকের ভেতর সেই ভাবটা ঢোকাবার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা দেখতে পাচ্ছনা? শ্রীচৈতন্যদেব মহা ত্যাগী পুরুষ ছিলেন।
স্ত্রীলোকের সংস্পর্শেও থাকতেন না। কিন্তু পরে চেলারা তাঁর নাম ক’রে নেড়া-নেড়ীর দল করলে। আর তিনি যে-প্রেমের ভাব নিজের জীবনে দেখালেন, তা স্বার্থশূন্য কামগন্ধহীন প্রেম। তা কখনও সাধারণের সম্পত্তি হতে পারে না।
অথচ তাঁর পরবর্তী বৈষ্ণব গুরুরা আগে তাঁর ত্যাগটা শেখানোর দিকে ঝোঁক না দিয়ে তাঁর প্রেমটাকে সাধারণের ভেতর ঢোকাবার চেষ্টা করলেন । কাজেই সাধারণ লোকে সে উচ্চ প্রেমভাবটা নিতে পারলে না এবং সেটাকে নায়ক-নায়িকার দূষিত প্রেম করে তুললে।
প্রশ্ন : মহাশয়, তিনি তো আচন্ডালে হরিনাম প্রচার করলেন, তা সেটা সাধারণের সম্পত্তি হবে না কেন?
স্বামী বিবেকানন্দ : প্রচারের কথা হচ্ছে না গো, তাঁর ভাবের কথা হচ্ছে—প্রেম, প্রেম-রাধাপ্রেম। যা নিয়ে তিনি দিন রাত মেতে থাকতেন, তার কথা হচ্ছে।
প্রশ্ন : সেটা সাধারণের সম্পত্তি হবে না কেন?
স্বামী বিবেকানন্দ : সাধারণের সম্পত্তি কি করে হয়, তা এই জাতটা দেখে বোঝ না ? ওই প্রেম প্রচার করেই তো সমস্ত জাতটা ‘মেয়ে’ হয়ে গিয়েছে । সমস্ত উড়িষ্যাটা কাপুরুষ ও ভীরুর আবাস হয়ে গিয়েছে। আর এই বাঙলা দেশটায় চারশ’বছর ধরে রাধাপ্রেম করে কি দাঁড়িয়েছে দেখ! এখানেও পুরুষত্বের ভাব প্রায় লোপ পেয়েছে। লোকগুলো কেবল কাঁদতেই মজবুত হয়েছে।
ভাষাতেই ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তা চারশ’বছর ধরে বাঙলা ভাষায় যা কিছু লেখা হয়েছে, সে-সব এক কান্নার সুর । প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কিছুই নেই। একটা বীরত্বসূচক কবিতারও জন্ম দিতে পারেনি!
প্রশ্ন : ওই প্রেমের অধিকারী তবে কারা হতে পারে ?
স্বামী বিবেকানন্দ : কাম থাকতে প্রেম হয় না—এক বিন্দু থাকতেও হয় না। মহাত্যাগী, মহাবীর পুরুষ ভিন্ন ও-প্রেমের অধিকারী কেউ নয় । ওই প্রেম সাধারণের সম্পত্তি করতে গেলে নিজেদের এখনকার ভেতরকার ভাবটাই ঠেলে উঠবে।
ভগবানের উপর প্রেমের কথা মনে না পড়ে ঘরের গিন্নিদের সঙ্গে যে প্রেম, তার কথাই মনে উঠবে । আর প্রেমের যে অবস্থা হবে, তা তো দেখতেই পাচ্ছ!
প্রশ্ন : তবে কি ঐ প্রেমের পথ দিয়ে ভজন ক’রে—ভগবানকে স্বামী ও নিজেকে স্ত্রী ভেবে ভজন করে-তাঁকে (ভগবানকে) লাভ করা গৃহস্থের পক্ষে অসম্ভব?
স্বামী বিবেকানন্দ : দু-এক জনের পক্ষে সম্ভব হলেও সাধারণ গৃহস্থের পক্ষে যে অসম্ভব, এ-কথা নিশ্চিত । আর এ-কথা জিজ্ঞাসারই বা এত আবশ্যক কি? মধুরভাব ছাড়া ভগবানকে ভজন করবার আর কি কোন পথ নেই ? আরও চারটে ভাব আছে তো, সেগুলো ধরে ভজন কর না । প্রাণভরে তাঁর নাম কর না । হৃদয় খুলে যাবে ।
তারপর যা হবার আপনি হবে । তবে এ-কথা নিশ্চিত জেনো যে, কাম থাকতে প্রেম হয় না । কামশূন্য হবার চেষ্টাটাই আগে কর না । বলবে, তা কি করে হবে?—আমি গৃহস্থ । গৃহস্থ হলেই কি কামের একটা জালা হতে হবে ? স্ত্রীর সঙ্গে কামজ সম্বন্ধ রাখতেই হবে ? আর মধুরভাবের ওপরই বা এত ঝোঁক কেন? পুরুষ হয়ে মেয়ের ভাব নেবার দরকার কি ?
প্রশ্ন : হাঁ, নামকীর্তনটাও বেশ , সেটা লাগেও বেশ । শাস্ত্রেও কীর্তনের কথা আছে । চৈতন্যদেবও তাই প্রচার করলেন । যখন খোলটা বেজে ওঠে, তখন প্রাণটা যেন মেতে ওঠে আর নাচতে ইচ্ছে করে ।
স্বামী বিবেকানন্দ : বেশ কথা। কিন্তু কীর্তন মানে কেবল নাচাই মনে করোনা। কীর্তন মানে ভগবানের গুণগান, তা যেমন করেই হোক। বৈষ্ণবদের মাতামাতি ও নাচ ভাল বটে, কিন্তু তাতে একটা দোষও আছে। সেটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যেও। কি দোষ জানো ? প্রথমে একেবারে ভাবটা খুব জমে, চোখ দিয়ে জল বেরোয়, মাথাটাও রি-রি করে, তারপর যেই সংকীর্তন থামে তখন সে ভাবটা হু হু করে নামতে থাকে ।
ঢেউ যত উঁচু উঠে, নামবার সময় সেটা তত নীচুতে নামে । বিচারবুদ্ধি সঙ্গে না থাকলেই সর্বনাশ, সে-সময়ে রক্ষা পাওয়া ভার। কামাদি নীচভাবের অধীন হয়ে পড়তে হয় । আমেরিকাতেও ওইরূপ দেখেছি, কতকগুলো লোক গির্জায় গিয়ে বেশ প্রার্থনা করলে, ভাবের সঙ্গে গাইলে, লেকচার শুনে কেঁদে ফেললে। তারপর গির্জা থেকে বেরিয়েই বেশ্যালয়ে ঢুকল।
প্রশ্ন : তা হলে মহাশয়, চৈতন্যদেবের দ্বারা প্রবর্তিত ভাবগুলির ভেতর কোনগুলি নিলে আমাদের কোনরূপ ভ্রমে পড়তে হবে না এবং মঙ্গলও হবে?
স্বামী বিবেকানন্দ : জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির সঙ্গে ভগবানকে ডাকবে। ভক্তির সঙ্গে বিচারবুদ্ধি রাখবে। এ ছাড়া চৈতন্যদেবের কাছ থেকে আরও নেবে তাঁর Heart (হৃদয়বত্তা), সর্বজীবে ভালবাসা, ভগবানের জন্য টান, আর তাঁর ত্যাগটা জীবনের আদর্শ করবে।
প্রশ্নকর্তা : ঠিক বলেছেন, মহাশয়। আমি আপনার ভাব প্রথমে বুঝতে পারিনি । (করজোড়ে)মাপ করবেন। তাই আপনাকে বৈষ্ণবদের মধুরভাব নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করতে দেখে কেমন বোধ হয়েছিল।
………………………………………..
উৎস : স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা , নবম খণ্ড , প্রকাশক উদ্বোধন কার্যালয় , কলকাতা
…………………………………..
আরও পড়ুন-
নদের নিমাই
যুগে যুগে মহাপ্রভু
প্রসঙ্গ ‘শ্রীচৈতন্যদেব’
গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব
বৈষ্ণব মতবাদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….